ইসলামী শরীয়াহর ধারাবাহিকতা, মদীনা সনদ ও উম্মাহর ধারণা
[এডিটর’স নোট: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর ড. আ. ক. ম. আব্দুল কাদের বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একজন ইসলামী স্কলার। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের শরীয়াহ ফ্যাকাল্টির সাবেক ডিন। ২০১৮ সালের ২২ মে চবি ক্যাম্পাসের পাহাড়িকা আবাসিকে অবস্থিত তাঁর বাসায় এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়। তারপর ট্রান্সক্রিপ্টেড কপিতে তিনি কিছু যোজন-বিয়োজন করেন। সেই উপলক্ষ্যে পহেলা আগস্ট ২০১৯ তারিখে আরেক দফা তাঁর সাথে কথা হয়। সর্বশেষ কথপোকথনের আলোকে এই স্ক্রিপ্টটি চূড়ান্ত করে সিএসসিএস-এর পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক।]
মূল সাক্ষাৎকারটি শুনুন এখান থেকে–
দ্বিতীয় দফা কথোপকথনের আলাপ শুনুন এখান থেকে–
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: রাসূল (সা.) মক্কায় যে নবুয়তী কার্যক্রম শুরু করলেন এবং ওহীর নির্দেশ ও নির্দেশনার ভিত্তিতে যে রিফর্ম শুরু করলেন এবং মদীনায় গিয়ে তা সম্পন্ন করলেন, এ বিষয়ে প্রচলিত ধারণার চেয়ে একটু ভিন্ন ধরনের কিছু আইডিয়া আমি আপনার কাছ থেকে পেয়েছি। বিষয়টি আমার পর্যবেক্ষণেও ছিলো, বাট ইউ কনফার্মড ইট প্রিসাইসলি। তারমধ্যে একটি হলো— শরীয়াহর কন্টিনিউশনটা একেবারে অভিনব কিছু নয়। এর অধিকাংশই মক্কায় প্রচলিত ছিলো। কিন্তু সেগুলোর কিছু তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার তিনি করেছেন। এগুলো নতুন করে আনেন নাই। যেমন— সেখানে হজ্ব ছিলো, যাকাতের একটি ফরম্যাট চালু ছিলো, নামাযেরও একটি ফরম্যাট চালু ছিলো, রোযাও এক ধরনের ছিলো। মানে, ইসলাম একেবারে নতুন কোনো কথা বলে নাই। সমাজের মধ্যে যে ভালো দিকগুলো ছিলো, সেগুলোই আসলে সুন্দরভাবে, সিস্টেমেটিক্যালি ইসলামী শরীয়াহর মাধ্যমে এসেছে।
প্রচলিত ধারণা হলো— ইসলাম একেবারে নতুন। ‘জাহেলী যুগের’ সাথে এর কোনো সম্পর্ক নাই। এবং থাকলে তা ইসলামের জন্য ডিসক্রেডিট। অর্থাৎ, ‘জাহেলিয়াত’ থেকে টার্ম নিয়েছে, ‘জাহেলিয়াত’ থেকে রিচুয়াল নিয়েছে, ‘জাহেলী যুগের এক ধরনের কন্টিনিউশন— এমন ধারণা ইসলামের জন্য ডিসক্রেডিট বলে মনে করা হয়।
আ. ক. ম. আব্দুল কাদের:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিলো।”
[সূরা বাকারা: ১৮৩]
কন্টিনিউশন তো এই আয়াত দ্বারাই বুঝা যাচ্ছে।
– তখন উনারা বলবেন, এই কন্টিনিউশন তো ইবরাহীমের (আ.) সাথে সম্পর্কিত। মক্কার লোকদের সাথে তো নয়।
– ঠিক আছে। মক্কার লোকদের সাথে রিলেটেড হলেও, মক্কার লোকেরা আসলে কারা?
– মক্কার লোকদেরকে তো প্যাগান বলা হচ্ছে, মূর্তিপূজক বলা হচ্ছে। এরা এক সময় ইবরাহীমের (আ.) অনুসারী ছিলো বটে, কিন্তু…।
– ঠিক আছে। ইসমাঈলের (আ.) অবস্থান এবং সামগ্রিক কার্যক্রম মক্কাকেন্দ্রিক ছিলো।
– তিনি তো ইন্তেকালও করেছেন সেখানে।
– মক্কাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে সবকিছু যে একেবারে মুছে গেছে, তা নয়। কিছু জিনিস বিকৃত হয়েছে। একটা উদাহরণ দেই। আমরা যে বিচার-আচারে তৃতীয় পক্ষ নিয়ে আসি, সালিস মানি, আরবীতে একে বলে ‘সালেস’ অর্থাৎ, তৃতীয় পক্ষ। মানে, বাদী (মুদ্দা আলাইহি) ও বিবাদী (মুদ্দায়ী) পক্ষের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য যিনি থাকেন, তিনি হলেন ‘সালেস’। এই পদ্ধতিটিকে কোরআন বলছে ‘হাকাম’। মানে, যে চূড়ান্ত ফয়সালা দেবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে, এর ফয়সালা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে— দুই পক্ষ থেকে দুইজন লোক আনবে, যারা তাদের হয়ে কথা বলবে। সূরা নিসার ৩৫ নং আয়াতে আছে— حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا (স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে)। তাহলে ‘হাকাম’ শব্দটি তো তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো, যা কোরআনে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
– কোরআনের এই আয়াতে ‘হাকাম’ শব্দটি যে ইসলামপূর্ব আরব থেকে নেয়া হয়েছে, এর প্রমাণ কী?
– এর প্রমাণ হলো, এই পদ্ধতিটি তাদের মাঝে প্রচলিত ছিলো। ‘হাকাম’ পদ্ধতি তখনকার সমাজব্যবস্থার অংশ ছিলো।
– মানে, সেখানকার ইতিহাস পড়লে আমরা সেটি জানতে পারি?
– হ্যাঁ, তখন আমরা জানতে পারি যে এই সিস্টেমটা ওখানে ছিলো।
– আরবিট্রেশনের ধারণাটা তো সব সমাজের মধ্যেই কমবেশি থাকার কথা…।
– ঠিক আছে। কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলো মানবসমাজের জন্য প্রযোজ্য। ইহুদী, খ্রিষ্টান থেকে শুরু করে সকল সমাজেরই কিছু মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে।
– যেমন, পারিবারিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কিছু বিষয়…।
– যেমন, ইহুদীদের মধ্যে যে ব্যক্তি জায়গা-জমি লগ্নি করে, উৎপাদিত ফসল বা শষ্যের ক্ষেত্রে বর্গাভাগ (যেমন: আল্লাহর রাসূল (সা.) খায়বার যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন ইত্যাদি), সেটার নাম হলো ‘মুখাবারা’ (জায়গা-জমি বর্গা দেয়া)। শব্দটির রুট হলো ‘খাইবার’। মানে খাইবারের সাথে মুখাবারার সম্পর্ক। খাইবারের জমিতে যে নীতি ছিলো সেটাই হলো মুখাবারা। ইসলামও সেটি বহাল রেখেছে।
– খাইবারের ইহুদীরা পরস্পরের সাথে এটা করতো?
– হ্যাঁ। ইসলাম এটাকে বাতিল করেনি। যেমন: পুত্র সন্তানদের খৎনা। এটি ইবরাহীমের (আ.) সময় থেকে চলে আসছে। আরবদের মধ্যেও এটি প্রচলিত ছিলো। ওদের মধ্যে অনেক জাহেলিয়াত থাকার পরেও কিন্তু খৎনা সিস্টেম তারা বাতিল করেনি। সেই খৎনার বিধান ইসলামও গ্রহণ করেছে।
যেমন, কুরবানী আদমের (আ.) সন্তানদের সময় থেকে প্রচলিত। আল-কোরআনে এর বিবরণ আছে। পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে ইবরাহীমের (আ.) সময় থেকে।
এসবের অর্থ হলো, যদি বলা হয়— ইসলাম হঠাৎ করে আসা একটি ধর্ম, তাহলে যুগে যুগে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধারাবাহিকতাকে কাট-আপ করে ফেলতে হবে। অথচ প্রত্যেকে নতুন শরীয়ত নিয়ে এসেছে। শরীয়ত তো নতুন নয়, এটি আল্লাহ প্রদত্ত। যুগের পরিবর্তন, কালের পরিবর্তনের কারণে বিধানের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ধরনের সংযোজন…।
– কিছু বেশকম হয়েছে। সংযোজন–বিয়োজন হয়েছে।
– হয়েছে। কিন্তু…
– মূল কাঠামো ঠিক ছিলো।
– অবশ্যই ঠিক ছিলো। কারণ, তাওহীদের কাঠামোর তো পরিবর্তন হয়নি।
– রোযার কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন। এছাড়া যাকাত, নামায, হজ্ব তো জাহেলী যুগেই ছিলো। নাকি?
