গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম সাব্যস্তকারীদের দলীল ও ব্যাখ্যা
|| অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখান থেকে ||
গান, বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্রসহ গানকে যারা হারাম সাব্যস্ত করেন তারা এর পক্ষে কিছু দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তবে যারা গানকে হালাল মনে করেন, তারা অবশ্য এসব দলীল-প্রমাণকে খণ্ডন করে থাকেন। নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে তারা তাদের মতামতের পক্ষে দলীল হিসেবে তুলে ধরেন–
ক) কোরআনের আয়াত।
খ) মারফু ও মাওকুফ হাদীস।
গ) গান, বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্রসহ গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে বলে দাবি করা।
ঘ) সাদ্দে যারায়ী তথা হারাম কাজ করার অজুহাত বন্ধের মূলনীতি।
ঙ) সন্দেহজনক কাজ থেকে বেঁচে থাকা ও সাবধানতা অবলম্বন সংক্রান্ত মূলনীতি।
আমরা তাদের উপস্থাপিত প্রত্যেকটি প্রমাণ উল্লেখ করে একে একে তা খণ্ডন করে যুক্তি তুলে ধরবো।
ক) কোরআন থেকে উপস্থাপিত দলীল ও এর ব্যাখ্যা
যারা গান শোনাকে নিষিদ্ধ মনে করেন এবং একে হারাম সাব্যস্ত করেন তারা বেশ কিছু কোরআনের আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আমরা প্রথমে সেই আয়াতগুলো এখানে তুলে ধরবো। তারপর সেগুলো গানকে আদৌ হারাম প্রতিপন্ন করে কিনা, সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করবো।
১। লাহওয়াল হাদীস (অর্থহীন কথাবার্তা) সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত:
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّـهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
“মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে, যাতে করে সে (এ দিয়ে মানুষদের) অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে হাসি-বিদ্রুপ-তামাশা হিসেবেই গ্রহণ করে; এদের জন্যে অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা লোকমান: ৬)
ইবনে মাসউদ (রা.), ইবনে আব্বাস (রা.) ও ইবনে ওমর (রা.) থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত আছে: উল্লেখিত আয়াতে ‘লাহওয়াল হাদীস’ বলতে গানকে বোঝানো হয়েছে। ইবনে মাসউদ (রা.) তো রীতিমতো শপথ করেই বলেছেন: আল্লাহর শপথ! ‘লাহওয়াল হাদীস’ বলতে গানকেই বোঝানো হয়েছে![1] ইবনুল কায়্যিমসহ অনেকেই এটি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ‘আল-মুসতাদরাক’ গ্রন্থের তাফসীর অধ্যায়ে ইমাম হাকীম বলেছেন: তাফসীর শাস্ত্রের ছাত্ররা যেন এটা জেনে রাখে– শায়খাইনের (হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমকে একত্রে শায়খাইন বলা হয়) মতে সাহাবীদের করা পবিত্র কোরআনের তাফসীর মুসনাদ হাদীসের[2] অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম হাকীম তাঁর বইয়ের অন্যত্র বলেছেন: সাহাবীগণ কোরআনের যেসব তাফসীর করেছেন, আমাদের মত অনুযায়ী সেগুলো মারফু হাদীসের[3] ক্যাটাগরিতে পড়বে।
ইবনুল কায়্যিম বলেছেন: যদিও এখানে কথা থাকে, তারপরও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাহাবীদের করা কোরআনের তাফসীর সাহাবীদের পরবর্তীকালে অন্যদের রচিত তাফসীরের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য।[4]
ইমাম আল-ওয়াহেদী উল্লেখ করেছেন: অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে লাহওয়াল হাদীস দ্বারা গান বুঝানো হয়েছে। এটি মূলত বিশিষ্ট মুফাসসির মুজাহিদ ও ইকরিমার দাবি।[5]
এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান:
এই পদ্ধতিতে দলীল উপস্থাপনের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রথমত: এই আয়াতের এটিই একমাত্র তাফসীর নয়। মুফাসসিরদের অনেকে আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, লাহওয়াল হাদীস বলতে রোম সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন অনারব রাজ্যের রাজা-বাদশাহদের নিয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের কিচ্ছা, গালগপ্পো ও গুজবকে বুঝানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নাদার বিন হারিসের কথা বলা যায়। কোরাইশদের মধ্যে এই লোকটি ছিলো একজন কট্টর মুশরিক। এই লোক মক্কাবাসীদের এইসব গুজব ও গালগপ্পো বলে বেড়াতো, যাতে করে তাদেরকে কোরআন থেকে বিমুখ রাখা যায়। মজার বিষয় হলো, এই বিষয়টি ইবনুল কায়্যিম নিজেও উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত: সাহাবীদের তাফসীরের পক্ষে কোনো সাবাবুন নুযূল[6] বা এ জাতীয় নির্ভরযোগ্য কিছু পাওয়া না গেলে, সেই তাফসীরকে আমরা মারফু হাদীসের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি না। কোরআনকে সাহাবীগণ যেভাবে বুঝেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের তাফসীরগুলো সেই বুঝজ্ঞানের বেশি কিছু নয়। এ জন্য দেখা যায়, কখনো কখনো একজন সাহাবীর তাফসীর আরেকজন সাহাবীর তাফসীরের বিপরীত। যদি তাঁদের সকল ব্যাখ্যাই মারফু হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে তাঁদের তাফসীরে এ ধরনের মতদ্বৈততা থাকতো না।
তৃতীয়ত: আয়াতটির এই তাফসীরের যথার্থতা ও এটি মারফু হাদীসের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার দাবিকে আমরা যদি মেনেও নেই এবং তাফসীরটি যদি প্রকৃতপক্ষে মারফু হাদীসভুক্ত হয়েও থাকে, তাহলেও আমাদের আলোচ্য বিষয়ে এই আয়াতটি দলীল হিসেবে টিকে না। কারণ, এতে নিছক গান কিংবা লাহওয়াল হাদীসে মগ্ন হওয়াকে নিন্দা করা হয়নি। বরং যে ব্যক্তি আল্লাহর পথের ব্যাপারে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে লাহওয়াল হাদীস ক্রয় করে এবং এ ব্যাপারটিকে ঠাট্টা-মশকরা হিসেবে বিবেচনা করে, তার ব্যাপারেই ভর্ৎসনা ও অপমানজনক শাস্তির কথা হয়েছে। তাই এই আয়াতটি আমাদের আলোচ্য বিষয়ে প্রাসঙ্গিক নয়।
ইবনে হাজমের মতামত:
ইবনে মাসউদ ও অন্যান্যদের কথা টেনে যারা দলীল পেশ করেন তাদের জবাবে আবু মুহাম্মদ ইবনে হাজম যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন: “এই প্রসঙ্গে ইবনে মাসউদ (রা.) ও অন্যান্যদের তাফসীর কয়েকটি কারণে দলীল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না।
প্রথমত: আল্লাহর রাসূল (সা.) ছাড়া আর কারো কথাই চূড়ান্ত যুক্তি বা দলীল হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত: তাঁদের মতামত অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত থেকে ভিন্ন।
তৃতীয়ত: তাঁরা যে আয়াতটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, সেটি স্বয়ং তাঁদের যুক্তিকে খণ্ডন করে। কারণ আয়াতে বলা হয়েছে: “মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে, যাতে করে সে অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে হাসি-বিদ্রুপ-তামাশা হিসেবেই গ্রহণ করে; এদের জন্যে অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা লোকমান: ৬)। এটি এমন একটা কাজ যা কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে করলে কাফের হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে কোরআনের একটি কপিও ক্রয় করে এবং ব্যাপারটিকে তামাশা হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে নিঃসন্দেহে সে কাফের হয়ে যাবে। মূলত এই বিষয়টিকেই আল্লাহ ভর্ৎসনা করেছেন। এই উদ্দেশ্যের বাইরে স্রেফ অবকাশ ও বিনোদন হিসেবে লাহওয়াল হাদীস ক্রয়কারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে মোটেও ভর্ৎসনা করেননি। অন্যদিকে, ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগকারী ব্যক্তি যদি গান, আড্ডাবাজি, এমনকি কোরআন তেলাওয়াত, হাদীস পাঠ ইত্যাদিও করে, তাহলে সেই ব্যক্তি নিশ্চিত ফাসেক। আবার, কেউ বিনোদনমূলক বিষয়গুলোতে জড়িত থাকলেও কোনো ফরজ বিধান লংঘন না করলে সেই ব্যক্তি নিশ্চয় মুহসিন।”[7]
ইবনে হাজমকে ইমাম গাজ্জালীর সমর্থন:
ইমাম ইবনে হাজমের বক্তব্যের উপর ইমাম আবু হামীদ আল গাজ্জালী বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। আলোচ্য আয়াত দিয়ে যারা গানকে হারাম সাব্যস্ত করতে চান,তাদের জবাবে ইমাম গাজ্জালী বলেছেন:
“দ্বীনের পরিবর্তে লাহওয়াল হাদীসকে প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ, আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে লাহওয়াল হাদীস ক্রয় করা নিশ্চয় অত্যন্ত নিন্দনীয় ও হারাম কাজ। এতে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। তবে সব গান এমন নয়, যেমনটা আলোচ্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করানোর উদ্দেশ্যে কেউ যদি কোরআন তেলাওয়াতও করে, তাহলে সেটিও হারাম হবে। মুনাফিকদের একটি ঘটনা এই মতকে শক্তিশালী করে। এক মুনাফিক নামাজের ইমামতি করতো। সূরা আবাসা ছাড়া অন্য কোনো সূরা সে নামাজে তেলাওয়াত করতো না। সূরাটিতে যেহেতু আল্লাহর তরফ থেকে রাসূলকে (সা.) একটু কড়া কথা বলা হয়েছে, তাই সে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজ করতো। মানুষকে বিভ্রান্ত করা যেহেতু লোকটির উদ্দেশ্য ছিলো, তাই ওমর (রা.) লোকটির এহেন কাজকে হারাম সাব্যস্ত করেন। ফলে গান বা কবিতা দিয়ে কেউ যদি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়, তবে তা নিশ্চয় হারাম হওয়ার দাবি রাখে।”[8]
আয়াতে বর্ণিত ‘কঠিন শাস্তি’ বলতে আসলে যা বোঝায়:
এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজম এবং ইমাম গাজ্জালীর মতামত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মতে, নিছক বিনোদন বা খেল-তামাশায় লিপ্ত হলে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে, এমনটা এই আয়াতে বুঝানো হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী আয়াতটি বিবেচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّىٰ مُسْتَكْبِرًا كَأَن لَّمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا ۖ فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
“যখন তার সামনে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে দম্ভ ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি, যেন সে বধির। তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও।” (সূরা লোকমান:৭)
একজন মুসলিম কখনই আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিটির মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে না। কারণ, মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করে– কোরআন নিশ্চয়ই আল্লাহর কালাম। কোনোভাবেই এর ভেতর মিথ্যা প্রবেশ করতে পারে না। কারণ এটি এমন এক গ্রন্থ, যা মহা প্রজ্ঞাময় ও সমস্ত প্রশংসার আধার আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ।
আর তাই আমরা দেখি, ইমাম ইবনুল কায়্যিমের মতো ব্যক্তিও (গান হারাম হওয়ার পক্ষে যিনি ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার) স্বীকার করেছেন– আলোচ্য আয়াতগুলোতে বর্ণিত কঠিন শাস্তি মূলত এমন লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে ব্যক্তি কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই স্রেফ ঠাট্টাচ্ছলে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে কোরআনের স্থলে লাহওয়াল হাদীসকে প্রতিস্থাপন করে। তার সামনে কোরআন তেলাওয়াত করা হলে অহংকারবশত মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে বধির, কিছুই শুনতে পায়নি! যখন কোরআন থেকে কিছু জানার সুযোগ তার হয়, তখন সে তা নিয়ে মশকরা শুরু করে। খুব বড় মাপের কাফেরের মধ্যেই কেবল এই সকল বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে।[9]
এ পর্যায়ে এসে আমরা দেখি, প্রায়োগিক দিক থেকে ‘কঠিন শাস্তি’ সংক্রান্ত আয়াত দুটো বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ধরনের লোকেরা কোরআন বুঝা ও মেনে চলতে আগ্রহীদেরকে খেল-তামাশা বা বিনোদনের নামে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়।
ইবনে ওয়াহাবের বরাত দিয়ে ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এ সম্পর্কে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। ইবনে ওয়াহাব উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে…’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জায়েদ বলেছেন: আয়াতে নির্দেশিত ব্যক্তিরা হলো মূলত কাফেরের দল। তোমরা কি এই আয়াত দেখোনি, যেখানে আল্লাহ বলেছেন– ‘যখন তার সামনে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে দম্ভ ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি, যেন সে বধির।’ এ বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে বিদ্যমান, তারা আদৌ মুসলিম হতে পারে না।
তিনি আরো বলেছেন: লোকেরা বলে, এই আয়াত নাকি তোমাদের, মানে মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। তিনি আরো বলেছেন: ‘লাহওয়াল হাদীস’ মানে গালগপ্পো ও অর্থহীন কথাবার্তা।[10]
ইমাম ইবনে আতিয়্যাহ বলেছেন: সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, আয়াতটিতে ‘লাহওয়াল হাদীস’ দিয়ে কুফরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। যেহেতু “যাতে করে সে (এ দিয়ে মানুষদের) অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে হাসি-বিদ্রুপ-তামাশা হিসেবেই গ্রহণ করে…” মর্মে আয়াতটির শেষে কঠিনঅপমানজনক শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে।[11]
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীও তাঁর তাফসীরে উপরের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে তাঁর ব্যাখ্যাটি বেশ অভিনব। তিনি ছাড়া আর কেউ এমনটা উল্লেখ করেননি। ইমাম রাযী ‘মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে…’ আয়াতটির তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, “আল-কোরআন হলো প্রজ্ঞাময় আয়াত সম্বলিত কিতাব। অথচ কাফেররা একে অগ্রাহ্য করে অন্য কিছুতে মগ্ন হয়ে পড়তো। বেশ কিছু কারণে তাদের এই আচরণকে মন্দ হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়–
প্রথমত, স্বভাবতই প্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করে অন্য কোনো আলোচনায় নিমগ্ন হওয়াটা একটা বাজে কাজ।
দ্বিতীয়ত, মগ্ন হওয়া আলোচনার বিষয়টিও যদি বাজে ও নিরর্থক হয়, তাহলে সেটি আরো বেশি খারাপ কাজ।
তৃতীয়ত, কখনো কখনো আনন্দ-তামাশার বিষয়গুলো স্রেফ চিত্তবিনোদনের জন্য হয়ে থাকে। যেমনটা ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, তোমরা আনন্দ-বিনোদন করো। আর রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “তোমরা ক্বলবকে মাঝেমধ্যে বিনোদিত হবার সুযোগ দিও।” হাদীসটি দায়লামী আনাস থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া সহীহ মুসলিমে এর সমর্থনে আরেকটা হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “ও হানযালা! সব কিছুর জন্য নির্ধারিত সময় আছে।” এসব হাদীস থেকে সাধারণ মানুষজন মনে করে, এখানে লাগামহীন হাসি-তামাশা বা রসিকতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আলেমদের মত হলো– এখানে যথাযথভাবে ইবাদত ও সংশ্লিষ্ট করণীয়গুলো পালন করার সাপেক্ষে বিনোদনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অন্যথায় নয়। আর যখন এই বিনোদনের উদ্দেশ্য হয় অন্যকে পথভ্রষ্ট করা, তখন এ ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে গর্হিত ও অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা ‘মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে’ মর্মে আয়াতটিতে যেমনটা উল্লেখ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তায়ালা ‘بغير علم’ দিয়ে সেসব লাহওয়াল হাদীস বেচাকেনাকে উদ্দেশ্য করেছেন, যা তারা কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে ক্রয় করে থাকে এবং ‘ويتخذها’ মানে হলো আল্লাহর পথকে তারা গ্রহণ করে ঠাট্টা-মশকরা হিসেবে। তাই তাদের জন্য অপমানজক শাস্তি বরাদ্দ করা হয়েছে। ‘مهين’ তথা অপমানজক শাস্তি বলতে আল্লাহ তায়ালা শাস্তির স্থায়িত্বকে ইঙ্গিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক রাজা তার কর্মচারীদের মধ্য থেকে একজনকে শাস্তির আদেশ দিলো। কিন্তু দণ্ড কার্যকরের জন্য নিয়োজিত রাজকীয় সৈনিক যদি বুঝতে পারে, কর্মচারীটি বাদশাহর বশ্যতা পুনরায় মেনে নেবে, তাহলে জেলের মধ্যে তাকে কিছুটা সম্মান করবে, শাস্তিও তুলনামূলকভাবে কম দেবে। আর যদি মনে হয়, কর্মচারীটির মধ্যে রাজার বশ্যতা মেনে নেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে তাকে অপমানজনক শাস্তি মুখোমুখি হতে হয়। ‘عذاب مهين’ দিয়ে মূলত এই ধরনের অপমানজনক শাস্তির কথা বোঝানো হয়েছে। এ থেকে মুমিন ও কাফেরের শাস্তির পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুমিনকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য মূলত তাকে সংশোধন করা, অপমান করা নয়।”
তারপর “যখন তার সামনে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে দম্ভ ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি, যেন সে বধির। তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও।” আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী বলেন,
“এর মানে হলো অর্থহীন কথাবার্তা সে মূল্য দিয়ে ক্রয় করে। আর অর্থপূর্ণ সত্য বিনামূল্যে সামনে আসলেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আয়াতটি সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, এর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব আছে। সচরাচর কোনো ক্রেতা যখন কিছু কিনতে চান, তখন সেই পণ্যের জন্য তার কাছ থেকে দাম চাওয়া হয়। তবে ক্রেতা কিনতে চাননি এমন কিছু ফ্রি দেয়া হলে সেটি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করে থাকেন। একইভাবে বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও হিকমাহ তথা প্রজ্ঞা ক্রয় করা। কিন্তু প্রজ্ঞাময় কোরআনের আয়াত না চাইতেও যখন তাদের কাছে আসলো, তখনও মুখ ফিরিয়ে নেয়া দাম্ভিক লোকগুলো তা শুনতে চাইতো না। এখানেও আবার কয়েকটা পর্যায় রয়েছে:
প্রথমত, হিকমাহ (প্রজ্ঞা) পরিহার করা। এটি নিঃসন্দেহে একটি মন্দ কাজ।
দ্বিতীয়ত, অহংকার প্রদর্শন করা। কারণ, যে ব্যক্তি রুস্তম-বাহরামের কাহিনীর মতো ফালতু বিষয়ে মগ্ন থাকে, সে স্বভাবতই অহংকারের কারণে প্রজ্ঞা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেবল তখনই তার অহংকার করা মানায় যদি সে দাবি করতে পারে, কোরআনের আয়াতের মতো প্রজ্ঞাময় কিছু বলার সামর্থ্য তারও রয়েছে। অথচ বাস্তবে তার সেই সামর্থ্য নেই। এই অক্ষমতার কারণেই সে অর্থহীন সব কাহিনী ফেরি করে বেড়ায়।
তৃতীয়ত, আয়াতের ‘যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি’ অংশটুকু দ্বারা সেই অহংকারী লোকটাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যে আজেবাজে কাহিনী শুনতে অভ্যস্ত। লোকটি কোরআনের প্রজ্ঞাময় কথার দিকে ফিরে তাকায় না এবং এমন ভাব করে যেন তার কাছে এসবের কোনো পাত্তাই নেই।
চতুর্থত, ‘যেন সে বধির’ আয়াতাংশ দ্বারা মূলত ব্যক্তিটির স্পর্ধার মাত্রা বোঝানো হয়েছে। আর ‘তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও’ আয়াতের মানে হলো– এ ধরনের স্পর্ধা দেখানো ব্যক্তিটির জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি; অতএব, আপনি তাকে সতর্ক করুন এবং ভয় দেখান। কিংবা, হতে পারে এই আয়াত দিয়ে এটা বোঝানো হয়েছে, যার আচরণ উল্লেখিত করা ব্যক্তিটির মতো হবে, অতএব ‘তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও।”[12]
২। অর্থহীন কথাবার্তা (লাগ্উ) এড়িয়ে চলা সংক্রান্ত আয়াত:
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীদের আরেকটি দলীল হলো কোরআনের সেই আয়াত, যেখানে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের প্রশংসা করে বলেছেন–
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ
“আর যখন তারা অর্থহীন কথাবার্তা শুনে, তখন তারা সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা কাসাস: ৫৫)
তাদের মতে, গানও অর্থহীন কথাবার্তার (লাগ্উ) অন্তর্ভুক্ত। তাই আয়াতের মর্মানুসারে গান শোনা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অথচ আয়াতটির মূল অর্থের দিকে মনোযোগ দিলে বুঝা যায়, এখানে ‘আল-লাগ্উ’ শব্দটির মানে হলো– কাউকে মূর্খের মতো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা, অপমান করা ইত্যাদি। আয়াতটির বাকি অংশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
“আর যখন তারা অর্থহীন কথাবার্তা শুনে, তখন তারা সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে আমাদের কাজের ফল আমাদের এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের। তোমাদেরকে সালাম। আমরা জাহেলদের মতো পথ চলতে চাই না।” (সূরা কাসাস: ৫৫)
এই আয়াতের সাথে অন্য একটি আয়াতের বেশ মিল রয়েছে। সেখানে আল্লাহ তায়ালা ‘রহমানের বান্দাদের’ প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন:
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
“তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে আসে, তখন তারা বলে সালাম।” (সূরা ফুরকান: ৬৩)
এখন গানকেও যদি ‘লাগউ’ শব্দের অন্তর্ভুক্তু হিসেবে স্বীকার করা হয়, তাহলে আয়াতের ভাষ্য থেকে মূলত প্রতিপাদিত হয়: গান না শোনা মুস্তাহাব তথা উত্তম কাজ। অর্থাৎ, একে হারাম গণ্য করা হচ্ছে না।
‘লাগউ’ শব্দটি ‘বাতিল’ শব্দটির কাছাকাছি, যার অর্থ হলো: যে বিষয়ের মধ্যে কোনো ফায়দা বা উপকারিতা নেই। আর ফায়দাহীন গান শোনা ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা কোনো অধিকার ক্ষুণ্ন করছে, বা কোনো কর্তব্য পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইবনে জুরাইহ সম্পর্কে বর্ণিত আছে: তিনি গান শোনাকে বৈধ মনে করতেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো: গান শোনা কেয়ামতের দিন আপনার ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে, নাকি মন্দ কাজ হিসেবে গণ্য হবে? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন: এটি ভালো-মন্দ কোনোটা হিসেবেই গণ্য হবে না। কারণ, গান শোনা ‘লাগ্উ’ তথা অনর্থক কাজের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন:
لَّا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّـهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ
