চিন্তার স্বাধীনতা ও ইসলাম

ভূমিকা

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কেননা, আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন এবং স্বাধীনতা নিয়েই তার জন্ম হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক মানবসন্তান ফিতরাতের (প্রকৃতি) উপর জন্মগ্রহণ করে।” (বুখারী)। আরবী ভাষাতত্ত্ব অনুযায়ী, এই ফিতরাত শব্দটির মধ্যে স্বাধীনতার মর্মার্থ নিহিত রয়েছে। এ স্বাধীনতার অর্থ ও তাৎপর্য অত্যন্ত বিস্তৃত, যা মানুষের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় ও দিককে অর্ন্তভুক্ত করে। তার চিন্তা-চেতনায়, মননে, কর্মে; এক কথায়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার উপস্থিতি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন:

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

“আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।”

[সূরা বাকারা: ৩০]

মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এই খেলাফতের মর্যাদালাভের পেছনে রয়েছে মানুষের জ্ঞান ও চিন্তাজগতের শ্রেষ্ঠত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালনে রত থাকলেও তাদের ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা নেই।

অন্যদিকে, মহান আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীবরূপে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়ে মানবজাতিকে অত্যন্ত সম্মানিত করেছেন। তিনি বলেন,

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

“আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি, তাদের জন্য জলে-স্থলে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে পবিত্র রিযক দিয়েছি আর আমি তাদেরকে আমার অধিকাংশ সৃষ্টির উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।”

[সূরা বনী ইসরাঈল: ৭০]

এ আয়াত স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিচ্ছে, আল্লাহ মানুষকে তার কিছু স্বকীয়তার কারণে এই শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। ভালো-মন্দের বিচার-বিবেচনা, স্বীয় কল্যাণচিন্তা, ইচ্ছা করার অধিকার এবং ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি এই স্বকীয়তার অন্যতম।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিভিন্ন সৃষ্টির কাছে একটি বিশেষ বিষয় গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করেন, কিন্তু কেউ তা গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি। কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا

“আমি আসমান, যমীন ও পর্বতের প্রতি (ইসলামের বোঝা বহন করার) আমানত পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানালো, তারা তাতে আশংকিত হলো, কিন্তু মানুষ সে দায়িত্ব নিলো। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ।”

[সূরা আহযাব: ৭২]

‘আমানত’ শব্দটি এই আয়াতে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, সে বিষয়ে মুফাসসিরগণ মতভেদ করেছেন। এর ব্যাখ্যায় তারা যেসব মত ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে একটি মতানুযায়ী, এখানে ‘আমানত’ অর্থ হলো ভালো-মন্দ বাছাইয়ের ক্ষমতা ও ইচ্ছার স্বাধীনতা।

অতএব, চিন্তার স্বাধীনতার বিষয়টি মানুষের সৃষ্টি, তার সম্মান ও দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চিন্তার অধিকার তাই মানুষের একটি সহজাত ও স্বভাবগত অধিকার। একজন মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। সব মানুষই যে কোনো বিষয়ে ভাবতে ও গবেষণা করতে পারে। তবে তা হতে হবে শরীয়াহ নির্ধারিত নীতিমালার আলোকে।

ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনাকে নিম্নোক্ত কয়েকটি অংশে বিভক্ত করা যায়:

১। চিন্তার স্বাধীনতা ও দাসত্ব
২। ধর্মীয় স্বাধীনতা
৩। বুদ্ধিবৃত্তিচর্চা ও ইসলাম
৪। ইচ্ছার স্বাধীনতা
৫। চিন্তার স্বাধীনতার শরয়ী নীতিমালা

১। চিন্তার স্বাধীনতা ও দাসত্ব

দাসত্ব স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে অন্তরায়। এ কারণে ইসলাম মানুষকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে দেখতে চায়। ইসলামের দৃষ্টিতে, কেউ তাকে তার এ স্বাধীনতা ভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না এবং জোর-জবরদস্তি করে তাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করবে না। এ প্রসঙ্গে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) সেই বিখ্যাত উক্তিটিও উল্লেখযোগ্য। তিনি ঘোষণা করেছেন,