– যাকাতের বিষয়ে কোরআনে অনেকগুলো আয়াত আছে। যেগুলোতে প্রত্যেক নবী-রাসূলকে যাকাত দিতে বলা হয়েছে।
– তাহলে ‘বুনিয়াল ইসলামু আলা খামসিন’ শীর্ষক উমর ইবনুল খাত্তাবের (রা.) যে বিখ্যাত হাদীস বা হাদীসে জিবরীলের মধ্যেও যেটা আছে— ইসলাম কী বলুন…।
– ইসলাম কী? ঈমান কী? ইত্যাদি…
– জ্বি। তো, এখন এই পঞ্চস্তম্ভ, বলা যায়, এটি…
– ইসলাম তো মুহাম্মদের (সা.) সময় থেকে চালু হয়েছে, এমন নয়। ‘হুয়া সাম্মাকুমুল মুসলিমীন’ আয়াতটি তো আগে থেকেই চলে আসছে।
– ইবরাহীমের (আ.) সময় থেকে?
– হুম।
– আচ্ছা, আমরা যদি ইবরাহীমের (আ.) পূর্ববর্তী যুগের কথা বলি, তাহলে সেখানকার ব্যাপারে কী হবে?
– সে ব্যাপারে কথা হলো, সর্বপ্রথম কিতাব নাযিল হয়েছে বা শরীয়ত এসেছে নুহের (আ.) উপর। তার আগ পর্যন্ত শুধু তাওহীদী কনসেপ্ট ছিলো। মানে তাওহীদ মানতে হবে, রাসূল মানতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাপকভিত্তিতে শরীয়ত এসেছে নুহের (আ.) সময় থেকে।
– নিজেদের মতো করে জীবনযাপনের জন্য যা কিছু করণীয় ছিলো…
– এই যে ‘মারুফ’ বা ‘মুনকার’ বলা হয়, এগুলো প্রত্যেক যুগে ছিলো। মারুফ মানে কী? এর শাব্দিক অর্থ হলো পরিচিত। অর্থাৎ সমাজে যে কাজগুলো ভালো হিসেবে পরিচিত।
– কিন্তু পরিভাষাগত অর্থ কী হবে?
– পরিভাষাগত অর্থে মারুফ তো মারুফই। মারুফ মানে যেটি ‘উরুফ’। মারুফের সাথে উরুফের সম্পর্ক। উরুফ মানে হলো কাস্টমস বা usage।
– ও, আচ্ছা, উরুফ? উরুফ শব্দটি আমি প্রথম শুনেছি (প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক) খতিবী স্যারের কাছ থেকে, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া প্রসঙ্গে। আর্টস ফ্যাকাল্টির লাউঞ্জে এসে অজু করে এক কোনার সোফায় তিনি সাধারণত বসতেন। তারপর শহরের গাড়ি ধরার জন্য চলে যেতেন। এই ফাঁকে আমি উনার সাথে কথা বলতাম। একদিন বললাম, ‘স্যার, এই যে এরা শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেয়, এটা তো হারাম।’ এ কথা বলার সাথে সাথে তিনি আমার দিকে এমন করে তাকালেন, যেন আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। বললেন, ‘তোমাকে কে বলেছে এটা হারাম?’ আমি বললাম, ‘স্যার, এটা তো আমার কাছে হারামই মনে হয়।’
তিনি বললেন, ‘না, হারাম হওয়ার জন্য ‘নস’ থাকা শর্ত। সেটা এখানে নাই।’ তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে এটি কী?’ তিনি বললেন, ‘এটা একটা উরুফ বা সামাজিক প্রথা। তবে এটা একটা বাজে বা খারাপ সামাজিক প্রথা। এটা থেকে বেঁচে থাকাই ভালো। কিন্তু হারাম বলার জন্য তো অকাট্য দলীল লাগবে।’
তো, নস এবং উরুফ শব্দ দুটি আমি উনার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছি।
– উরুফের সাথে মারুফের সম্পর্ক।
– উরুফ তো নাকি শরীয়াহর উৎসগুলোর একটি?
– উরুফ দুই রকম। উরুফে আম এবং উরুফে খাস। শরীয়তের বিধানগুলো মানার ক্ষেত্রে যে প্রমাণগুলো আমরা গ্রহণ করি — কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস, ইজতিহাদ — সেখানে কিন্তু উরুফও অন্তর্ভুক্ত। ‘আল-উরফু ওয়াল-আদালাতু ওয়াত-তাকালীদ’— বর্তমান স্কলারগণ এই তিনটা শব্দ এনেছেন।
শরীয়তের গ্রহণযোগ্যতার জন্য এই তিনটা শব্দ স্কলারগণ বের করেছেন। তাহলে উরুফ মানে কী? উরুফ মানে হলো, ওই যে, যেটা পছন্দ, ভালো জিনিস হিসাবে। এই উরুফ থেকেই কিন্তু মারুফ।
– আমরা যে লোকাচার একটা শব্দ বলি…।
– এগুলোই আরকি। বাবাকে ‘আপনি’ বলতে হবে। ‘তুমি’ সম্বোধন করলে বেয়াদবি হবে। এসব তো কোনো কিতাবে নাই। তুমি খুঁজে পাবে না। আরবীতে তো ‘তুমি’ সর্বনামটাই নাই। আছে ‘আনতা’। তো, এই লোকাচারগুলোই উরুফ।
– তাহলে এটারও কি শরয়ী মর্যাদা আছে?
– হ্যাঁ, আছে। ওয়াহহাব আয-যুহাইলী, শাইখ আবু যাহরাহ, আব্দুল ওয়াহহাব খাল্লাফসহ সকল ইসলামিক স্কলার উরুফকে ইসলামী শরীয়তের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মদীনা সনদেও অনেকবার উরুফ তথা প্রথার স্বীকৃতি বিষয়ক প্রসঙ্গ দেখা যায়।
উরুফের শরয়ী মর্যাদা না থাকলে আরবদের প্রচলিত যেসব ধারণা শরীয়তে এসেছে, সেগুলো তো টিকবে না। যেমন: হজ্ব আরবরাও করতো। তবে তারা উলঙ্গ হয়ে করতো। ইসলাম এসে হজ্বের নির্দিষ্ট কাপড় ঠিক করে দিয়েছে। পরিবর্তনগুলো এভাবে হয়েছে। তারপর, ওরা সালাত আদায় করতো হয়তো দেবদেবীর জন্য, সূর্যোদয়ের সময় সূর্যকে পূজা করার জন্য। কিন্তু ইসলামে সালাত হলো আল্লাহর জন্য। এবং যাকাতের বিধানের ব্যাপারে তো বললাম, এটি বিভিন্ন যুগে ছিলো। আমি কয়েকদিন আগে রিবা নিয়ে পড়েছি। রিবার উপর পড়তে গিয়ে দেখলাম, প্লেটো-এরিস্টটলরাও রিবা নিয়ে কথা বলেছেন। অর্থাৎ, তৎকালীন সমাজে রিবার ব্যাপক প্রচলন ছিলো, এগুলো যে শোষণের হাতিয়ার, তা দেখে তাঁরা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
– তখনকার জ্ঞানীগুণী, চিন্তাবিদগণ এগুলো নিয়ে নানাভাবে প্রতিক্রিয়া বা…।
– প্রতিক্রিয়া মানে, তাঁরা এর বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন যে এগুলো সোশ্যাল ইনজাস্টিস। এর অর্থ হলো, এই রিবার ক্ষেত্রেও…।
– তাহলে তো স্যার, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হওয়ার মতো অবস্থা! মানুষের ভেতরের যে অন্তর্গত একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য, সেটা তো তাহলে দেখা যাচ্ছে সবসময়ই…।
– এটাই হলো মূলধর্ম বা স্বভাবধর্ম। কীভাবে? সেটি তোমাকে বলি। মূর্তি ভাঙ্গার পরে ইবরাহীম (আ.) তো লুকিয়ে ছিলেন। আট বছর বয়সে। সেখান থেকে তিনি বের হলেন। বেরিয়ে প্রথম কী দেখলেন? তারকা। তিনি সন্ধ্যার পশ্চিমাকাশে জ্বলজ্বলে তারকা দেখতে পেলেন। এবং বললেন— ‘হাযা রাব্বী’ (এটাই আমার রব)। এর উপর তিনি অটল আছেন। কিছুক্ষণ পর গভীর রাতে যখন আকাশে বড় চাঁদ উঠলো, তখন তিনি বলে উঠলেন, তাহলে ওইটা তো রব নয়, ওইটা ছোট, ‘হাযা রাব্বী’ (এটাই আমার রব)। এরপর চাঁদও যখন ডুবে গেলো, রাত পোহালো, দিন হলো। এরপর যখন সকালবেলা প্রচণ্ড উত্তাপ নিয়ে সূর্য উঠলো, তখন তিনি বলে ওঠলেন— ‘হাযা রাব্বী, হাযা আকবর’।
তাহলে তুমি যেটা বললা, এই যে মানুষের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা বা ইনকুইজেটিভনেস, এটি তো সবসময় ছিলো।
– তাহলে স্যার, মাঝখানে একটা কথা যদি বলে ফেলি। ইবরাহীম (আ.) কি অন্তত একদিনের জন্য হলেও শিরক করেছিলেন?