“তোমাদের নিরর্থক (লাগ্উ) শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে ধরবেন না।” (সূরা বাকারা: ২২৫)
ইমাম গাজ্জালী বলেছেন: চুক্তি বা সংকল্প করা হয়নি এমন কোনো বিষয়ে আল্লাহর নামে শপথ করা একটি নিরর্থক কাজ। বেহুদা হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনো জবাবদিহিতা বা শাস্তি নেই। তাহলে কাব্য ও নৃত্যের মতো নিরর্থক কাজের জন্য কীভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়?[13]
এই কথার জের ধরে আমরা আরো বলতে পারি: গান মাত্রই নিরর্থক নয়। গানের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিয়ত ভেদে এ সংক্রান্ত বিধানের তারতম্য হতে পারে। সৎ নিয়তের কারণে মুবাহ, কিংবা অনর্থক কাজ ইবাদতের মানে উন্নীত হতে পারে। অন্যদিকে, অসৎ ও অশুদ্ধ নিয়ত এমন কাজকে ধ্বংস করে দেয়, যা বাইরে থেকে ইবাদতের মতো মনে হলেও ভিতরে লুকিয়ে থাকে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। সহীহ হাদীসে এসেছে: “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বাহ্যিকতা বা ধন-সম্পত্তির দিকে মোটেও তাকান না। তিনি মূলত তোমাদের অন্তর ও কাজসমূহ দেখেন।”[14]
এ পর্যায়ে আমরা ইমাম ইবনে হাযমের একটি চমৎকার বক্তব্য উদ্ধৃত করতে পারি। এটি তিনি তাঁর ‘আল-মুহাল্লা’ নামক বিখ্যাত ফিকাহর কিতাবে উল্লেখ করেছেন। গান-বাজনার বিরোধিতা করে, এমন ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন: “(গানের বিরোধীরা) প্রমাণ হিসেবে বলে থাকেন বলেন: গান কি ‘আল-হক’ তথা সত্যের অন্তর্ভুক্ত? নাকি সত্য নয় এমন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত? হকের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বা না হওয়া – এই দুইয়ের বাইরে বিকল্প কোনো তৃতীয় পন্থা হতে পারে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “সত্য আসার পর (আল্লাহকে না মানা) গোমরাহী ছাড়া আর কী?” (সূরা ইউনুস: ৩২)। এক্ষেত্রে আমাদের উত্তর হলো– রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তা-ই পায়, যা সে নিয়ত করে।’[15] অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার নিয়তে গান শুনবে, সে নিঃসন্দেহে ফাসিক। গান ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও এই কথাটি সমপরিমাণে সত্য।
যে ব্যক্তি আরো ভালোভাবে আল্লাহর আনুগত্য করা ও ভালো কাজে নেমে পড়ার জন্য নিজেকে উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে গান শুনবে, সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আনুগত্যপরায়ণ ও ভালো মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যে ব্যক্তি গান শোনার ক্ষেত্রে আনুগত্য কিংবা পাপ কাজ কোনোটারই নিয়ত করে না, তার কাজটি ক্ষমাপ্রাপ্ত অর্থহীন কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে গান শোনাও বাগানে ঘোরাফেরা করা; বাগানের গেটে বসে চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করা; আকাশী, সবুজ বা অন্য কোনো রঙিন কাপড় পরিধান করা; পা ছড়িয়ে বা ভাঁজ করে আরাম করে বসে থাকার মতো সাধারণ একটি কাজ হিসেবে গণ্য হবে।”[16]
৩। অর্থহীন বিষয়কে ভদ্রতার সাথে পাশ কাটানো সংক্রান্ত আয়াত:
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ আরেকটা আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেন। সেটি হলো:
وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا
“আর যারা মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন অর্থহীন কাজকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মানসম্মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে সরে পড়ে।” (সূরা ফুরকান: ৭২)
সালাফদের কেউ কেউ ‘আয-যূর’ (মিথ্যা কাজ) শব্দটির তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, এটি দিয়ে মূলত গান বোঝানো হচ্ছে। যেমন– মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যা বলেছেন: এই আয়াতে ‘আয-যূর’ শব্দটি দিয়ে গান ও নিরর্থক কাজকর্মকে বোঝানো হচ্ছে। হাসান, মুজাহিদ ও আবু জাহহাফ থেকে ঠিক একই ধরনের তাফসীর বর্ণিত আছে। আর গানকে ‘আয-যূর’ হিসেবে অভিহিত করায় এটি হারাম হিসেবে বিবেচিত হওয়াকেই প্রতিপাদন করে।
অন্যদিকে, আল-কালবী বলেছেন: মুমিনরা নিরর্থক বা ফালতু আসরে উপস্থিত হন না,[17] আর গান তো এসব নিরর্থক ও ফালতু আসরেরই অংশ।
উপরোক্ত এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কিছু কথা আছে:
প্রথমত: কোনো কোনো মুফাসসির আয়াতটির এমন ব্যাখ্যা করেছেন, যার সাথে গান বা তৎসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর দূরতম সম্পর্কও নেই। তারা আয়াতে উল্লেখিত ‘ইয়াশহাদুন’ (يشهدون) শব্দটির অর্থ করেছেন ‘শাহাদাহ’ (الشهادة) তথা সাক্ষ্য দেয়া হিসেবে; ‘শুহুদ’ (الشهود) তথা অবলোকন করা বা দেখা অর্থে নয়। এর ফলে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়, “(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না।” যদিও আমি এই অর্থটিকে প্রাধান্য দেই না।
যেমন কাতাদাহ বলেছেন, আয়াতে উল্লেখিত ‘আয-যুর’ শব্দের মূল অর্থ হলো মিথ্যা। অন্যদিকে, দাহহাক বলেছেন, এখানে ‘আয-যুর’ শব্দের অর্থ হলো শিরক।
দ্বিতীয়ত: মুফাসসিরদের কেউ কেউ ‘আয-যুর’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন ‘মুশরিকদের আনন্দ-উৎসব’ হিসেবে। কারণ, এসব উৎসবে জাহেলিয়াত ও পৌত্তলিকতা থেকে শুরু করে নানান ধরনের ভ্রান্ত বিষয়ের প্রচলন ছিল। ইবনে আব্বাস থেকে আল-খাতীব এমনটাই বর্ণনা করেছেন।
এছাড়া এ ব্যাপারে ইকরিমার বক্তব্যটি এই মতের বেশ কাছাকাছি। আয়াতটির ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন: ‘আয-যূর’ শব্দটি দিয়ে জাহেলী যুগে প্রচলিত খেলাধূলাকে বুঝানো হয়েছে।[18]
এছাড়া কিছু কিছু বিদয়াতপন্থী ও বিকৃতিকারীরা ওলী-আউলিয়াদের কবর ঘিরে যেসব সীমালঙ্ঘনমূলক কার্যকলাপ করে থাকে, সেগুলোও এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ ব্যাপারে মূলনীতি হলো: কোনো দলীলে যদি শরীয়তসম্মত একাধিক সঠিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে অকাট্যভাবে একমাত্র সঠিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
তৃতীয়ত: তর্কের খাতিরে যদি ‘আয-যুর’ শব্দটির ব্যাখ্যা হিসেবে ‘গান’কে সঠিক বলে ধরেও নিই, তখনও কিছু কথা থাকে। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, এর মাধ্যমে সে ধরনের গানকেই বুঝানো হচ্ছে, যেগুলো মানুষকে পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়, আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং যেগুলোতে খারাপ কাজের মিশ্রণ থাকে।
চতুর্থত: তাছাড়া আলোচ্য আয়াতে এমন কোনো উপাদান নেই, যা দিয়ে ওয়াজিব বা আবশ্যকতা আরোপ করা যায়। বরং আলোচ্য আয়াতটিতে কেবল উল্লেখিত কাজগুলো পালন করাকে রহমানের বান্দাদের গুণ হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে। অন্য আরেকটি আয়াতেও যেভাবে প্রশংসা করে বলা হয়েছে:
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
“(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান হয়ে।” (সূরা ফুরকান: ৬৪)
এটা তো সহজেই বোধগম্য যে, এখানে যা করতে বলা হয়েছে সেগুলো কোনো আবশ্যকীয় ফরজ ইবাদত নয়। বরং এগুলো পরিপূর্ণতাদানকারী মুস্তাহাব কাজ।
৪। শয়তানের আওয়াজ সংক্রান্ত আয়াত:
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীদের চতুর্থ দলীল হলো কোরআনের সেই আয়াতসমূহ, যেখানে আল্লাহ তায়ালা অভিশপ্ত শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:
قَالَ اذْهَبْ فَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَّوْفُورًا – وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُم بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا
“আল্লাহ তায়ালা বললেন– যাও (দূর হও এখান থেকে), যারা তোমার আনুগত্য করবে, তোমাদের সবার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, আর (জাহান্নামের) শাস্তি (হবে) পুরোপুরি। এদের মধ্যে যাকে যাকে পারো, তুমি তোমার আওয়াজ দিয়ে গোমরাহ করে দাও, তোমার যাবতীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদের ওপর দিয়ে চড়াও হও, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে তুমি তাদের সাথী হয়ে যাও এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে থাকো; আর শয়তান তাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা তো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৬৩-৬৪)
কোনো কোনো মুফাসসির এখানে উল্লেখিত ‘শয়তানের আওয়াজ’ শব্দের তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গান। মুজাহিদ বলেছেন, শয়তানের আওয়াজ মানে হলো গান, বাঁশী ও বিনোদন। আর দাহ্হাক বলেছেন, শায়তানের আওয়াজ মানে হলো বাঁশির আওয়াজ।
উপরোক্ত তাফসিরই একমাত্র সঠিক ও ভুলত্রুটির উর্ধ্বে, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। ফলে একে মেনে নেয়া বাধ্যতামূলকও নয়। যেহেতু অন্যান্য মুফাসসিরগণ এই তাফসীরের বিপরীত মত দিয়েছেন। যেমন– ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত: শয়তানের আওয়াজ মানে হলো আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহ্বানকারী যে কোনো কিছু। আবার বলা হয়েছে, শয়তানের আওয়াজ মানে হলো শয়তানের কুমন্ত্রণা।[19]
আর একটু আগে উল্লেখিত মূলনীতি তো রয়েছেই– কোনো দলীলে যদি শরীয়তসম্মত একাধিক সঠিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে অকাট্যভাবে একমাত্র সঠিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
মূলকথা হলো: এখানে আয়াতের অর্থটা বাহ্যিক বা আক্ষরিকভাবে বুঝতে চাওয়াটা উচিত নয়। বরং আয়াতটির উদ্দেশ্য হলো অভিশপ্ত শয়তানকে এই কথা বলা যে– তুমি তোমার সমস্ত অস্ত্র দিয়ে আদমের সন্তানদের বিভ্রান্ত করতে কোমর বেঁধে নামো। তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে তোমার সমস্ত সৈন্য আর কৌশলকে কাজে লাগাও। এত কিছুর পরেও তুমি আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না।
৫। ‘ওয়া আনতুম সা-মিদূন’ শীর্ষক আয়াত:
এ সংক্রান্ত পঞ্চম দলীল হিসেবে সূরা নাজমের শেষ দিকের কয়েকটি আয়াতকে উপস্থাপন করা হয়। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَفَمِنْ هَـٰذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ – وَتَضْحَكُونَ وَلَا تَبْكُونَ – وَأَنتُمْ سَامِدُونَ
“তাহলে এসব কথায় কি তোমরা অবাক হয়ে যাচ্ছো? তোমরা হাসিঠাট্টা করছো, অথচ কাঁদছো না! তোমরা ‘সামিদূন’ হয়ে রয়েছো।” (সূরা নাজম: ৫৯-৬১)
ইবনে আব্বাস থেকে ইকরিমা বর্ণনা করেছেন, ইবনে আব্বাস বলেছেন: ‘সামাদা’ হলো গাধার স্বরে নিকৃষ্ট ভাষায় গান করা। যেমন: আরবীতে বলা হয়: اُسْمُدْ لَناَ (উস্মুদ লানা), অর্থাৎ আমাদেরকে গান শোনাও। যখন তারা কোরআন তেলাওয়াত শুনতো, তখন তারা গান গাইতো, হাসি-তামাশা করতো; যাতে করে তাদের কোরআন শুনতে না হয়।
কিন্তু আলোচ্য শব্দটি দিয়ে কী বোঝাচ্ছে এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন আরো ব্যাখ্যা রয়েছে। এমনকি স্বয়ং ইবনে আব্বাস থেকে আল-ওয়ালিবী ও আল-আওফী বর্ণনা করেছেন: ‘সামিদূন’ মানে হলো, উদাসীন, অবজ্ঞাকারী। এছাড়া কুরতুবী বলেছেন, আরবী ভাষায় শব্দটির ক্রিয়াপদের এই ব্যবহারটি খুব প্রসিদ্ধ: সামাদা–ইয়াস্মুদু–সুমূদান। যার মানে হলো: উদাসীন হওয়া, পাত্তা না দেয়া বা অবজ্ঞা করা। অন্যদিকে, দাহহাক বলেছেন, সামিদূন অর্থ উদ্ধত ও অহংকারী। আস-সিহাহ গ্রন্থে এসেছে: সামাদা–সুমূদান ক্রিয়াপদের অর্থ: অহংকারবশত মাথা উঁচু করে চলা। যে ব্যক্তি এভাবে চলাফেরা করে, তাকে বলা হয় সামিদ। আর কবি মুবাররিদ বলেছেন: সামিদূন অর্থ– যারা নিষ্ক্রিয় ও নির্লিপ্ত। কবি বলেছেন:
أتى الحدثان نسوة آل حرب بمقدور سمدن له سمودا
فرد شعورهن السود بيضا ورد وجههن البيض سودا
“ভাগ্যের ফেরে আলে হারবের নারীরা এমন বিপদের মুখোমুখি,
যা তাদের হতবুদ্ধি করে দিয়েছে।
ফলে তাদের কালো চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে,
আর ফর্সা চেহারাগুলো হয়ে গেছে কালো।”
অর্থাৎ, এই কবিতায় এসে কবি সামাদা শব্দটিকে ভিন্ন একটি অর্থে ব্যবহার করেছেন।
আর এটা তো নির্ধারিত একটা বিষয় যে– কোনো দলীলে যদি শরীয়তসম্মত একাধিক সঠিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে অকাট্যভাবে একমাত্র সঠিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
এই আয়াতকে যারা গান হারাম হওয়ার পক্ষের দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন, তাদের জবাবে ইমাম গাজ্জালী বলেছেন: তাদের দাবী অনুযায়ী গানকে হারাম হিসেবে মেনে নিলে তো হাসাহাসি করা তো হারাম হবেই, এমনকি কান্না না করাও হারাম! কারণ আয়াতটিতে এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “তোমরা হাসিঠাট্টা করছো, অথচ কাঁদছো না!”
গাজ্জালী আরো বলেছেন: যদি বলা হয়ে থাকে, এই আয়াতটি তো মুসলমানদের ইসলাম গ্রহণের কারণে যারা হাসাহাসি করে, তাদের জন্য প্রযোজ্য। তাহলে এক্ষেত্রেও শুধু সেসব গান ও কবিতাই হারাম হবে, যেগুলো মুসলমানদেরকে উপহাস ও অবজ্ঞার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমনটা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে” (সূরা শোয়ারা: ২২৪)। এখানে অবশ্য আল্লাহ তায়ালা কাফির কবিদের কথা বুঝাতে চেয়েছেন। স্বয়ং কবিতাকে হারাম গণ্য করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়।[20]
আলোচনার এই পর্যায়ে এসে আমরা দেখতে পাই– পবিত্র কোরআনে এমন একটা আয়াতও নেই, যাকে অকাট্য ও শর্তহীনভাবে গান হারাম হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
সমস্ত প্রসংশা মহান আল্লাহর, যিনি আমাদের সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। তিনি ব্যতীত কোনোভাবেই আমরা সঠিক পথের দিশা পেতাম না।
খ) সুন্নাহ থেকে উপস্থাপিত দলীল ও এর ব্যাখ্যা
গান ও বাদ্যযন্ত্রকে যারা হারাম মনে করেন, তারা কোরআনের আয়াতের পাশাপাশি কতিপয় মারফু[21] হাদীস ও মাওকুফ[22] হাদীসকেও দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। আগের অধ্যায়ে আমরা সেগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখেছি, তারা কোরআনের যেসব আয়াতকে দলীল হিসেবে তুলে ধরেছেন, সেগুলোর কোনোটিই গান হারাম হওয়ার অকাট্য দলীল নয়। সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার পক্ষে তাদের উপস্থাপিত হাদীসগুলোকে এবার আমরা আগের মতোই একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করে দেখবো। পাশাপাশি সাহাবীদের কথাগুলোও পর্যালোচনা করবো, যাতে প্রকৃত বিষয়টা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
তাদের উপস্থাপিত হাদীসগুলোর সনদ ও প্রামাণ্যতার বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করবো। পাশাপাশি হাদীসগুলোর মতন (কন্টেন্ট) এবং তারা এর যে অর্থ করেন, তাও খতিয়ে দেখবো।
১। মায়াযিফ (المعازف) সংক্রান্ত হাদীস
গানকে যারা হারাম সাব্যস্ত করতে চান, তাঁরা সম্ভবত মায়াযিফের হাদীসটিকে দলীল হিসেবে খুব বেশি ব্যবহার করেন। এই হাদীসটির ব্যাপারে তীব্র মতভেদ রয়েছে।
এটি সহীহ বুখারীতে হিশাম বিন আম্মার থেকে বর্ণিত মুয়াল্লাক[23] হাদীস হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে, যার সনদ আবু আমের কিংবা আবু মালিক আশআরী পর্যন্ত পৌঁছেছে। তিনি রাসূলকে (সা.) বলতে শুনেছেন: “আমার উম্মতের একটা দল অবশ্যই আল-হির[24], রেশমী কাপড়, মদ এবং মায়াযিফকে হালাল জ্ঞান করবে।”[25] এখানে মায়াযিফ শব্দের অর্থ হচ্ছে বিনোদন বা বাদ্যযন্ত্র।
এই হাদীসটি যদিও সহীহ বুখারীতে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু এটি মুয়াল্লাক হাদীসের অন্তর্ভুক্ত, মুসনাদ[26] বা মুত্তাসিল[27] হাদীস নয়। ফলে সনদ বিচ্ছিন্নতার দায়ে ইবনে হাযম হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এছাড়া আরো কিছু কারণ উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, হাদীসটির সনদ ও মতন সমস্যামুক্ত নয়। তাই হাদীসটি দিয়ে হারাম সাব্যস্ত করার ব্যাপারটিও সুস্পষ্ট নয়। কোনো কিছু হারাম করার ক্ষেত্রে শরীয়তে বেশ কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। কারণ, লোকেরা যেন হারাম বিষয়ের ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব না দেখায় এবং আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব পবিত্র রিযিক ও সৌন্দর্য-শোভা বরাদ্দ করেছেন সেগুলোকে হারাম করতে না পারে।
তবে ইবনে হাজার আসকালানী এই হাদীসটিকে মুত্তাসিল হিসেবে প্রমাণ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। তিনি আরো ৯টি সনদের মাধ্যমে এটিকে কার্যত মুত্তাসিল হাদীস হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর উল্লেখিত প্রতিটি সনদেই এমন একজন বর্ণনাকারী আছে, যার ব্যাপারে হাদীস যাচাইকারী অনেক আলেমের আপত্তি রয়েছে। সেই বর্ণনাকারীর নাম হিশাম বিন আম্মার।[28] তিনি মূলত দামেশকের খতীব, কারী, মুহাদ্দিস, ফকীহ এবং আলেম ছিলেন। ইবনে মঈন এবং আল-ইজলী তাকে সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তবে আবু দাউদ তার ব্যাপারে বলেছেন, তিনি চারশ’ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার কোনোটিরই ভিত্তি নাই।
আবু হাতিম বলেছেন, তিনি সত্যবাদী হলেও পরবর্তীতে তার এই অবস্থান বজায় থাকেনি। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন হলো যে তার কাছে হাদীসের নামে যাই আসতো, যাচাই-বাছাই না করেই সেগুলোকে তিনি হাদীস হিসেবে গ্রহণ করতেন। ইবনে সাইয়ারও অনুরূপ কথা বলেছেন। এটা এক বিরাট সমস্যা। এ কারণে তিনি যা কিছু বর্ণনা করেছেন, সেসব বিষয়ে আমরা ভালো-মন্দ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। কারণ, সিদ্ধান্ত দিলে এমন কিছু বর্ণনাও হাদীস হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে যেতো, যা ‘সত্যবাদী’ অবস্থান থেকে সরে আসার পরে তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
ইমাম আহমদ বলেছেন, তিনি কিছুটা অমনোযোগী ছিলেন।
নাসায়ী বলেছেন, তার ব্যাপারে তেমন আপত্তি নেই। (এই কথা দ্বারা সাধারণভাবে কাউকে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় না, বরং এর মাধ্যমে বর্ণনাকারীর দুর্বলতাই বুঝা যায়।)
যাহাবী তাকে সমর্থন করা সত্ত্বেও বলেছেন: তিনি সত্যবাদী, তবে প্রচুর মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছেন।[29]
তাছাড়া অনেকে হিশাম বিন আম্মারকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই অভিযোগে যে তিনি সম্মানী ছাড়া হাদীস বর্ণনা করতেন না!
এটা সত্য যে হিশাম বিন আম্মার সহীহ বুখারীর হাদীস বর্ণনাকারীদের একজন। কিন্তু তিনি এমনই একজন, যার কারণে হাদীস বিশ্লেষকগণ ইমাম বুখারীর সমালোচনা করেছেন। তবে হাফিয ইবনে হাজার ‘হাদয়ুস সারী’ কিতাবে হিশাম বিন আম্মারের বিষয়ে সমালোচকদের সমালোচনা উল্লেখ করার পর ইমাম বুখারীর পক্ষে বলতে গিয়ে লিখেছেন: তিনি সহীহ বুখারীতে তার কাছ থেকে কেবল দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তারমধ্যে একটি বেচাকেনা অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হাদীসটির সনদ হিশাম থেকে শুরু করে আবু হোরায়রা (রা.) পর্যন্ত। হাদীসটি হলো: “একজন ব্যবসায়ী মানুষকে ঋণ দিয়ে বেড়াতেন…..।” তবে হাদীসটি অন্য একটি সনদ তথা ইব্রাহীম বিন সাদ যুহরীর কাছ থেকেও বুখারী বর্ণনা করেছেন।
আর দ্বিতীয় হাদীসটি ‘মানাকিব আবু বকর’ অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে, যার সনদ হিশাম থেকে শুরু করে আবু দারদা পর্যন্ত পৌঁছেছে। তবে একই সূত্র থেকে হাদীসটির ভিন্ন বর্ণনাকারীও রয়েছেন।
ইবনে হাজার বলেছেন: ইমাম বুখারী হিশাম বিন আম্মারের কাছে থেকে ‘আশরিবাহ’ (পানীয় দ্রব্য) অধ্যায়ে মায়াযিফ হারাম হওয়া সংক্রান্ত মুয়াল্লাক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
তারপর তিনি বলেছেন: আমার কাছে যদ্দুর স্পষ্ট হয়েছে তাতে এই সিদ্ধান্ত দেওয়া যায়, হিশাম বিন আম্মার বর্ণিত উল্লেখিত হাদীসগুলোই কেবল ইমাম বুখারী দলীল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।[30]
বিরোধপূর্ণ বিষয়, বিশেষত ‘উমূমুল বালওয়া’র[31] অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে তাঁর এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
এছাড়া ইবনে হাজার তাঁর ‘তাগলীক আত-তালীক’ গ্রন্থে আলোচ্য মুয়াল্লাক হাদীসটিকে অন্য একটি সনদে মুত্তাসিল হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু এই সনদে এমন একজন বর্ণনাকারী আছেন, যিনি হিশাম বিন আম্মার থেকেও বেশি দুর্বল। তিনি হলেন মালিক বিন আবু মারইয়াম। এই বর্ণনাকারী সম্পর্কে ইবনে হাযম বলেছেন: তিনি আসলে কে, এ ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। রিজাল শাস্ত্রের অন্যতম শীর্ষ বিশেষজ্ঞ ইমাম যাহাবী তার ‘মাজহূল’ বা অজ্ঞাত হিসেবে মন্তব্য করেছেন।
হাফিযুল উম্মত ইবনে হাজার আসকালানী যে ৯টি সনদের উল্লেখ করেছেন, এগুলোর কোনোটাই নির্ভেজাল সহীহ মানে উত্তীর্ণ নয়। তবে এসব বর্ণনার কোনো কোনোটিতে মদকে ভিন্ন নাম দিয়ে পান করে গায়িকা ও নর্তকী সমেত গান-বাজনার আয়োজন করাকে তিরষ্কার করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গান ও বাদ্যযন্ত্র অবশ্যই হারাম হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম মায়াযিফ সংক্রান্ত এই হাদীসটিকে শক্তিশালী হিসেবে সাব্যস্ত করতে গিয়ে বলেছেন: আবু দাউদ হাদীসটিকে তাঁর সুনান গ্রন্থে মাওসুল তথা অবিচ্ছিন্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দাবিটি সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি আসলে শক্তিশালী হয় না। কারণ, হাদীসটির সনদে এমন বর্ণনাকারী রয়েছেন, যাকে হাদীস বিশারদগণ দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তাছাড়া আবু দাউদ তাঁর হাদীস সংকলনে বিতর্কের মূল অংশটি অর্থাৎ ‘আল-মায়াযিফ’ (বাদ্যযন্ত্র) শব্দটি উল্লেখই করেননি।[32]
আবু দাউদ হাদীসটিকে উল্লেখ করেছেন ‘আশরিবাহ’ (পানীয় দ্রব্য) অধ্যায়ের ‘দাযী’ (শস্যবীজ) পরিচ্ছেদে। শস্যদানাকে নাবীযের (এক প্রকার মদ) মধ্যে রেখে দিলে সেটি পরিবর্তিত হয়ে শক্ত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হাদীসের ভাষ্য হলো: “আমার উম্মতের কিছু মানুষ ভিন্ন নাম দিয়ে মদ পান করবে।” এরপর আর কিছু উল্লেখ নেই। এমতাবস্থায় এই হাদীসটিকে গান হারাম হওয়ার দলীল হিসেবে কীভাবে ব্যবহার করা যায়!
