‘নারীদের জন্য মসজিদের চেয়ে ঘরে নামায পড়াই উত্তম’ কথাটি কি রাসূল (সা) বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছেন। তবে কথাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। রাসূলের (সা) এই কথাটি সব নারীর জন্যও নয়, সবসময়ের জন্যও নয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উম্মে হুমাইদ (রা) সম্পর্কে ইবনে হিব্বান ও আহমদ কর্তৃক উদ্ধৃত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছিলো— “তোমার জন্য জামায়াতে নামায পড়ার চেয়ে ঘরে নামায পড়া উত্তম।” হাদীসটি সহীহ, কিন্তু উদ্ধৃত বর্ণনাটি অপূর্ণাঙ্গ। প্রচলিত বর্ণনাগুলোতে হাদীসটির প্রেক্ষাপট ও পূর্ণাঙ্গ ঘটনা ব্যাখ্যা করা হয়নি।
যাই হোক, ইমাম তাবারানী, বায়হাকী, ইবনে আবু শায়বা, ইবনে আবু আসিমসহ অন্যান্য হাদীস সংকলকগণ এ ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁদের (বিশুদ্ধ) বিস্তারিত বর্ণনা থেকে জানা যায়, উম্মে হুমাইদের (রা) সাথে তাঁর স্বামী আবু হুমাইদ আস-সাইদীর (রা) দাম্পত্য কলহের প্রেক্ষিতে রাসূল (সা) এ পরামর্শটি দিয়েছেন। উম্মে হুমাইদ (রা) জামায়াতে নামায পড়ার জন্য নিয়মিত মসজিদে নববীতে আসতেন। একে কেন্দ্র করেই তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হতো। তাই একদিন উম্মে হুমাইদ (রা) কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে রাসূলের (সা) কাছে এসে বললেন, “হে রাসূলুল্লাহ! আমরা আপনার সাথে জামায়াতে নামায পড়তে পছন্দ করি, কিন্তু আমাদের স্বামীরা আমাদেরকে মসজিদে আসতে বাধা দেয়।[1]
আবু হুমাইদ আস-সাইদী (রা) ছিলেন বনী সাইদা গোত্রের লোক। এটি খাজরাজ গোত্রের একটি শাখা। তখন তাঁরা মসজিদে নববী থেকে অনেক দূরে মদীনার এক প্রান্তে বসবাস করতেন। তাদের নিজেদের ক্ষেত-খামার ছিলো, নিজেদের সালিশ কেন্দ্র (সাকীফায়ে বনী সাঈদা) ছিলো, সর্বোপরি নিজেদের মসজিদও ছিলো। রাসূল (সা) একবার সেই মসজিদটিতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে নামাযও পড়েছিলেন (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১২১৭)। এলাকার মসজিদ ছেড়ে রাসূলের (রা) পেছনে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে উম্মে হুমাইদ (রা) দীর্ঘ পথ হেঁটে আসতেন। তাই নিজের সন্তান ও পরিবারের স্বার্থে রাসূল (সা) তাঁকে স্বামীর অনুরোধ মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং নিজ গোত্রের মসজিদ কিংবা ঘরে নামায আদায় করতে বলেছিলেন।
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে নারীদের মসজিদে আসার সাধারণ নিয়মকে রাসূল (সা) পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। বরং অনেকগুলো বর্ণনায় রাসূল (সা) উল্লেখ করেছেন, নারী-পুরুষ যে কেউ মসজিদে নববীতে এসে নামায পড়লে বিশেষ সওয়াব পাবে।
ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে আপাত বিরোধ সমাধানের জন্য এটিই হলো সম্ভাব্য একমাত্র ব্যাখ্যা। ফিকাহ শাস্ত্রের একটি মৌলিক নিয়ম হচ্ছে, কোনো একটা দলীলকে উপেক্ষা করার চেয়ে এটিকে সংশ্লিষ্ট সবগুলো দলীলের সাথে সমন্বয় করা অপেক্ষাকৃত ভালো।