– না, তিনি শরীক করেন নাই। তিনি তখন তাওহীদ অন্বেষণ করছিলেন। তুমি এটাকে শিরক বলতে পারো না। যেমন: বাংলাদেশের লোকেরা কী সন্তুষ্টচিত্তে ব্রিটিশদের শাসন মেনে নিয়েছিলো?
– না, এটি একটি প্রসেসে আসছে আরকি…।
– প্রসেসে মেনে নেয়নি। বরং তারা পথ খুঁজছিলো কীভাবে এই গোলামি হতে বের হওয়া যায়। সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছে, এটা হয়েছে, সেটা হয়েছে। তারপর তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা হয়েছে। তাহলে বুঝা গেলো, এরা মেনে নেয়নি। বরং…।
– না, কোনো একটা অবস্থায় তো অন্য আরেকটা অবস্থা পেরিয়ে আসতে হয়। মানে, লাফ দিয়ে তো কোনো কিছু ঘটে না।
– তাহলে ‘তিনি শিরক করেছেন’ নয়, বরং বলতে হবে তাওহীদের জার্নিতে ছিলেন, জার্নির পথে প্রথম যেটা পেয়েছেন সেটাকে…। এবং এই জার্নিতে থাকার কারণে ওই সময় যদি তাঁর মৃত্যুও ঘটতো, তাহলেও উনাকে মুশরিক বলার সুযোগ ছিলো না। কারণ, তিনি তো একক সত্তাকে তালাশ করছিলেন।
– এই প্রসঙ্গে তাহলে এ কথাটাও চলে আসে। দূরের কোনো এলাকায়, যেখানে কোনো সত্যের বাণী পৌঁছেনি এবং কারো কুফুরী করার সুযোগও হয় নাই। তারা প্রাকৃতিক জীবনযাপন করে…
– “রাজুলুন মা’তা ‘আলা শাহিকিল জাবালি” কথাটি কিতাবেই আছে।
– কোন কিতাবে?
– প্রায় কিতাবেই আছে। আগের কিতাবগুলোতে আছে। আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবেই আছে। ইমাম আবু হানীফার (রহ.) ‘ফিকহুল আকবর’ কিতাবটির ব্যাখ্যা গ্রন্থে মোল্লা আলী কারীসহ অনেক প্রাচীন স্কলার এ বিষয়ে মত দিয়েছেন।
এ কথার মানে হলো— কোনো লোক যদি পাহাড়ের চূড়ায় মারা যায়, যেখানে রাসূল পৌঁছেনি, কিতাব পৌঁছেনি, রিমোট অঞ্চল, তুমি যেমনটা বললা, এমতাবস্থায় হাশরের ময়দানে তাকে রেসালাত বা নামায সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তাকে কেবল এই প্রশ্নটি করা হবে, ‘তুমি এত নেয়ামত ভোগ করেছো। তোমার মাথায় কি একবারও আসেনি, এগুলো কে তৈরি করলো?’ এই প্রশ্নের ইতিবাচক ও সঠিক উত্তর দিতে পারলে সে নাজাত পেয়ে যাবে।
– মানে তাওহীদকেন্দ্রিক যে কোর কনসেপ্ট, ওইটা…
– এর কারণ হলো, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ইনটুইশন দিয়েছেন, আক্বল দিয়েছেন। “ওয়াল ‘আক্বলু হুনাকা বিমাজাতিল ওয়াহী”— এখানে আক্বলকে ওহীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
– এটা কীসের কথা?
– এটি হলো আমরা আকাইদের যেসব কিতাব পড়েছি, সেখানকার কথা।
– এই কথাগুলোর ভিত্তি কি কোরআন–হাদীসের মধ্যে আছে?
– না, কোরআন-হাদীসে (সরাসরি) নেই। মানে, এমন হতে পারে…
– মানে, তাঁরা স্টাডি করে এমনটা চিন্তা করেছেন…
– মানে, এমনটা হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি আছে না? এখনও তো বহু জায়গায় এমনটা আছে। সেক্ষেত্রে তাহলে তাদেরকে পরকালে কী প্রশ্ন করা হবে? তখন স্কলারগণ সমাধান বের করলেন যে সেখানে যেহেতু মানুষ আক্বল দিয়ে…। ইবরাহীম (আ.) তো আক্বল দিয়েই কাজ করেছেন। কোরআনে তো আক্বলকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘লা’য়াল্লাকুম তা’কিলূন’ (যাতে তারা আক্বলকে কাজে লাগাতে পারে)। এ ধরনের অনেক আয়াত পবিত্র কোরআনে বিদ্যমান। আমরা এও জানি, ইবাদত কার্যকর হওয়া ও সম্পন্ন করার জন্যও আক্বল বা সুস্থ বিবেকবুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞান থাকা শর্ত।
– সমকালীন ইসলামী দর্শন পড়াতে গিয়ে আমি এক সময় শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী হতে কিছু অংশ পড়াতাম। JN Jalbani’র ‘Teachings of Shah Waliullah of Delhi’ বইটা হতে। তখন দেখেছি তিনি বলেছেন, জাহান্নামে চিরদিন থাকার যে কথা কোরআনে বলা হয়েছে, সেটা শুধু কাফেরদের জন্য প্রযোজ্য, যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। তিনি বলেছেন, এমনকি যাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়া হয় নাই, যাদেরকে ইগনোর করা হয়েছে, যারা দাওয়াত দানকারীদের দ্বারা মিসলিড হয়েছে, তাদেরকেও আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দিবেন।
– “ফামাই ইয়া’মাল মিসকা’লা যাররাতিন খাইরাইয়ারাহ” (সামান্য ভালো কাজ করলেও এর প্রতিদান সে পাবে) — এটা তো কোরআনেরই কথা। এখানে এই সেন্সের কথাই বলা হচ্ছে।
– কিন্তু আবার আরেকটা হাদীসে আছে না হাতেম তাঈ সম্পর্কে? উনার ছেলে জিজ্ঞেস করেছিলো— আমার বাবা তো এ রকম অনেক ভালো কাজ করেছে। এগুলোর কী হবে? তাকে জবাব দেয়া হয়েছে— সে দুনিয়াতেই যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। আখেরাতে কিছু পাবে না।
– এর কারণ হলো, সে তো তখন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য খরচ করেনি। তার খরচটা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতো…। তার মধ্যে তো সোশ্যাল স্বীকৃতি পাওয়ার ইয়ে ছিলো। এই ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলকে (সা.) যখন জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি বললেন— তার কাজের মাধ্যমে মনে হচ্ছে সে মুসলিম ছিলো, কিন্তু আকীদায় ঈমান তো ছিলো না। সে সামাজিকভাবে…। যেমন: হাদীসে তিনজন লোকের ব্যাপারে বলা হয়েছে, একজন শহীদ, একজন আলেম ও একজন দানশীল ব্যক্তি, যারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তের পরিবর্তে মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য নিজেদের অর্জনকে ব্যবহার করে। ওইটার সাথে এর কিছুটা সম্পর্ক আছে।
