মাদরাসাগুলো এখন যাদুঘরে পরিণত হয়েছে

[‍ড. মোহাম্মদ আকরাম নদভীThe Role of Education in Solving Societal Problems” শীর্ষক একটি লেকচার দিয়েছিলেন ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। সেখানকার কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে অনুবাদ করেছি।]

আমাদের মাদরাসা সিস্টেম ‘যাদুঘরের’ মতো। আর যাদুঘর মানে কোনো প্রাণ নেই যেখানে। পুরাতন ইতিহাস। বর্তমান সমাজব্যবস্থার কোনোরূপ মিল নেই মিউজামে। আপনি সেখানে জানবেন, প্রস্তর যুগের মানুষরা কী ব্যবহারে আর আচারণে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু আপনি তো আর প্রস্তর যুগে বাস করছেন না। তাই মিউজিয়ামে আধুনিক যুগের সলুশ্যান নেই।

আপনি যদি মিউজিয়াম বানান, আর প্রস্তর যুগের সকল বিষয়ে খুবই ভালো জানেন। বলুন তো, এ মিউজিয়াম থেকে শিক্ষিত হয়ে এ যুগের কোনো সমাধান দিতে পারবেন? না, পারবেন না। ‘প্রস্তর যুগ’ সম্পর্কে শিখেছেন কিন্তু বর্তমান যুগ সম্পর্কে কিছুই শিখেননি। আর এই মাদরাসাগুলো ‘প্রস্তর যুগের’ সমাধান দেয়।

গ্রিক ফিলোসোফি, গ্রিক লজিক [মানতেক], অন্য যত সকল বিষয়ে মাদরাসায় শিখলেন, একটাও বর্তমান সমাজের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। এ মাদরাসা থেকে পড়ে বের হোন তখন একটা নতুন পৃথিবীতে আসেন যেখানকার আপনি কিছুই জানেন না। আর তখন কীভাবেই বা আপনি বর্তমান সময়ের সমস্যার সমাধান করবেন? মাদরাসা থেকে পড়ে এসেছেন, কিন্তু কুরআন কখনো বুঝেননি। মাদরাসা কারিকুলাম দেখুন, দেখবেন সেখানে কুরআন নেই।

‌‘দারসে নেজামি’ সবচেয়ে জনপ্রিয় কারিকুলাম। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এটি প্রায় তিনশো বছর ধরে চলমান। এ কারিকুলামে কুরআনের স্থান নেই। কারিকুলামের প্রায় ৮০% কিতাব গ্রিক লজিক ও গ্রিক ফিলোসফির উপর। আমাকে বলুন, ইন্ডিয়ার ইসলামী কারিকুলামে গ্রিক লজিকের কী প্রয়োজন?

ইন্ডিয়ার লক্ষ্ণৌতে ওলামারা কারিকুলাম অনুযায়ী যে বইগুলো পড়ান তার ৮০% গ্রিক লজিক আর গ্রিক ফিলোসফির। এসবের মাত্র কিছু টেক্সটবুক আর অধিকাংশ ফুটনোট ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ (হাশিয়া)। শুধু চিন্তা করুন, যদি এ কারিকুলামে পড়েন তাহলে আপনি মানুষের প্রয়োজনে কি কিছু করতে পারবেন?

৮০% বই এ রকম। আর বাকি ২০% হলো আরবী গ্রামারের। গ্রামারের বইগুলো কোনোক্রমেই পড়া যায় না। কোনো কাজের না। আল্লামা শিবলী নোমানি ‌‘শরহে নেযামী’ (অন্যতম গ্রামার বই) সম্পর্কে বলেন, এ বইটিতে ‘গ্রামার ছাড়া’ বাকি সব কিছু আছে। গ্রামার বই থেকে গ্রামার শিখছেন, কিন্তু গ্রামারের কিছুই শিখছেন না!

আর হাদীসের গ্রন্থ মাত্র একটি! মিশকাত। বুখারী নেই, মুসলিম নেই, আবু দাউদ নেই! মূল সোর্সের কোনো বই নেই। আছে শুধু একটা বই— ‘মিশকাত’। আর তা পড়েই এ কারিকুলামের ছাত্ররা হয়ে যান ইন্ডিয়ার ‘ওলামা’!

কুরআনের তাফসীর হিসেবে পড়ানো হয় ‘জালালাইন’। আর কোনো বিখ্যাত তাফসীর নাই! আল্লামা শিবলী নোমানী বলেন, কুরআনের শব্দ সংখ্যার চেয়েও এই তাফসিরের শব্দ সংখ্যা কম। অথচ এই তাফসীরটাই পড়ানো হয়।

কারিকুলামে গ্রিক ফিলোসফির আশি ভাগ বই কি কুরআনের তুলনায় জীবনের জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক আর বাস্তবভিত্তিক?

