গুলেন মুভমেন্ট ও ইসলাম
এডিটর’স নোট: তুরস্কের গুলেন মুভমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে কিছুটা কাজ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাইমুল আহসান খান এই আন্দোলন নিয়ে ‘The vision & Impact of Gulen Movement: A new Paradigm for Social Activism’ এবং ‘Introducing Fetullah Gulen to Bengal and Beyond’ শিরোনামে দুটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে অনেকেই এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। গুলেন মুভমেন্টের সংক্ষিপ্ত একটা পরিচয় পাওয়া যায় The Gülen Movement and Islam শিরোনামের একটি আর্টিকেলে। এর বাংলা অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক।
*****
ফেতুল্লাহ গুলেন কর্তৃক উদ্বুদ্ধ আন্দোলন, সংক্ষেপে গুলেন মুভমেন্ট (বিশেষ কোনো) আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ নয় (not ideologically driven organization)। ইসলামকে একটা রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপারে ফেতুল্লাহ গুলেনের ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। সেই দৃষ্টিতে গুলেন মুভমেন্টকে রাজনৈতিক ইসলামের সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করাটা একটি মারাত্মক ভুল। তাঁর মতে, ‘ইসলামপন্থা’ (Islamism) একটা আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে উঠে আসার পিছনে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব রয়েছে। এ দৃষ্টিতে প্রাচ্যবাদ তথা ওরিয়েন্টেলিজম হচ্ছে উপনিবেশবাদের অন্যতম আদর্শিক-রাজনৈতিক ফল। এই ওরিয়েন্টিলিজম বা প্রাচ্যবাদের টার্গেট শুধুমাত্র মুসলিম বিশ্বই নয় উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশসমূহও বটে। প্রাচ্যবাদের বিষয়টি এমন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষিত জগতের বাইরে তাবৎ সংস্কৃতি এবং সভ্যতাই হলো (প্রাচ্যবাদের দৃষ্টিকোণ হতে) পশ্চাৎপদ, বর্বর ও প্রতিক্রিয়াশীল; যা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে পরিচিত। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্প্রসারণবাদকে জায়গা করে দেয়ার মতো একটা সাংস্কৃতিক রূপায়নের (transformation) লক্ষ্য ছিল তথাকথিত প্রাচ্যবাদের মূল আদর্শ। অন্তর্গত দিক থেকে শোষণমূলক এবং ঔপনিবেশিক প্রাচ্যবাদের প্রেক্ষাপটে ইসলামী মতাদর্শ বা রাজনৈতিক ইসলামের উদ্ভব ঘটেছে। এই শোষণের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক পরিচয় (identity) হিসেবে ইসলাম প্রশ্ন হাজির হয়েছে।
বলাবাহুল্য, বর্তমান সময়কাল এবং পরিস্থিতি ইতোপূর্বকার সনাতনী প্রাচ্যবাদ এবং ইসলামপন্থার আবির্ভাবকালীন সময় থেকে অনেকটাই ভিন্ন। অর্থাৎ পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। সনাতনী প্রাচ্যবাদের যে সব ভিত্তি ছিল সেগুলোর অনেক কিছুই বর্তমান আন্তর্জাতিক আবহে তেমনভাবে আর নেই। এখন এটি অনেক বেশি মানবতাবাদ, নৈতিকতা এবং সার্বজনীন মূল্যবোধভিত্তিক। এই পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনগুলোকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছে। এটি নিশ্চিত যে, এতদসত্ত্বেও এমন অনেক প্রান্তিক বা চরমপন্থী দল রয়ে গেছে যারা রাজনৈতিক এবং আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সবকিছুকে বিবেচনা করে। এই গ্রুপসমূহের কোনো ভিশন নেই। মোটের ওপরে তারা জাগতিক শক্তি, সাধারণ সমর্থন এবং আদর্শিক দিক থেকে অনেক বেশি দুর্বল। অতএব বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সব ধরনের কাজকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিছক রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটাকে হুমকি বিবেচনা করা স্পষ্টতই ভুল। গুলেন মুভমেন্ট সম্পর্কে এটা বিশেষভাবে সত্য।
উল্লেখ্য, এই আন্দোলনের মৌলিক ভিত্তির মধ্যে একটি ধর্ম এবং বিশেষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ছোঁয়া থাকলেও তা সব ধরনের রাজনৈতিক বা মতাদর্শিকতার বেড়াজাল হতে মুক্ত (independent of any political and ideological structure)। গুলেন তার পুরো জীবনে রাজনীতিতে জড়িত হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলেছেন। তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু বলেননি বা করেননি। কখনো একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ইসলামকে উপস্থাপন করেননি। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত হননি। তাঁর বিবেচনায় এই ধরনের মনোভাব ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা। স্বীয় চিন্তাধারাকে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতা এবং বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। [সূত্র: M. Fethullah Gülen, The Statue of Our Souls, NJ: The Light, Inc., 2005, p. 122, 145, 159]
গুলেন মুভমেন্ট সম্পর্কে একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো এটাকে নিছক একটি ধর্মীয় আন্দোলন মনে করা। গুলেন মুভমেন্টকে সঠিকভাবে জানতে হলে আমাদেরকে সামাজিক আন্দোলনের যে বিশ্লেষণী ধারা তার চেয়ে গভীরে যেতে হবে (we need to incorporate more than just social movement analysis)। মনে রাখতে হবে, গুলেন মুভমেন্ট কোনোভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন পরিচালনায় যারা রয়েছেন তারা তুর্কি সমাজের নির্বাচিত অংশ (selected circles) থেকে ওঠে এসেছেন। এই নিঃস্বার্থ, আত্মনিবেদিত ব্যক্তিবর্গ মূলত শহুরে এলাকার। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক ও সমকালীন মূল্যবোধে গভীরভাবে বিশ্বাসী। যেহেতু তাঁরা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ নন সে কারণে গুলেন মুভমেন্টের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গবিদ্যমান রাষ্ট্রীয় আদর্শসমূহের ব্যাপারেও তেমন কোনো নেতিবাচক মানসিকতা পোষণ করেন না (not reactionaries against the official state ideologies)। চরমপন্থী অথবা প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনসমূহের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় তাঁরা তেমন ধরনের কোনো বিক্ষুব্ধ চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ নন। বরং তাঁরা মতৈক্য, সংলাপ এবং সহনশীলতার সম্পর্কে বিশ্বাস করেন। তাঁদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্কসমুহ কেবলমাত্র ইতিবাচক কর্মকাণ্ডেই প্রোথিত। তাঁরা সামাজিক বিষয়াবলী বা সম্পর্কসমূহকে উত্তম বিকল্প দিয়ে রূপান্তর করতে চান। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করেন না বা শক্তি প্রয়োগ করে সেগুলোকে ধ্বংস বা পরিবর্তন করতেও চান না। অথবা প্রচলিত ব্যবস্থাকে (existing system) উপড়ে ফেলতেও আগ্রহী নন। বরং তাঁরা চান প্রচলিত সামাজিক সম্পর্কগুলোর যে আওতা বা পরিধি সেটাকে ইতিবাচক অর্থে সম্প্রসারিত করা। এক কথায় গুলেন মুভমেন্টের সাধারণ লক্ষ্য (general ideal) হলো ব্যক্তি, সমাজ এবং মানবতার সেবা করা।