যাই হোক, বর্ণনাটিতে আমরা আরেকটা বিষয় পাই। তা হলো, উম্মে হুমাইদ (রা) ঘরের ‘সবচেয়ে অন্ধকার’ ও ‘সবচেয়ে দূরবর্তী’ স্থানকে নামায পড়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস, বর্ণনাটি যদি সত্য হয়, এটি রাসূলের (সা) নির্দেশনা ছিলো না, বরং একান্তই উম্মে হুমাইদের (রা) নিজস্ব পছন্দ ছিলো। কারণ, নারীদের জামায়াতে নামাযের পক্ষে শতাধিক হাদীস রয়েছে, কিন্তু কোথাও ‘অন্ধকার’ ও ‘দূরবর্তী’ স্থানে নামায আদায় করতে বলা হয়নি।
উপরে আলোচিত উম্মে হুমাইদের (রা) হাদীসটি ব্যতীত আর কোনো সহীহ হাদীস নেই, যার ভিত্তিতে নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিরুৎসাহিত করা, বা বাধা দেওয়া যায়। তাছাড়া নারীদের জন্য মসজিদে নববীর চেয়ে ঘরে নামায পড়া উত্তম— এমন কোনো সাধারণ নিয়মও নেই। উপরন্তু, প্রসিদ্ধ একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন, “আমার এই মসজিদে একবার নামায পড়া অন্য কোথাও হাজারবার নামায পড়ার চেয়ে উত্তম। তবে এর একমাত্র ব্যতিক্রম হলো মক্কার মসজিদে হারাম।”[2] এই ফযিলত বর্ণনায় রাসূল (সা) নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি।
যাই হোক, স্কলারদের কেউ কেউ মসজিদে নারীদের যাতায়াতে বাধা দেওয়ার জন্য কিছু দুর্বল বর্ণনাকে ‘প্রমাণ’ হিসাবে হাজির করেন! অথচ অসংখ্য সহীহ হাদীসের বিপরীতে এসব দুর্বল বর্ণনা শক্ত দলীল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না, বা সহীহ হাদীসগুলোর হুকুমও রহিত করতে পারে না।
এই দুর্বল বর্ণনাগুলোর একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। নারী সংক্রান্ত বা নারীদের মসজিদে যাতায়াতে বাধাদান সংক্রান্ত সমসাময়িক অসংখ্য ফতোয়ায় এই দুর্বল বর্ণনাটির রেফারেন্স দেওয়া হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।[3] এই বর্ণনাটিতে দাবি করা হয়, রাসূল (সা) নাকি তাঁর মেয়ে ফাতেমাকে (রা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, “একজন নারীর জন্য সবচেয়ে উত্তম কী?” বর্ণনা মতে, ফাতেমা (রা) জবাব দিয়েছিলেন, “একজন নারীর উচিত কোনো পুরুষকে না দেখা এবং কোনো পুরুষও যেন তাকে দেখতে না পারে।” বর্ণনা অনুযায়ী, এরপর রাসূল (সা) ফাতেমাকে (রা) জড়িয়ে ধরে বললেন, “উত্তম বংশ থেকেই যোগ্য সন্তান জন্মলাভ করে থাকে।”[4]
একে তো হাদীসটির বর্ণনাসূত্র (সনদ) দুর্বল, তার উপর হাদীসটির তাৎপর্য কোরআনের অসংখ্য সুস্পষ্ট আয়াতের বিপরীত। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নারীদের সাথে পুরুষদের দেখা-সাক্ষাতের কথা কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলের (সা) সন্তানদের কথা বলেছেন, যেখানে ফাতেমাও (রা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহ বলেছেন,
فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِن بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَتَ اللَّـهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
“তোমার কাছে (পূর্ণ) জ্ঞান আসার পরে কেউ তার (ঈসার) ব্যাপারে তোমার সাথে বিতর্ক করলে বলবে, “এসো আমরা আমাদের ও তোমাদের পুত্রদেরকে, নারীদেরকে ও নিজেদেরকে ডাকি (অর্থাৎ নিজেদের স্ত্রীপুত্রদেরকে ডেকে নিয়ে আমরা উভয়পক্ষ বসি); তারপর (সবাই একত্রে) প্রার্থনা করে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত দেই।” (সূরা আলে ইমরান: ৬১)
এই আয়াতটিতে স্পষ্টভাবে রাসূলের (সা) সন্তানদের কথাই বুঝানো হয়েছে। আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর নাজরান অঞ্চলের প্রতিনিধিদলের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন:
“তারা সত্যকে স্বীকার করতে চায়নি। এরপর, নতুন নাযিলকৃত আয়াতটির সংবাদ তাদেরকে জানিয়ে দেওয়ার পর, সকালবেলা রাসূল (সা) হাসান (রা) ও হোসাইনকে (রা) তাঁর চাদরে আবৃত করে বের হয়ে আসলেন। এবং তাঁর পেছন পেছন হেঁটে আসছিলেন ফাতেমা (রা)।”[5]
এছাড়া অসংখ্য হাদীস থেকে জানা যায়, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফাতেমাকে (রা) প্রকাশ্যে ‘দেখা’ যেতো এবং তিনি স্বাভাবিকভাবে পুরুষদের সাথে কথাবার্তাও বলতেন।
তবে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত, নারী বা পুরুষদের মসজিদে গমনের অযুহাতে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দায়িত্বের ব্যাপারে যেন অবহেলা না করা হয়। যদিও ব্যক্তি, পরিবার ও বিশেষ পরিস্থিতি সাপেক্ষে এটি আপেক্ষিক ব্যাপার। এ কারণেই রাসূল (সা) উম্মে হুমাইদকে (রা) তাঁর পরিবারের কাছাকাছি থাকতে বলেছিলেন, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। একই কারণে তিনি জুমার নামায মসজিদে আদায় করাকে পুরুষদের জন্য যেমন আবশ্যক করেছেন, নারীদের জন্য তেমনটা করেননি। এ বিষয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে নারীদেরকে একটা বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেহেতু তাদেরকে নানান ধরনের পারিবারিক বিষয় ও দায়দায়িত্ব সামাল দিতে হয়। বিশেষত মায়েদেরকে তাদের ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হয়।
যাইহোক, সাধারণ নিয়ম হলো— নারীরা যদি মসজিদে যেতে চায়, তাহলে তাদেরকে বাধা দেওয়া যাবে না। ঘরে বা অন্য কোথাও নামায পড়ার চেয়ে মসজিদে নামায আদায় করা নারীদের জন্যও উত্তম এবং বেশি সওয়াবের কাজ।
[মূল: ড. জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]
***
অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেফারেন্স ও নোট:
[1] বায়হাকী, ১৯০/৩; ইমাম তাবারানী, মুজামুল কবীর, ১৪৮/২৫ এবং আহাদ ওয়াল মাসানী, ১৫০/৬।
[2] বুখারী, ১১৯০; মুসলিম, ১৩৯৪। বুখারী ও মুসলিমের অন্যান্য বর্ণনায় এবং অন্যান্য গ্রন্থে হাদীসটির অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।
[3] উদাহরণ হিসেবে দেখুন— www.almunajjid.com/6433
[4] আলবানী তাঁর ‘সিলসিলাতুল যয়ীফাহ’ (দুর্বল হাদীস সংকলন) গ্রন্থে হাদীসটিকে (নং ৫৭৪৩) সনদের দিক থেকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া দেখুন— আবু নাঈম, আল হিলয়াহ, ২/৪০; এবং অন্যান্য।
[5] তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৫৪/২।