তাছাড়া হাদীসটি সাদাকা বিন খালিদের সূত্রে হিশাম বিন আম্মার বর্ণনা করেছেন। শাওকানী তাঁর ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে সাদাকা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ইয়াহিয়া ইবনে মঈন থেকে ইবনে জুনাইদ উল্লেখ করেছেন: তিনি আসলে কিছুই নন। এছাড়া আহমদ বিন হাম্বল থেকে মিযযী বর্ণনা করেছেন: তিনি সঠিক নন।[33] তবে সত্যি কথা হলো, আমি জারাহ ওয়াত তাদীল[34] সংক্রান্ত বইপত্র ঘেঁটে এমন কথার কোনো সূত্র খুঁজে পাইনি। আর ইবনে হাজারও বুখারীর সমালোচকদের তরফ থেকে এমন কথা উল্লেখ করেননি।
ইমাম বুখারীর সততার একটা উদাহরণ হলো: তিনি আলোচ্য হাদীসটিকে মুয়াল্লাক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং অন্য কোথাও এটিকে মুত্তাসিল হিসেবে বর্ণনা করেননি। তিনি যে ফিকহী জ্ঞানে প্রাজ্ঞ ছিলেন, সেটি বুঝা যায় এ সংক্রান্ত অধ্যায়টির নামকরণে তাঁর দূরদর্শিতা থেকে। তিনি শিরোনাম দিয়েছেন ‘যারা মদকে ভিন্ন নাম দিয়ে হালাল জ্ঞান করবে’, ‘গান হারাম হওয়া প্রসঙ্গে’ জাতীয় কোনো কথা অধ্যায়ের শিরোনামে তিনি যোগ করেননি। তাছাড়া ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থের কোথাও এমন কোনো অধ্যায় রাখেননি, যেখানে গান হারাম হওয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে।
হাদীসটির উপরিউক্ত পর্যালোচনার পাশাপাশি আরো বলা যায়, এসব পরিভাষার একাধিক অর্থ রয়েছে। যেমন: ‘মায়াযিফ’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন: এর অর্থ হলো প্রমোদকেন্দ্র। এটি আসলে ‘মুজমাল’ শব্দ (অর্থাৎ যেসব শব্দ দ্বারা বিস্তৃত ব্যাখ্যাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়, এটি তেমন একটি শব্দ)। আবার কেউ বলেছেন: এর অর্থ হলো বাদ্যযন্ত্র।
‘মায়াযিফ’ শব্দের অর্থ হিসেবে বাদ্যযন্ত্রকে মেনে নিলেও বুখারীর বর্ণিত মুয়াল্লাক হাদীসটি ‘মায়াযিফ’ হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল নয়। কারণ, হাদীসে বর্ণিত “ইয়াসতাহিল্লুনা” শব্দটির দুটো অর্থ হতে পারে, যেমনটা ইবনুল আরাবী উল্লেখ করছেন। প্রথমটি হলো: তারা এটিকে হালাল হিসেবে বিশ্বাস করে। দ্বিতীয় অর্থটি হলো: তারা সেসব জিনিসকে ভোগ করার জন্য শিথিল করে নিবে— রূপকার্থে এমনটি বোঝানো হচ্ছে। এমতাবস্থায় শব্দটি দ্বারা এসব বিষয়কে হালাল করে নিলে তা কুফরী হবে। কারণ, অকাট্য হারাম বিষয়কে (যেমন: মদ ও যিনা) হালাল বানিয়ে ফেললে তা যে কুফর, সে বিষয়ে সর্বসম্মত ঐক্যমত্য রয়েছে।
আর উল্লেখিত শব্দটি দ্বারা এসব বিষয়কে যদি হারাম বিবেচনা করা হয়, তাহলে একটি প্রশ্ন চলে আসে। সেটি হলো: হাদীসে উল্লেখিত সবগুলো বিষয় (যিনা, রেশমী কাপড়, মদ এবং মায়াযিফ) কি একত্রে হারাম হবে নাকি আলাদাভাবে হারাম হবে? এক্ষেত্রে বলা যায়, সবগুলো একসাথে হারাম সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি বেশি সঠিক। কারণ, হাদীসটিতে মূলত এমন একদল মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নিন্দা করা হয়েছে, যারা বিলাসিতা, পাপাচার, যিনা ও মদ্যপানে নিমগ্ন থাকে। তারা নারী, মদ, বিনোদন, গান, রেশম, স্বর্ণ নিয়ে বিভোর হয়ে থাকে। এ কারণেই আবু মালিক আশয়ারীর সূত্রে ইবনে মাজাহ হাদীসটিকে নিম্নোক্ত ভাষ্যে বর্ণনা করেছেন: “আমার উম্মতের কতক লোক মদকে ভিন্ন নাম দিয়ে পান করবে। (এমতাবস্থায়) তাদের সামনে বাদ্যবাজনা চলবে এবং গায়িকারা গান পরিবেশন করবে। আল্লাহ তায়ালা এদেরকে মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেবেন এবং তাদের কতককে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করবেন।”[35] এছাড়া ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে[36] এবং বুখারী তাঁর তারীখে এটি উদ্ধৃত করেছেন।
হিশাম বিন আম্মার বাদে অন্য সনদে যারাই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন, তারা মূলত মদ্যপানের শাস্তি বোঝানোর জন্য এটি উদ্ধৃত করেছেন। এসব ক্ষেত্রে ‘মায়াযিফ’ প্রসঙ্গটি মূলত পরিপূরক ও আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবে এসেছে। ফলে গান হারাম হওয়ার জন্য এটি উপযুক্ত দলীল নয়।
২। কূবা ও গুবাইরা (الكوبة والغبيراء) হারাম হওয়া সংক্রান্ত হাদীস
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ ইবনে ওমর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। এটি আহমদ ও আবু দাউদ সংকলন করেছেন। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন মদ, জুয়া, কূবা ও গুবাইরা… আর নেশা উদ্রেককারী যে কোনো কিছু হারাম।” আহমদের বর্ণনায় বলা হয়েছে: “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের উপর হারাম করেছেন মদ, জুয়া, মিয্র (এক ধরনের মদ), কূবা ও ক্বিন্নীন (এক প্রকার বীণা)।”
গানকে যারা হারাম মনে করেন, তারা এখানে ‘কূবা’ শব্দটিকে ঢোল-তবলা অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। আর ‘গুবাইরা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তথা ঢাক, তাম্বুরা, ঊদ (এক ধরনের বীণা), বারবাত (এটিও এক ধরনের বীণা) ইত্যাদি হিসেবে। এছাড়া ইবনে আব্বাসের বরাতে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর নবী (সা.) আব্দুল কায়েসের প্রতিনিধিকে বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উপর হারাম করেছেন, অথবা বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ হারাম করেছেন মদ, জুয়া এবং কূবা। আর নেশা উদ্রেককারী প্রত্যেকটি জিনিসই হারাম।”
এই হাদীসের অন্যতম একজন রাবী আলী বিন বাযীমাহকে সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেছিলেন: কূবা কী জিনিস? তিনি জবাব দিয়েছিলেন: ঢোল-তবলা।
কিন্তু প্রামাণ্যতা ও অর্থের দিক থেকে এ দুটো হাদীসের প্রকৃত অবস্থান কী, সে ব্যাপারে আমাদের কথা আছে।
প্রামাণ্যতা ও সনদের দিক থেকে ইমাম শাওকানী তাঁর “নাইলুল আওতার” গ্রন্থে ইবনে ওমরের হাদীস প্রসঙ্গে বলেছেন: “আত-তালখীস” গ্রন্থে আল-হাফিয হাদীসটির ব্যাপারে চুপ থেকেছেন। আর হাদীসটির সনদে রয়েছেন ওয়ালীদ বিন আবদাহ, যিনি ইবনে ওমর থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আবু হাতিম আর-রাযী তার সম্পর্কে বলেছেন: সে অজ্ঞাত। ইবনে ইউনুস “তারীখুল মিসরিয়্যীন” গ্রন্থে বলেছেন: তার (ওয়ালীদ বিন আবদাহ) কাছে থেকে বর্ণনা করেছেন ইয়াযিদ বিন আবু হাবীব। আল-মুনযিরী বলেছেন: এই হাদীসটি মা’লূল।[37] মুসনাদে আহমদের তাখরীজ (হাদীসের মান যাচাইয়ের পদ্ধতি) করতে গিয়ে ইবনে আব্বাসের হাদীসের (২৪৬৭ নং) সনদকে শাইখ শাকির সহীহ সাব্যস্ত করেছেন। একইভাবে শাইখ শুয়াইব ও তাঁর সহযোগীরাও মুসনাদে আহমদের তাখরীজ করতে গিয়ে হাদীসটিকে (২৪৬৭নং) সহীহ সাব্যস্ত করেছেন। হাদীসটির সনদের মধ্যে থাকা ইবনে বাযীমাহকে ইবনে মঈন ও অন্যান্যরা সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) সাব্যস্ত করলেও ইমাম আহমদ বলেছেন: তিনি সিকাহ হলেও কিছু বিষয় থেকে যায়। তিনি আরো বলেছেন: তিনি হাদীস বর্ণনার উপযুক্ত, কিন্তু শিয়া মতের দিকে তার ঝোঁক ছিল। তা সত্ত্বেও তার বর্ণিত হাদীসগুলো সুনান গ্রন্থকারগণ গ্রহণ করেছেন।
এদিকে ইবনে বাযীমাহ যদিও ‘কূবা’ শব্দের ব্যাখ্যায় ঢোল-তবলার কথা বলেছেন, কিন্তু অন্যান্যরা তার সাথে দ্বিমত করেছেন। ইবনুল আরাবী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: কূবা শব্দের অর্থ হলো পাশা খেলা। একইভাবে আল-খাত্তাবী ও আবু উবাইদ “গরীবুল হাদীস” (হাদীসে উল্লেখিত কঠিন শব্দগুলোর ব্যাখ্যা সংবলিত কিতাব) গ্রন্থে বলেছেন: ইয়েমেনবাসীদের ভাষায় কূবা শব্দের অর্থ হলো পাশা খেলা। একইভাবে গুবাইরা শব্দটির ক্ষেত্রেও তারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ ঢাক-তাম্বুরা ইত্যাদি। আর কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ নাবীয বা মাদকজাতীয় এক প্রকার পানীয় যা গম বা ভূট্টা থেকে তৈরি করা হয়। হাদীসে উল্লেখিত কঠিন বা অপ্রচলিত শব্দগুলোর ব্যাখ্যাসম্বলিত “আন-নিহায়াহ” গ্রন্থে ইবনুল আসীর এমনটাই উল্লেখ করেছেন।
যেহেতু হাদীসগুলোতে ব্যবহৃত কঠিন বা অপ্রচলিত শব্দগুলোর অর্থের ব্যাপারে আলেমগণ একমত নন এবং এগুলোর একাধিক অর্থ রয়েছে, সেহেতু এই শব্দগুলোর যে কোনো একটি অর্থকে একমাত্র সঠিক ধরে নিয়ে প্রমাণ হিসেবে পেশ করাটা সঠিক নয়।
এছাড়া ‘কূবা’ শব্দটিকে পাশা খেলা এবং ‘গুবাইরা’ শব্দটিকে ‘মিযর’ বা ‘নাবীয’ তথা এক প্রকার মদ অর্থে বিবেচনা করলে হাদীসের সাথে তা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়। কারণ, হাদীসে প্রথমদিকে মদ এবং জুয়ার কথা উল্লেখ আছে। এর অব্যবহিত পরে পাশা খেলার কথা আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এজন্য হাদীসটি শেষ হয়েছে রাসূলের (সা.) এই কথা দিয়ে: “আর নেশা উদ্রেককারী প্রত্যেকটি জিনিসই হারাম।”[38]
৩। ‘তিন ধরনের বিনোদন ছাড়া বাকি সব বাতিল’ শীর্ষক হাদীস
গান ও বাদ্যযন্ত্রকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ প্রমাণ হিসেবে আরেকটি হাদীসের কথা বলেন যেটি ইমাম আহমদ, ইমাম হাকীম ও বিভিন্ন সুনান সংকলকগণ উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা (কাফিরদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধে একটি তীরের বিপরীতে তিনজনকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন …।” এই হাদীসটির এক পর্যায়ে বলা হয়েছে: “একজন মুসলমানের জন্য তিন ধরনের বিনোদন ছাড়া বাকি সব বাতিল। সেই তিনটি হলো: ধনুক নিক্ষেপ অনুশীলন, ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ এবং নিজ পরিবারের সাথে একত্রে খেলাধুলা করা। কারণ, এগুলো যথাযথ ও সঠিক।”[39]
কয়েকটি দিক থেকে এই হাদীসটির ব্যাখ্যা দেয়া যায়:
প্রথমত: এই হাদীসটিকে অনেক আলেম দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। যেদিকে আল-ইরাকী ইঙ্গিত করেছেন এবং আল-মানাওয়ী স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আলবানী এই মতটিকে জোর দিয়েছেন। আমরা জানি, হুকুমের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না।
দ্বিতীয়ত: হাদীসটি সহীহ হিসেবে মেনে নেওয়ার পরেও ইমাম গাযালী তাঁর “এহইয়াউ উলুমুদ্দীন” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘বাতিল’ শব্দটি দিয়ে হারাম বোঝায় না, বরং ‘উপকারহীনতা’ বোঝায়। শাওকানী বলেছেন: এই ব্যাখ্যাটি সঠিক। আর যে বিষয়ের মধ্যে উপকার নেই সেটি মুবাহ বা বৈধ।[40]
তৃতীয়ত: হাদীসে খেলাধুলা বা বিনোদনকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিষয়টি ছিল অনিচ্ছাকৃত। কারণ, হাবশীদের খেলা দেখে বিনোদন নেওয়ার বিষয়টি জায়েজ বা বৈধ (এ সম্পর্কিত হাদীস সহীহাইন তথা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)। অথচ হাবশীদের খেলা দেখে আনন্দ নেওয়ার বিষয়টি উপরের হাদীসে উল্লেখিত বিনোদনের তিনটি ধরনের মাঝে নেই! ইমাম গাযালী বলেছেন: নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর সাথে অনির্দিষ্ট বিষয়গুলোও যুক্ত হতে পারে কিয়াসী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। ব্যাপারটি সেই হাদীসের মতো যেখানে এসেছে: “তিনটি কারণের একটি ছাড়া কোনো মুসলিমের রক্ত বৈধ নয়।” কিন্তু এই হাদীসের তিনটি কারণের সাথে চতুর্থ ও পঞ্চম কারণও যুক্ত হতে কোনো আপত্তি নেই।
একইভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁর স্ত্রীদের সাথে যে খেলাধুলা করেছিলেন, তাতেও আনন্দ উপভোগ ছাড়া আর কোনো ফায়দা ছিল না। আর গানের মধ্যেও আনন্দ উপভোগ করার বিষয়টিই আছে, যা রাসূলের (সা.) খেলাধুলার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এজন্য ফুলের বাগান উপভোগ করা, পাখির কিচিরমিচির শোনা এবং বিভিন্ন ধরনের কৌতুক ও রসিকতা যা মানুষকে আনন্দিত করে— এসব কিছু কারো জন্য হারাম বা অবৈধ নয়, এমনকি এগুলোকে বাতিল বা অনর্থক হিসেবে সাব্যস্ত করা হলেও।[41]
৪। নাচ-গানে পারদর্শী দাসী গ্রহণ, বাদ্যযন্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের দফের ব্যাপারে সতর্ককারী হাদীসসমূহ
হারাম সাব্যস্তকারীগণ তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে আরো কিছু হাদীসের উল্লেখ করে থাকেন। এসব হাদীসে নাচ-গানে পারদর্শী দাসী গ্রহণকারী, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারকারী বা ক্রেতা-বিক্রেতা কিংবা বিক্রয়লব্ধ অর্থের সুবিধাভোগীদের জন্য লাঞ্চনা ও বিভিন্ন ধরনের পশুতে রূপান্তর করে ফেলার সতর্কবার্তা এসেছে।
এসব হাদীসের অধিকাংশই ইবনে তাইমিয়ার দাদা মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া তার “মুন্তাকাল আখবার মিন আহাদীসি সায়্যিদিল আখয়ার” শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এসব হাদীস থেকে ইতোমধ্যে আমরা “মদ ও বাদ্যযন্ত্র হালাল জ্ঞান করবে” এবং “মদ ও কূবা হারাম” সংক্রান্ত হাদীস নিয়ে আলোচনা করেছি।
এ পর্যায়ে আমরা ‘কিয়ান’ (নাচ-গানে পারদর্শী দাসী) ও বাদ্যযন্ত্র সংক্রান্ত হাদীস নিয়ে আলোচনা করবো:
ইমরান বিন হোসাইন থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “এই উম্মতের মধ্যে এক সময় লাঞ্চনা আসবে, উম্মতের লোকেরা পশুতে পরিণত হবে এবং পাথর ছুঁড়ে আযাব দেওয়া হবে। তখন মুসলমানদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো: এটা কখন ঘটবে, ইয়া রাসূলুল্লাহ? তিনি বললেন: যখন ‘কিয়ান’ ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটবে এবং মদ পান করা হবে।”[42]
আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন— রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, আমানতের সম্পদ লুটের মালে পরিণত হবে, যাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে, ধর্ম বিবর্জিত শিক্ষার প্রচলন ঘটবে, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়ে যাবে কিন্তু নিজ মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধু-বান্ধবকে কাছে টেনে নেবে কিন্তু পিতাকে দূরে ঠেলে দেবে, মসজিদে আওয়াজ ও হট্টগোল হবে, পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হবে, নিকৃষ্ট লোক জাতির কর্ণধার হবে, কারো অনিষ্ট হতে বাঁচার জন্য তাকে সম্মান দেখানো হবে, গায়িকা-নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটবে, মদপান করা হবে, এই উম্মতের শেষ যামানার লোকেরা পূর্ববর্তীদের অভিশাপ দেবে, তখন তোমরা অগ্নিবায়ু, ভূমিধ্বস, ভূমিকম্প, চেহারা বিকৃতি ও পাথর বর্ষণের মতো শাস্তিসহ আরো আলামতের অপেক্ষা করবে, যা একের পর এক নিপতিত হতে থাকবে, যেমনিভাবে পুরানো পুঁতির মালা ছিড়ে গেলে একের পর এক পুঁতি ঝরে পড়তে থাকে।”[43]
আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন: “আমার উম্মতের একটি দল খাওয়া, পান করা, বিনোদন আর খেলায় মত্ত থাকবে। এরপর তারা বানর ও শূকরে পরিণত হবে। এরপর তাদের মধ্যকার জীবিতদের উপর এমন বাতাস পাঠানো হবে, যা সব চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলবে। যেমনটা তাদের পূর্বের জাতিদের সাথে করা হয়েছিল। কারণ, তারা মদ, দফ বাজানো, আর নাচ-গানে পারদর্শী দাসী গ্রহণ করাকে হালাল সাব্যস্ত করেছিল।” এটি ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির সনদে ফারকাদ আস-সুবখী নামের একজন ব্যক্তি আছেন, যার সম্পর্কে ইমাম আহমদ বলেছেন: সে নির্ভরযোগ্য নয়। আর ইবনে মঈন বলেছেন: সে নির্ভরযোগ্য। ইমাম তিরমিযী বলেছেন: ইয়াহইয়া বিন সাঈদ তার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন, যদিও তার কাছ থেকে লোকেরা হাদীস বর্ণনা করেছে।[44]
উবাইদুল্লাহ বিন যাহর থেকে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেছেন আলী বিন ইয়াযিদ থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন কাসিম থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন আবু উমামা থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন নবী (সা.) থেকে। তিনি বলেছেন: আমাকে আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য দয়া ও হেদায়াতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আর আমাকে আদেশ দিয়েছেন বাঁশি ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র এবং জাহেলী যুগে ইবাদত করা হতো এমন সকল মূর্তি মুছে ফেলতে।”[45] ইমাম বুখারী বলেছেন: উবাইদুল্লাহ বিন যাহর নির্ভরযোগ্য, কিন্তু আলী বিন ইয়াযিদ দুর্বল। আর কাসিম বিন আব্দুর রহমান আবু আব্দুর রহমান নির্ভরযোগ্য। এই সনদেই আরেকটি হাদীসে নবী (সা.) বলেছেন: গায়িকা-নর্তকী ক্রয়-বিক্রয় করো না, তাদের প্রশিক্ষিত করো না, তাদের নিয়ে ব্যবসার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই, তাদের থেকে প্রাপ্ত দাম বা মূল্য হারাম। আর এ প্রসঙ্গেই এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে: “মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস ক্রয় করে, যাতে করে সে (এ দিয়ে মানুষদের) অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে ঠাট্টা-বিদ্রুপ হিসেবেই গ্রহণ করে; এদের জন্যে অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা লোকমান: ৬)
এটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী।[46] ইমাম আহমদেরও এ রকম একটি বর্ণনা আছে।[47] কিন্তু সেটিকে তিনি আয়াতের প্রেক্ষাপট হিসেবে উল্লেখ করেননি। এছাড়াও হাদীসটি হোমায়দী তার মুসনাদে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণনাটি হলো: “গায়িকা বেচাকেনা, তার মূল্য গ্রহণ এবং তার গান শোনা হালাল নয়।”
এই হাদীসগুলোর ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী বলেছেন: ইমরান বিন হোসাইনের হাদীসটি সংকলনের পর ইমাম তিরমিযী বলেছেন: ইবাদ বিন ইয়াকুব আল-কুফী থেকে বর্ণিত, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, তিনি আল-আমাশ থেকে, তিনি হিলাল বিন ইয়াসাফ থেকে, তিনি ইমরান থেকে বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটি আল-আমাশ বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমান বিন সাবাত থেকে, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন মুরসাল হিসেবে। এটি একটি গরীব হাদীস।
