নারীবাদ প্রসঙ্গে আমার ভাবনা
নারীবাদের ধারণাকে পুরোপুরি হেসে উড়িয়ে দেয়ার বদলে আমাদের উচিত এর কিছু বিষয়কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনা। একথা অকাট্য সত্য যে নারীরা প্রত্যেক সমাজেই তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আজকের দিনে নারীবাদের যে র্যাডিক্যাল ফর্মেশন আমরা দেখতে পাই- তা মূলত বহুদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। পুঁজিপতিদের দমন পীড়নের ফলে সমাজতন্ত্রের যেরকম কিছু কনসেপচুয়াল আইডিয়ার বিকাশ হয়েছিলো- নারীবাদের ক্ষেত্রেও প্রায় তেমনটাই ঘটেছে।
‘পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস’ – এই ধরণের ফলস বাইনারি ধারণাগুলোর বিকাশ ইতিহাসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো। যেহেতু পুঁজিপতিরা শাসন আর শোষণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল- তাই সেসব পুঁজিপতিদের দমন কিম্বা হত্যা করাই যেন সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে হয়েছিলো শ্রমিক জনতার কাছে। রুশ বিপ্লবে মারা পড়েছিলো লক্ষাধিক মানুষ। জুলুমের শাস্তি দেয়া হয়েছিলো অন্য আরেক জুলুম চর্চার মাধ্যমে। তারপরও, শান্তি কি এসেছে? ইম্প্র্যাক্টিক্যাল আইডিয়ালিস্টিক চিন্তাভাবনা আদতে এক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনই তার জলন্ত প্রমাণ। কিন্তু শ্রেণি বৈষম্যের সমস্যা তো আজও বিদ্যমান! সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার। কিন্তু সমাজের একটা বৃহৎ অংশকে পুরোপুরি ডিমোরালাইজ করে কিম্বা অস্বীকার করে কখনো সমাজ সংস্কার করা যায় না।
ইকোনমিক রেইসিজমের মতো নারীবাদীতাও একটা পর্যায়ের পর সেক্সুয়াল রেইসিজমের রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজতন্ত্রীদের মতো নারীবাদীদেরও মনে হতে থাকে- ‘পৃথিবীর ইতিহাস মূলত নারীদের প্রতি বৈষম্যের ইতিহাস।’ যেন নারী সমস্যাই পৃথিবীর মূল সমস্যা, এ ছাড়া আর কোন সমস্যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে বিদ্যমান নেই। কমিউনিজম যেমন করে একপর্যায়ে ধনীদের প্রতি বিদ্বেষের রূপ নিয়েছিলো- তেমনি র্যাডিক্যাল ফেমিনিজমের চিন্তাভাবনাগুলোও একপর্যায়ে পুরুষ বিদ্বেষী রূপ গ্রহণ করে। নারীবাদ যখন সোশাল ডগমায় পরিণত হয়- তখন সমাজের নারীরা নিজেদের পুরুষের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে, যা আদতে প্রকৃতি বিরুদ্ধ। বাস্তবতা হলো নারী বা পুরুষ- আমরা কেউই কারো প্রতিপক্ষ নই। আমাদের ভেতরকার সম্পর্ক হওয়া উচিত অংশীদারিত্ব আর সহযোগিতার।
আজকাল নিজেদের প্রটেকশনের জন্য পর্দা করার কথা বলা হলে নারীবাদীরা বলে- ‘ধর্মে বলা আছে নিজের দৃষ্টিকে সংযত করো। তাই পুরুষদের উচিত বরং নিজেদের চোখের পর্দা করা।’ আসলে আল্লাহ নারী পুরুষ উভয়কেই নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত করতে এবং জমিনে বিনয়ের সাথে চলাচল করতে বলেছেন। এখন বাস্তবতা হলো নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগিতা ছাড়া পর্দার আমল করাটা উভয়ের জন্যই এক প্রকার দুঃসাধ্য কাজ। নারীরা (টাইটফিট আর চিত্তাকর্ষক) পোশাকের মাধ্যমে পুরুষের হৃদয়ে আকর্ষণ তৈরির চেষ্টা করলে পুরুষরা স্বাভাবিকভাবে শারীরিক মানসিক উভয়ভাবেই আকর্ষিত হবে, এটাই বাস্তবতা। এখন কোন মেয়ে যদি বলে ‘আমার এমন পশ্চিমা পোশাক পরাতে পুরুষদের আকর্ষণ করার কোন উদ্দেশ্য নেই- তাহলে বলতে হবে হয় যে চরম মিথ্যাবাদী, নয়তো মানসিক রোগী।