متى استعبدتم الناس وقد ولدتهم أمهاتهم أحرارا؟

“কীভাবে তুমি মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছো? অথচ তার মা তাকে স্বাধীন মানুষ রূপেই জন্ম দিয়েছে।”

(কানযুল উম্মাল, আছার নং ৩৬০১০]

ইসলাম তাই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মানবতাকে মুক্তির জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন:

ক. দাসত্ব কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক মানুষের জন্য অপর মানুষের দাসত্ব সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি শ্রেষ্ঠতম মানব সন্তান নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রেও এ বিধান পূর্ণমাত্রায় প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।”

[সূরা বাকারা: ২১]

فَأَرْسَلْنَا فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ

“আর তাদের মাঝে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছিলাম এই বলে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নেই, তবুও কি তোমরা (তাঁকে) ভয় করবে না?”

[সূরা মুমিনুন: ৩২]

مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ

“কোনো মানবসন্তানের পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, জ্ঞান ও নুবুওয়াত দান করেন, অতঃপর সে লোকেদেরকে বলে, ‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার বান্দা হয়ে যাও’।”

[সূরা আলে ইমরান: ৭৯]

খ. সকল মানুষকে একই পিতা-মাতার সন্তান ঘোষণার মাধ্যমে তাদের মর্যাদাগত পার্থক্য বিলোপ করা হয়েছে। যাতে কেউ কাউকে দাস হিসেবে গ্রহণ না করে। আল্লাহ বলেছেন,

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً

“হে মনুষ্য সমাজ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি মাত্র ব্যক্তি হতে পয়দা করেছেন এবং তা হতে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর সেই দুজন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।”

[সূরা নিসা: ১]

وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ

“তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর (প্রত্যেকের জন্য) একটি স্থান অধিক দিন থাকার জন্য এবং একটি স্থান অল্প দিন থাকার জন্য রয়েছে। এই নিদর্শনসমূহ আমি তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করলাম যাদের বুদ্ধি বিবেচনা আছে।”

[সূরা আনআম: ৯৮]

গ. একইভাবে সমষ্টিগত বা বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাতে সামষ্টিক দাসত্বের ধারণাও বিলুপ্ত হয়।

يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

“হে মানুষ! তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক সম্মানিত যে ব্যক্তি অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সব খবর রাখেন।”

[সূরা হুজরাত: ১৩]

মহানবী (সা.) বলেছেন:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَلَا إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى أَعْجَمِيٍّ وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى

“হে মানবমণ্ডলী! জেনে রাখো, তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের সকলেই এক পিতার সন্তান। আরো জেনে রাখো, কোনো অনারবের উপর আরবের, অনুরূপ কোনো আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদা নেই। একইভাবে কালো বর্ণের মানুষের উপর লাল বর্ণের মানুষের এবং লাল বর্ণের মানুষের উপর কালো বর্ণের মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদা নেই। তবে কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে (একজনের উপর অপরজনের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হবে)।”

(ইমাম আহমদ; এবং আলবানীর ‘সহীহাহ’, ৬/১৯৯]

ঘ. যুদ্ধ দাস সৃষ্টির অন্যতম কারণ। তৎকালীন সময়ে যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর মধ্য হতে আটককৃত নারী-পুরুষ-শিশু দাস হিসেবেই গণ্য হতো। ইসলাম দাস সৃষ্টির এ উৎসটি বন্ধের জন্য এ সংক্রান্ত নতুন বিধান দিয়েছে। যুদ্ধবন্দীদের ক্ষমা করে নিঃশর্ত মুক্তি অথবা মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার বিধান জারি করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانْتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِنْ لِيَبْلُوَ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَنْ يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ

“অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত হানো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাস্ত করো, তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলো। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ করো, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করো। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করে। এ নির্দেশই তোমাদেরকে দেয়া হলো। আল্লাহ ইচ্ছে করলে (নিজেই) তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান (এজন্য তোমাদেরকে যুদ্ধ করার সুযোগ দেন)। যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তিনি তাদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করবেন না।”