আবু হোরায়রার (রা.) বর্ণিত হাদীসটি আলী ইবনে হাজারের সনদে সংকলন করার পর ইমাম তিরমিযী বলেছেন: এই হাদীসটি আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ বিন ইয়াযিদ আল-ওয়াসিতী, তিনি মুসলিম বিন সাঈদ থেকে, তিনি রামীহ আল-জুযামী থেকে। এই অধ্যায়ে আলী থেকে বর্ণিত এই হাদীসটি গরীব। এই সনদ ছাড়া অন্য কোনো সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আলীর হাদীসটি তিনি যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন সেটি তিনি তাঁর সুনান গ্রন্থে সংকলন করেছেন আবু হোরায়রার (রা.) হাদীসটিরও আগে। আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত;[48] তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যদি আমার উম্মত ১৫টি কাজ করে, তাহলে তার উপর বিপদ নেমে আসবে। এর মধ্যে আছে: মদ, রেশম, নর্তকী-গায়িকা দাসী এবং বাদ্যযন্ত্রকে মেনে নেয়া।” হাদীসে উল্লেখিত অভ্যাসগুলোকে হিসাব করার পর তিনি বলেছেন: এটি গরীব হাদীস। আলীর এই হাদীসটি ইয়াহইয়া বিন সাঈদের কাছ থেকে ফারাজ বিন ফাদালাহ ছাড়া অন্য কোনো সনদে কেউ বর্ণনা করেছে বলে আমাদের জানা নেই। আর হাদীস বিশারদগণ ফারাজ বিন ফাদালাহকে মুখস্তের দিক থেকে দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তার কাছ থেকে ওয়াকী ও অন্যান্য ইমামগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন।[49]
শাওকানী আরো বলেছেন: আবু উমামার প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীস নিয়ে সংকলক কথা বলেছেন। আর তৃতীয় হাদীসটি সংকলনের পর তিরমিযী বলেছেন: এ রকম হাদীস কেবল এই সনদেই আছে বলে জানা যায়। আলী ইবনে ইয়াযিদের ব্যাপারে অনেক আলেম কথা বলেছেন এবং তাকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন (তিনি ছিলেন শামী)।[50] এছাড়াও হাদীসটি ইবনে মাজাহ,[51] সাঈদ বিন মানসুর ও আল-ওয়াহিদী তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
উবাইদুল্লাহ বিন যাহর সম্পর্কে আবু মুসহির বলেছেন: এই লোকটি হলো সব সমস্যার হোতা। ইবনে মঈন বলেছেন: দুর্বল। অন্যত্র বলেছেন: সে কিছুই নয়। ইবনুল মাদীনী বলেছেন: তিনি মুনকার হাদীস বর্ণনাকারী। দারাকুতনী বলেছেন: তিনি নির্ভরযোগ্য নন। ইবনে হিব্বান বলেছেন: তিনি অনেক বেশি মুনকার হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি “আসবাত” বা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের নামে বর্ণিত বানোয়াট হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আলী ইবনে ইয়াযিদ থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বিশাল ঝামেলা পাকিয়ে ফেলতেন।[52]
এ কারণে ইমাম বুখারী তাকে নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করায় আল-মুন্তাকা গ্রন্থের লেখক বিস্মিত হয়েছেন। তবে ইবনে হাজার বর্ণনা করেছেন যে বুখারী ‘আত-তারীখ’ গ্রন্থে বলেছেন: মুকারিবুল বা মুকারাবুল হাদীস (অর্থাৎ, বর্ণনাকারী খুব ভালোও নন, আবার একেবারে মন্দও নন)। কিন্তু বুখারীর এই মতটি আলী ইবনে ইয়াযিদের ব্যাপারে দেয়া হয়েছিল (উবাইদুল্লাহ বিন যাহর সম্পর্কে নয়)। বাস্তবতা হলো, জারাহ ওয়াত তাদীলের অধিকাংশ ইমামগণ তাকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। যেমন: ইয়াহিয়া বিন মঈন, ইবনুল মাদীনী, ইয়াকুব বিন সুফিয়ান, আবু মুসহির, দারাকুতনী, আল-ইজলী, ইবনে হিব্বান ও অন্যান্যরা। ‘তাহযিবুল কামাল’ গ্রন্থের ৩৬৬৩ নং জীবনীতে এমনটা উল্লেখ রয়েছে।
নাচ-গানে পারদর্শী দাসী সংক্রান্ত হাদীসগুলো প্রসঙ্গে:
হারাম সাব্যস্তকারীগণ গায়িকা-নর্তকীদের বেচাকেনা ও তাদের মূল্য হারাম হওয়া সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে বেশ কদর করেন এবং সেগুলোকে বিভিন্ন সনদের মাধ্যমে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালান। এ ব্যাপারে জবাব হলো:
প্রথমত: এই প্রসঙ্গে বর্ণিত সবগুলো হাদীসই দুর্বল, যেমনটা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। আর নাচ-গানে পারদর্শী দাসীদের বেচাকেনা এবং সেগুলোকে গ্রহণ করা হারাম প্রসঙ্গে বর্ণিত সবগুলো হাদীসই দুর্বল।[53] এটি সত্যি যে কেউ কেউ এগুলোকে হাসান হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু বাকিরা এগুলোকে দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। আল্লামা শাওকানী বলেছেন: গায়িকা-নর্তকী সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো বিভিন্ন সনদে এসেছে, যা একটি আরেকটিকে শক্তিশালী করে। সবগুলো হাদীস একত্রিত করলে এটি ‘হাসান লি-গাইরিহি’র মানে উত্তীর্ণ হয়।[54] কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের বিষয়ে কোনো কিছু হাসান লি-গাইরিহি হওয়াটা যথেষ্ট নয়। কেননা, হাসান লি-গাইরিহি হলো একাধিক দুর্বল হাদীসের সমষ্টি মাত্র।
দ্বিতীয়ত: ইমাম গাযালী বলেছেন: নাচ-গানে পারদর্শী দাসী বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যারা মদের আড্ডায় পুরুষদের জন্য গান করে। ফিতনা বা যিনার আশংকা থাকা অবস্থায় কোনো পাপাচারী পুরুষের জন্য অপরিচিত কোনো মহিলার গাওয়া গান শোনা হারাম। এখানে তারা ফিতনা দিয়ে মূলত হারাম ফিতনাকে বুঝিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে দাসী তার মালিককে গান শোনানোর বিষয়টি জায়েজ হওয়ার কারণে উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে তাদের গান শোনা মালিকের জন্য হারাম প্রতিপাদিত হয় না। এমনকি ফিতনার আশংকা না থাকলে মালিক ব্যতীত অন্য কেউ দাসীর গান শোনাটা হারাম নয়। এর দলীল হলো, সহীহাইনের মধ্যে বর্ণিত হাদীস যেখানে আয়েশার (রা.) ঘরে দুজন দাসীর গান আল্লাহর রাসূল (সা.) শুনেছিলেন। এই হাদীসটি পরবর্তীতে আলোচনায় আসবে।
তৃতীয়ত: তখনকার সময় নাচ-গানে পারদর্শী এসব দাসীরা ক্রীতদাস প্রথার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কিন্তু এ প্রথাকে ধারাবাহিকভাবে মিটিয়ে দেয়ার জন্য ইসলাম এসেছিল। তাই ‘ইসলামী সমাজে এই শ্রেণী এখনও রয়ে গেছে’ জাতীয় দাবির সাথে কেউ একমত হতে পারে না। ফলে হাদীসে এ ধরনের দাসীকে মালিকানাধীন করার বিষয়কে নিন্দা করা এবং এসব দাসী ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করার মাধ্যমে দাসপ্রথার খুঁটিকেই মূলত ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চতুর্থত: ইসলামের আগে বা পরে এসব গায়িকা দাসীরা যেভাবে লালিত-পালিত হতো এবং যেভাবে তাদেরকে কাজে লাগানো হতো, তাতে করে এরা ছিলো সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের অন্যতম নিয়ামক। তাদের কারণে সমাজের লোকদের মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ভাবগাম্ভির্যের পরিবর্তে অশালীনতা ও শিথিলতা ছড়িয়ে পড়ছিলো, সমাজের মানুষ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতার মাধ্যমে প্ররোচিত হতো। এসব গায়িকা-দাসীদের প্রভাবে সমাজের অধঃপতনের চিত্র তুলে ধরে বিশিষ্ট সাহিত্যিক জাহিয একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন।
বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও দাঈ ড. মুহাম্মদ ফাতহী উসমান তাঁর একটি বইয়ে এসব দাসীদের বিপজ্জনক প্রভাব বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি সমাজ, ঈমান ও চারিত্রিক মূল্যবোধে এর নেতিবাচক প্রভাব কীভাবে বিস্তার লাভ করছে সে ব্যাপারেও আলোচনা করেছেন। বইটিতে তিনি বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য দলীল ও সূত্র নিয়ে এসেছেন। আগ্রহীগণ সেগুলো মিলিয়ে দেখতে পারেন।[55]
গায়িকা-দাসীদের ব্যাপারে আলেমদের কড়াকড়ির এটাই হলো আসল রহস্য। এমনকি ইমাম মালিক দাসী কেনার পর একে ফেরত দেয়াকে দোষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। আর ইমাম আহমদ ইয়াতীম হওয়ার কারণে অসহায় গায়িকা-দাসী (যাকে ‘সাযিজা’ বলা হয়) বিক্রির ব্যাপারে অনড় থেকেছেন। তাকে বলা হলো, একটি ‘সাযিজা’র বিক্রয়মূল্য দুই হাজার দিরহাম, আর একটি গায়িকার বিক্রয়মূল্য তিন হাজার দিরহাম। এক্ষেত্রে কোনটি বিক্রি করা হবে? তিনি কোনো তোয়াক্কা না করেই ‘সাযিজা’ বিক্রির ব্যাপারে অনড় থেকেছিলেন।
৫। ‘দুটো ধ্বনি হলো অভিশপ্ত’ শীর্ষক হাদীস
একটি হাদীসে বলা হয়েছে: “দুটো ধ্বনি হলো অভিশপ্ত: বিলাসিতা বা স্বাচ্ছন্দ্যের সময় বাঁশির আওয়াজ, দুর্যোগের সময় কান্নার আওয়াজ।”
শাইখ নাসির উদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে তাঁর ‘সিলসিলাতুস সহীহা’ গ্রন্থের ৪২৭ নং ক্রমিকে উল্লেখ করেছেন। এই হাদীসটি দিয়ে তিনি বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে দলীল পেশ করেছেন। তিনি হাদীসটির তাখরীজ করতে গিয়ে বলেছেন:
“আবু বকর শাফেয়ী ‘আর-রুবাইয়্যাত’ গ্রন্থে (২/২২/১) হাদীসটিকে এই সূত্রে উল্লেখ করেছেন: আমাদেরকে মুহাম্মদ বিন ইউনুস বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে দাহহাক বিন মাখলাদ বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে শাবীব বিন বিশর বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে আনাস বিন মালিক মারফু হাদীস হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
আমার কথা হলো— এই সনদের সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য, শুধু মুহাম্মদ বিন ইউনুস ব্যতীত। তিনি ছিলেন কুদাইমী। তার বিরুদ্ধে হাদীস বানানোর অভিযোগ আছে। তবে এই হাদীসের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করা যায়। কারণ এই হাদীসটিকে আল-দ্বিয়া তাঁর ‘আল-মুখতারা’ (১৩১/১) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন অন্য দুই সনদে, যার একটি বর্ণিত হয়েছে দাহহাক থেকে। সেই হিসেবে হাদীসটির সনদ ইনশাআল্লাহ হাসান পর্যায়ের।
হায়সামী ‘আল-মাজমা’ (৩/১৩) গ্রন্থে আল-মুনিযিরীর ‘আত-তারগীব’ গ্রন্থানুযায়ী বলেন: “হাদীসটি বাযযার বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।”
আমার মতে: হাদীসটির পক্ষে একটি শাহেদ বা সাক্ষ্য আছে যেটি হাদীসটিকে শক্তিশালী করে। ইমাম হাকিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লার সূত্রে। তিনি বর্ণনা করেছেন আতা থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন জাবির থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমান বিন আওফ থেকে। তিনি বলেছেন: “নবী (সা.) আমার হাত ধরলেন, আমি তাঁর সাথে তাঁর ছেলে ইবরাহীমের কাছে গেলাম। সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে নিজের বুকে চেপে ধরে রাখলেন। তারপর তাকে আগের জায়গায় শুইয়ে রাখলেন এবং কাঁদলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম: আপনি কাঁদছেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি আমাদের কাঁদতে নিষেধ করেননি? তিনি বললেন: আমি তো কাঁদতে নিষেধ করিনি, শুধু নির্বোধ ও পাপাচারী দুটি আওয়াজের বিষয়ে নিষেধ করেছি। একটি হলো খেলা ও বিনোদনের সময় বাজানো সুর ও শয়তানের বাঁশি; আর অন্যটি হলো বিপদের সময় নিজ মুখে চড় মেরে ও বুক ফাটিয়ে বিলাপ করা। আর আমার কান্না তো দয়ার কারণে বেরিয়ে আসা অশ্রু। মনে রেখো, যে দয়ালু হয় না, তাকে আল্লাহর তরফ থেকে দয়া করা হয় না। যদি (আল্লাহর) ওয়াদা সত্য না হতো, (যদি আল্লাহর) কথা সত্য না হতো এবং আমাদের প্রথম জনের সাথে শেষের জনের মিলিত হওয়ার কথাটি যদি মিথ্যে হতো তাহলে তোমার (ইবরাহীম) জন্য এই দুশ্চিন্তা ও কষ্ট আরো বৃদ্ধি পেতো। হে ইবরাহীম, আমরা তোমার জন্য শোকাহত। তোমার জন্য চোখ অশ্রুসিক্ত হচ্ছে, অন্তর কষ্ট পাচ্ছে; কিন্তু আমরা এমন কিছু বলছি না, যা আমাদের প্রভুকে অসন্তুষ্ট করবে।”
হাদীসটির ব্যাপারে হাকিম এবং যাহাবী চুপ থেকেছেন। তবে এর সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য, শুধু ইবনে আবু লায়লা ব্যতীত। তার মুখস্ত করার অবস্থা সুবিধার ছিল না। তার মতো বর্ণনাকারীকে সমর্থন কিংবা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না।”[56]
এই কথার পর শাইখ আলবানী “হাদীসটির সনদ ইনশাআল্লাহ হাসান পর্যায়ের” বলা সত্ত্বেও এটি হাসান হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। তবে তিনি “সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব” গ্রন্থে হাদীসটিকে জোর দিয়ে হাসান বলেছেন। একইভাবে বলেছেন “তাহরীম আলাত তারব” গ্রন্থেও।
হাদীসের সনদ ও রাবীদের বিষয়ে শাইখ আলবানীর মতো যোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন ব্যক্তি যদি এই হাদীসের ক্ষেত্রে আবু বকর শাফেয়ী রচিত “আর-রুবাইয়্যাত” গ্রন্থের উপর নির্ভর না করতেন, তাহলে আমি খুশি হতাম। হাদীসটির বর্ণনাকারীর উপর অন্যরা নির্ভর করলেও তিনি কীভাবে নির্ভর করতে পারলেন, যেখানে এই বর্ণনাকারীর বিরুদ্ধে রাসূলের (সা.) নামে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা ছড়ানোর অভিযোগ আছে!
উপরন্তু, হাদীসটির পক্ষে আল-দ্বিয়ার সূত্রে অন্য যে দুটি সনদের কথা আলবানী বলেছেন, সেগুলো তিনি উল্লেখ করেননি। তা করলে আমরা সেই সনদ দুটোর বর্ণনাকারীদের যাচাই করে দেখতে পারতাম।
এর পরিবর্তে শাইখ আলবানী বরং বাযযারের বর্ণিত হাদীসটির ব্যাপারে আল-মুনযিরী ও হায়সামীর “তার বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য” কথাটিকে শক্তিশালী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
অথচ এটি জানা কথা যে “তার বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য” বক্তব্যটি দিয়ে সবসময় আবশ্যিকভাবে কোনো হাদীস সহীহ বা হাসান হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য হওয়ার পরেও সনদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা অন্যান্য ত্রুটি থাকতে পারে।
একইভাবে এটাও অজানা নয়, হাদীসের ইমামগণ ‘উৎসাহ ও ভীতি প্রদর্শনমূলক’ হাদীসের বিষয়ে বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন।
এ কারণে বাযযার কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির বর্ণনাকারীদের নির্ভযোগ্যতা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে তাদের নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে সবাই কি একমত?
এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমি হায়সামীর ‘কাশফুল আসতার আন-যাওয়াইদিল বাযযার’ গ্রন্থে হাদীসটি ঘেঁটে দেখলাম। হায়সামী এই গ্রন্থের হাদীসগুলো নিজের সনদে বর্ণনা করেছেন, যদিও নিজের রচিত ‘মাজমাউল যাওয়াইদ’ গ্রন্থের হাদীসগুলোর ক্ষেত্রে তিনি নিজের সনদে বর্ণনা করেননি। আমি দেখতে পেলাম তিনি ‘কাশফুল আসতার আন যাওয়াইদিল বাযযার’ গ্রন্থের ৭৯৫ নং হাদীসে বলছেন: আমাদেরকে আমর বিন আলী বলেছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে আবু আসিম বলেছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে শাবীব বিন বিশর আল-বাজালী বলেছেন, তিনি বলেন: আমি আনাস বিন মালিককে বলতে শুনেছি… এরপর তিনি হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।
এখানে আমর বিন আলী (আল-কাল্লাস) এবং আবু আসিম (আন-নাবীল) (যিনি আসলে দাহহাক বিন মাখলাদ) — এ দুজন ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী হিসেবে খুব প্রসিদ্ধ। কিন্তু শাবীব বিন বিশর এই মর্যাদায় উন্নীত নন। অবশ্য ইবনে মঈন তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইবনে শাহীন ‘আস-সিকাত’ গ্রন্থে তার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আবু হাতিম তার সম্পর্কে বলেছেন: হাদীসের ক্ষেত্রে শিথিল এবং তার হাদীস হলো ‘হাদীসুশ শুয়ূখ’ (কিঞ্চিৎ দুর্বল বর্ণনাকারীদের হাদীস)। ইবনুল জাওযী তার নাম উল্লেখ করেছেন ‘আদ-দুয়াফা’ (দুর্বল বর্ণনাকারীগণ) গ্রন্থে। নাসায়ী বলেছেন: তিনি আবু আসিম ছাড়া আর কারো কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ভুল করতেন। আর যাহাবী তাকে দুর্বল বর্ণনাকারীদের নিয়ে রচিত ‘আল-মুগনী ফিদ দুয়াফা’ গ্রন্থের ২৭৩৫ নং জীবনীতে উল্লেখ করেছেন।[57]
তাহলে যে বর্ণনাকারীর ব্যাপারে এ ধরনের মতভেদ রয়েছে, বিশেষত স্মরণশক্তি কম থাকায় প্রচুর ভুল করার কারণে যার ব্যাপারে আপত্তি আছে, তার বরাত দিয়ে প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় না। আর ব্যাপক মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ে তার হাদীসের উপর নির্ভর করা যায় না।
উপরোল্লেখিত হাদীসটির সমর্থনে শাইখুল হাদীস আলবানী হাকিমের একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন ইবনে আবু লায়লা থেকে, তিনি আতা থেকে, তিনি …। তাঁর মতে, সনদে বর্ণিত হাদীস উক্ত হাদীসটিকে শক্তিশালী করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো হাকিমের হাদীসটি ঐ হাদীসটিকে শক্তিশালী করতে পারে না এর বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লার কারণে। তবে একজন নিরপেক্ষ গবেষক যে বিষয়টি দেখে তাজ্জব হয়ে যাবে সেটি হলো, হাদীস নিরীক্ষায় ইমাম ইবনুল কায়্যিমের মতো পারদর্শী ব্যক্তি যখন তার ‘ইগাসাতুল লাহফান’ ও সঙ্গীত প্রসঙ্গে রচিত আরেকটি গ্রন্থে তিরমিযীর সূত্রে[58] হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হুবহু সনদ ও মতনের হাদীসটির উপর নির্ভর করেন, যে হাদীসটি যথারীতি ইবনে আবু লায়লার সূত্রে বর্ণিত! হাদীসটি উল্লেখ করার পর ইবনুল কায়্যিম বলেছেন:
“এই জোরালো নিষেধাজ্ঞাটি খেয়াল করুন, যেখানে রাসূল (সা.) গানের আওয়াজকে নির্বোধের আওয়াজ বলে অভিহিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি একে পাপাচার হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এমনকি তিনি একে শয়তানের বাঁশি বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া আবু বকর কর্তৃক গানকে ‘শয়তানের বাঁশি’ অভিহিত করাকে আল্লাহর রাসূল (সা.) সমর্থন করেছেন মর্মে একটি সহীহ হাদীস পাওয়া যায় (সামনে এ সংক্রান্ত আলোচনা আসবে)। তারপরও যদি গানকে হারাম সাব্যস্ত করা না যায়, তাহলে রাসূলের (সা.) কোনো নিষেধাজ্ঞা থেকেই কোনো কিছুকে হারাম বলা যাবে না।
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলতেন, “এটা করো না,” কিংবা বলতেন, “আমি তোমাদেরকে এটা থেকে নিষেধ করছি।” হারাম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এ দুটো উক্তির মাঝে কোনটির দৃঢ়তা বেশি?