তোমাকে একটা নতুন তথ্য দেই। আমি ছাত্রজীবনে কাদিয়ানীদের কিছু বই পড়তাম। ওই যে আমাদের চবি শাহজালাল হলে কিছু কাদিয়ানী ছিলো, ২/৩ জন। এদের একজনের নাম ছিল মসীহ। তো, ওরা একসময় আমার সাথে ডিবেটে আসলো। ডিবেটে তারা হেরে যায়। এরপর তারা তাদের ঊর্ধ্বতনদের কাছে রিপোর্ট করেছে। তারপর থেকে তারা আমার নামে (ডাকযোগে) তাদের বহু ‘রিসালাহ’ পাঠিয়েছে। রিসালাহ হলো কাদিয়ানীদের (আহমদিয়া) পত্রিকা। হয়তো এখনো আসছে। আমি ঠিক জানি না। কারণ, আমি তো এখন আর ওখানে থাকি না।
যা হোক, তাদের রিসালাহর মধ্যে আমি দেখলাম, ওদের মতে, কাফেররাও আজীবন জাহান্নামে থাকবে না। এটা ওদের আকীদা। কেন থাকবে না? আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘ফা’আম্মা মান খাফ্ফাত মাওয়াজিনুহু ফা উম্মুহু হাওয়িয়াহ’ — যে ব্যক্তির নেকির পাল্লা হালকা হবে তার ‘উম্’ হবে ‘হাবিয়া’। ‘উম্’ কী? উম্ম মানে মা। মানুষ উম্ম বা মায়ের পেটে থাকে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত। তাহলে আল্লাহ তায়ালা ‘উম’ শব্দ ব্যবহার করে বুঝাচ্ছেন, একটা সন্তান মায়ের পেটে ‘আবাদান আবাদ’ (চিরদিন) থাকে না। এটা কাদিয়ানীদের দলীল। কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো এই কথাটা। যদিও এ ব্যাপারে ইসলামের মত হলো স্বতন্ত্র।
– আরেকটা বিষয়। আপনার কাছ থেকেই এটি প্রথম জানতে পারি। এছাড়া ‘রাসূলের (সা.) যুগে মদীনার সমাজ’ বইটাসহ মদীনা সনদ নিয়ে নানা ধরনের পড়াশোনা করে যা জানতে পেরেছি, সেটা আমাদের পপুলার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে ভিন্ন রকম। সেটি হলো, মুহাম্মদ (সা.) যখন মদীনায় হিজরত করলেন, তখন আরব, হালিফ ও মাওয়ালীসহ সবমিলিয়ে মদীনার জনসংখ্যা ছিলো হাজার দশেক। তারমধ্যে হিজরতের প্রথম দিকে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো ৭/৮ শত বা সর্বোচ্চ হাজারখানেক, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ। এর মানে হলো মদীনায় মুসলমানরা তখন ছিলো সংখ্যালঘু।
কিন্তু লোকেরা তো মনে করে, ইসলামী রাষ্ট্র মানে হলো মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্র। যেখানে প্রায় সবাই থাকবে মুসলমান। অথচ দেখা যাচ্ছে, তৎকালীন মদীনায় মুসলমানরা ছিলো মোট জনসংখ্যার দশভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ, অত্যন্ত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু।
কিছুদিন আগেও আমাকে একজন কলিগ জিজ্ঞেস করেছেন, দশভাগের বাকি নয় ভাগ সংখ্যাগুরু অমুসলিমরা কেন মুহাম্মদকে (সা.) শাসনকর্তা হিসেবে মেনে নিয়েছিলো? তারা যদি তাঁকে নবী হিসেবে মেনে থাকে, তাহলে তো they were expected to be counted as Muslims. কিন্তু তারা তো মুসলিম ছিলো না। তাহলে তারা কেন তাঁকে মানলো? আর তারা যদি তাঁকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে না মেনে জনপদের নেতা হিসেবে, অর্থাৎ আমরা পলিটিক্যাল লিডার বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বলতে যা বুঝাই সে হিসেবে তাঁর নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে থাকে, তাহলে তো এটা এক ধরনের সেক্যুলার ফরম্যাটই হলো। যেমন, উনার ধর্মীয় বিধানগুলো উনার অনুসারীরাই শুধু মানবে। কিন্তু দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি বা সামাজিক ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু তিনি বলবেন, সেগুলো উনার অনুসারী কিংবা অনুসারী নয় এমন সবাই মানবে। তাহলে আমরা সেক্যুলার ফরম্যাট বলতে এখন যা বুঝি, এটি তো তেমন ধরনেরই একটা ব্যাপার হলো। তাই নয় কি?
– চমৎকার একটি পয়েন্ট তুমি বলেছো। এটি নিয়ে আমি লিখেছি, যদিও এই পয়েন্টটিকে তেমন হাইলাইট করি নাই। আমার একটি পেপার সীরাত বিশ্বকোষে প্রকাশিত হয়েছে। বনু কাইনুকা গোত্র নিয়ে লিখতে গিয়ে সম্ভবত এই কথাটা আমি হাইলাইট করেছি। চবি ল জার্নালে প্রকাশিত আমার একটা গবেষণা প্রবন্ধেও মদীনা সনদ নিয়ে কিছু আলোচনা এনেছি।
– ওদেরকে যেহেতু বহিস্কার করা হয়েছে, তাই সনদের প্রসঙ্গ তো আসবেই। ওদেরকে বহিস্কার করা হয়েছে না?
– আমি যে বিষয়টা বলতে চেয়েছি সেটি হলো, আল্লাহর রাসূল (সা.) কোন প্রেক্ষাপটে মদীনায় আসলেন? আরো কোথায় কোথায় যেন লিখেছি, এখন ঠিক মনে নাই।
– আকাবার শপথে নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি যে, তাঁকে নিরাপত্তা দেয়া হবে, নেতা হিসেবে মানা হবে? Actually, he became leader before he migrated.
– কিন্তু সেটা কেন হয়েছে, সে কথাটাও আমি লিখেছি। এখন মুশকিল হলো, লেখা তো অনেকগুলো হয়েছে…।
– আমার ধারণা হলো, মদীনার ইহুদীরা বলতো— আমাদের নবী আসার সময় হয়েছে, তিনি এলে তখন আমরাই নেতৃত্ব দেবো। তখন পর্যন্ত তো তারা আউস–খাযরাজের আশ্রিত গোত্র ছিলো। তারপর মদীনার লোকেরা মক্কায় হজ্ব করতে গিয়ে যখন শুনলো, একজন নবুয়তের দাবি করছে; তখন তারা যাচাই করে দাবিকে সঠিক পেয়ে আগেভাবেই নবীর…।
– প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিজস্ব স্বার্থ চিন্তা করেছে।
– এমনকি আব্বাস (রা.) নিজে মুসলমান হওয়ার আগেই তো কোনো একটি আকাবার শপথের রাতে অংশগ্রহণ করে বলেছিলেন— আমার ভাতিজাকে যে তোমরা নিতে চাচ্ছো, পুরো আরব কিন্তু তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তোমরা তাকে নিরাপত্তা দিতে পারবা কিনা।
– হ্যাঁ, তিনি এটা বলেছিলেন।
– তারমানে আমরা যেভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখি, ব্যাপারটা সে রকম ছিলো না।
– হ্যাঁ, সে রকম ছিলো না।
– কারণ, সেক্ষেত্রে আব্বাস কেন তাহলে মধ্যস্থতা করতে যাবেন?