[সূরা মুহাম্মদ: ৪]

উপরিউক্ত আয়াতে দুটি মাত্র অপশন রাখা হয়েছে। তৃতীয় কোনো বিকল্প তথা দাস বানানোর কোনো অপশন এখানে রাখা হয়নি।

ঙ. ইসলাম আগমনের প্রাক্কালে যে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল, তা থেকে মানবতাকে মুক্তির জন্য ইসলামের গৃহীত পদক্ষেপও এক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখে। এ ব্যাপারে ইসলাম ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন:

  • পবিত্র কোরআনের মক্কী ও মাদানী উভয় যুগের সূরাতেই দাস মুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে, এর মাহাত্ম্য ও ফযিলত বর্ণনা করা হয়েছে।

فَلَا اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ. وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ. فَكُّ رَقَبَةٍ

“(মানুষকে এত গুণবৈশিষ্ট্য ও মেধা দেয়া সত্ত্বেও) সে (ধর্মের) দুর্গম গিরিপথে প্রবেশ করলো না। তুমি কি জানো দুর্গম গিরিপথ কী? (তা হচ্ছে) দাসমুক্তি।”

[সূরা বালাদ: ১১-১৩]

  • মাদানী সূরাসমূহ থেকে এখানে আমরা একটি আয়াত উদ্বৃত করছি:

لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

“তোমরা নিজেদের মুখ পূর্ব দিকে করো কিংবা পশ্চিম দিকে, এতে কোনো কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ আছে এতে যে কোনো ব্যক্তি ঈমান আনবে মহান আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ ও নবীগণের প্রতি এবং মহান আল্লাহর ভালোবাসার্থে ধন-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন, মুসাফির ও যাচ্ঞাকারীদের এবং দাসত্বজীবন থেকে নিষ্কৃতি দিতে দান করবে এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দিতে থাকবে, ওয়াদা করার পর স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করবে এবং অভাবে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রাম-সঙ্কটে ধৈর্যধারণ করবে। এসব লোকেরাই সত্যপরায়ণ। আর এ লোকেরাই মুত্তাকী।”

[সূরা বাকারা: ১৭৭]

  • দাসমুক্তিকে যাকাত ব্যয়ের অন্যতম খাত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
  • ভুলক্রমে হত্যা, শপথভঙ্গ, যিহার ইত্যাদি অপরাধের কাফফারা হিসেবেও দাসমুক্তির বিধান দেয়া হয়েছে।

অতএব বলা যায়, ইসলাম মৌলিকভাবে দাসপ্রথাকে নাকচ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, দাস সৃষ্টির রাস্তা বন্ধ করেছে। তৃতীয়ত, কোনো কারণে কেউ দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলে তার মুক্তির ব্যবস্থা করেছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট দাস ইচ্ছা করলে নিজের মুক্তির জন্য মালিকের সাথে অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করতে পারে। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, যদি খেলাফতে রাশেদা আরও কিছুকাল চলমান থাকতো, তাহলে ইসলামী সভ্যতা থেকে দাসপ্রথা একবারে বিলুপ্ত হয়ে যেত।

২। ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা

মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে তার ধর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে ধর্মবিশ্বাস গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াতসমূহ থেকে এ সম্পর্কিত ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্টভাবে জানা যায়।

মক্কী জীবনে মহানবীর (সা.) উপর অবতীর্ণ আয়াতসমূহে তাঁকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে মানুষের ধর্মীয় অধিকার সর্বাবস্থাতেই স্বীকৃত থাকবে। ঈমান আনা না আনা ব্যক্তির ইচ্ছা বা এখতিয়ারভুক্ত বিষয় হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَن شَاء فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاء فَلْيَكْفُرْ

“আর বলে দাও, সত্য এসেছে তোমাদের রবের নিকট হতে, কাজেই যার ইচ্ছে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করুক।”

[সূরা কাহাফ: ২৯]

وَلَوْ شَاء رَبُّكَ لآمَنَ مَن فِي الأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُواْ مُؤْمِنِينَ

“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছে করলে দুনিয়ার সমস্ত লোক অবশ্যই ঈমান আনতো, তাহলে কি তুমি ঈমান আনার জন্য মানুষদের উপর জবরদস্তি করবে?”