সঠিক উত্তরটি হলো: নিঃসন্দেহে “আমি তোমাদেরকে এটা থেকে নিষেধ করছি” উক্তিটির দৃঢ়তা বেশি। কারণ, “এটা করো না” উক্তিটি দিয়ে বারণ করা বা অন্য কিছুও বুঝানো হতে পারে। কিন্তু “নিষেধ করছি” মর্মে দ্ব্যর্থহীন ক্রিয়াবাচক বাক্যের ক্ষেত্রে ভিন্ন অর্থ করার সুযোগ থাকে না।
তাহলে আল্লাহর রাসূল (সা.) যা নিষেধ করেছেন; নির্বোধ ও পাপাচারের আওয়াজ এবং শয়তানের বাঁশি বলে যাকে অভিহিত করেছেন, গান ও অভিশপ্ত বিলাপকে এর সহোদর হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, সে বিষয়টিকে কীভাবে একজন বুদ্ধিমান জ্ঞানী ব্যক্তি বৈধ মনে করতে পারে? অথচ তিনি উভয়টিকে সমমাত্রায় নিষেধ করেছেন এবং উভয়টিকে একই বৈশিষ্ট্য দ্বারা (নির্বোধ ও পাপাচার) অভিহিত করেছেন।”[59]
এখানে আশ্চর্যের বিষয় হলো ইবনুল কায়্যিম কীভাবে এই হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করলেন এবং এটিকে তিরমিযীর হাদীস বলে উল্লেখ করলেন! অথচ তিরমিযী হাদীসটি খুব সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন। স্বয়ং তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সাব্যস্ত না করলেও সেই হাদীসের উপর তিনি কীভাবে নির্ভর করলেন, তা ভেবে অবাক লাগে। অথচ তিনি জানেন, এর বর্ণনাকারীদের একজন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লার স্মরণশক্তি অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। কীভাবে তিনি হাদীসটির মান বিবেচনা না করে হাদীসটির বক্তব্য বিবেচনা করতে পারলেন? তাঁর মতো একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির তো ইবনে আবু লায়লার ব্যাপারে না জানার কথা নয়।
এছাড়া তিরমিযীর বর্ণনায় দ্বিতীয় ধ্বনি বা আওয়াজটির ক্ষেত্রে শুধু “শয়তানের ধ্বনি” শব্দটি উল্লেখ আছে। এটি অস্পষ্ট একটি শব্দ। ফলে এর উপর ভিত্তি করে ইবনুল কায়্যিম যে পদ্ধতিতে গানকে হারাম সাব্যস্ত করেছেন, সেভাবে কোনো কিছু হারাম সাব্যস্ত করা যায় না।
হাদীসটির অন্যতম বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লা যে ফিকাহ, ফতোয়া, সত্যবাদিতা, সাহসিকতা ও চারিত্রিক সততার দিক থেকে প্রসিদ্ধ ইমামগণের একজন ছিলেন, তা কারো অজানা নয়। কিন্তু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত তথা ‘দাবত’[60] পূরণ করতে পারেননি। অথচ দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে হলে সংশ্লিষ্ট হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে ‘আদালত’[61] ও ‘দাবত’ উভয় শর্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। আমরা জানি, হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণ তাঁর হিফজ ও দাবত বিবেচনা করে তাকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। তবে ফিকাহবিদ হিসেবে তিনি যে জগতসেরা ছিলেন, সেই স্বীকৃতি দিতে তারা কার্পণ্য করেননি।
হাফিজ যাহাবী ‘মীযানুল ই’তিদাল’ গ্রন্থে তার জীবনী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন: সাদুক (সত্যবাদী), ইমাম ও সায়্যিউল হিফয (দুর্বল মুখস্তশক্তির অধিকারী)। তবে তিনি আস্থাবান।
তার ব্যাপারে অন্যান্য আলেমের মতামতও তিনি উল্লেখ করেছেন। যেমন:
আহমদ বিন আব্দুল্লাহ আল-ইজলী বলেন: তিনি ছিলেন একজন ফকীহ, সাদুক, সুন্নাহর অধিকারী, জাইযুল হাদীস,[62] ক্বারী, আলেম। আবু হামযা আয-যায়্যাত তার কাছে পড়েছেন।
আবু যুরয়াহ বলেছেন: তিনি খুব একটা শক্তিশালী নন।
আহমদ বলেছেন: তিনি মুদতারিবুল হাদীস।[63]
শু’বা বলেছেন: হিফযের ক্ষেত্রে তার মতো মন্দ আমি কাউকে দেখিনি।
ইয়াহয়া আল-কাত্তান বলেছেন: মুখস্তশক্তির দিক থেকে তিনি অত্যন্ত দুর্বল।
ইয়াহয়া বিন মঈন বলেছেন: তিনি দুর্বল।
নাসায়ী বলেছেন: তিনি শক্তিশালী নন।
দারাকুতনী বলেছেন: তার হিফযের অবস্থা খারাপ, তদুপরি তিনি প্রচুর ভুল করেন।
আবু আহমদ আল-হাকিম বলেছেন: তার অধিকাংশ হাদীসই মাকলুব।[64]
আহমদ বিন ইউনুস বলেছেন: তিনি তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ফিকাহবিদ ছিলেন।
ইয়াহয়া বিন ইয়ালা আল-মুহারিবী বলেছেন: ইবনে আবু লায়লার হাদীসকে যাইদাহ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইবনে খিরাশ বলেছেন, আমাদেরকে ইসহাক বিন ইবরাহীম বিন শাযান বলেছেন, তিনি সাদ বিন আস-সালত থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন: নাবীয পান না করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কথা ইবনে আবু লায়লা গ্রহণ করতেন না ।
আহমদ বিন ইউনুস বলেছেন: আমি যাইদাহকে ইবনে আবু লায়লা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেছিলেন: তিনি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফকীহ।
বিশর বিন ওয়ালীদ বলেছেন: আমি আবু ইউসুফকে বলতে শুনেছি যে বিচারকের দায়িত্ব পালনের জন্য ইবনে আবু লায়লা যোগ্যতর ছিলেন, তিনি আল্লাহর দ্বীনের বিষয়ে সবচেয়ে ভালো বুঝেন, আল্লাহর কিতাব সবচেয়ে ভালো পাঠ করেন, আল্লাহর ব্যাপারে অধিক সত্য বলেন এবং সম্পদের ব্যাপারে সব থেকে বেশি লালসাহীন থাকেন।
আহমদ বলেছেন: আতা থেকে ইবনে আবু লায়লা ও মাতার-এর বর্ণনাকে ইয়াহয়া দুর্বল সাব্যস্ত করতেন।
উসমান দারেমী ও মুয়াবিয়া বিন সালিহ বর্ণনা করেছেন ইবনু মঈন থেকে, তিনি বলেছেন: (ইবনে আবু লায়লা) হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল। আর ইবনে হিব্বান বলেছেন: তার হিফজের অবস্থা ছিল বাজে, ভুল ছিল মারাত্মক। ফলে তার হাদীসের মধ্যে মুনকার এর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। এজন্য তিনি পরিত্যায্য হওয়ার উপযুক্ত। তাকে আহমদ ও ইয়াহয়া পরিত্যাগ করেছেন।
যাহাবী ‘আল-মীযান’ গ্রন্থে বলেছেন: আমরা মনে করি না যে তারা দুজন তাকে ত্যাগ করেছেন। বরং তারা তাকে লাইয়িন বা দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন।[65]
তার সম্পর্কে ইবনে হাজার ‘আত-তাকরীব’ গ্রন্থে সংক্ষেপে বলেছেন: তিনি সত্যবাদী, তবে মুখস্ত শক্তি অত্যন্ত দুর্বল।[66]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়— ইবনে আবু লায়লা যে হাদীস বর্ণনা করেছেন — তাও আবার আতা থেকে — সেই হাদীসের উপর নির্ভর করা ইমাম ইবনুল কায়্যিমের মোটেও উচিত হয়নি।
৬। রাখালের বাঁশির হাদীস
হারাম সাব্যস্তকারীগণ নাফে কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসের কথা বলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন: একদিন ইবনে ওমর রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে আঙ্গুল দিয়ে দুই কান চেপে ধরলেন এবং তিনি তার বাহনকে সে পথ থেকে সরিয়ে এক পাশে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি বললেন: হে নাফে, তুমি কি এখনও কিছু শুনতে পাচ্ছো? আমি বললাম: জ্বি। জবাব শুনে তিনি কানে আঙ্গুল দিয়ে সময় পার করতে লাগলেন। যখন আমি বললাম: শোনা যাচ্ছে না। তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল বের করলেন এবং বাহনকে রাস্তার উপরে নিয়ে এসে যাত্রা শুরু করলেন। এরপর বললেন: “আমি আল্লাহর রাসূলকে (সা.) একদিন রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনটা করতে দেখেছি।”[67]
এই হাদীসটি সম্পর্কে আবু দাউদ বলেছেন: এটি একটি মুনকার হাদীস। তিনি একে মুনকার সাব্যস্ত করায় হাফেয মুনযিরী কোনো আপত্তি করেননি। ‘মুখতাসার সুনানে আবু দাউদ’ গ্রন্থে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে।[68] আবু দাউদ কর্তৃক এই হাদীসটিকে মুনকার সাব্যস্ত করার ব্যাপারে অতীতের কোনো হাদীস বিশারদ সমালোচনা করেছেন বলে জানা যায় না। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ‘আওনুল মাবুদ’ গ্রন্থটির গ্রন্থকার বলেছেন: হাদীসটিকে কেন মুনকার সাব্যস্ত করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। হাদীসটির সনদ বরং শক্তিশালী। সনদে কোনো সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারীর বিপরীত কেউ নেই।
কথা হচ্ছে, হাদীসটি যদি সহীহ হয়েও থাকে, তাহলেও সেটি হারাম সাব্যস্তকারীদের পক্ষে যায় না। বরং বিপক্ষের দলীল হিসেবে সাব্যস্ত এটি হবে। কারণ, বাঁশি শোনা হারাম হলে রাসূল (সা.) ইবনে ওমরকে তা শোনার অনুমতি দিতেন না। আর ইবনে ওমর একে হারাম মনে করলে নাফেকে তা শোনার অনুমতি দিতেন না। এটি হারাম হয়ে থাকলে রাসূল (সা.) অবশ্যই সেটি বাজাতে নিষেধ করতেন এবং বাঁশি ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমে এই মন্দ কাজটি প্রতিহত করতেন। অন্ততপক্ষে রাখালকে ডেকে বলতেন, সে যা করছে সেটি হারাম। কারণ, প্রয়োজনের সময় যেটি বলা জরুরি, সেটি না বলে দেরি করা বৈধ নয়।
শাওকানী বলেছেন: রাখালকে মন্দ কাজ থেকে তৎক্ষণাৎ বিরত রাখার পেছনে আল্লাহর রাসূলের (সা.) সামর্থ্য না থাকার কথা বলা মোটেও সমীচীন হবে না। কারণ, ইবনে ওমর (রা.) হলেন আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাহাবী। তিনি ছিলেন মদীনায়। ইসলাম তখন বিজয়ী ও শক্তিশালী। অথচ তিনিও ঠিক একইভাবে নিষেধ করার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। আর এতেই প্রমাণিত হয়, বিষয়টি হারাম ছিল না।[69] অতএব, ইবনে ওমরের (রা.) ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের (সা.) মৌন সম্মতি এবং রাখালকে নিষেধ না করে চুপ থাকার বিষয়টি থেকে প্রতীয়মান হয়, এটি বৈধ। বাঁশির সুর শোনা থেকে রাসূলের (সা.) নিজের বিরত থাকার বিষয়টি দুনিয়াবী অন্যান্য বৈধ বিষয় ও আরাম-আয়েশ (যেমন হেলান দিয়ে আয়েশ করে খাওয়া, টাকা-পয়সা… ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকার মতো একটি ব্যাপার।
এজন্য আবু দাউদ হাদীসটিকে উল্লেখ করেছেন ‘গান ও বাঁশি মাকরূহ’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে। আর ইমাম খাত্তাবী ‘মায়ালিমুস সুনান’ গ্রন্থে বলেছেন: বাঁশির সুর যদি মাকরূহ হয়েও থাকে, তারপরও এটি ততটা অপছন্দনীয় নয়; অশ্লীল, নির্লজ্জ ও লম্পট প্রকৃতির লোকজন কর্তৃক ব্যবহৃত বাঁশি, বীনা ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারটি যতটা কঠোর হারাম হিসেবে সাব্যস্ত। যদি তাই হতো, তাহলে বাঁশির সুর শোনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনাই শেষ কথা হতো না। বরং এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা, এটি থেকে বিরত রাখা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকতো।[70]
৭। ‘সঙ্গীত অন্তরে নিফাক তৈরি করে’ সংক্রান্ত হাদীস
হারাম সাব্যস্তকারীগণ আরেকটি দলীল দিয়ে থাকেন, যেখানে বর্ণিত আছে: “নিশ্চয়ই গান অন্তরে নিফাক তৈরি করে।” কিন্তু এটি আল্লাহর রাসূলের (সা.) হাদীস নয়,[71] বরং সাহাবী বা তাবেয়ীর কথা হিসেবে প্রমাণিত। বায়হাকী এটিকে ইবনে মাসউদের (রা.) বরাত দিয়ে মাওকুফ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[72]
হাফেয ইবনে তাহের বলেছেন: এই কথাটি যে কয়টি সনদে বর্ণিত হয়েছে, তারমাঝে সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদ হলো সেটি, যেটিতে এটিকে ইবরাহীম নাখয়ীর[73] কথা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদি কথাটি ইবনে মাসউদ (রা.) বা তাঁর চিন্তার অনুসারী কারো (যেমন: ইবরাহীম নাখয়ী) কথাও হয়ে থাকে, তাহলেও সেটি দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, আল্লাহর রাসূল (সা.) ছাড়া আর কোনো ব্যক্তির কথা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ব্যাপারে পড়াশোনা করতে গিয়ে একটি যুক্তি দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি। “নিশ্চয়ই গান অন্তরে নিফাক তৈরি করে, পানি যেভাবে শস্য উৎপাদন করে”— ইবনে মাসউদের (রা.) এই কথাটির ক্ষেত্রেও মারফু হাদীসের বিধান প্রযোজ্য হবে বলে কেউ কেউ দাবি করেছেন! তাদের মতে, ইবনে মাসউদ (রা.) যেহেতু এমন একটি বিষয়ে বলেছেন, যা দেখা যায় না (অর্থাৎ, নিফাক); তাই এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার পথ খোলা নেই।[74] কারণ, মানুষের পক্ষে অদৃশ্য বা গায়েবী বিষয় সম্পর্কে জানার সুযোগ নেই। তবে একজন সাহাবী যদি গায়েবী বিষয় সম্পর্কে কিছু বলেন, তখন তিনি তা নিশ্চয় রাসূলের (সা.) কাছ থেকে শুনেছেন বলেই ধরে নিতে হবে, এমনকি তিনি রাসূলের (সা.) নাম না নিলেও!
এ ধরনের দাবির আসলে কোনো ভিত্তি নেই। নির্ভুল ওহীর জ্ঞান ব্যতীত, নিছক মানুষের বোধবুদ্ধি দিয়ে বুঝা অসম্ভব, এমন কোনো গায়েবী বিষয় সম্পর্কে এখানে বলা হয়নি। বরং তেমন বিষয় সম্পর্কেই বলা হয়েছে, যা মানুষ সচরাচর বুঝতে পারে এবং যার প্রভাব দৃশ্যমান। বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ মতামত প্রদানও করতে পারে। মানুষের মন ও অন্তরের উপর কর্মের প্রভাবের ব্যাপারটি মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিমাত্রই জানেন। মনোবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সূফী (তাসাউফ ও সুলুক) এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
সর্বোপরি, এটি একজন মানুষের মতামত বা বক্তব্য, যিনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন। ফলে অনেকেই এই বক্তব্যের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এদের মধ্যে, বিশেষত সূফী ঘরানার লোকজনের কথা হলো: সঙ্গীত মানুষের হৃদয়কে কোমল করে, পাপ কাজের ব্যাপারে অনুতাপ ও মর্মপীড়া জাগিয়ে তোলে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরিতে অনুপ্রাণিত করে। এসব কারণে তারা অন্তরকে সঞ্জীবিত করা, সংকল্পে উদ্দীপ্ত হওয়া এবং প্রেরণা জাগিয়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে: এটি এমন একটি বিষয় যা চর্চা, অভিজ্ঞতা ও পরখ না করে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যে চেখে দেখেছে, সে জানতে পেরেছে। কোনো কিছু জানার জন্য নিজে চেখে দেখার চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে!
সূফীদের এই বক্তব্যকে ইমাম গাযালী গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, এই ব্যাখ্যাকে তিনি শ্রোতার জন্য নয় বরং গায়কের জন্য প্রযোজ্য বলে মতামত দিয়েছেন। অথচ আমরা জানি, সুকণ্ঠ দিয়ে প্রভাবিত করে অন্যদের কাছে নিজের পরিচিতি বাড়ানোর একটি উদ্দেশ্য গায়কদের সাধারণত থাকে। ফলে মানুষকে তার গানের দিকে আকৃষ্ট করতে গায়করা কপটতা ও মেকি ভালোবাসা প্রদর্শন করে থাকে। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও গাযালী বলেছেন, এসব কারণে এটিকে হারাম গণ্য করার শর্ত তৈরি হয় না। কারণ, সুন্দর জামা পরিধান করা, আরামদায়ক বাহনে চড়া, সব ধরনের শোভা ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী বস্তু, ক্ষেত-খামার ও গবাদি পশু নিয়ে গর্ব করা ইত্যাদি মানুষের অন্তরে নিফাক তৈরি করলেও এগুলোকে হারাম বলার অনুমোদন নেই। আসলে পাপ কাজ নয়, মুবাহ বা বৈধ কাজগুলোই মানুষের মনে নিফাক তৈরি করে। কারণ, চোখের সামনে থাকা বৈধ কাজগুলোই মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে।[75]
৮। “শয়তানের মন্ত্রসঙ্গীত” মর্মে হাদীস
হারাম সাব্যস্তকারীগণ কয়েকজন সাহাবীর কথাকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। এটা ঠিক, আমরাও ব্যাপক অর্থে সাহাবীদের কথাকে সুন্নাহর অংশ মনে করি। তারা প্রমাণ হিসেবে সর্বপ্রথম আবু বকরের (রা.) কথাকে উপস্থাপন করেন। যেমন: একবার তিনি আয়েশার (রা.) ঘরে দুজন দাসীকে গান গাইতে শুনে আয়েশার (রা.) নিন্দা করে বলেছেন: আল্লাহর রাসূলের (সা.) ঘরে শয়তানের মন্ত্রসঙ্গীত! এরপর তিনি দাসীদের তাড়িয়ে দেন। ইবনুল কায়্যিম তাঁর ‘ইগাসাতুল লাহফান’ গ্রন্থে এবং অন্যান্য হারাম সাব্যস্তকারীগণ এমনটাই উল্লেখ করেছেন।
মজার ব্যাপার হলো, যারা গানকে হালাল মনে করেন, তারা এই হাদীসটিকেই সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। হাদীসটির ভাষ্য অনুযায়ী, রাসূল (সা.) আয়েশাকে (রা.) গান শোনার অনুমতি তো দিয়েছিলেনই, তিনি নিজেও তাদের গান শুনছিলেন। অন্যদিকে, তিনি আবু বকরের (রা.) কঠোরতার জবাবে বলেছিলেন: আবু বকর! তাদেরকে তাদের মতো গাইতে দাও। আজ তো ঈদের দিন।
আল্লামা কাত্তানী ‘আত-তারাতীবিল ইদারিয়্যাহ’ গ্রন্থে একটি বলিষ্ঠ জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “হাফেয আবু বকর মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আহমদ বিন হাবীব আল-আমেরী আল-বাগদাদী তাঁর সঙ্গীত সংক্রান্ত রচনায় বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আবু বকরের (রা.) ব্যাখ্যা অনুযায়ী গানকে ‘শয়তানের মন্ত্রসঙ্গীত’ বলে মেনে নিবে, সে ভুল করবে। বেশ কয়েকটি দিক থেকে এটি ভুল। যেমন:
আবু বকরের (রা.) কঠোরতার বিপরীতে রাসূলের (সা.) অবস্থান এবং রাসূলের (সা.) অবস্থানের দিকে আবু বকরের (রা.) প্রত্যাবর্তন সত্ত্বেও কেউ যদি আবু বকরের (রা.) পূর্ববর্তী কথাটিকে আঁকড়ে থাকে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে ভুল করবে।
উক্ত হাদীস মোতাবেক, রাসূল (সা.) দাসীদের গান শুনেছেন এবং এর প্রতি তাঁর অনুমোদন ছিলো। ফলে গান হালাল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থাকে না। এরপরও কেউ যদি রাসূলকে (সা.) উপেক্ষা করে আবু বকরের (রা.) কথার উদ্ধৃতি দেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সে ভুলের মধ্যেই থাকবে। কারণ, আবু বকর (রা.) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনো বাতিল কোনো কিছুর ব্যাপারে অনুমোদন দিতে পারেন না। তাই রাসূলের (সা.) সরাসরি আদেশ ও অনুমোদনকে হারাম মনে করা ছিলো তাঁর জন্য অসম্ভব একটি ব্যাপার।
এক্ষেত্রে আবু বকরের (রা.) কথাটির সঠিক ব্যাখ্যা হলো: তিনি দফ বাজানো ও সুর করে গান গাওয়াকে ইবাদত-বহির্ভূত বৈধ বিনোদন হিসেবেই মনে করতেন। কিন্তু নবুয়ত ও রিসালাতের উপর অপরিসীম সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধে তাঁর হৃদয় ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ। ফলে তিনি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, রাসূল (সা.) যে কোনো ধরনের বিনোদন থেকে পবিত্র। ওই পরিস্থিতিতে রাসূলের (সা.) পবিত্র গৃহে জিকির ও ইবাদত জারি থাকাকে তিনি বেশি উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন। ফলে তিনি গান গাওয়ার জন্য ধমক দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে রাসূল (সা.) দুটি কারণে বাতিল করেছিলেন:
প্রথমত: উম্মতের জন্য ব্যাপকতা, বদান্যতা এবং প্রশস্ততার খাতিরে ইসলাম যেসব বিষয় বৈধ করেছে, সেগুলোকে হারাম সাব্যস্ত না করা।
দ্বিতীয়ত: এর মধ্য দিয়ে শরীয়ত প্রণেতার মাহাত্ম্য, মুসলমান ও উম্মাহর জন্য তাঁর প্রশস্ততা ফুটে ওঠে। যাতে করে মুসলমানরা এ ধরনের বৈধতার মাধ্যমে বিনোদনের সুযোগ পায় এবং এর মাধ্যমে প্রফুল্ল চিত্তে ইবাদতের কাজে মনোযোগী হতে পারে। যেমন: ‘কোরআন নাকি কবিতা?’— রাসূলকে (সা.) আবু বকর (রা.) এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন: ‘কিছু সময় কোরআন, আর কিছু সময় কবিতা।’”[76]
উপরোক্ত যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায়, আবু বকর সিদ্দীক (রা.) গানকে ‘শয়তানের মন্ত্রসঙ্গীত’ অভিহিত করলেও তা হারাম সাব্যস্ত হয় না। কারণ, আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজেই এর অনুমোদন দিয়েছিলেন।
এছাড়া যেসব বিষয়ের সাথে শয়তানকে সম্পর্কিত করা হয়, সেগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়টি হারাম নয়, মাকরূহ। মূলত ভয় দেখিয়ে সেই কাজ থেকে বিরত রাখাই ছিলো উদ্দেশ্য। এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। যেমন রাসূল (সা.) বলেছেন, “হাঁচি আসে রহমান বা আল্লাহর তরফ থেকে, আর হাই আসে শয়তানের তরফ থেকে।”[77] এ কথা দ্বারা হাই তোলাকে গুনাহর কাজ বলা হচ্ছে না, বরং নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ, এটি অলসতা ও অবসাদগ্রস্ততার প্রতীক, যা সাধারণত অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়ার ফলে হয়ে থাকে।
এ ধরনের আরেকটি উদাহরণ হলো রাসূলের (সা.) সেই ভাষ্যটি যেখানে তিনি বলেছেন: “একটি বিছানা পুরুষের, আরেকটি তার স্ত্রীর, আরেকটি অতিথির এবং চতুর্থ বিছানাটি শয়তানের জন্য।”[78] এখন এর অর্থ এ নয় যে চতুর্থ তথা অতিরিক্ত বিছানা থাকা মানেই তা হারাম। বরং হাদীসটি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাবপত্র ও বাহুল্য ভোগসামগ্রীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ পাচ্ছে।
৯। গান প্রসঙ্গে উসমানের (রা.) বক্তব্য
হারাম সাব্যস্তকারীগণ উসমানের (রা.) একটি বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন। তিনি বলেছেন: আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছে বাইয়াত নেওয়ার পর থেকে আমি কখনও গান গাইনি, গান করার ইচ্ছাও পোষণ করিনি এবং আমার ডান হাত দিয়ে আমার যৌনাঙ্গ স্পর্শ করিনি।[79]
এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য:
প্রথমত: একমাত্র রাসূলের (সা.) কথাই হলো নির্ভুল কথা। অন্য কারো কথা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ফলে উসমান (রা.) কিংবা অন্য কোনো সাহাবী স্বয়ং শরীয়তের উৎস হতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত: উসমান (রা.) যে কেবল হারাম কাজই পরিত্যাগ করতেন তা নয়। তিনি বরং সংশয়পূর্ণ, বেমানান, মাকরুহ, এমনকি কিছু হালাল বিষয়ও এড়িয়ে চলতেন। আসলে এ সংক্রান্ত রাসূলের (সা.) একটি হাদীস রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “কোনো বান্দা ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে নির্দোষ ও বৈধ বিষয় ছেড়ে না দেয়া পর্যন্ত মুত্তাকীদের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে না।”[80]
তৃতীয়ত: উসমান (রা.) যেসব বিষয় পরিত্যাগ করেছেন সেগুলো বিবেচনায় নিলে স্পষ্টতই বুঝা যায়, গুনাহ বা হারাম হওয়ার কারণে তিনি সেগুলো পরিত্যাগ করেননি। বরং সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিষ্টাচার বজায় রাখতে গিয়ে তিনি তা করেছেন। যদি গান করার ইচ্ছা পোষণ করা হারাম হয়ে থাকে, তাহলে ডান হাত দিয়ে যৌনাঙ্গ স্পর্শ করাকেও হারাম বলতে হবে। অথচ এমনটা কেউ বলেনও না, এর পক্ষে কোনো দলীলও পাওয়া যায় না।[81] বরং এটি হলো একটি মুস্তাহাব বিষয় কিংবা উন্নত শিষ্টাচারের নির্দেশনা, যেমনটা হাদীসে এসেছে: “তোমাদের কেউ যেন পেশাব করার সময় ডান হাতে তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ না করে এবং টয়লেট সেরে যেন ডান হাতে শৌচ না করে।”[82]
নারীদের কণ্ঠস্বর কি আওরা বা পর্দার অন্তর্ভুক্ত?