– শুধু তাই নয়, উনার যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা (political sagacity) ছিলো সেটি হলো— এই যে আরবদের অর্থাৎ, মক্কার লোকদের শতভাগ আয়ের উৎস ছিলো ব্যবসাকেন্দ্রিক, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট। কী এক্সপোর্ট করতো? ওই যে পশু পালন, পশুর চামড়া, এটা, ওটা। আর ইমপোর্ট করতো কী? মক্কায় খেজুর গাছ খুব কম ছিলো। এখনো কম হয়। কিছু গম-টম হতো। বাইরে থেকে খাবার, গার্মেন্টস জাতীয় পণ্য, সমরাস্ত্র এগুলো তারা নিয়ে আসতো। এগুলো হলো তাদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের পণ্য সামগ্রী।
যা হোক, ব্যবসার প্রতি তাদের এই শতভাগ নির্ভরতার কারণে পলিটিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে হিজরতের জন্য মদীনাকেই উপযুক্ত স্থান বলে তাঁর মনে হলো। তিনি চিন্তা করলেন, মদীনা ইচ্ছা করলে মক্কাকে কলাপ্স করে দিতে পারে। তৎকালীন সময়ে ‘রিহলাতাশ শিতা-ই ওয়াস সাইফ’ (শীত ও গ্রীষ্মকালীন বাণিজ্য সফর) ছিলো ইয়েমেন, তায়েফ ও সিরিয়া তথা শামকেন্দ্রিক। আল্লাহর রাসূল (সা.) দুইবার শাম দেশে গিয়েছিলেন। আর শামে যাওয়ার বড় পথ হলো মদীনার পার্শ্বস্থ পথ। মদীনার এই পথ দিয়ে শামে যেতে হয়।
– হ্যাঁ, তিনি তো খাদীজা (রা.) কর্তৃক নিয়োগকৃত কর্মকর্তা হিসেবে গিয়েছিলেন। সে হিসেবে ওই রুটগুলোর তাৎপর্য তাঁর জানা ছিলো।
– নিছক একজন ধর্মীয় হুজুর বা মাওলানা সাহেবকে দাওয়াত দিয়েছে, আর তিনি মদীনায় চলে গেছেন— ব্যাপারটা সে রকম ছিলো না।
– কিংবা, এখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন…।
– না, না, এ রকম ছিলো না। এটা একটা বিশাল প্ল্যান ছিলো। আর ইহুদীদের একটা মতলব ছিলো। মদীনায় তিনটা গ্রুপ ছিলো। একটা গ্রুপ তো মুসলমান হলো। আরেকটা গ্রুপ ছিলো, যারা ধর্মকর্ম মানতো না। ওই যে জাপানী বা অন্যদের মতো। এ রকম একটা গ্রুপ ছিলো। আরেকটা গ্রুপ ছিলো হানীফ ধর্মের অনুসারী। দ্বীনে হানীফের অনুসারী। এদের মধ্য থেকেই বিশাল একটা সংখ্যা মুসলমান হয়ে গেলো। আর কিছু ইহুদী ছিলো। ইহুদীদের দুই/তিনটা মতলব ছিলো।
একটা হলো: নবী এবং রাসূল যে আসছেন, তাঁকে যদি আমরা আগে থেকেই ক্যাপচার করতে পারি, তাহলে তা আমাদের জন্য লাভজনক হবে।
দুই নম্বর লাভ হলো: নবী যেখানে যায়, সেখানে একটা সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাতে আমাদের ব্যবসায়িক প্রফিট হবে। এরা তো ব্যবসায়ী জাতি।
– মানে, নবী আমাদের হলে আমরাই সবকিছু হবো?
– আমাদের দেশে গ্রামে একটা মাহফিলেও আমরা সেটা দেখি তো। যেখানে মাহফিল হয়, সেখানে বুটওয়ালা, বাদামওয়ালা এসে হাজির। যেখানে মানুষ যাবে, সেখানে ব্যবসা জমবে। অতএব, নবীকে কেন্দ্র করে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠবে, এতে করে তাদের বিজনেস বাড়বে।
তিন নম্বর ব্যাপার হলো: আউস-খাযরাজের দ্বন্দ্বের ব্যাপারে তারা চিন্তা করলো, দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য তিনি শান্তির বাণী নিয়ে আসছেন, এই শান্তি আমাদের দরকার, যুদ্ধ করতে আমরা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে গেছি। এই তিনটা টার্গেট ছিলো তাদের।
– আউস–খাযরাজের মধ্যে কি ফরমাল কোনো যুদ্ধ চলছিলো?
– যথেষ্ট, দীর্ঘদিন। এবং এটা থামানোর জন্যও কোনো মধ্যস্ততা…।
– ওরাই তো নেটিভ ছিলো। আচ্ছা, ওরা…।
– এবং এদেরকে আবার তাল দিতো ইহুদীরা।
– আচ্ছা, ইহুদীদের তো তিনটি গোত্র: বনু কাইনুকা, বনু নজীর এবং…?
– বনু কোরাইযা। এই তিনটা হলো বড় গোত্র।
– তারমানে, আরো ছোট গোত্র ছিলো?
– ছোট গোত্রের নাম তুমি ইয়ের মধ্যে দেখতে পাবা। মদীনা সনদে তো ১০/১২টা গোত্রের নাম আছে।
– আচ্ছা, সেখানে তাহলে নাম উল্লেখ করা আছে?
– সবগুলো আছে। কিন্তু মদীনা সনদে বনু কাইনুকা, বনু কোরাইযা ও বনু নজীরের নাম কিন্তু নাই। এটা খুবই সিগনিফিকেন্ট। অথচ এই তিন গোত্র ছিলো সবচেয়ে বড় গোত্র।
– কিন্তু এর কারণ তো বোধহয় এটাই যে এই তিনটা গোত্র আউস ও খাযরাজের আশ্রিত ছিলো।
– মানে হালিফ। হালিফ মানে হলো ওদের সাথে এটাচড।
– হ্যাঁ, নিরাপত্তা চুক্তি। চুক্তিতে বলা আছে, এরা হলো একটি পক্ষ এবং এদের অধীনে যারা আছে, তারাও এদের মধ্যে ইনক্লুডেড হবে।
– সে কথাই বলছি। এত বড় গোত্র হওয়া সত্ত্বেও ওদের নাম কিন্তু ওখানে নেই। কেন নাই? যেহেতু তারা ছিলো হালিফ। হালিফ মানে হলো হেল্প করার চুক্তিতে…।
– মানে মিত্রচুক্তির অধীনে…।
– ইংরেজি help শব্দটি কিন্তু আরবী হালিফ শব্দ থেকে এসেছে। হেল্প মানে কী? আমি তোমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।
– আচ্ছা, এখানে আরেকটা ব্যাপার খুব সিগনিফিকেন্ট। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে যে আউস–খাযরাজের লোকেরা রাজা বানানোর জন্য প্ল্যান–প্রোগ্রাম করেছিলো, মুকুট বানিয়েছিলো, বা এ রকম কিছু একটার বর্ণনা আমরা পাই। প্রথমে এটি অথেন্টিক কিনা, সেটি বলবেন। যদি অথেন্টিক হয়ে থাকে, একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তো আপনার পড়াশোনা আছে, সমগ্র আরবের কোথাও তো কিংশিপ ছিলো না। রোমান বা পারস্য সাম্রাজ্যের মতো আরব অঞ্চলে তো কোনো রাজা–বাদশা ছিলো না। আরবে ছিলো গোত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
– শেখ ছিলো আরকি। গোত্রের শেখ বা গোত্রপ্রধান।
– গোত্রের আইডেন্টিটিই হচ্ছে সেখানকার হাইয়েস্ট পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি। এটা থেকে তারা আরেকটা ফেজে যেতে চাইলে তো তা কিংশিপে যাওয়ার কথা। এবং রাসূল (সা.) সেখানে গিয়ে এই কিংশিপ বাদ দিয়ে একটা উম্মাহ সিস্টেম স্টাবলিশ করলেন। কিংশিপও কিন্তু গোত্রপ্রথা নয়, উম্মাহও গোত্রপ্রথা নয়।
– উম্মাহর তো অনেকগুলো অর্থ আছে।
– হ্যাঁ, মদীনা সনদের মধ্যে প্রথমদিকে উম্মাহ যেভাবে আছে, তাতে এটি একটি…।
– বহুজাতিক রাষ্ট্রের মতো।
– বহুজাতিক রাষ্ট্র। আর মুসলিম উম্মাহ বা ধর্মীয় উম্মাহ বলতে আমরা যেটি বুঝি, সেটি তো আলাদা জিনিস। তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের এই ঘটনাটা কি সঠিক?