আমরা হয়তো গোটা দুনিয়াকে পরিবর্তন করতে পারবো না। কিন্তু আমাদের মুসলিম সমাজের নারী পুরুষ সবারই উচিত ধর্মের মূল দাবীগুলো পূরণ করা- তাহলে সমাজের অজাচার কমে আসবে। মেয়েদের ভেতরকার সৌন্দর্যবোধ আর প্রশংসা প্রাপ্তির প্রবৃত্তি প্রাকৃতিকভাবেই বিদ্যমান। ছেলেদের ভেতরেও এই প্রবৃত্তি স্বাভাবিকভাবেই আছে। শালীনতা বজায় রেখে যে সৌন্দর্যবোধ আর তার চর্চা- এতে একপ্রকার ঐশ্বরিক ব্যাপার আছে। সুন্দর ও মার্জিত রুচিবোধ মানুষের পোশাকে এবং আচরণে সমভাবে প্রকাশ পায়। মানুষের রুচিশীলতা তার ভেতরকার ব্যাপার। অনেক দিনের স্বতস্ফূর্ত প্রচেষ্টা আর অভ্যাসের ব্যাপার। একজন চমৎকার মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটাতে পারাও চমৎকার ব্যাপার। প্রশান্ত আত্মার সান্নিধ্যে অপর একজনের আত্মাও পবিত্র হয়ে ওঠে। তাই সৌন্দর্যের চর্চা হয়ে উঠুক শালীন, পরিশীলিত ও মার্জিত।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকগুলো মত পথ নিয়েই একেকটি সমাজ গড়ে ওঠে। সমাজের একাংশকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কিম্বা তাদের ডিমোরালাইজ করে কখনো কোন সামাজিক সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। নারীবাদের সমস্যা মূলত পুরুষেরও সমস্যা। আপনার বোন কিম্বা স্ত্রীর নারীবাদী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আপনার দায় আপনি কখনোই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা ভাবুন। আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা কিম্বা বোনকে কতটা ভালোবাসেন- তা কথায় ও কাজের মাধ্যমে প্রদর্শনের ব্যাপারে প্যাসিভ হবেন না। সমস্যা আছে- এটা মেনে নেয়াই সমাধানের প্রথম ধাপ। তারপর পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর সহযোগিতার মনোভাব যতটা উন্নত করা যাবে ততই আমরা সমাধানের পথে পৌঁছাতে পারবো। নারীদেরও উচিৎ তাদের বেটার হাফ, সন্তান অথবা ভাইকে সাহায্য করা; তাদের দায়িত্বগুলোর কথা সুন্দর ভাষায় মনে করিয়ে দেয়া। সম্পর্ক আর ধার্মিকতার ক্ষেত্রে ইগোর চর্চা সকল প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করে দেয়। ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে হয় তারচেয়েও বেশি। শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা- এগুলোর হাত ধরে যা অর্জিত হয়- তা অধিকার অর্জনের চাইতেও বেশিকিছু। সামাজিক সচেতনতা আর বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব এনে দিতে পারে সামাজিক বিপ্লব।
আমরা হয়তো আমাদের ভেতরকার সমস্যাগুলোকে নিমেষেই মিটিয়ে দিতে পারবো না। কিন্তু নিজের প্রতি সৎ থাকার প্রেরণা এবং সমস্যার সঠিক উপলব্ধি যদি অর্জিত হয়- তাহলে সমাধানের পথ তরান্বিত হবে। সবার আগে পরিবর্তন আনতে হবে নিজের মননে, কথায়, কাজে। নিজের পরিবার আর কাছের মানুষগুলোর যত্ন নেয়া দরকার। প্রাণে প্রাণে ভালোবাসা ছড়ানো দরকার। কেউ যেন আমার কারণে নিজেকে বঞ্চিত মনে না করে!
সুন্দর ,গোছানো ভারসাম্যপূর্ণ লেখা। বিশেষ করে কয়েকটা পয়েন্টে খুবই সুন্দর চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। লেখকের কাছ থেকে সামনে এরকম আরও আশা করি…:-D
(ছোট্ট একটা পরামর্শ : লেখকের পরিচয়ের ঘরটাতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বানানটা একটু ঠিক করে নিবেন।জাযা-কাল্লাহ…)