হারাম সাব্যস্তকারীগণ বিশেষ করে নারীদের গাওয়া গানকে হারাম সাব্যস্ত করেন মানুষের কাছে প্রচলিত হয়ে যাওয়া একটি ধারণাকে ব্যবহার করে। সেটি হলো নারীদের কণ্ঠস্বর পর্দার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এ ব্যাপারে শরীয়তসম্মত দলীল তো দূরে থাক, দলীলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোনো বিষয়ও নেই। পুরুষ সাহাবীগণের উপস্থিতিতে নারীরা আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছে প্রশ্ন করতেন। আবার (রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের পর) পুরুষ সাহাবীরা উম্মুল মুমিনীনদের কাছে গিয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করতেন এবং তাঁরা তাঁদেরকে ফতোয়া দিতেন, কথাবার্তা বলতেন। কেউ কখনো বলেনি যে আয়েশা (রা.) বা অন্যদের এসব কাজ পর্দার খেলাফ। অথচ নবীপত্নীদের উপর অন্যান্য সাধারণ মহিলাদের তুলনায় পর্দার কড়াকড়ি বেশি ছিল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ
“নবীর স্ত্রীদের কাছে তোমরা কিছু জিজ্ঞেস করলে বা চাইলে, পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।” [সূরা আহযাব: ৫৩]
প্রশ্ন করলে যেহেতু জবাব দেবার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়, তাই প্রশ্নের জবাব দিতে কোনো অসুবিধা নেই। নবীর স্ত্রীগণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا
“আর তোমরা স্বাভাবিক ও ভালোভাবে কথা বলো।” [সূরা আহযাব: ৩২]
যদি তারা বলেন, এসব বিধান তো স্বাভাবিক কথাবার্তার জন্য প্রযোজ্য, গানের ক্ষেত্রে নয়। তাহলে আমরা বলবো, বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে যে আল্লাহর রাসূল (সা.) দুজন দাসীর গান শুনেছিলেন এবং তাদের নিষেধ করেননি। আবু বকর (রা.) নিষেধ করতে গেলে তাঁকে তিনি বলেছিলেন: তাদের ছেড়ে দাও। ইবনে জাফরসহ সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনেকেই দাসীদের গাওয়া গান শুনেছেন।
গান হারাম হওয়ার পক্ষের হাদীসগুলো বিশুদ্ধ নয়
সংক্ষেপে কথা হলো, যারা গানকে হারাম দাবি করেন, তারা দলীল হিসেবে যেসব হাদীস পেশ করেন; সেগুলো হয় বিশুদ্ধ কিন্তু দ্ব্যর্থবোধক, নয়তো দ্ব্যর্থহীন কিন্তু সন্দেহযুক্ত। এমন একটিও বিশুদ্ধ, দ্ব্যর্থহীন ও মারফু হাদীস নেই, যেটি গানকে হারাম সাব্যস্ত করার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে। যাহেরী, মালেকী, হাম্বলী ও শাফেয়ী মাযহাবের বিশেষজ্ঞরা তাদের উপস্থাপিত সকল হাদীসকেই দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
কাজী আবু বকর আল-আরাবী তাঁর ‘আহকামুল কোরআন’ গ্রন্থে বলেছেন: এ বিষয়ে হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো বর্ণনাই বিশুদ্ধ নয়।[83]
ইমাম গাযালী তাঁর ‘এহইয়াউ উলুমুদ্দীন’[84] গ্রন্থে এবং ইবনে নাহভী তাঁর ‘আল-উমদাহ’[85] গ্রন্থে একই রকম কথা বলেছেন।
ইবনে তাহির ‘আস-সামাঊ’ গ্রন্থে বলেছেন: এগুলোর মধ্যে একটি অক্ষরও বিশুদ্ধ নয়।[86]
ইবনে হাযম ‘আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থে বলেছেন: এ প্রসঙ্গে কোনো কিছুই বিশুদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে যা কিছু আছে, সব কিছুই বানোয়াট বা জাল। আল্লাহর শপথ! এর সবগুলো কিংবা এক বা একাধিক বর্ণনা যদি নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মারফতে আল্লাহর রাসূলের (সা.) তরফ থেকে সাব্যস্ত হতো, তাহলে আমরা কখনোই সেটি গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত হতাম না।[87]
সম্ভাব্য বিশুদ্ধ হাদীসগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা
বিভিন্ন দুর্বল সনদের অনেকগুলো হাদীস একত্রিত করার কারণে আমরা যদি এগুলোকে কিছুটা বিশুদ্ধ ধরেও নেই, তাহলে — ইমাম গাযালী যেমনটা বলেছেন — হারাম হওয়ার বিষয়টি সেই গানগুলোর ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে, যেগুলো মানুষের অন্তরকে শয়তানের ইচ্ছার দিকে প্রলুব্ধ করে। যেমন: কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ, সৃষ্টির প্রতি অন্যায্য প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদি। আর যেসব গান আল্লাহর ভালোবাসা, উৎসবের দিনে আনন্দ উদযাপন, সন্তান ভূমিষ্ট, কারো আগমন ইত্যাদি উপলক্ষে গাওয়া হয়, সেসব গান শয়তানের উদ্দেশ্যের বিপরীত হয়। এর পক্ষে দলীল হলো: দাসী ও হাবশীদের গান গাওয়ার বর্ণনা সংবলিত হাদীসগুলো, যা আমরা বিশুদ্ধ রেফারেন্সে উল্লেখ করেছি। কোনো বিষয় এক জায়গায় বৈধ হিসেবে পাওয়া গেলে তা বৈধ। কিন্তু অন্য হাজারো জায়গায়ও যদি ওই বিষয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়, তাহলে তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ হয়ে পড়ে এবং হারামের স্তর থেকে নিচে নেমে আসে। আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজে করেছেন, এমন কোনো কাজের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যা খাটবে না। একান্ত বাধ্যগত পরিস্থিতি তৈরি না হলে কোনো হারাম কাজ হালাল হবে না। আবার বিশেষ কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি না হলে কোনো হালাল কাজও হারাম হবে না। এমনকি নিয়ত ও ইচ্ছার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য।[88] এই কথাগুলো বিজ্ঞ ও সুপ্রসিদ্ধ একজন ফিকাহবিদের মতামত।
এ কারণে আমরা বিধিনিষেধ ও শর্তারোপ না করে সকল গানকে বৈধ বলি না। কোনো গানকে বৈধ হতে হলে এর বিষয়বস্তু, পরিবেশনের ধরন, সংখ্যা ও মান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয় এসব শর্ত ও বিধিনিষেধের আওতায় থাকতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যথাস্থানে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
ইমাম ইবনুল কায়্যিমের অবস্থান
এখানে বলে রাখি, আমি দুজন মুজাদ্দিদ ইমামের চিন্তাধারার ছাত্র। তাঁরা হলেন শাইখুল ইসলাম আবুল আব্বাস ইবনে তাইমিয়া এবং তাঁর ছাত্র ইমাম আবু আব্দুল্লাহ ইবনুল কায়্যিম। তবে তাঁদের ছাত্র হওয়ার অর্থ হলো: আমি তাদের পদ্ধতিকে গ্রহণ করি, কিন্তু সব বিষয়ে তাদের বক্তব্যকে গ্রহণ করি না। তাঁদের সব কথাকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়ার মানে হলো অন্ধ অনুসরণ, তাঁরা স্বয়ং যা করতে অস্বীকার ও নিষেধ করেছেন।
আমি ইবনুল কায়্যিমের অধিকাংশ বই পড়েছি, ঘেঁটে দেখেছি এবং সেখান থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছি। সেগুলোর ভেতর একটি বইয়ের নাম হলো ‘ইগাসাতুল লাহফান মিন মাসায়িদুস শায়তান’। এই বইতে তিনি গান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন এবং একে হারাম সাব্যস্ত করেছেন। আরা যারা একে হালাল বা বৈধ বলেছেন তাদেরকে তিনি প্রচণ্ড আক্রমণ করেছেন। একইভাবে আলাদা করে গানের বিষয়ে তাঁর রচিত আরেকটি বই আমি সর্বশেষ পড়েছি। বইটির নাম হলো ‘কাশফুল গিতা ফী মাসআলাতিল গিনা’।[89]
ইবনুল কায়্যিম এবং তাঁর ফিকাহর মৌলিকত্ব, চিন্তার উর্বরতা, জ্ঞানের প্রশস্ততা, যুক্তির শক্তিমত্তা, আকর্ষণীয় পদ্ধতি এবং কোনো বিষয়ের সমর্থনে বলার পাণ্ডিত্য ইত্যাদির প্রতি আমার মুগ্ধতা রয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও গানকে হারাম সাব্যস্ত করার জন্য তিনি যেসব দলীল উপস্থাপন করেছেন, সে ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। এই ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা যতটা না ছিলো ফকীহসুলভ, তারচেয়ে বেশি ওয়ায়েজ বা বক্তাসুলভ। তিনি দুর্বল দলীলকে শক্তিশালী এবং শক্তিশালী দলীলকে দুর্বল হিসেবে দেখানোর প্রয়াস চালিয়েছেন। এছাড়া তিনি মাকতু হাদীসকে মাওসুল, মাওকুফ হাদীসকে মারফু হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। গানকে হারাম সাব্যস্ত করার জন্য তাঁর উপস্থাপিত দলীলগুলো দ্ব্যর্থবোধক, অর্থাৎ এগুলোর একাধিক ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। তিনি (আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন) তিলকে তাল করেছেন। তাছাড়া গানের বৈধতার পক্ষের সকল যুক্তি ও দলীলকে তিনি খণ্ডন করতে পারেননি। অথচ বিতর্কশাস্ত্রের সুপরিচিত ও স্বতঃসিদ্ধ সূত্র হলো: কোনো দাবি ততক্ষণ পর্যন্ত খারিজ হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই দাবিটির পক্ষের সমস্ত প্রমাণ খণ্ডন করা না যায়।
ইবনুল কায়্যিম ও তাঁর শিক্ষক ইবনে তাইমিয়ার যে মানহাজ আমি গ্রহণ করি, যার উপর আস্থা রাখি এবং যার কথা লোকদেরকে বলি, সেই মানহাজের কারণেই এই ইস্যুতে তাঁর সাথে দ্বিমত করছি, যদিও তাঁদের উভয়কে আমি ভালোবাসি ও সম্মান করি। তাঁর মানহাজ হলো— বক্তাকে নয়, বরং বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয়া। ব্যক্তির মাধ্যমে সত্যকে নয়, বরং সত্যের মাধ্যমে ব্যক্তিকে চেনা। যখনই দলীল পাওয়া যাবে, তখন তা অনুসরণ করা।
ইমাম ইবনুল কায়্যিমের ‘ব্যক্তিকে নয়, দলীলকে অনুসরণ করা’র নীতি বিবেচনায় নিলে এই প্রসঙ্গে আমি তাঁর সাথে দ্বিমত করলেও তাঁর মানহাজের সাথে দ্বিমত করিনি। আল্লাহর রাসূল (সা.) ছাড়া কেউই ভুল করার সম্ভাবনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।
ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কায়্যিমের মতো দুজন বিজ্ঞ ব্যক্তির গানের বিষয়ে কঠোরতা এবং একে বৈধ সাব্যস্তকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করার রহস্য আমি পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই আপাত রহস্যের মূলকথাটা বলি: তাঁদের সময়ে ছড়িয়ে পড়া সূফীদের গানগুলো ছিলো এর কারণ। এসব গানের মাধ্যমে সূফীপন্থীরা ইবাদত করতো। ব্যাপারটিকে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কায়্যিম বিদয়াত ও পথভ্রষ্টতা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে আসবে।
গ) গান ও বাদ্যযন্ত্র হারামের পক্ষে ইজমা হওয়ার দাবির পর্যালোচনা
কুরআনের আয়াত, রাসূলের (সা.) হাদীস এবং সাহাবীদের আছার থেকে দলীল উপস্থাপনের পাশাপাশি গান ও বাদ্যযন্ত্রকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ ইজমা[90] থেকেও প্রমাণ পেশ করে থাকেন।
এদের মধ্যে কারো কারো দাবি হলো, আলেমগণ শুধু সেসব গানকেই বৈধ বলেছেন, যেগুলো মানুষ সহজাত অভ্যাস থেকে গেয়ে ওঠে। যেমন: সফরের সময় উটচালকের গান, বিয়ের অনুষ্ঠানে দাসীর গান ইত্যাদি। কিন্তু আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে সুরারোপকৃত পেশাদার গায়কদের গান, বিশেষত বাদ্যযন্ত্র সহকারে গাওয়া গানকে উম্মাহর কোনো সালাফ বা প্রাথমিক যুগের সালফে সালেহীন আলেমগণ বৈধ হিসেবে সাব্যস্ত করেননি।
কেউ কেউ দাবি করেছেন, সালাফদের এই গ্রুপ থেকে শুধু দুজন আলেম ভিন্নমত পোষণ করতেন বলে তাঁরা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হতেন। এ দুজন পেশাদার গায়কদের গানকে বৈধ সাব্যস্ত করেছিলেন। তাঁদের একজন হলেন ইবরাহীম বিন সাদ। তিনি ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আওফের (রা.) বংশধর। তিনি মদীনার সেইসব আলেম ও মুহাদ্দিসদের অন্যতম ছিলেন, যাদের কাছ থেকে অন্য আলেমগণ হাদীস বর্ণনা করতেন। আরেকজন হলেন উবায়দুল্লাহ বিন হাসান আল-ইবরী। তিনি ছিলেন বসরার বিচারক। বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন হিসেবে তিনি গণ্য ছিলেন।
মুতাখখিরিন বা পরবর্তী আলেমদের মধ্যে যারা সঙ্গীত নিয়ে লেখালেখি করেছেন, তাদের অনেকেই উপরোল্লেখিত দুজন আলেমের মর্যাদাকে খাটো করার এবং তাঁদের সম্মানহানী করার চেষ্টা করেছেন। তাদের হাবভাব এমন ছিল যেন সেই আলেম দুজনের মতামতের কোনো মূল্য নেই।
গান, বিশেষত বাদ্যযন্ত্রসহ গানকে হারাম সাব্যস্তকারীদের মধ্যে অনেকে এ বিষয়ে চার মাযহাবের ইজমা হওয়ার প্রমাণ পেশ করে থাকেন। এদের মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী। চার মাযহাবের ইজমা হওয়ার কথাটা তিনি আমার ‘ইসলামে হালাল হারামের বিধান’ বইয়ের তাখরীজ করতে গিয়ে ‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আমার বইটির ৩৯৯ নম্বর হাদীসের তাখরীজ করতে গিয়ে তিনি আমার বিরোধিতা করেছেন এবং দাবি করেছেন যে আমি নাকি চার মাযহাব কর্তৃক সর্বসম্মত বিষয়ের বিপরীতে গিয়েছি।
ইমাম ইবনে জামায়া, আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী এবং অন্যান্য বিজ্ঞ আলেমদের মতে, অনেক আগে থেকেই এই বিষয়ে প্রচুর মতভেদ হয়ে আসছে। তাহলে এমন একটি স্বীকৃত মতভেদযোগ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ইজমা কিংবা ইজমার কাছাকাছি কোনো বিষয়ের দাবি কীভাবে করা যেতে পারে! বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। সঙ্গীতকে বৈধ সাব্যস্তকারী আলেম দুজন মাত্র নন, বরং অনেক। বিখ্যাত ‘কুতুল কুলুব’ (আত্মার খোরাক) গ্রন্থের রচয়িতা আবু তালিব মক্কী উল্লেখ করেছেন— যে গানকে অস্বীকার করে, সে মূলত ৭০ জন সিদ্দীক বা সত্যবাদীর মতকেই অস্বীকার করে।
আল্লামা হায়তামী বিষয়টির পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: লেখক এখানে ‘৭০’ সংখ্যা দিয়ে আধিক্য বুঝিয়েছেন। কার্যত গানকে বৈধ সাব্যস্তকারী সত্যবাদী আলিমের সংখ্যা এত বেশি যে একে সংখ্যায় প্রকাশ করা কঠিন![91]
তবে আবু তালিব মক্কীর কথাটি উদ্ধৃত করে বিশিষ্ট মুহাক্কিক ইবনুল কায়্যিম তা খণ্ডন করেছেন।[92] তার দাবি অনুযায়ী, ৭০ জন সিদ্দীক বিষয়টিকে বৈধ সাব্যস্ত করে থাকলে, এর দ্বিগুণেরও বেশি আলেম তাদের বিরোধিতা করেছেন। এছাড়া তাদের বিরোধিতা করা ব্যক্তিগণ জ্ঞান, ঈমান ও মর্যাদার দিক থেকে অনেক বেশি উত্তম ছিলেন। ইবনুল কায়্যিমের এই বক্তব্যের মাধ্যমে আসলে ‘৭০ জন সত্যবাদীর’ দাবির খণ্ডন হয় না। বরং তাদের বিপরীত মতের সত্যবাদীগণ যে আরো বড় মাপের আলেম এবং সংখ্যায় বেশি, এটুকুই বুঝা যায় মাত্র।
এসব কথাবার্তা এখানে বলার উদ্দেশ্য হলো, আলোচ্য প্রসঙ্গে মতভেদ থাকার বিষয়টি তুলে ধরা। পক্ষে বা বিপক্ষে আলেমদের সংখ্যা বেশি নাকি কম, সেটি এখানে মুখ্য বিষয় নয়। অধিকাংশ লোকেরা কোনো বিষয়ে একমত হলেই যে সেটি ইজমা হয়ে যায় না— এ বিষয়টি স্বীকৃত। তাছাড়া উম্মাহ কখনো সামগ্রিকভাবে ভ্রান্তির উপর একমত হয় না। মাঝে মাঝে অধিকসংখ্যক মানুষের গৃহীত সিদ্ধান্ত ভুল হয়, আবার অল্পসংখ্যকের সিদ্ধান্তও সঠিক ও সত্য হয়। আমরা অনেক ইমামের ক্ষেত্রে দেখতে পাই, তাঁরা এককভাবে এমন অনেক মত পোষণ করতেন, অন্যরা যেগুলোর বিরোধিতা করতেন। যেমনটা হাম্বলী মাযহাবের ‘মুফরাদাত’ থেকে জানা যায়। গ্রন্থটিতে এ বিষয়গুলোকে বিশেষভাবে শ্রেণীবদ্ধ করে সাজানো হয়েছে। হাম্বলী মাযহাবের আলেমগণ এ বিষয়ে বেশ ভালো কাজও করেছেন।
এ পর্যায়ে সাহাবীদের যুগ ও পরবর্তী যুগে যারা গানকে বৈধ সাব্যস্ত করেছিলেন, তাদের বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন। মজার ব্যাপার হলো, রাসূলের (সা.) যুগ ও সাহাবীদের যুগে গায়ক-গায়িকা ছিল। সাহাবীদের যুগে এদের সংখ্যা রাসূলের (সা.) যুগের তুলনায় বেশি ছিল। তাঁদের যুগের অন্য সভ্যতাগুলোর শিল্পকলার সাথে তাঁরা পরিচিত ছিলেন। এসবের মাঝে যেগুলো পরিশীলিত ও স্বাভাবিক ছিল সেগুলো তাঁদের সময়ে বিকশিত, সুবিন্যস্ত এবং সুনিপুণ হয়ে উঠেছিল।
সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার পক্ষে ইজমা হয়েছে বলে যে দাবি করা হয়, তা খণ্ডন করে ইমাম শাওকানী একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটির শিরোনাম হলো ‘ইবতাল দাওয়ায়িল ইজমায়ী আলা তাহরীমি মুতলাকিস সামায়ী’ (সঙ্গীত হারামের পক্ষে ইজমা হওয়ার দাবি খণ্ডন)। এই গ্রন্থে তিনি সালাফ ও খালাফদের (পরবর্তী যুগের পরহেজগার আলেমগণ) মধ্যে যারা গানকে বাদ্যযন্ত্রসহ কিংবা বাদ্যযন্ত্র ব্যতীত বৈধ সাব্যস্ত করেছিলেন, তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন।
একইভাবে ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে তিনি গানকে বৈধ সাব্যস্তকারীদের যুক্তিগুলোর সারসংক্ষেপ গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এ পর্যায়ে আমরা ইজমা দাবিদারদের দাবির প্রত্যুত্তরে সেই সারসংক্ষেপটি এখানে উল্লেখ করছি।
গানকে বৈধ সাব্যস্তকারীদের যুক্তির সারসংক্ষেপ:
যাদের কাছ থেকে সঙ্গীতের বৈধতার কথা বর্ণিত হয়েছে: মদীনার অধিবাসীগণ (অথচ তাঁরা খোদাভীরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন), যাহেরী মাযহাবের আলেমগণ (যদিও কোরআন-হাদীসের আক্ষরিক ও বাহ্যিক অর্থের মধ্যেই তাঁদের ব্যাখ্যা সীমাবদ্ধ) এবং সুফীগণ (অথচ দ্বীনের রুখসতের (সহজ বিকল্প) পরিবর্তে আযীমত (সর্বোচ্চ মান) গ্রহণ করার কঠোর অভ্যাস তাঁদের ছিলো)।
‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে ইমাম শাওকানী বলেছেন: ঊদ (এক ধরনের বীণা) ও নলখাগড়া দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র সহকারে গান শোনাকে মদীনাবাসী, যাহেরী আলেমগণ এবং সুফী সম্প্রদায় বৈধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
উস্তাদ আবু মনসুর আল-বাগদাদী আশ-শাফেয়ী তাঁর ‘আস-সিমাঊ’ গ্রন্থে বলেছেন: আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর গান শোনার বিষয়টিকে সমস্যাজনক মনে করতেন না। নিজের বীণার তারে সুর তুলে তিনি দাসীদের গান শুনতেন। এটি আমীরুল মুমিনীন আলীর সময়ের কথা।
কাজী শুরাইহ, সাঈদ ইবনে মুসয়াব, আতা বিন আবু রাবাহ, যুহরী এবং শাবী সম্পর্কেও উস্তাদ আবু মনসুর একই ধরনের কথা উল্লেখ করেছেন।
ইমামুল হারামাইন জুয়াইনী তাঁর ‘আন-নিহায়াহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং ইবনে আবু দাম বলেছেন: বিশ্বস্ত ঐতিহাসিকদের মতে, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের (রা.) কিছু দাসী ছিল, যারা ঊদ বাজাতে পারতো। একদিন ইবনে উমর (রা.) তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পাশে ঊদ দেখতে পেলেন। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাহাবী! এই জিনিসটি কী? তারপর সেটি হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন: এটি মনে হয় শাম অঞ্চলের নিক্তি। জবাবে ইবনে যুবায়ের (রা.) বললেন: এটি দিয়ে মনের ওজন মাপা হয়।
হাফেয আবু মুহাম্মদ ইবনে হাযম তাঁর গান সংক্রান্ত ‘আস-সিমাউ’ গ্রন্থে ইবনে সিরিনের সূত্রে বর্ণনা করেছেন: এক লোক কিছু দাসী নিয়ে মদীনায় আসলো। তারপর সে ইবনে উমরের (রা.) বাড়িতে গেলো এবং দাসীদের মধ্য থেকে একজনকে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বললো। তারপর লোকটি দাসীদের বিক্রির জন্য দর কষাকষি করতে লাগলো। কিন্তু তিনি তেমন আগ্রহ দেখালেন না। তখন লোকটি বললো: আমি এখন এমন একজন ব্যক্তির কাছে যাবো যিনি আপনার চেয়ে ভালো দাম দেবেন। ইবনে উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন: কে সেই ব্যক্তি? লোকটি বললো: আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.)। এরপর সে আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের (রা.) কাছে দাসীদেরকে উপস্থাপন করলো। তখন তিনি তাদের একজনকে নির্দেশ দিলেন: এই ঊদটি নাও। দাসীটি সেটি নিলো এবং গান গাইলো। লোকটি তখন তাঁর কাছে দাসীটিকে বিক্রি করে ইবনে উমরের (রা.) কাছে ফিরে আসলো। …”
‘আল-আকদ’ গ্রন্থ প্রণেতা প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবু উমর আন্দালুসী বর্ণনা করেছেন: আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একদিন ইবনে জাফরের (রা.) ঘরে গেলেন। গিয়ে দেখেন— একটি বিশেষ ধরনের ঊদ এক দাসীর কোলে রাখা। তখন ইবনে উমরকে (রা.) তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এতে কোনো সমস্যা আছে বলে কি আপনি মনে করেন? তিনি জবাব দিলেন: না, এতে কোনো সমস্যা নেই।
মুয়াবিয়া (রা.) ও আমর ইবনুল আস (রা.) সম্পর্কে মাওয়ারদী বর্ণনা করেছেন: তারা দুজনে ইবনে জাফরের (রা.) বাসায় ঊদ শুনেছেন।
আবুল ফারাজ আসবাহানী বর্ণনা করেছেন: মিযহার নামক এক ধরনের প্রাচীন বীণার বাদ্য সহকারে ইজ্জত আল-মায়লার কণ্ঠে হাসসান বিন সাবিত (রা.) নিজের রচিত একটি কবিতাকে গান হিসেবে শুনেছেন।
আবুল আব্বাস মুবাররিদও একই ধরনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ভাষাবিদদের কাছে মিযহার মানে হলো ঊদ। ‘আল-ইমতা’ গ্রন্থে আদফায়ী উল্লেখ করেছেন: উমর ইবনে আব্দুল আযীয খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে দাসীদের গান শুনতেন। আর ইবন সাময়ানী এর বৈধতা সম্পর্কে তাঊস থেকে বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে কুতাইবা ও ‘আল-ইমতা’ গ্রন্থের রচয়িতা এটি বর্ণনা করেছেন মদীনার বিচারক সাদ বিন ইবরাহীম বিন আব্দুর রহমান যুহরীর নিকট থেকে। তিনি ছিলেন একজন তাবেয়ী। আর আবু ইয়ালা আল-খলীলী ‘ইরশাদ’ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন আব্দুল আযীয ইবনে সালামা আল-মাজশূনের নিকট থেকে। তিনি ছিলেন মদীনার অন্যতম একজন মুফতী।
কাফফালের নিকট থেকে রুইয়ানী বর্ণনা করেছেন: ইমাম মালেক বিন আনাসের মাযহাব মোতাবেক বাদ্যযন্ত্র সহকারে গান বৈধ। ইমাম মালেকের নিকট থেকে উস্তাদ আবু মানসুর আল-ফুরানী ঊদ বৈধ হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। আবু তালিব মক্কী ‘কুতুল কুলুব’ গ্রন্থে শুবা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন: তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মিনহাল ইবনে আমরের ঘরে ঢাক-তাম্বুরা শুনেছেন।