– ইবনে হিশাম তো এভাবেই লিখেছেন।
– এটা আবার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করা হয়েছে কিনা? সীরাতে তো অনেক কিছু এক্সাজারেটেড হয়েছে।
– ইবনে হিশাম লিখেছেন, তাকে রাজা করে মুকুট বানানো…। রাজত্ব সিস্টেমের পরিবর্তে বরং তিনটা গোত্রের সমন্বিত লিডার হিসেবে আমরা এটাকে মূল্যায়ন করতে পারি। রাজতন্ত্রের ধারণা আলাদা ব্যাপার।
– তিনটা মানে কী? দুইটা না?
– আউস এবং খাযরাজ। এর সাথে ইহুদীরা যুক্ত হয়েছে।
– কিন্তু ইহুদীদের কোনো গোত্র তো আউসের সাথে, কোনোটা খাযরাজের সাথে– এভাবে ভাগাভাগি করে ছিলো।
– কারণ হলো, ইহুদীরা এখানকার আদি অধিবাসী নয়। বাইরে থেকে আসার কারণে এই লোকগুলো আরবের নিয়ম অনুযায়ী কারো না কারো সাথে এটাচড থাকতে হবে। এদেরকে দুইভাবে এটাচড করা হয়েছে। কাউকে মাওয়ালী, কাউকে হালিফ। মাওয়ালীরা নন-আরব। বাইরে থেকে এসে কারো সাথে এটাচড হয়েছে। মাওয়ালী শব্দটা কোরআনে আছে।
– তাহলে মাওয়ালীর রুট হচ্ছে মাওলা।
– হ্যাঁ। মাওলা শব্দের অনেকগুলো অর্থ। এর মধ্যে একটা অর্থ হলো আশ্রিত।
– মাওলার অর্থ আশ্রিত, নাকি আশ্রয়দাতা?
– আশ্রয়দাতা, চাচাতো ভাই, মুনিব, লিডার। মাওলার অনেকগুলো অর্থ। আমাদের দেশে মৌলভী, মাওলানা শব্দগুলোও মাওলা শব্দের সাথে রিলেটেড।
– তাহলে মাওয়ালীর অর্থ কী হবে?
– মাওয়ালীর অর্থ এখানে আশ্রিত। মাওলা শব্দের ১২টি অর্থ আছে। এমনকি চাচাতো ভাইও এর একটি অর্থ। আরবীতে আছে, ‘সারাহা মিম মাওলায়ী আফালা আসতাসিরুহা’, এই কথাটা আমার চাচাতো ভাই থেকে এসেছে। এর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। এটি আউফ ইবনুল আহওয়াসের কবিতা থেকে উদ্ধৃত।
– তাহলে মদীনার আর্লি পিরিয়ডটা আমার কাছে মনে হয় খুব বেশি সিগনিফিকেন্ট।
– তুমি আকরাম জিয়া আল উমরীর লেখা ‘রাসূলের (সা.) যুগে মদীনার সমাজ’ পড়োনি?
– হ্যাঁ, পড়েছি।
– এটা কিন্তু বেশ ভালো বই। দুই খণ্ডে লেখা।
– আমি বলতে চাচ্ছিলাম, রাসূল (সা.) গিয়ে যে ওখানে…।
– আচ্ছা, আমি তোমাকে একটা বই দেই। খুঁজে দেখি পাই কিনা। ‘রাসূলের যুগে মদীনার সমাজ’ নামে আরেকটা বই লিখেছেন আ. ফ. ম. খালেদ হোসেন। বইটির ভূমিকা লিখেছি আমি।
– আচ্ছা, আমার আলাপটা শেষ করে নিই। কারণ, আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। বিশেষ করে আমরা যারা ইসলামী আন্দোলন করি, সিস্টেমেটিক ও সাসটেইনেবল ওয়েতে সমাজে ইসলাম কায়েম করতে চাই, মহানবী (সা.) কীভাবে এই কাজের আঞ্জাম দিয়েছেন সেই স্টাডিটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সাধারণত মনে করি, মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গিয়েই তিনি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে ফেলেছিলেন। কুবা পল্লীতে দু’তিন দিন থেকে সেখান হতে শুক্রবার মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পথিমধ্যে, বর্তমানে ‘মসজিদে জুমা’ হিসেবে পরিচিত স্থানে প্রথমবারের মতো যোহরের পরিবর্তে জুমার নামায আদায় করেছিলেন। কিন্তু…
– ইসলামী রাষ্ট্র তখনো ছিলো না। বরং ইসলাম ডমিনেটেড একটা রাষ্ট্র ছিলো। এর মানে হলো, সবকিছু রাসূল (সা.) ফয়সালা করবেন, যুদ্ধ লাগলে এটা করতে হবে, মদীনাকে রক্ষা করতে হবে, তাঁর সিদ্ধান্তকে অন্যদের মেনে নিতে হবে। এইসব ব্যাপারে তাঁর ডমিন্যান্সি ছিলো। কিন্তু এটা তো তখনকার সময়েও অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরী সনে যখন মদীনা সনদ হয়। এই সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে যে কাজগুলো আল্লাহর রাসূল (সা.) করেছেন, এর একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আমি লিখেছি, আমার লেখায় তুমি দেখেছো। এবং হযরত আনাসের (সা.) বাড়িতে এই চুক্তিটা হয়েছিলো। এবং এই চুক্তিটা সবাই মেনে নিয়েছিলো। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, তখনকার সময়ে ইহুদী, আরব, বনু নজীর, বনু কাইনুকাসহ যারা আছে, সবগুলোকে এই চুক্তির আওতায় নিয়ে এসে মদীনাকে বহুজাতিক একটি রাষ্ট্রের ধারণা দেয়া হয়েছে। এটাকে একেবারে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে না।
– তাহলে আরেকটা জিনিস একটু ইয়ে হচ্ছে না? মদীনা সনদ তো এক সিটিংয়ে বসে কমপ্লিটলি লেখা হয় নাই। এটা কাইন্ড অব কম্পাইলেশন না?
– কিছু কিছু জিনিস এ রকম হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তৎকালীন সময়ে ছিলো লেখক ও লেখার উপকরণের স্বল্পতা। এগুলোসহ নানা কারণে সবগুলো একসাথে লিখিতভাবে পাওয়া যায় না।
– কাব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে তাদের সাথে আবার একটি চুক্তি হলো। সেটিও মদীনা সনদে অন্তর্ভুক্ত হলো। অথচ এই চুক্তিটি হয়েছে পরে। তারপর আকাবা শপথের এগ্রিমেন্টগুলোর কিছু কিছুও তো মদীনা সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
– যে কোনো সনদ যদি পড়তে যাও, সনদ মানে Memorandum of Understanding (MOU)। সেইসব সমঝোতা চুক্তি বা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের একটা ধারাবাহিকতা থাকতে হয়। হঠাৎ করে…। কারণ, তুমি যে এখানে বসবা, অ্যাডমিশন নিয়েছো ঠিক আছে, তার জন্য ফরম পূরণ করতে হয়েছে, এক কথায় একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটাও কিন্তু একটা অংশ।
– তাহলে আপনি যে বললেন, আনাস ইবনে মালিকের (রা.) ঘরে চুক্তিটা হয়। তিনি তো মুহাজির ছিলেন।
– না, তিনি মুহাজির নন। তিনি তো আল্লাহর রাসূলের (সা.) খাদেম ছিলেন।
– তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় যাননি?