[সূরা ইউনুস: ৯৯]

لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ

“তোমাদের পথ ও পন্থা তোমাদের জন্য, আর আমার জন্য আমার পথ।”

[সূরা কাফিরুন: ৬]

মাদানী সূরায় এসে আরও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে:

لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ

“দ্বীনের মধ্যে জবরদস্তির অবকাশ নেই, নিশ্চয় হিদায়াত গোমরাহী থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।”

[সূরা বাকারা: ২৫৬]

এক্ষেত্রে রাসূলের দায়িত্ব শুধুমাত্র প্রচার বা দাওয়াত দান। মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ রাসূলের দায়িত্ব বহির্ভূত বিষয়। এই বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ

“অতঃপর যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পাবে; আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার দায়িত্ব শুধু প্রচার করা। আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।”

[সূরা আলে ইমরান: ২০]

فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ

“আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রেখো আমার রাসূলের দায়িত্ব হলো সুস্পষ্টভাবে (আমার বাণী) পৌঁছে দেয়া।”

[সূরা মায়েদা: ৯২]

দাওয়াতের পদ্ধতিও জানিয়ে দেয়া হয়েছে:

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ

“জ্ঞান-বুদ্ধি আর উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তুমি (মানুষকে) তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান জানাও, আর লোকেদের সাথে বিতর্ক করো এমন পন্থায় যা অতি উত্তম। তোমার প্রতিপালক ভালোভাবেই জানেন কে তাঁর পথ ছেড়ে গোমরাহ হয়ে গেছে। আর কে সঠিক পথে আছে তাও তিনি বেশি জানেন।”

[সূরা নাহল: ১২৫]

কোরআন বরং ধর্ম গ্রহণের জন্য ব্যক্তির চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে তার উপর ছেড়ে দিয়েছে। এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

قَدْ جَاءَكُمْ بَصَائِرُ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ أَبْصَرَ فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ عَمِيَ فَعَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِحَفِيظٍ

“তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে (অন্তরের) আলো এসে পৌঁছেছে, যে লোক (এই আলো দিয়ে) দেখবে তাতে তার নিজেরই কল্যাণ হবে, আর যে অন্ধ থাকবে, তার অকল্যাণ তার ঘাড়েই পড়বে। (বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে) আমি তোমাদেরকে পাহারা দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হইনি।”

[সূরা আনআম: ১০৪]

৩। বুদ্ধিবৃত্তিচর্চা ও ইসলাম

বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ছাড়া কোনোভাবেই চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না। ধর্মীয় স্বাধীনতা বা স্বাধীন সত্তার সুফলও ভোগ করা যায় না।

  • ইসলামী শরীয়ার মূল উদ্দেশ্য বা মাকাসিদে শরীয়াহর একটি হলো, হেফজুল আকল বা বুদ্ধিমত্তার সংরক্ষণ।
  • ইসলাম মানুষকে তার চিন্তা ও বুদ্ধি প্রয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে لعلكم تعقلون، يتفكرون، تدبر، تفقه ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
  • আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিন্তা ও গবেষণা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন:

قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَنْ تَقُومُوا لِلَّهِ مَثْنَى وَفُرَادَى ثُمَّ تَتَفَكَّرُوا مَا بِصَاحِبِكُمْ مِنْ جِنَّةٍ إِنْ هُوَ إِلَّا نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ

“(হে নবী,) তুমি বলো, আমি তোমাদের শুধু একটি কথারই উপদেশ দিচ্ছি। তা হচ্ছে, তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্যই (সত্যের উপর) দাঁড়িয়ে যাও, দুই দুইজন করে, (দুইজন না হলে) একা একা; অতঃপর ভালো করে চিন্তাভাবনা করো।”

[সূরা সাবা: ৪৬]

  • যারা চিন্তাশক্তির প্রয়োগ করে না, কোরআন তাদের নিন্দা করেছে:

أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ

“তারা কি যমীনে ভ্রমণ করে না? তাহলে তারা হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারতো, আর তাদের কান শুনতে পারতো। প্রকৃতপক্ষে চোখ তো অন্ধ নয়, বরং বুকের ভিতর যে হৃদয় আছে তা-ই অন্ধ।”

[সূরা হজ্ব: ৪৬]

  • একই কারণে কোনো কিছুর অন্ধ অনুকরণ নিষিদ্ধ করে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে বিশ্লেষণ করে দ্বীনের বিষয়গুলো গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে:

قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ

“বলো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে নিজেদের দলীল পেশ করো।”

[সূরা বাকারা: ১১১]

  • কোরআন নির্ধারিত দাওয়াতের অন্যতম একটি পদ্ধতি হলো ‘মুজাদালাহ’, যা চিন্তা-গবেষণা ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।
  • বিচারকের জন্য চিন্তা ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগকে অনুমোদন করা হয়েছে। মুয়াজকে (রা.) ইয়েমেনে প্রেরণের প্রাক্কালে রাসূল (সা.) তাঁকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যা বলেছিলেন, সেই হাদীসটি এ বিষয়ের অন্যতম দলীল।
  • ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতার কারণেই বরং একই বিষয়ে নানা মত, দল ও উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। তাফসীর ও ফিকাহসহ ওহীর জ্ঞান ব্যতীত অন্যান্য জ্ঞানের আলোচনাকে আমরা মতবিরোধে পূর্ণ দেখতে পাই। মুজতাহিদগণ নির্দ্বিধায় একে অপরের ভুল ধরেছেন এবং স্বীয় বুঝজ্ঞান মোতাবেক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত ও দালীলভিত্তিক জবাব দিয়েছেন।
  • মতানৈক্য সত্ত্বেও ভিন্ন চিন্তাকে আলেমগণ সম্মান করেছেন। আমরা দেখতে পাই, ইমাম জামাখশারী রচিত ‘তাফসীরে কাশশাফ’ গ্রন্থটিকে সুন্নী ও মুতাজিলা উভয় দলই সমাদর করেছে। ইমাম জামাখশারী মুতাজিলাপন্থী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই তাফসীর থেকে সুন্নীরা উপকৃত হয়েছেন। এটিকে কেউ কোনো সমস্যা মনে করেন নাই।

৪। ইচ্ছার স্বাধীনতা

ইচ্ছার স্বাধীনতার ব্যাপারে ইসলামের ইতিহাসের দার্শনিক চিন্তাগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। তাদের মধ্যে একদল মনে করে, মানুষের কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। অন্য দল মনে করে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে। উভয় পক্ষের মতের পক্ষে পবিত্র কোরআনের আয়াত বিদ্যমান।

মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে:

وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الْآخِرَةِ نُؤْتِهِ مِنْهَا وَسَنَجْزِي الشَّاكِرِينَ

“যে ব্যক্তি পার্থিব ফল চায়, আমি তা থেকে তাকে দেই; আর যে ব্যক্তি আখেরাতের ফল চায়, আমি তাকে তা থেকে দেই এবং কৃতজ্ঞদেরকে আমি শীঘ্রই বিনিময় প্রদান করব।

[সূরা আলে ইমরান: ১৪৫]

مَنْ كَانَ يُرِيدُ ثَوَابَ الدُّنْيَا فَعِنْدَ اللَّهِ ثَوَابُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا بَصِيرًا

“যে ব্যক্তি পার্থিব পুরস্কার কামনা করে সে জেনে রাখুক যে আল্লাহর নিকট ইহলৌকিক ও পারলৌকিক পুরস্কার আছে। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”

[সূরা নিসা: ১৩৪]

مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ

“যারা এ দুনিয়ার জীবন আর তার শোভা সৌন্দর্য কামনা করে, তাদেরকে এখানে তাদের কর্মের পুরোপুরি ফল আমি দিয়ে দেই, আর তাতে তাদের প্রতি কোনো কমতি করা হয় না।”

[সূরা হুদ: ১৫]

مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا

“যে কেউ নগদ নগদ পেতে চায় তাকে আমি এখানেই জলদি করে দিয়ে দেই যাকে যা দিতে ইচ্ছে করি, অবশেষে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। তাতে সে জ্বলবে ধিকৃত ও রহমত বঞ্চিত অবস্থায়।”

[সূরা বনী ইসরাঈল: ১৮]

مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ

“যে লোক পরকালের ক্ষেত করতে চায়, আমি তার জন্য তার ক্ষেতে বৃদ্ধি দান করি। আর যে লোক দুনিয়ার ক্ষেত চায়, আমি তাকে তা থেকে দেই, কিন্তু পরকালে তার অংশে (বা ভাগ্যে) কিছুই নেই।”

[সূরা শূরা: ২০]

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا – وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا

“হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদের বলে দাও— তোমরা যদি পার্থিব জীবন আর তার শোভাসৌন্দর্য কামনা করো, তাহলে এসো, তোমাদেরকে ভোগসামগ্রী দিয়ে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদেরকে বিদায় দেই। আর তোমরা যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালের গৃহ কামনা করো, তবে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য আল্লাহ মহা পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।”

[সূরা আহযাব: ২৮-২৯]

إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ

“আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে।”

[সূরা রাদ: ১১]

৫। চিন্তার স্বাধীনতা সংক্রান্ত শরয়ী নীতিমালা

ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি সুসংবদ্ধ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক হলো:

  • চিন্তার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ দ্বীন জানা, বুঝা ও এর প্রচার-প্রসারের জন্য কাজ করা।
  • মানবতার কল্যাণ, উম্মাহর সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য চিন্তা করা।
  • দ্বীনের ব্যাপারে বিতর্ক সৃষ্টি করা থেকে দূরে থাকা।
  • সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অকল্যাণকর চিন্তা থেকে দূরে থাকা।
  • শরয়ী কোনো বিষয়ে গবেষণা করলে যথাযথ নীতি ও পদ্ধতি অবলম্বন করা।
  • মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে নিছকই সঠিক সিদ্ধান্ত বা অধিকতর সহীহ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর নিয়ত পোষণ করা এবং ভিন্ন মতকে সর্বাবস্থায়ই সম্মান করা।
  • চিন্তার ক্ষেত্রে নৈতিকতার দাবিকে সমুন্নত রাখা।
  • অন্ধ অনুকরণ থেকে বাঁচার জন্যই চিন্তা ও গবেষণা করা।
  • চিন্তার প্রকাশের ক্ষেত্রে যথাযথ নীতি মেনে চলা।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সহজেই অনুধাবন করা যায়, মহান আল্লাহ মানব সত্তার সাথে স্বাধীনতাকে একীভূত করে দিয়েছেন। জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ স্বাধীন। এ কারণে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে দাসপ্রথা নির্মূলের জন্য ইসলাম সচেষ্ট হয়েছে। কেননা, মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে দাসত্ব হলো একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। একমাত্র আল্লাহর জন্য দাসত্বকে নির্দিষ্ট করার পরে মানুষকে স্বীয় পছন্দ মোতাবেক ধর্ম গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। একই সাথে, তাকে মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের হুকুম দেয়া হয়েছে। প্রবৃত্তিপূজা, অজ্ঞতা, অন্ধ অনুকরণের বশবর্তী হয়ে অথবা দলীল-প্রমাণবিহীন ধারণার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বরং, বুদ্ধিবৃত্তির যথাযথ প্রয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি, তাকে দেয়া হয়েছে ইচ্ছার স্বাধীনতা। যাতে করে তারই ইচ্ছার ভিত্তিতে সম্পাদিত কর্মের কারণে তাকে পারলৌকিক জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যায়। তথাপি, মানুষের এই চিন্তার স্বাধীনতার জন্য একটি সাধারণ নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে মানব সমাজ এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করতে না পারে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।

[সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র কর্তৃক ৩১ মার্চ ২০১৯ তারিখে আয়োজিত ‌‘চিন্তার স্বাধীনতা ও ইসলাম’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত।]

এ ধরনের আরো লেখা