আবুল ফজল ইবনে তাহির তাঁর ‘আস-সিমাঊ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: মদীনাবাসীদের মধ্যে ঊদ বৈধ হওয়ার বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
ইবনে নাহভী ‘উমদা’ গ্রন্থে বলেছেন: ইবনে তাহির বলেছেন যে এ বিষয়ে মদীনাবাসীদের মধ্যে ইজমা আছে।
ইবনে তাহির বলেছেন: জাহেরীগণের সকলেই এই মতকে গ্রহণ করেছেন। আদফায়ী বলেছেন: উপরে উল্লেখিত ইবরাহীম বিন সাদের সাথে যে বর্ণনাটিকে সম্পর্কিত করা হয়, সে বর্ণনার বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যার কাছ থেকে সকল হাদীস সংকলকই (অর্থাৎ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী এবং ইবনে মাজাহ) হাদীস গ্রহণ করেছেন।
এছাড়া মাওয়ারদী কোনো কোনো শাফেয়ী আলেমের নিকট থেকে ঊদ বৈধ হওয়ার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আবু ইসহাক শিরাজীর বরাতে আবুল ফজল ইবনে তাহির, রুইয়ানী ও মাওয়ারদীর বরাতে ‘আল-মুহিম্মাত’ গ্রন্থে আসনাভী, উস্তাদ আবু মনসুরের বরাতে ইবনে নাহভী, ইবনে তাহিরের বরাতে ‘উমদা’ গ্রন্থে ইবনে মুলাক্কিন, শায়খ ইযযুদ্দীন ইবনে আব্দুস সালামের বরাতে আদফায়ী এবং আবু বকর আল-আরাবীর বরাতে ‘আল-ইমতা’ গ্রন্থের লেখক— তাঁরা সবাই গান বৈধ হওয়ার পক্ষে জোরালো মতামত বর্ণনা করেছেন। এমনকি বাদ্যযন্ত্রসহ গান বৈধ বলে মত দিয়েছেন।
বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গানের ব্যাপারে ‘আল-ইমতা’ গ্রন্থে আদফায়ী বলেছেন: আল-গাযালী ফিকাহ সংক্রান্ত কিছু রচনায় এ ব্যাপারে আলেমদের ঐক্যমত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে তাহির এ সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীদের ইজমা তথা ঐক্যমতের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে তাজ ফাযারী ও ইবনে কুতাইবা মক্কা ও মদীনাবাসীদের ইজমা বা ঐক্যমতের কথা বর্ণনা করেছেন। ইবনে তাহির এবং ইবনে কুতাইবা এ বিষয়ে মদীনাবাসীদের ইজমা বা ঐক্যমতের কথা উল্লেখ করেছেন। মাওয়ারদী বলেছেন: যে সময়গুলোতে ইবাদত ও যিকিরে মশগুল থাকার আদেশ রয়েছে, সেই দিনগুলোতেও সঙ্গীত বৈধ বলে হেজাযবাসীরা মনে করতেন।
‘উমদা’ গ্রন্থে ইবনে নাহভী বলেছেন: গান গাওয়া ও শোনা বৈধ হওয়ার পক্ষে একদল সাহাবী ও তাবেয়ীদের কাছ থেকে বর্ণনা রয়েছে। এই সাহাবীদের দলে ছিলেন উমর (রা.) (ইবনে আব্দুল বার ও অন্যরা তাঁর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন), উসমান (রা.) (মাওয়ারদী, আল-বায়ান গ্রন্থকার ও রাফেয়ী তাঁর বরাতে বর্ণনা করেছেন), আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) (ইবনে আবু শায়বা বর্ণনা করেছেন), আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) (বায়হাকীর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত), সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) (তাঁর বরাতে ইবনে কুতাইবা বর্ণনা করেছেন), আবু মাসুদ আনসারী (রা.) (বায়হাকীর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত), হামযা (রা.) (সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত), ইবনে উমর (রা.) (তাঁর সূত্রে ইবনে তাহির বর্ণনা করেছেন), বারা ইবনে মালিক (রা.) (তাঁর সূত্রে আবু নাঈম বর্ণনা করেছেন), আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) (তাঁর বরাতে ইবনে আব্দুল বার বর্ণনা করেছেন), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) (তাঁর কাছ থেকে আবু তালিব মক্কী বর্ণনা করেছেন), হাসসান (রা.) (তাঁর সূত্রে আবুল ফারাজ আসবাহানী বর্ণনা করেছেন), আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) (তাঁর সূত্রে যুবাইর ইবনে বাক্কার বর্ণনা করেছেন), কারাযাহ বিন কাব আনসারী (রা.) (তাঁর সূত্রে ইবনে কুতাইবা বর্ণনা করেছেন), খাওয়াত বিন জুবাইর (রা.) ও রাবাহ আল-মুতারিফ (রা.) (তাঁর সূত্রে আল-আগানী’র গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন), মুগীরা বিন শুবা (রা.) (তাঁর সূত্রে আবু তালিব মক্কী বর্ণনা করেছেন), আমর ইবনুল আস (রা.) (তাঁর সূত্রে মাওয়ারদী উল্লেখ করেছেন), আয়েশা (রা.) ও রাবী (রা.) (সহীহ বুখারী ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত)।
তাবেয়ীদের মধ্যে ছিলেন সাঈদ ইবনে মুসয়াব, সালেম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমর, ইবনে হাসসান, খারিজা বিন যায়েদ, কাজী শুরাইহ, সাঈদ বিন জুবায়ের, আমের শাবী, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আতিক, আতা বিন আবু রাবাহ, মুহাম্মদ বিন শিহাব যুহরী, উমর ইবনে আব্দুল আযীয এবং সাদ বিন ইবরাহীম যুহরী।
আর তাবে তাবেয়ীদের সংখ্যা এত বেশি যে তাঁদের গণনা করা প্রায় অসম্ভব। তন্মধ্যে চার ইমাম, অধিকাংশ শাফেয়ী আলেম ও ইবনে উয়াইনাহ উল্লেখযোগ্য। ইবনে নাহভীর এই পুরো কথাটুকু শাওকানী তাঁর ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[93]
সঙ্গীতকে বৈধ সাব্যস্তকারীদের দলীল পর্যালোচনা করার সময় আমরা তাঁদের বক্তব্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবো।
ঘ) হারামের আশংকায় বৈধ বিষয়কে নিষিদ্ধ করার বিধান প্রসঙ্গ
যারা গণহারে সঙ্গীত, বিশেষত বাদ্যযন্ত্রকে হারাম সাব্যস্ত করেন, তারা আরেকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এটি করে থাকেন। সেটি হলো ‘সাদ্দে যারায়ী’।[94] এর মানে হলো হারামের দিকে ধাবিত হওয়ার আশংকায় বৈধ বিষয়কে নিষিদ্ধ করা। এটি মালেকী এবং হাম্বলী মাযহাবের একটি প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি। অন্যান্য মাযহাবেও এটি মোটাদাগে গ্রহণযোগ্য। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম ‘ইলামুল মুওয়াক্কিয়ীন’ গ্রন্থে সাদ্দে যারায়ীর প্রামাণ্যতা প্রতিপাদন করতে গিয়ে এর নিরানব্বইটি কারণ ও এ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করেছেন।
সঙ্গীতকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ এ প্রসঙ্গে বলে থাকেন, বর্তমান জামানা নষ্ট হয়ে গেছে এবং অধঃপতনের দিকে আহ্বানকারীর সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। এ লক্ষ্যে তারা নিত্য নতুন পন্থা বের করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মুসলমানদের চরিত্রকে হালকা করে ফেলা, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা নষ্ট করে দেয়া এবং ব্যক্তিত্বের স্থিরতা ও প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলাকে কাজে লাগানো। উম্মাহর শত্রুদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও মুসলিম ছেলেমেয়েদের মাঝে অশ্লীলতা প্রসারের লক্ষ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও প্রভাবশালী শিল্পকলা হলো গান ও বাদ্যযন্ত্র। বিশেষত এই শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য নেশা, লাম্পট্য, অশ্লীলতা, মাদকদ্রব্যের ব্যবহার, নামায ছেড়ে দেয়া এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করা একদম মামুলি ব্যাপার।
তারা আরো বলেন, এগুলো এখন আর অতীতের মতো সীমিত আকারে নেই। এসব এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে, পুরো কমিউনিটিকে গ্রাস করেছে। এমনকি উপকূলীয় গ্রামাঞ্চল ও মরুভূমিতে পর্যন্ত এগুলোর বিস্তার ঘটেছে। এসব কর্মকাণ্ড নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে সবার মাঝে প্রভাব বিস্তার করেছে। রেডিও-টিভির মারফতে গোয়াল ঘরে পর্যন্ত এসব ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে টেলিভিশনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কারণ, এর মাধ্যমে একইসাথে দেখা ও শোনা যায়।
এসব কারণে ফকীহগণকে শুরু থেকেই এই অনিষ্ট প্রতিরোধ করতে হয়েছিলো এবং ফিতনা ছড়িয়ে পড়ার পথগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো। নয়তো এই ফিতনার প্রবল স্রোতে আমরা ভেসে যেতাম এবং আমাদের প্রচণ্ড ক্ষতি ও সর্বনাশ হয়ে যেতো।
সাদ্দে যারায়ীর যুক্তি খণ্ডন:
উপরোক্ত মতামত পোষণকারী মুখলিস ভাইদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য হলো, আমরা সাদ্দে যারায়ীকে অস্বীকারকারী আলেমদের সমর্থক নই। আমরা বরং মনে করি, এটি শরিয়তের সুপ্রতিষ্ঠিত একটি মূলনীতি ও ফিকাহর অন্যতম ভিত্তি। তাই এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কিংবা শিথিলতা দেখানো যাবে না। বরং স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী এই মূলনীতিকে প্রয়োগ করতে হবে।
ইমাম কারাফী ও ইমাম শাতিবীর মতো গবেষক আলেমদের মতানুযায়ী, কোনো কিছুকে সাদ্দে যারায়ীর অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, অথবা সাদ্দে যারায়ীকে গুরুত্ব না দেয়ার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি— উভয়টির পরিণামই ভালোর চেয়ে মন্দ হয় এবং উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়।
সাদ্দে যারায়ী গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করলে এর অপব্যবহারের পথ খুলে যায়। গানকে হারাম সাব্যস্তকারী ভাইয়েরা এ ধরনের বাড়াবাড়ি করে এই পথ খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন। আবার সাদ্দে যারায়ীর ব্যাপারে শিথিলতা দেখালেও মানুষ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ ও উপকার থেকে বঞ্চিত হয়। উভয় ধরনের বাড়াবাড়ি আল্লাহ প্রদত্ত বৈধ বিষয়গুলোকে অবৈধ এবং উদার বিষয়গুলোকে দমন করার হাতিয়ারে পরিণত হয়।
কঠোরতাকে পরিহার করে সহজতাকে গ্রহণ করা, দ্বীনকে চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সহজ হিসেবে তুলে ধরা, ভয় দেখানোর পরিবর্তে সুন্দরভাবে দ্বীনের প্রচার করা আল্লাহর দ্বীনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এইসব বাড়াবাড়ি এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে পাল্টে দিয়ে দ্বীনকে অনমনীয় ও কঠোর করে তোলে। খৃষ্টানদের বৈরাগ্যবাদ, প্রাচীন পারস্যের মানিবাদসহ[95] অন্য যেসব ধর্ম ও মতবাদ মানুষ ও জীবন সম্পর্কে নৈরাশ্যব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, সেগুলোর সাথে এই বাড়াবাড়ির মিল রয়েছে। এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে সূরা আরাফে বর্ণিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, তাওরাত ও ইঞ্জিলের মতো পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোতে মুহাম্মদের (সা.) রিসালাতের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির উল্লেখ ছিলো।
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِىَّ الْأُمِّىَّ الَّذِى يَجِدُونَهُۥ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِى التَّوْرٰىةِ وَالْإِنجِيلِ يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهٰىهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلٰلَ الَّتِى كَانَتْ عَلَيْهِمْ ۚ
“(এরা তো তারাই) যারা সেই রাসূল ও নিরক্ষর নবীর অনুসরণ করে, যার কথা তারা তাদের তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পাচ্ছে। সে তাদেরকে ভালো কাজ করার আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ করতে নিষেধ করে, তাদের জন্য ভালো জিনিসকে বৈধ ও খারাপ জিনিসকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং তাদের উপর চেপে থাকা ভারকে লাঘব করে ও এমনসব বাঁধন থেকে তাদের মুক্ত করে, যাতে তারা আবদ্ধ হয়ে ছিল।” (সূরা আরাফ: ১৫৭)
ইমাম কারাফী তাঁর ‘আল-ফুরুক’ গ্রন্থে যারায়ীকে নিম্নোক্ত তিন ভাগে ভাগ করেছেন:
১। যেসব যারায়ীর ব্যাপারে উম্মত একমত।
২। যেসব যারায়ী অনুমোদিত হওয়ার ব্যাপারে উম্মত একমত।
৩। যেসব যারায়ী সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম মালিকের মতো অনেকে সাদ্দে যারায়ীকে বিবেচনায় রাখেন, আবার অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন।
১। সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি ও মানুষের অভ্যাস বিবেচনায় যেসব কাজ নিশ্চিত ক্ষতিকর বা মানুষকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়, সেসব কাজ সাদ্দে যারায়ী হওয়ার ব্যাপারে উম্মাহ একমত। যেমন: মানুষের চলাচলের রাস্তায় কূপ খনন করা। এর ফলে যেহেতু মানুষের কূপে পড়ে যাওয়ার আশংকা আছে, সেহেতু স্বভাবতই এর ক্ষতিকর দিকটি অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
২। কিছু কাজ আছে, যেগুলো করতে গেলে অকল্যাণ হওয়ার আশংকা অত্যন্ত কম। তাই এসব যারায়ী বা কাজ অনুমোদিত হওয়ার ব্যাপারে উম্মত একমত। কারণ, ক্ষতি বা অকল্যাণের আশংকায় এগুলো বাদ দিলে দৈনন্দিক জীবনে মানুষ অনেক প্রয়োজনীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে। যেমন: মদ উৎপাদনের আশংকা থাকা সত্ত্বেও আঙ্গুর চাষ বৈধ, যিনার আশংকা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশি হিসেবে পাশাপাশি বাড়িতে বসবাসের বৈধতা।
এসব বিষয়ে অকল্যাণের আশংকাগুলোকে শরীয়ত বিবেচনায় নেয়নি। কারণ, এসব দূরবর্তী আশংকা বাস্তবে রূপ লাভ করার সম্ভাবনা অনেক কম। উপরন্তু, এই বিষয়গুলোতে অকল্যাণ হওয়ার সম্ভাব্য আশংকার চেয়ে বাস্তব কল্যাণ বা উপকার লাভের পরিমাণই বেশি।
৩। তৃতীয় ধরনের যারায়ী উপর্যুক্ত উভয় প্রকার থেকে ভিন্ন। এ ধরনের যারায়ী মানুষকে এমন অকল্যাণের দিকে নিয়ে যায় বলে আশংকা করা হয়, যা সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি অকাট্য বা অকাট্যতার কাছাকাছি নয়, যান্নী বা অনুমিত হিসেবেও সাব্যস্ত নয়।
তবে এ ধরনের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ইমাম মালিক সাদ্দে যারায়ীকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্যরা গ্রহণ করেননি। গানকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ প্রায়শই গানকে এই প্রকারভুক্ত করে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে আমার মতামত হলো: বৈধ গানের ক্ষেত্রে আমরা যদি শরীয়তসম্মত মানদণ্ড এবং কার্যকর কিছু শর্ত প্রণয়ন করতে পারি, তাহলে ‘সাদ্দে যারায়ী’র মূলনীতিটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। দ্ব্যর্থহীন নস (কুরআন-হাদীসের টেক্সট), মাকাসিদে কুল্লিয়্যাহ (শরীয়তের সামগ্রিক উদ্দেশ্য) এবং ফিকাহর সার্বজনীন নিয়মনীতিগুলো বিবেচনায় রাখাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
এ বিষয়ে যারা আশংকা প্রকাশ করেন এবং কঠোরতা দেখান, তাদের কথা মেনে নিলে আরো অনেক বিষয়কে হারাম সাব্যস্ত করতে হবে। যেমন: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব সুন্দর ও আকর্ষণীয় জিনিস এবং যেসব উত্তম রিযিক বরাদ্দ করেছেন, সেগুলোকেও (মানুষের নানাবিধ অবস্থা ও অপপ্রয়োগের অজুহাতে) হারাম বলতে হবে। ফলে দ্বীনের মধ্যে এমনসব বিধিবিধান চালু করতে হবে, যার অনুমতি আল্লাহ আমাদের দেননি।
দুঃখজনকভাবে, অতীতে অনেক মুসলিম সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ফিতনার আশংকায় সাদ্দে যারায়ীর অজুহাত দেখিয়ে নারীদেরকে মসজিদে নামায আদায় করতে বাধা দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি কোনো কোনো শতাব্দীতে নারীদের জন্য ধর্মীয় জ্ঞান অজর্ন হারাম ছিলো। এর পরিণতিতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে (শুদ্ধভাবে) এক রাকাত নামায আদায় না করেই অনেক নারী পুরো জীবন পার করে দিয়েছে।
আমাদের যুগে এসেও অনেক ধর্মীয় ব্যক্তি এক সময় নারীদের শিক্ষা গ্রহণে বাধা দিতেন। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে এটি নারীদেরকে অধঃপতন ও বিকৃতির দিকে নিয়ে যাওয়ার এক বিপজ্জনক মাধ্যম। তবে পরবর্তীতে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমের আপত্তি ছাড়াই মোটামুটি সবাই একমত হয়েছেন যে দ্বীন ও দুনিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব শিক্ষা নারীদের জন্য এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে, সেসব বিষয় শেখার সুযোগ তাদেরকে দিতে হবে।
ঙ) সাবধানতা অবলম্বন ও সংশয় থেকে বেঁচে থাকার দোহাই
গান ও বাদ্যযন্ত্রকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ সর্বশেষ যে যুক্তিটি দিয়ে থাকেন, সেটি হলো: দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও সংশয় থেকে বেঁচে থাকার স্বার্থে এগুলোকে হারাম বিবেচনা করা উচিত। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে নোমান ইবনে বশীর (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন: “হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্ট। এ দুটির মাঝখানে কিছু জিনিস রয়েছে সন্দেহপূর্ণ। এগুলো সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই যে আসলে তা হালাল নাকি হারাম। এমতাবস্থায়, যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সেসব থেকে দূরে থাকবে, সে নিশ্চয়ই নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। কিন্তু কেউ এগুলোর কোনোটির সাথে জড়িয়ে গেলে তার পক্ষে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়া অসম্ভব কিছু নয়। যেমন কোনো রাখাল নিষিদ্ধ চারণভূমির আশেপাশে পশু চড়ালে, পশুগুলো নিষিদ্ধ অঞ্চলে ঢুকে পড়ার আশংকা থাকে।”
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন: “যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে দিয়ে সন্দেহমুক্ত বিষয় গ্রহণ করো।”[96]
তিরমিযীর একটি হাদীসে বলা হয়েছে: “কোনো বান্দা ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে বৈধ অক্ষতিকর বিষয় না ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত মুত্তাকীদের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে না।”[97]
ইমাম শাওকানী ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে গান সম্পর্কে আলেমদের মতামত তুলে ধরেছেন। গানকে যারা হালাল, মাকরূহ, হারামসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন, তাদের সবার মতামত স্ব স্ব পক্ষের দলীলসহ সবিস্তারে তিনি উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে গান বৈধ হওয়ার দলীলগুলো অধিক শক্তিশালী এবং হারাম সাব্যস্তকারীদের একটি দলীলও ধোপে টেকে না। তিনি উপসংহার টেনেছেন এভাবে:
“হালাল ও হারাম সাব্যস্তকারী উভয় পক্ষের যেসব দলীল বর্ণনা করেছি, সেগুলো পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়— গান হারাম হওয়ার দাবি খারিজ হলেও সংশয়যুক্ত বিষয় হিসেবে থেকেই যায়। আর সহীহ হাদীস থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানি, সংশয়যুক্ত বিষয়ে জড়িত হওয়া মুমিনের জন্য শোভন নয়। যে ব্যক্তি সংশয়যুক্ত বিষয় ত্যাগ করবে, তার দ্বীন ও মর্যাদা নিরাপদ থাকবে। আর যে ব্যক্তি সংশয়যুক্ত বিষয়ের ধারেকাছে যাবে, সেখানে তার পতিত হওয়ার আশংকাও বেশি থাকবে। বিশেষত, এর সাথে যখন দৈহিক অঙ্গভঙ্গি, সৌন্দর্যের প্রদর্শনী, নেশা, বেহায়াপনা ও ব্যক্তিত্বহীন কর্মকাণ্ড জড়িত থাকে, তখন গানের শ্রোতা এসব বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকে না।”[98]
‘সংশয়যুক্ত বিষয়’ নিয়ে পর্যালোচনা:
১। আমার কথা হলো: সংশয় থেকে বেঁচে থাকা ফরজ বা ওয়াজিব নয়। এটি মুস্তাহাব কাজ, সংশয়ের মাত্রার আলোকের গুরুত্ব বাড়ে। আর নয়তো সুস্পষ্ট হারাম ও সংশয়পূর্ণ বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকবে না। অথচ দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়।
২। যার কাছে কোনো বিষয় সংশয়যুক্ত মনে হবে, তার উপর ‘দ্বীন ও মর্যাদা নিরাপদ’ রাখার স্বার্থে তা থেকে বেঁচে থাকার দায়িত্ব বর্তাবে। কিন্তু যার কাছে হালাল বা হারাম সুস্পষ্ট, তার জন্য এই দায়িত্ব প্রযোজ্য হবে না।
এ কারণেই আমরা বলি: যিনি গানকে বৈধ মনে করেন, তার কাছে এর পক্ষের দলীল ও যুক্তিগুলো সুস্পষ্ট। ফলে তার জন্য গান সংশয়যুক্ত বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত হবে না।
৩। যেসব বিষয়ে প্রবল সংশয় তৈরি হয়, সেগুলোই কেবল সংশয়যুক্ত বিষয় হিসেবে বিবেচ্য হবে। হালকা সংশয়ের বিষয়গুলো বিবেচ্য হবে না।
৪। যে ব্যক্তি সংশয়যুক্ত বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে চাইবে, তাকে আগে তাকওয়াবান হতে হবে। কবিরা গুনাহ ও সুস্পষ্ট হারাম কাজে লিপ্ত থাকা কিংবা ফরজ বিধান ত্যাগ করা যার অভ্যাস, তাকে সংশয়যুক্ত বিষয় থেকে দূরে থাকার নসিহত করে লাভ নেই।
এ কারণে ইবনে ওমরকে (রা.) এক ব্যক্তি মুহরিম অবস্থায় মাছি হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় তিনি তাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কোত্থেকে এসেছো? সে জবাব দিল: ইরাক থেকে। তিনি বললেন: এই ব্যক্তি মাছির রক্তের বিধান সম্পর্কে জানতে চাইছে। অথচ তার দেশের লোকেরা আল্লাহর রাসূলের (সা.) নাতির [হোসাইন ইবনে আলী (রা.)] রক্ত ঝরিয়েছে!