– না, তিনি আনসার।
– আচ্ছা। যা হোক, রাসূল (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর জুমার নামায চালু করলেন। আমরা যে ইসলামী রাষ্ট্রের একটা চিন্তা করি, যেখানে ঈদ আছে, জুমা আছে, নামায আছে, রোযা আছে, মানে যা যা ইত্যাদি আছে। তো, এই আর্লি পিরিয়ডে, আবার মাঝামাঝি এবং শেষের দিকে, আমরা যদি দশ বছরকে তিন ভাগে ভাগ করি, তাহলে তিন ভাগের চেহারা তো তিন রকম।
– তিন ভাগ নয়, প্রতি বছরকে তুমি একটা ভাগ ধরতে পারো। একসাথে তিনটা পিরিয়ডে সব হয়ে গেছে, তা নয়। ওই যে তুমি বলেছিলে কন্টিনিউশন, এটা হলো কন্টিনিউশন। তুমি যদি আজকেও ইসলামী রাষ্ট্র করতে চাও, সেক্ষেত্রে ওই যে সুন্নাহ অব গ্র্যাজুয়ালিটির কথা বলেছি, ওই পন্থায় যেতে হবে। এক দিনে সব পারবা না।
– তাহলে গ্র্যাজুয়ালিটির কথাটা একটু বলে ফেলি। এ প্রসঙ্গে আপনি তো মুহাম্মদ আল গাযালির একটি বই ‘কাইফা নাতা’য়ামালু মায়াল কোরআন ওয়া কাইফা নাতা’য়ামালু মায়াসসুন্নাহ’ শিরোনামে একটা বইয়ের কথা বলেন। এখন কথা হলো, গ্র্যাজুয়ালিটির এই কনসেপ্টটা তো খুব চমৎকার। কিন্তু যখন এর ইমপ্লিকেশনের প্রশ্ন আসে, তখন আমরা খুব হ্যাসিটেন্ট হয়ে পড়ি। আমি আপনাকে বাস্তবতাটা বলি। বাস্তবতা হলো আমরা এমন একটা সমাজে বসবাস করি, যেখানে ইসলাম যতটুকু প্রতিষ্ঠিত আছে, তারচেয়ে এটার প্রতি এক ধরনের হাইপ তথা প্রবল ভালোবাসা, এক ধরনের উন্মাদনা বা এক ধরনের অতি আবেগ, অথবা এ ধরনের ইউটোপিয়া আমাদের মধ্যে কাজ করে। কিন্তু যখনই আমরা ‘তাদাররুজ’ তথা ক্রমধারার কথা বলবো, তখন দেখা যাবে যে ইসলামিক্যালি…।
– তখনই তোমাকে ইন্টালেকচুয়ালিটির দিকে যেতে হবে। হাইপের কথা যে বলেছো, এর মধ্যে আর থাকা যাবে না।
– কিন্তু এটা তো আবার পাবলিক পারসেপশনের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে।
– না, কন্ট্রাডিক্ট করে না। সেটা এই জন্য …
– পাবলিক মনে করে, কোরআন-হাদীস, অর্থাৎ যা কিছু নাযিল হওয়ার তা তো হয়ে গেছে, কমপ্লিট হয়ে গেছে। আমাদের উপর সম্পূর্ণ ফরয হয়ে গেছে। সুতরাং, আমরা এখানে কোনো তাদাররুজ করতে পারবো না।
– না, ঠিকই আছে। আমাদের উপর সম্পূর্ণ ফরয হয়েছে ঠিকই। কোরআন যদি সম্পূর্ণ ফরয হয়ে যায়, তাহলে এই মুহূর্তে একটা লোক ইসলাম কবুল করলে তার উপর সালাত ফরয হয়ে যাবে। সালাত ফরয হয়ে গেলে সালাতের জন্য কেরাত পড়া, রুকু করা, সেজদা করা, আত্তা হিয়্যাতু পড়া— সবগুলো ফরয, ওয়াজিব বা মুস্তাহাব হয়ে যায়। লোকটি কি এগুলো শিখে তারপর ইসলাম কবুল করবে? কেউ কি একেবারে সবকিছু শিখে তারপর ইসলাম কবুল করবে?
– না, এটা তো কমনসেন্স থেকেই বুঝা যায়। এটা উচিতও নয়। বরং কনসেপ্টটাকে নিয়েই সে ইসলাম গ্রহণ করবে। ঈমান নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে। তারপর ধীরে ধীরে বাকি জিনিসগুলো জানবে।
– তাহলে তোমাকে তাদাররুজে যেতেই হবে।
– এটা তো একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে। কিন্তু একটা সমাজের ক্ষেত্রে আপনি…।
– সমাজের ক্ষেত্রেও সেইম ব্যাপার হবে। ধরো, আজকে হঠাৎ আমেরিকা নিজেদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দিলো। তো, এই ইসলামী রাষ্ট্রে আমাদের একজন আল্লাহর বান্দা গেলেন, যাওয়ার পর তার কোনো সুযোগ আসলো, ফলে তিনি আমেরিকাকে মদীনা সনদের আলোকে করে ফেললেন। তাহলে অ্যাট অ্যা টাইম কি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব? কারণ সমাজ চলে তাদাররুজের পন্থায়। হঠাৎ করে সমাজের র্যাডিক্যাল চেঞ্জ হয় না।
– তাছাড়া সোশ্যাল সাইকোলজিরও ব্যাপার আছে। রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন তো হলো বাইরের দিক। আমরা যাকে বলি হেড অব দ্যা আইসবার্গ। ভেতরে হলো এর কনসেপ্টটা। তো, সমাজের যে প্রচলিত ধ্যানধারণা, সেগুলোর পরিবর্তন না করে শুধু আইনকানুন পরিবর্তন করাটা তো টেকসই হবে না।
– সাসটেইনেবল হবে না। অতএব, তোমাকে ওই তাদাররুজে যেতে হবে। এই যে ইসলামী ব্যাংক, তারা এখনো ইসলামী ব্যাংক করতে পারে নাই। আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্যান্য ব্যাংকসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে প্রতিদিন যে লেনদেন হয়, সেখান থেকে যে সুদ আসে, সেগুলো তোমরা কী করো? তারা বললো, আমরা এগুলোকে সন্দেহজনক হিসাবে আলাদা করে রাখি। সেগুলো আমরা ব্যাংকের ফাউন্ডেশনে দিয়ে দেই জনস্বার্থে। এগুলো আমরা মূলধনে আনি না। কারণ, তাতে এগুলো সুদ হয়ে যাবে।
যে কথাটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, সমাজ পরিবর্তন করতে হলে সমাজ পরিবর্তনের যে অনুষঙ্গগুলো, সেগুলোকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে হবে। এ বিষয়ে ইবনে খালদুনসহ অন্যরাও বিস্তারিত বলেছেন। রাতারাতি তো টেকসই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। মদ ও সুদ নিষিদ্ধকরণের ধারাবাহিকতা হতেও এটি আমরা বুঝতে পারি।
ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারা অবলম্বনের অন্যতম শক্তিশালী দলীল ও এর পদ্ধতি নিয়ে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীসটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ:
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মুয়াজ ইবনে জাবালকে ইয়েমেনে (শাসক নিযুক্ত করে) প্রেরণের সময়ে বললেন, তুমি অবিলম্বে আহলে কিতাবদের মধ্যে যাবে। যখন তুমি তাদের মধ্যে পৌঁছবে তখন তাদেরকে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল’— এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আহ্বান করবে। তারা এটি মেনে নিলে তাদেরকে জানিয়ে দিবে, আল্লাহ তোমাদের উপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা এটাও মেনে নেয়, তবে তাদেরকে অবগত করবে, আল্লাহ তোমাদের উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা ধনীদের নিকট হতে নিয়ে গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। যদি তারা এটাও মেনে নেয়, তবে তাদের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ (যাকাত হিসেবে) গ্রহণ করা হতে বিরত থাকবে। আর মজলুমের অভিশাপকে ভয় করবে। তার অভিশাপ ও আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা নাই।