বলুন, যদি কুরআনই না বুঝেন, তাহলে কীভাবে আপনার সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধান করবেন? তাই বলতে চেয়েছি, এটি মিউজিয়ামের মত অকার্যকর।

তারা গ্রিক লজিক এ যুগেরটা শিখে না। শিখে প্রাচীন সময়ের। এমনকি তারা ইবনে সীনা, ফারাবীকেও শিখে না। তারা এরিস্টেটলকেও সরাসরি শিখে না। হাল আমলের লোকদের বই থেকে শিখে। তারা সব করাপ্ট লজিক আর লিখাসমুহ শিখে। গ্রিক ফিলোসফির যে বইগুলো ইন্ডিয়ান মাদ্রাসাগুলোতে শিখানো হয় সেগুলো গ্রামারে ভুলে ভরা। আমি বইগুলোর মাঝে অসংখ্য ভুল খুঁজে পাই। এসব পড়ে ছাত্ররা কি কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে? বেসিক্যালি, এ কারণে মাদরাসাগুলো যাদুঘরে পরিণত হয়েছে।

যদি ওয়েস্টার্ন শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকান, অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে আসেন, তাহলে বুঝবেন, আপনি ‘ইসলাম’ শিখছেন নাকি ‘ইসলাম সম্পর্কে’ শিখছেন। তারা আপনাকে ‘হাদীস’ শিখাবে না, শিখাবে ‘হাদীস সম্পর্কে’। হাদীসের ইতিহাস, এটি কীভাবে লেখা হয়েছে ইত্যাদি।

আপনি কোনো ফিকাহ জানবেন না। অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজের ইসলামিক স্টাডিজের যে কোনো প্রফেসরকে ফিকাহর ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন না। কারণ, তারা ফিকাহ জানে না। তারা জানে ফিকাহ সম্পর্কে। ফিকাহ কত পুরাতন, রোমান আইনের উপর এর প্রভাব, এটি কোথা থেকে নেয়া হয়ে হয়েছে— এসব আইডিয়া। শুধু আইডিয়া জানে, কিন্তু এসব বিষয়ে তারা কিছু জানে না।

যদি এসব ইউনিভার্সিটিতে ইসলাম সম্পর্কে শিখতে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি হাদীস শিখবেন না, ফিকাহ শিখবেন না। বুখারী সম্পর্কে জানবেন না। অক্সফোর্ডের ইসলামিক স্টাডিজের অনেককে জানি, যারা সহীহ বুখারী কী জিনিস তা জানে না। আমি বুখারীর বেসিক কিছু ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি যে তারা সেগুলো জানে না। অথচ তারাই বুখারী-মুসলিম শেখায়। আমাকে বলুন, তাহলে কীভাবে তাদের নিকট থেকে শিখব?

আধুনিক মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ইসলাম নিয়ে জ্ঞান শিক্ষা না দিতে পারে, তাহলে কীভাবে দাবি করবেন, আপনি কুরআন জানেন? আপনি কুরআন, বুখারী, মুসলিম, ফিকাহ, আবু হানিফা, হাম্বলী, শাফেয়ী জানবেন না। শুধু জানবেন তাদের নাম। কিন্তু আসলে জানবেন না তারা কী করেছেন। তাই আমাদের জ্ঞানগুলো ভাসাভাসা।

আর এটিই মিউজিয়ামের নলেজ। এর সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এই জ্ঞান দিয়ে বিশ্বের বা আমাদের কোনো সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারবো না। অবস্থা যদি এরকম হয়, আর অভিযোগ করি যে আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করছে; তাহলে তো তাদের ইসলাম ত্যাগ করাই উচিত! কারণ, তারা যা শিখছে স্কুল-ইউনিভার্সিটি থেকে তা আসলে অনেক প্রাসঙ্গিক। কিছুটা হলেও তারা কিছু প্রয়োগ করতে পারছে। তারা কিছু দেখাতে পারছে, সঠিক যুক্তি দেখাতে পারছে। স্কুলের প্রথম থেকেই শিক্ষা দেয়া হয় যে একটা ‘রচনা’ লিখতে হলে সাম্প্রতিক সোর্স, প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সোর্স থেকে ইনফরমেশন নিয়ে লিখতে হবে। ‘এ লেভেলের’ একটা বাচ্চাও এটা জানে।