৫। ‘সাবধানতা অবলম্বন ও সংশয়পূর্ণ বিষয় পরিহার করার মূলনীতিটি অন্য একটি মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। সেটি হলো সহজতা অবলম্বনের মূলনীতি। এই মূলনীতির পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল রয়েছে। এই মূলনীতিটি বিশেষত সাধারণ মানুষের জন্য বেশি দরকারী। বর্তমান যুগে আমাদের উচিত মানুষের জন্য যথাসম্ভব সহজতার মূলনীতি গ্রহণ করা। কারণ, আমাদেরকে কঠোরতা আরোপকারী হিসেবে নয়, বরং সুবিধা প্রদানকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে।
ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জন্য ফতোয়াও বিভিন্ন রকম হতে পারে। দ্বীনকে যারা খুব ভালোভাবে পালন করে, তাদের জন্য আমরা তাদের উপযোগী ফতোয়া প্রদান করবো। আর বাদবাকি সংখ্যাগরিষ্ট সাধারণ মানুষের জন্য আমরা সহজতার মূলনীতির আলোকে ফতোয়া দেবো। যাতে করে তাদের উপর থেকে কষ্ট ও বোঝা লাঘব করা যায় এবং তারা যেন সহজেই দ্বীনের উপর টিকে থাকতে পারে।
[মূল: ইউসুফ আল-কারযাভী, অনুবাদ: শাইখুল আবরার]
|| অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখান থেকে ||
নোট ও রেফারেন্স:
[1] দেখুন: ইমাম বায়হাকীর সুনানে কুবরা, ১০/২২৩।
[2] যেসব হাদীসের সনদ কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছাড়া সরাসরি রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে, সেসব হাদীসকে মুসনাদ হাদীস বলা হয়। — অনুবাদক।
[3] কোনো কথা, কাজ, মৌন সম্মতি, গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে সরাসরি রাসূলের (সা.) সাথে সম্পর্কিত করাকে মারফু হাদীস বলে। যেমন: ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের কথা বলা যায়। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” — অনুবাদক।
[4] ইগাসাতুল লাহফান মিন মাসায়িদুশ শায়তান, ইবনুল কায়্যিম, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৫৭-২৫৯, মুস্তাফা আল-হালাবী।
[5] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭; আরো দেখুন: সুনানে বায়হাকী, ১০/২২৩, ইমাম বায়হাকী তাঁর সুনান গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মুজাহিদ ও ইকরিমার পাশাপাশি ইবরাহীম নাখয়ীর নামও উল্লেখ করেছেন।
[6] যেসব কার্যকরণ ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে কোরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে, সেসব প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণকে ‘সাবাবুন নুযুল’ বলা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেসব কার্যকারণ, প্রেক্ষাপট বা ঘটনাগুলো অতি অবশ্যই শরীয়তের মূলনীতিকে সামনে রেখে বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে বর্ণিত হতে হবে। — অনুবাদক।
[7] আল-মুহাল্লা, ইবনে হাজম, ৯/১০, মুনিরীয়া সংস্করণ।
[8] এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৬০-২৬১, দারুল মারিফা, বৈরুত।
[9] ইগাসাতুল লাহফান, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৫৯।
[10] তাফসীরে তাবারী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪১, সূরা লোকমানের তাফসীর।
[11] তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ (মুহাররিরুল ওয়াজীয), খণ্ড: ১১, পৃ. ৪৮৪, দোহা, কাতার।
[12] ইমাম রাযী প্রণীত তাফসীরুল কাবীর, খণ্ড: ১৩, পৃ. ১৪১-১৪২।
[13] এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, সঙ্গীত অধ্যায়, পৃ. ১১৪৭, আশ-শাব প্রকাশনী, মিশর।
[14] আবু হোরায়রার (রা.) বরাত দিয়ে ইমাম মুসলিম তাঁর গ্রন্থে হাদীসটি সংকলন করেছেন। সৎ কাজ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: কোনো মুসলিমকে অত্যাচার করা হারাম হওয়া প্রসঙ্গে।
[15] ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে ‘মুত্তাফিকুন আলাইহ’ হিসেবে বর্ণিত। এটি সহীহ বুখারীর প্রথম হাদীস।
[16] আল-মুহাল্লা: ৯/৬০।
[17] দেখুন: ইগাসাতুল লাহফান, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৬০।
[18] দেখুন: দুররুল মানসুর, পঞ্চম খণ্ড, পৃ. ৮০।
[19] দেখুন: তাফসীরে কুরতুবী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৮৮, দারুল কুতুবুল মিসরিয়্যাহ।
[20] এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৮৫।
[21] মারফু হাদীস: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে শুরু করে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝখান থেকে কোনো রাবীর নাম বাদ পড়েনি। — অনুবাদক
[22] মাওকুফ হাদীস: যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ যে সনদ সূত্রে কোনো সাহাবীর কথা, কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে। এর অপর নাম আছার। — অনুবাদক
[23] মুয়াল্লাক হাদীস: হাদীসের সনদের শুরুর দিক থেকে অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে। — অনুবাদক
[24] আল-হির শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো যৌনাঙ্গ। তবে হাদীসে যিনা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
[25] দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৯০, ‘যে ব্যক্তি মদকে ভিন্ন নামে নামকরণ করে তা হালাল মনে করে শীর্ষক অধ্যায়।
[26] মুসনাদ হাদীস: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোনো স্তরেই রাবীর নাম বাদ পড়েনি। — অনুবাদক
[27] মুত্তাসিল হাদীস: মারফু বা মাওকুফ হাদীসের সনদ কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছাড়া ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হওয়া। — অনুবাদক
[28] দেখুন: ইবনে হাজার আসকালানী রচিত তাগলীক আত-তালীক, ৫/১৭-২২, তাহকীক: সাঈদ আল-কাযকী, প্রকাশনী: মাকতাবুল ইসলামী এবং দারে আম্মার।
[29] দেখুন: মীযানুল ইতিদাল গ্রন্থে হিশাম বিন আম্মারের জীবনী (৪/৩০২), জীবনী নং ৯২৩৪; আরো দেখুন: ইবনে হাজার রচিত তাহযীবুত তাহযীব (১১/৫১-৫৪)। এছাড়া দেখুন: মিযযী রচিত তাহযীবুল কামাল, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৪২-২৫৫, জীবনী নং ৬৫৮২।
[30] ইবনে হাজার আসকালানী, হাদয়ুস সারী মুকাদ্দিমাতুন সহীহুল বুখারী, পৃ. ৪৪৮, ৪৪৯, প্রকাশনী: তাবয়াতুস সালাফিয়্যাহ।
[31] উমূমুল বালওয়া বলতে উদ্ভূত এমন জটিল পরিস্থিতি বা নতুন কোনো চ্যালেঞ্জকে বুঝায়, যে কারণে নতুন ফতোয়া দেওয়া যেতে পারে। — অনুবাদক
[32] দেখুন: সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৬৮৮, কিতাবুল আশরিবাহ। হাদীসটির সনদে মালিক বিন আবু মারইয়াম নামের একজন বর্ণনাকারী আছে, যাকে ইবনে হিব্বান ছাড়া আর কেউ সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করেননি। যেমন— ইবনে হাযম বলেছেন: তার পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়নি। যাহাবী বলেছেন: সে অপরিচিত।
[33] নাইলুল আওতার, ৮/২৬৭।
[34] রাবী বা বর্ণনাকারীদের যাচাই-বাছাই করার জন্য হাদীস শাস্ত্রে বিদ্যমান বিশেষ জ্ঞানপদ্ধতিকে জারাহ ওয়াত তাদীল বলে। — অনুবাদক
[35] ইবনে মাজাহ অপরাধের শাস্তি অধ্যায়ে (কিতাবুল ফিতান) উল্লেখ করেছেন। হাদীস নং ৪০২০।
[36] দেখুন: আল-ইহসান, ১৫তম খণ্ড, হাদীস নং ৬৭৫৮। হাদীস বিশারদগণ একজন বর্ণনাকারীর দুর্বলতার কারণে হাদীসটিকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। সেই বর্ণনাকারী হলেন মালিক বিন আবু মারইয়াম, যাকে ইবনে হিব্বান ছাড়া আর কেউ সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করেননি। ইবনে হাযম বলেছেন: তার পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়নি। আর যাহাবী বলেছেন: সে অপরিচিত।
[37] দেখুন: মাউসুয়াতুল হাদীসিয়্যাহ: মুসনাদে আহমদ, ৩৬তম খণ্ড, হাদীস নং ২৪৬৭।
[38] দেখুন: মুন্তাকাল আখবার এবং এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ নাইলুল আওতার, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৩, বৈরুত: দারুল জাইল। আরো দেখুন: শাইখ শাকিরের তাখরীজ করা মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২৪৬৭ এবং সুনানে আবু দাউদ। আরো দেখুন: আল-মুনযিরী রচিত মুখতাসার সুনানে আবু দাউদ এবং এর সাথে মায়ালিমুস সুনান।
[39] আহমদ তাঁর মুসনাদে (৪/১৪৬, ১৪৭) বর্ণনা করেছেন এবং আবু দাউদ জিহাদ অধ্যায়ে (২৫১৩), তিরমিযী জিহাদ অধ্যায়ে (১৬৩৭) বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন: হাদীসটি হাসান, আর কিছু অনুলিপিতে আছে: হাদীসটি হাসান সহীহ। নাসায়ী জিহাদ অধ্যায়ে (৩৫৭৮) এবং ইবনে মাজাহ জিহাদ অধ্যায়ে (২৮১১) উল্লেখ করেছেন। হাকিম এটিকে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী এর সাথে একমত হয়েছেন। সবগুলো হাদীসই উকবা ইবনে আমের থেকে বর্ণিত। হাফিয আল-ইরাকী ‘এহইয়া উলুমুদ্দীন’ গ্রন্থের তাখরীজ করতে গিয়ে বলেছেন: এই হাদীসটির সনদে ইদতিরাব আছে। মুহাম্মদ গাযালীর ‘ফিকহুস সীরাত’ গ্রন্থের (২২৫) তাখরীজ করতে গিয়ে আলবানী হাদীসটিকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। এছাড়াও হাদীসটিকে তিনি ‘জঈফুল জামিউস সগীর ওয়া যিয়াদাতুহু’ গ্রন্থে (১৭৩২) এবং ‘জঈফ আবু দাউদ’ গ্রন্থে (২৩২) উল্লেখ করেছেন। ইবনে মাজাহ তাঁর সহীহ সংকলনে (২২৬৭) বলেছেন: দুর্বল, কিন্তু “একজন মুসলমানের জন্য তিন ধরনের বিনোদন ছাড়া বাকি সব বাতিল…” অংশটিকে আলাদা করে সহীহ বলেছেন, তবে “কারণ, এগুলোই যথাযথ ও সঠিক” অংশটুকু ছাড়া। হাদীসটিকে তিনি তার ‘আস-সহীহাহ’ গ্রন্থে (৩১৫) উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম নাসায়ীর সুনান গ্রন্থের ‘ইশরাতুন নিসা’ অধ্যায়ে (৫২, ৫৩, ৫৪) উল্লেখিত বর্ণনার উপর নির্ভর করেছেন। এছাড়া ইমাম তাবারানী তাঁর ‘মুজামুল কবীর’ গ্রন্থে যা উল্লেখ করেছেন তার সনদ সম্পর্কে ‘আত-তারগীব’ গ্রন্থে মুনযিরী বলেছেন: জায়্যিদ বা ভালো। আর হায়সামী (৫/২৬৯) বলেছেন: তাবরানীর বর্ণনাকারীগণ সহীহ গ্রন্থের বর্ণনাকারী, শুধু আব্দুল ওয়াহহাব বিন বাখত ব্যতীত।
[40] দেখুন: নাইলুল আওতার, ২/২৭০।
[41] দেখুন: যাবীদীর এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ও তার ব্যাখ্যা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৬৭৫, ৬৭৬।
[42] ইমাম তিরমিযী ফিতান অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন (২২১৩) এবং বলেছেন: এটি গরীব হাদীস। হাদীসটি মুরসাল হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে।
[43] তিরমিযী এটি বর্ণনা করেছেন (২২১২) এবং বলেছেন: এই হাদীসটি গরীব।
[44] শাইখ শোয়াইব ও তার সহযোগীরা মুসনাদে আহমদের তাখরীজ করতে গিয়ে তিনটি সনদেই হাদীসটিকে (২২২৩১) দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। প্রথম সনদের বর্ণনাকারীদের মাঝে সাত্তার বিন হাতিম ও ফারকাদ আস-সুবখীর দুর্বলতা; দ্বিতীয় সনদে ফারকাদের দুর্বলতা ও হাদীসটি মুরসাল হওয়া এবং তৃতীয় সনদে ফারকাদের দুর্বলতা ও হাদীসটি মুদ্বাল হওয়ার কারণে তারা হাদীসটিকে দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
[45] ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদের আবু উমামাহ অধ্যায়ে হাদীসটি (২২২১৮) উবাইদুল্লাহ বিন যাহরের পরিবর্তে ফারাজ বিন ফাদালাহর সনদে উল্লেখ করেছেন। শাইখ শোয়াইব ও তাঁর সহযোগীগণ মুসনাদে আহমদের তাখরীজ করতে গিয়ে বলেছেন: এর সনদটি খুব দুর্বল। ফারাজ বিন ফাদালাহ দুর্বল। আর আলী বিন ইয়াযিদ (যার নিসবত হলো আল-আলহানী) ধীশক্তির দিক থেকে দুর্বল। ৩৬তম খণ্ড, পৃ. ৫৫১, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ সংস্করণ।
[46] ইমাম তিরমিযী তাঁর সংকলনের তাফসীর অধ্যায়ে হাদীসটি (৩১৯৩) উল্লেখ করে বলেছেন: এটি গরীব হাদীস। হাদীসটি আবু উমামার সূত্রে আল-কাসিমের সনদেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সনদের আলী বিন ইয়াযিদকে হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল সাব্যস্ত করা হয়। ইমাম বুখারী বলেছেন: তার বর্ণনা ‘বুয়ূ’ অধ্যায়ে ১৩৮২ নং হাদীসে ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
[47] এটি হলো আগের প্যারায় উল্লেখিত হাদীসের অংশ, যার সনদকে খুব দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
[48] তিরমিযী ফিতান অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, হাদীস নং ২২১১।
[49] তিরমিযী ফিতান অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, হাদীস নং ২২১১।
[50] ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে হাদীসটি তাফসীর অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, হাদীস নং ৩১৯৩।
[51] ইবনে মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন ‘আত-তিজারাত’-এর ‘যেসব জিনিস বেচাকেনা হালাল নয়’ শীর্ষক অধ্যায়ে, হাদীস নং ২১৬৮। হাদীসটি তিনি বর্ণনা করেছেন হাশিম বিন কাসিমের নিজস্ব সনদে, যেটি উবাইদুল্লাহ ইবনে যাহর আল-ইফরিকী পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর তিনি বর্ণনা করেছেন আবু উমামা থেকে। হাদীসটি হলো: “গায়িকাদের ক্রয়-বিক্রয় করা, তাদের রোজগার এবং তাদের মূল্য থেকে কিছু গ্রহণ করাকে আল্লাহর রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন।” এই হাদীসটিও দুর্বল।
[52] দেখুন: মুন্তাকা ও এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ নাইলুল আওতার, ৮/২৬৩, দারুল জাইল সংস্করণ।
[53] দেখুন: ইবনে হাযম কর্তৃক এই হাদীসগুলোকে দুর্বল সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়া এবং পর্যালোচনা, আল-মুহাল্লা, ৯/৫৬-৫৯।
[54] দেখুন: নাইলুল আওতার, ৮/১৬৮।
[55] দেখুন: আদ-দ্বীনু ফী মাওকিফুদ দিফা, পৃ. ২৫৮-২৬৮। বইটির এই অধ্যায় এবং এর আগের অধ্যায়ে লেখক সমাজে গানকে সামঞ্জস্য বিধানের বিভিন্ন প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। পড়ে দেখার মতো একটি গবেষণাকর্ম।
[56] আলবানীর সিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস নং ৪২৭।
[57] দেখুন: মিযযী রচিত তাহযীবুল কামাল, তাহকীক: বাশশার আওয়াদ মারুফ, ১২তম খণ্ড, জীবনী নং ২৬৮৯ এবং এর পাদটীকাসমূহ; ইবনে আবু হাতিম রচিত জারাহ ওয়াত তাদীল, ৪র্থ খণ্ড, জীবনী নং ১৫৬৪; যাহাবী রচিত মীযানুল ইতিদাল, ২/৩৬৫৭ ও আল-মুগনী ফিদ-দুয়াফা, ১ম খণ্ড, জীবনী নং ২৭৩৫; এবং ইবনে হাজার রচিত তাহযীবুত তাহযীব, ৪/৩০৬ ও তাকরীবুত তাহযীব, জীবনী নং ২৭৪৮।
[58] ইবনুল কায়্যিম কর্তৃক উদ্ধৃত হাদীসের সাথে জাবিরের বরাতে তিরমিযীর “জানাইয” অধ্যায়ে (১০০৫) বর্ণিত হাদীসটির শব্দগত পার্থক্য রয়েছে। তিনি মূলত হাকিমের বর্ণনা উদ্ধৃত করে ভুলক্রমে তিরমিযীর রেফারেন্স দিয়েছেন। মানুষ মাত্রই ভুল করে এবং আল্লাহ তায়ালাই কেবল ত্রুটিমুক্ত।
[59] ইগাসাতুল লাহফান, (১/২৭৩)।
[60] যথাযথভাবে মুখস্ত ও লিখে রাখার মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষণ করার বৈশিষ্ট্যকে দাবত বলা হয়। কোনো হাদীস সহীহ বা বিশুদ্ধ হওয়ার পাঁচটি শর্তের মাঝে এটি অন্যতম। — অনুবাদক।
[61] মুসলিম হওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, বোধবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া, ফাসিক না হওয়া, ব্যক্তিত্বের ত্রুটি না থাকা— এই গুণগুলোকে একত্রে বলা হয় আদালত। হাদীস সহীহ বা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য বর্ণনাকারীর মাঝে যে পাঁচটি শর্ত থাকার কথা রয়েছে, তার মধ্যে আদালত অন্যতম। — অনুবাদক।
[62] জাইযুল হাদীস বলা হয় এমন বর্ণনাকারীকে, যার বর্ণিত হাদীস দুর্বল হলেও এতটা দুর্বল নয় যে তার হাদীসকে বর্জন করা হবে। এই পরিভাষাটি জারাহ ওয়াত তাদীলের নামকরা বিশেষজ্ঞ ইমাম আল-ইজলীর চেয়ে বেশি ব্যবহার কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। —অনুবাদক।
[63] কোনো ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোর সনদ ও মতনের বৈপরীত্যগুলো সমন্বয় করা অসম্ভব হয়ে পড়লে সেগুলোকে মুদতারিবুল হাদীস বলা হয়। বর্ণনাকারীর দাবত-এর দুর্বলতার কারণে একে দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। — অনুবাদক।
[64] হাদীসের সনদ ও মতন আগ-পিছ করে ফেলাকে মাকলুব বলে। দুর্বল হওয়ার কারণে এ ধরনের বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত। — অনুবাদক।
[65] তার জীবনী জানতে দেখুন: মীযানুল ইতিকাদ, ৩/৬১৩-৬১৬, জীবনী নং ৭৮২৫।
[66] দেখুন: তাকরীবুত তাহযীব গ্রন্থের জীবনী নং ৬০৭, বৈরুত: মুয়াসসাসাহ রিসালাহ সংস্করণ।
[67] সুনানে আবু দাউদ, আদাব অধ্যায়, হাদীস নং ৪৯২৪।
[68] দেখুন: মুখতাসার সুনানে আবু দাউদ, ৭ম খণ্ড, হাদীস নং ৪৭৫৫।
[69] নাইলুল আওতার, ৮/২৭।
[70] মায়ালিমুস সুনানের সাথে মুখতাসার আবু দাউদ, ৭/১২৮।
[71] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৯২৭। হাদীসটির সনদের মাঝে একজন অজ্ঞাত বর্ণনাকারী রয়েছেন।
[72] দেখুন: সুনানে বায়হাকী, ১০/২২৩। ইবনে আবুদ দুনিয়া ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের ১২ নম্বরে এটিকে মাওকুফ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
[73] আব্দুর রাজ্জাকও তার মুসান্নাফে এমনটাই বর্ণনা করেছেন। খণ্ড: ৪/১১, আছার নং ১৯৭৩৭।
[74] এই যুক্তির সীমাবদ্ধতাসহ এটি হায়তামী তার কাফফুল রিয়ায়ী গ্রন্থে (২০/২৭৯) উল্লেখ করেছেন।
[75] এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, কিতাবুস সিমায়ী, পৃ. ১১৫১, তাবয়াতুশ শায়াব, মিশর।
[76] দেখুন: আত-তারাতীবিল ইদারিয়্যাহ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১২২-১২৩।
[77] আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত মুত্তাফাকুন আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)। এছাড়া লুলু ওয়াল-মারজান ফী মাত্তাফাকা আলাইহিস শায়খান গ্রন্থের ১৮৮৫ নং হাদীসেও এটি বর্ণিত হয়েছে।
[78] ইমাম মুসলিম পোশাক ও সাজসজ্জা অধ্যায়ে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহর (রা.) বরাতে এটি বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং ২০৮৪।
[79] শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ইউসুফ আল-জুদাইয়ী তাঁর ‘আহাদীস যাম্মিল গিনা ওয়াল মায়াযিফ ফীল মীযান’ গ্রন্থের ১৪৫ নং পৃষ্ঠায় বলেছেন, উসমানের (রা.) কথাটি তাবারানী তাঁর মুজামুল কবীর গ্রন্থের ১২৪ নং ক্রমিকে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন: এটি হাসান পর্যায়ের হাদীস।
[80] তিরমিযী হাদীসটি কেয়ামতের বৈশিষ্ট্য অধ্যায়ে আতিয়্যাহ আস-সাদীর (রা.) বরাতে বর্ণনা করেছেন, হাদীস নং ২৪৫৩। এবং বলেছেন: এটি হাসান গরীব। এছাড়া ইবনে মাজাহ যুহ্দ অধ্যায়ে ৪২১৫ নং হাদীস হিসেবে এটি উল্লেখ করেছেন।
[81] দেখুন: এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৮৬।
[82] দেখুন: সুনানে আবু দাউদ, পৃ. ২৩ এবং সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃ. ৫৬।
[83] আহকামুল কোরআন, ৩/১৯৯৪।
[84] এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, ২/২৫।
[85] দেখুন: নাইলুল আওতার, ৮/১৬৯।
[86] ইবনে তাহির (আল-কায়সারানী) রচিত আস-সামাঊ গ্রন্থ, কায়রো: আল-মাজলিসুল আলা লিশ-শুউনিল ইসলামিয়্যাহ সংস্করণ।
[87] দেখুন: আল-মুহাল্লা, ৯/৫৯।
[88] দেখুন: এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৮৫।
[89] এটি প্রকাশিত হয়েছে মাকতাবাতুস সুন্নাহ থেকে, তাহকীক করেছেন রাবী আহমদ খালাফ।
[90] বিভিন্ন যুগে ইসলামের কোনো বিধানের উপর মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদ আলেমদের ঐক্যমত্য সংঘটিত হওয়াকে ইজমা বলা হয়। — অনুবাদক
[91] কাফফুর রিয়ায়ী আন মুহাররামাতিল লাহউ ওয়াস সিমায়ী। আয-যাওয়াজিরের ‘আন ইকতিরাফিল কাবাইর’ বইটিও এতে সংকলিত রয়েছে, (২/২৭৪)।
[92] দেখুন: ইবনুল কায়্যিম রচিত গ্রন্থ “কাশফুল গিতা আন হুকমি সিমায়িল গিনা”, পৃ. ২৬৯।
[93] নাইলুল আওতার: ৮/২৬৪-২৬৬, দারুল জীল, বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত।
[94] ‘সাদ্দ’ শব্দের অর্থ বাধা দেয়া, আর ‘যারায়ী’ শব্দের অর্থ মাধ্যম বা উপকরণ। ফলে সাদ্দে যারায়ীর অর্থ দাঁড়ায়— কোনো মাধ্যম বা উপকরণকে বাধা দেয়া। পারিভাষিক অর্থে— যেসব কাজ, মাধ্যম বা উপকরণ মানুষকে কোনো অন্যায়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে, সেগুলোর উপর শরীয়তসম্মত উপায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সাদ্দে যারায়ী বলে। — অনুবাদক
[95] প্রাচীন পারস্যে মানি নামের একজন ধর্মপ্রচারক এই ধর্ম প্রচার করতেন। এই ধর্মমতে, পৃথিবী অবধারিতভাবে অমঙ্গল, পাপ আর দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তাই পৃথিবীর ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করতে মানুষকে সন্যাসব্রত, তপস্যা গ্রহণ ও বিয়ে না করার আহ্বান জানাতো। — অনুবাদক
[96] হাসান ইবনে আলীর (রা.) বরাতে তিরমিযী হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। হাদীস নং ২৫১৮। তিরমিযীর মতে, হাদীসটি হাসান সহীহ।
[97] আতিয়্যা আস-সাদীর (রা.) বরাতে হাদীসটি তিরমিযী উল্লেখ করেছেন। হাদীস নং ২৪৫১। তিনি বলেছেন: হাদীসটি হাসান।
[98] নাইলুল আওতার, খণ্ড ৮, পৃ. ২৭০-২৭১, দারুল জাইল, বৈরুত।