[আবু মূসা আশয়ারী (রা.) ও মুয়াজ ইবনে জাবালকে (রা.) ইয়েমেনে প্রেরণ, কিতাবুল মানাবিক, সহীহ বুখারী]
– একদিনে সম্ভব নয় বুঝলাম, শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারা অবলম্বন অপরিহার্য, এটি অনস্বীকার্য। কিন্তু, ধারাবাহিকতার টাইমফ্রেম কী হবে? এক একটা পর্যায় কি হতে পারে তিন মাস, তিন বছর, অথবা তিরিশ বছর? কিংবা এরচেয়েও বেশি? এটা তো একটা…।
– এটা হলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোনোটাই তুমি একদিনে বা নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করে দিয়ে পারবা না। তাওহীদ বিশ্বাসকে অবিলম্বে ও অখণ্ডভাবে গ্রহণ করতে হয়। ইবাদতের বিষয়গুলোকে মানতে হয় যথাশীঘ্র। কিন্তু মুয়ামালাতের বিষয়গুলো বাস্তবায়নের বিষয়টি ভিন্নতর। মোট কথা হলো, একজন মুসলমান সবকিছু করবে তাওহীদকে কেন্দ্রে রেখে। যেমন, এই মুহূর্ত থেকে আল্লাহকে এক হিসাবে বিশ্বাস করতে হবে, তওহীদবিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না।
– এটা তো শুধু মুসলমানদের উপর প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা যখন সমাজের কথা বলবো, সমাজের সবাই তো তাওহীদপন্থী নয়।
– তোমার উপর নামায ওয়াজিব। তোমাকে এখন থেকে একেবারে তারতীব সহকারে রেগুলার নামায পড়তে হবে— এমনটির জন্য সময় দিতে হবে। কোরআন তোমাকে অবশ্যই পড়তে হবে। এটার জন্য তোমাকে, কথার কথা, ছয় মাস সময় দিতে হবে। অর্থাৎ, যেটা যতদিন লাগে ততদিন দিতে হবে।
– আমরা যেমন দুই-চার-পাঁচ বছর বা সাত থেকে দশ বছর চিন্তা করি, তখন মনে হয় যেন এটা খুবই প্লজিবল বা সম্ভবপর। কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থাপনাগুলো এমন, ওই যে জামায়াতে ইসলামীর তিন মাসের দাওয়াতী টার্গেটের মতো। এ রকম পাঁচ বছর বা দশ বছরে কি সমাজ পরিবর্তন সম্ভব? বর্তমান যে সমাজব্যবস্থা…।
– এটা তো কন্টিনিউশন। এটি একদিনেও সম্ভব নয়, দশদিনেও সম্ভব নয়। এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আজীবনেও সম্ভব নয়। এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো চলতেই থাকবে। কারণ…।
– সেক্ষেত্রে আলেম-ওলামা বা ইয়ংদের মধ্যে যারা কোরআন-হাদীস কিছুটা পড়ে এক ধরনের ফ্যাসিনেশনের মধ্যে আছে, তারা তো বলবে— না, এটি তো পুরাটাই নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সবই ফরয করেছেন।
তাহলে মদীনায় যিনি আজকেই মুসলমান হয়েছেন, তার জন্য গ্র্যাজুয়ালিটি কী? তাকে তো আজকে মুসলমান হওয়ার পর…। প্রত্যেককেই তো সমাজে যা কিছু আছে তার সবকিছুই করতে হয়…।
– গ্র্যাজুয়ালিটি হলো— যেমন, ইসলাম নামায ফরয করেছে। তাহলে নামাযের জন্য কেরাতও ফরয। কেরাত কী সে শিখেছে? না। তাহলে তার জন্য গ্র্যাজুয়ালিটি হলো সম্ভাব্য কম সময়ের মধ্যে নামাযের বিধানগুলো শিখে নেয়া। বুঝাতে পেরেছি? যদি একদিনেই ফরয হতো, সেক্ষেত্রে একটা দলীলই তোমার জন্য যথেষ্ট— রাসূলের (সা.) উপর যে বছর হজ্ব ফরয হয়েছে, সে বছর কি তিনি তা করেছেন?
– তিনি তো জীবনে একবারই হজ্ব করেছেন, সেটা দশম হিজরীতে।
– তিনি কি সেই বছরই হজ্ব করেছেন?
– মক্কা বিজয় হয়েছিলো অষ্টম হিজরীতে।
– হজ্ব ফরয হয় নবম হিজরীতে। সে বছর কি তিনি হজ্ব করেছেন? করেননি। অথচ, তাঁর উপর যত বিধান নাযিল হয়েছে, হজ্ব ব্যতীত অন্য সব বিধান তিনি সর্বাগ্রে তামিল বা আমল করেছেন। তাহলে ফরয হলেই যে করতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। কেন করেননি? আমার গবেষণায় যেটা ধরা পড়েছে, এটা কিতাবী কথা নয়, সেটি হলো— সে বছর যদি আল্লাহর রাসূল (সা.) হজ্ব করতেন, তাহলে আজ পর্যন্ত অমুসলিমদেরকে মক্কা থেকে হঠানো কঠিন হয়ে যেতো। এটা একটা সুন্নাহ হয়ে যেতো যে আল্লাহর রাসূল (সা.) এলাউ করেছেন যে হজ্বের সময় অমুসলিমরা ন্যাংটা হয়ে তাওয়াফ করবে, আর মুসলমানরা এভাবে করবে।
– মিক্সড হজ্ব?
– হ্যাঁ, মিক্সড হজ। এবং আমার মনে হচ্ছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) এই জন্য এক বছর অপেক্ষা করেছেন। তারপর কোরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। তারপর তিনি সে বছরের আমীরে হজ্ব আবু বকরের (রা.) কাছে নতুন ওহীর খবর পৌঁছানোর জন্য হযরত আলীকে (রা.) পাঠালেন। আবু বকর (রা.) তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন— তুমি যে এসেছো, এখন আমি কি তোমার আনুগত্য করবো, নাকি তুমি আমার আনুগত্য করবে? তুমি কি আমীর হিসেবে এসেছো, নাকি ফলোয়ার হিসেবে এসেছো?
– তিনি তো ফলোয়ার হিসেবেই গিয়েছিলেন।
– না, অত লম্বা ইতিহাস এখানে বলছি না। তিনি যে ওহীর খবর নিয়ে গিয়েছিলেন ওখানে একটা আয়াত ছিলো— “ইন্নামাল মুশরিকুনা নাজাসুন”… (মুশরিকরা তো অপবিত্র, এই বছরের পর তারা যেন আর না আসে)। তারা এটি মানতে বাধ্য ছিলো। কারণ, মক্কা মুসলমানদের অধীন হলেও সেখানে তখনো অনেক মুশরিক ছিলো। মক্কা বিজয় অলরেডি হয়ে গেছে আগের বছর। আগের বছর বিজয় হওয়া সত্ত্বেও পরের বছর এদেরকে আসতে নিষেধ করা হয় নাই, বারণ করা হয় নাই। ইচ্ছা করলে সেইবারই বলে দিতে পারতো— কেউ আসতে পারবে না, যাও। কিন্তু করেন নাই। ওই যে গ্র্যাজুয়ালি করেছেন, সে জন্য। কারণ, তখন বাধা দিলে কাবার চত্ত্বরে একটা হাঙ্গামা হয়ে যেতো, একটা মারামারি হয়ে যেতো।
– কারণ, তখন পর্যন্ত আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ক্লিয়ার ছিলো না। এখন হাওয়া-বাতাস কোনদিকে, কাদের এখন নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব, এটি আগে প্রতিষ্ঠিত হোক।
– এরপরে যখন রাসূল (সা.) গেলেন, যাওয়ার পর হজ্ব কমপ্লিট হলো, তারপর কোরআনের আয়াত সবাইকে পড়ে শোনালেন— হে মানুষেরা! তোমরা হজ্ব করেছো, যারা যেখান থেকে এসেছো তোমাদের নিয়ম অনুযায়ী…
– এমনিতে হজ্বে আরাফাতের যে ভাষণ, এটিই তো হজ্বের ফরম্যাট। তাহলে হযরত আলী (রা.) কি এ ধরনের ইনবিটুইন কোনো ধরনের একটা জমায়েত করে… তিনি যে বলেছেন…।
– তিনি বলেননি। তিনি এই ম্যাসেজটা হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। লিডারের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। এবং লিডার সবার মধ্যে তা জানিয়ে দিয়েছেন।