আর এ দেশের কোনো মুফতির কাছে ফতোয়ার জন্য যান, দেখবেন তিনি লেটেস্ট পসিবল সোর্স অনুযায়ী বলবেন, কিন্তু কোনো ইসলামের প্রাথমিক সোর্স থেকে বলবেন না। ফতোয়া জিজ্ঞেস করলে বলবে না যে আপনি মোহাম্মদ শাইবানি, বুখারি ইত্যাদি পড়ুন। বাদাউস সানায়া হেদায়া পড়তে বলবে না। এমনকি ফতোয়া ইবনে আবেদীন, হাসি ইবনে আবেদীন, শামেয়ী-ফতোয়া আলমগীরী পড়তে বলবে না। শুধু বলবে— পড়ুন ফতোয়া রহিমিয়া। ফতোয়া রহিমিয়া উর্দু ভাষায় সমসাময়িক সময়ে লিখিত। আমাকে বলুন, এটা কি স্কলারশিপ? মুফতির কাছে যান, বুকসেল্ফ থেকে ফতোয়া রাহিমিয়া-মাহমুদিয়া বের করে ফতোয়া লিখে দিবে। সে প্রাথমিক সম্ভাব্য সোর্স খুঁজতে একটুও কষ্ট করবে না। এ ফতোয়াগুলোতে কুরআন-হাদিসের কোনো রেফারেন্স পাবেন না। দশ খণ্ডের এসব ফতোয়া গ্রন্থে কুরআন-হাদিসের কোনো উল্লেখ নেই! সবকিছুতে অন্য মুফতির রেফারেন্স! তাহলে লোকজন এসব ফতোয়া শিখে কি হেদায়েত পাবে?

রাসূল (সা.) কুরআন পেয়েছিলেন, যা সকল আসমানী কিতাব বাতিলে সক্ষম ছিল। আমাদের হাতেও সেই একই কুরআন আছে, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। লোকজন তারাবী নামাজে কুরআন পড়ে, কিন্তু হেদায়েতের জন্য কুরআন থেকে বুদ্ধি নেয় না। কুরআন বলে, মুত্তাকিনদের জন্য এটি হেদায়েত। আর ওলামারা জোর দেয় তারাবীতে কুরআন শেষ করতে হবে। আর এই ওলামারাই কুরআন থেকে কোনো দিকনির্দেশনা নেয় না। তাদের সামনে কোনো সমস্যা আসলে ‌‘হেদায়া’ কিতাবে সমাধান খোঁজে, কিন্তু কখনো কুরআনের কাছে যায় না। তাদেরকে উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তারা ‘সিরাজী’ কিতাবের কাছে যায়, কিন্তু কুরআনের কাছে যায় না। তাদেরকে আধ্যাত্মিকতা (তাজকিয়্যা তথা অন্তরের পরিশুদ্ধি) নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা ইমাম গাজালীর ‘এহইয়া উলুমুদ্দীন’ অথবা মাওলানা রুমির কাছে যায়, কিন্তু কুরআনের কাছে যায় না। অথচ কুরআনটা এসেছেই তাজকিয়্যার জন্য, কিন্তু তারা তা থেকে পরামর্শ নেয় না।

আমরা যদি পরিস্থিতি ভালো করে না বুঝি, সংস্কার না করি; তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ থেকে খারাপের দিকে চলে যাবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই গভীরভাবে, যথাযথভাবে সংস্কার করা দরকার। আমাদের এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যা শিখাবে কীভাবে বুঝতে হয়, কীভাবে চিন্তা করতে হয়। তখনই আমাদের ছেলেমেয়েরা কুরআন বুঝবে, শিখবে, জানবে।

সাহাবীরা বলেছেন, আমরা কুরআন শিখার আগে ‘ঈমান’ শিখেছি। আর আমরা কখনোই ‘ঈমান’ শিখি না। কেউ বলুন তো, আপনারা কেউ ‘ঈমান’ শিখেছেন? অধিকাংশ মানুষ, এমকি ওলামাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, ঈমান বলতে কি বুঝায়? তারা বলতে পারবে না। তাদের জিজ্ঞেস করুন, ঈমান আর ইসলামের মধ্যে পার্থক্য কী? তারা বলতে পারবে না। যদি আমরা ঈমান না শিখি, তাহলে কীভাবে ইসলামকে জানবো? সাহাবীরা আগে ঈমান শিখেছেন, তারপর ইসলাম। আর আমরা না ঈমান শিখি, না কুরআন শিখি। এটাই আসল সমস্যা। এটাই সমাধান করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *