আল-মুহাদ্দিসাত: একটি সামগ্রিক বিশ্লেষণ

[ড. আকরাম নদভীর এ সাক্ষাৎকারটি লাইভ সম্প্রচারিত হয় ১ মে, ২০২১ তারিখে, ইস্ট লন্ডন মস্ক অ্যান্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টারের ইউটিউব চ্যানেলে। তাঁর লেখা ‌‘Al-Muhaddithat: The Women Scholars in Islam’ শীর্ষক বইটির অনুবাদের কাজ করার কারণে খুব ইচ্ছা করছিলো, এই কথাগুলোকে বই প্রকাশের আগেই দিনের আলোতে নিয়ে আসার। স্বাদবর্ধক হিসেবে দারুণ কিছু চিন্তার খোরাক এসেছে এখানে। অনুবাদে সহায়তা করেছেন শরিফ সাইদুর।]

আরজু আহমেদ: আসসালামু আলাইকুম। আজকের বিকেলে ইস্ট লন্ডন মসজিদের ভার্চুয়াল এই আয়োজনে আমাদের সাথে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকে জানাচ্ছি উষ্ণ অভ্যর্থনা। আমি আরজু আহমেদ, ‘মুসলিম উইমেন হিস্ট্রিজ প্রজেক্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা। আমি নাফিয়েল্ড কাউন্সিলে বায়ো-এথিকস গবেষক, সেই সাথে আল-মুহাদ্দিসাতের পাবলিকেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি। আল-মুহাদ্দিসাত নিয়ে আলোচনার জন্যই আজকে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি। আমাদের সৌভাগ্য যে নারী মুহাদ্দিসদের নিয়ে লেখা এই বইটি নিয়ে ইউকেতে প্রথম আয়োজনটি করছে ইস্ট লন্ডন মসজিদ। ২০০৫ সালের এক শনিবার বিকেলে এই মসজিদেই আমি শাইখ ড. আকরাম নদভীর কাছে প্রথম ক্লাস করি। যদ্দুর মনে পড়ে, সে ক্লাসটি ছিলো ইমাম মালিকের সংকলিত মুয়াত্তার ওপর।

আমার খুব ভালো লাগছে যে এই বইটি উপলক্ষ্যে আমরা আবার একসাথে কথা বলছি। আজকে যে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করবো, তা হলো হাদীস শাস্ত্রের চর্চা ও ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে নারীদের ভূমিকা। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এ সংক্রান্ত শাইখ মোহাম্মদ আকরাম নদভীর লেখা ৪৩ খণ্ডের বই— ‘আল-ওয়াফা বি আসমায়িন নিসা’। সংকলনটি প্রকাশ করেছে জেদ্দাস্থিত ‘দারুল মিনহাজ’। প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০২১। এখানে শাইখ আকরামের বিশ বছরের গবেষণার ফলাফল সন্নিবেশিত আছে। তিনি এখানে ১০ হাজারেরও বেশি সংখ্যক মুসলিম নারীর নাম লিপিবদ্ধ করেছেন, যাঁরা হাদীস চর্চার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য চমকপ্রদ। অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমি প্রিয় শিক্ষক ড. আকরাম নদভীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা ইতোমধ্যে তাঁকে চেনেন। তিনি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামাতে হাদীস নিয়ে গবেষণা করেছেন, পরবর্তীতে অক্সফোর্ড সেন্টার অফ ইসলামীক স্টাডিজের ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি সহীহ মুসলিমের ওপর কাজ করছেন। অবশ্য আমি জানি না কাজটা কতদূর এগিয়েছে।

আসসালামু আলাইকুম শাইখ! আপনাকে দেখে ভালো লাগছে।

আকরাম নদভী: ওয়ালাইকুমুস সালাম।

আরজু আহমেদ: আমরা একই শহরে আছি। এখনকার পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, অনলাইনে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়াটাই ভালো।

যা হোক, আমাদের আলোচনার ধরন হবে মোটামুটি এরকম: প্রথম ২০/২৫ মিনিট আমরা শাইখ আকরামের সাথে কথা বলবো। এরপর আমরা আপনাদেরকে সুযোগ দিতে চাই শাইখকে প্রশ্ন করার এবং আমাদের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণের। শুরু আগে আমি বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ অনুষ্ঠানটি রমজান মাস উপলক্ষ্যে ইস্ট লন্ডন মসজিদের ‘স্টে কানেক্টেড’ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আয়োজিত হচ্ছে। এই লাইভ অনুষ্ঠানটি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ইস্ট লন্ডন মসজিদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেইজ, ইউটিউব চ্যনেল এবং টুইটারে। এই সুযোগে আমি ইস্ট লন্ডন মসজিদকেও আন্তরিক ধন্যবাদ দিই, যাঁরা এরকম একটি সময়োচিত এবং প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন।

শাইখ আকরাম, প্রথমে আপনার কাছে জানতে চাই, কেন আপনি নারী মুহাদ্দিসদের নিয়ে এরকম একটি সংকলন করতে চেয়েছিলেন? আপনি কি শুরুতে বুঝতে পেরেছিলেন যে এর কলেবর এমন দাঁড়াবে?

আকরাম নদভী: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আ’লামীন। আসসালামু ওয়াসসালাতু আ’লা রাসূলিহিল মুহাম্মাদ, ওয়া আ’লা আলিহি ওয়া আসহাবিহী, আম্মা বা’দ। প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমি বলবো, এই প্রথম আমরা বইটি নিয়ে আলোচনা করছি। আপনি বলেছেন, এই ইস্ট লন্ডন মসজিদেই আপনি আমার সাথে প্রথম ক্লাস করেছিলেন। আসলে অক্সফোর্ডের পর এখানেই আমি প্রথম ইংলিশে পড়াতে শুরু করেছিলাম। আমাদের ভাই আবদুল্লাহ আল ফালেককে আল্লাহ এজন্য উত্তম প্রতিদান দিন, তিনিই এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারপরে অনেক স্থানে আমি মুয়াত্তা, কুদূরী এবং আরবী ব্যাকরণের ক্লাসগুলো নিতে থাকি। এখানেই আরও দুইজন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়– শাফি এবং জুনায়েদ। তাঁরা আমাকে ‘ফিকহুল ইসলামী’ লিখতে অনুরোধ করেন। আল্লাহ তাঁদেরকে বরকত দিন। আলহামদুলিল্লাহ।

আপনার প্রশ্নের জবাবে আসি। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, ১৯৯৫ সালে আমি ইন্ডিয়ায় ছিলাম। তখন কিছু লেখালিখি করতাম। বড় ধরনের কিছু নয়, আরবীতে কিছু আর্টিকেল লিখতাম। সেসময় মুসলিম নারীদের নিয়ে টাইমস পত্রিকায় এক ভদ্রলোকের লেখা কয়েকটা আর্টিকেল পড়লাম। লেখাগুলোতে তিনি বলার চেষ্টা করছিলেন, ইসলাম আসলে জ্ঞান অর্জনের দিক দিয়ে নারীদের কত পশ্চাদপদ করে রেখেছে! আমার মনে হলো, লেখাগুলোতে তথ্যের অভাব আছে, লোকেরা আসলে অনেক কিছু জানেই না। যেহেতু আমি হাদীস শাস্ত্র নিয়েই পড়াশোনা করতাম, তাই জানতাম যে কত বিপুল সংখ্যক নারী হাদীসের শিক্ষক ছিলেন, হাদীস চর্চাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমার মাথায় তখন কিছুই ছিলো না, না কোনো পরিকল্পনা, না কোনো প্রস্তাবনা। আমি ভাবলাম, নারীদের এই তথ্যগুলোকে একত্র করবো। হয়ত বড়জোর দুয়েক খণ্ডের একটা কাজ হবে। অন্তত এইসব অপপ্রচার কিংবা ভুল বোঝাবুঝির একটা জবাব দেয়া যাবে। আরও একটা লাভের কথাও মাথায় এসেছিলো। সেটা হলো, এই বই থেকে মুসলিম নারীরা জ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত হবেন। যদিও জ্ঞানের অনেক শাখায় নারীরা আজকাল অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু ইসলামকে জানার ক্ষেত্রে তারা অনেকটা পথ পিছিয়ে আছে। হয়তো এই কাজটি তাঁদেরকে কুরআন এবং হাদীসকে জেনে বিদূষী হতে উৎসাহিত করবে। শুরুতে আমি ভাবতেই পারিনি যে কাজটা এত বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। যা হোক, হয়তো আল্লাহ এখানে তাঁর বরকত ঢেলে দিয়েছেন যেন আমরা এ সময়োপযোগী কাজটা শেষ করতে পারি। আমি যতই গবেষণা করছিলাম ততই নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছিলো। আরও সময় দিলে আরও বেশি নারীদের ইতিহাস বেরিয়ে আসতো। মনে আছে, ২০১০ সালে কাতার গিয়েছিলাম। তখন শাইখ কারযাভী আমাকে এ নিয়ে তাঁর মসজিদে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেন। নারী মুহাদ্দিসদের এই বিপুল সংখ্যা দেখে তিনিও বিস্মিত হন এবং বলেন আমি যেন আপাতত এ কাজের ইতি টানি। নইলে এটি আসলে কোনোদিনই শেষ হবে না। আমি তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করি। ওই সফরে কাতার ইউনিভার্সিটিতে আমি এ বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিই। ওখানে এক শ্রোতা বললেন, এই ধরনের কাজ নাকি নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের এক ধরনের ষড়যন্ত্র! তো, এভাবেই আসলে কাজটি শুরু হয়েছিলো।

আরজু আহমেদ: আপনার এই পথচলা নিয়ে আরও শুনতে চাই। আপনি কি দর্শক-শ্রোতাদের জন্য বইয়ের নামটি অনুবাদ করে দেবেন?

আকরাম নদভী: ভালো কথা। আপনারা হয়তো জানেন যে হাদীস চর্চার শুরু থেকেই হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবন নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিলো। কারণ, কোনো হাদীসের উৎস নির্ভরযোগ্য কি না, তা আসলে বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি, জ্ঞান ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। এ নিয়ে লেখা একটি বই হলো মাকদিসীর লিখিত ‘আল-ক্বামাল ফী আসমাইর রিজাল’। ‘আল ক্বামাল’ অর্থ হলো পরিপূর্ণতা, অর্থাৎ এর মাধ্যমে হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনী লিপিবদ্ধের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। এরপর ইমাম মিজ্জী আরও অনেক তথ্য সংযোজন করেন। তিনি তাঁর ৩৫ খণ্ডের বইয়ের নাম দেন ‘তাহজীবুল ক্বামাল ফি আসমাইর রিজাল’। সেখানে কিন্তু কিছু নারীর উল্লেখ ছিলো, যদিও তা খুব বেশি নয়। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন মনে হয়েছিলো আমিও এই প্যাটার্নের নামই ঠিক করবো। ওয়াফা মানেও হলো পরিপূর্ণতা এবং নিসা হলেন নারীরা। সুতরাং এর নাম দেওয়া হলো ‘আল ওয়াফা বি আসমায়িন নিসা’।

আরজু আহমেদ: আপনি নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী সংগ্রহের বিষয়টি সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছেন। আমার মনে হয়, হাদীস শাস্ত্রের চর্চায় মুহাদ্দিসদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, শ্রোতাদের তা জানা থাকা দরকার। আলোচনার গভীরে যাবার আগে আপনি যদি খুব সংক্ষেপে এই বিষয়টি বুঝিয়ে বলতেন।

আকরাম নদভী: আপনি জানেন, যতদিন রাসূল (সা.) জীবিত ছিলেন ততদিন জ্ঞানের উৎস ছিলো কুরআন এবং তাঁর সুন্নাহ। আসলে সুন্নাহ হলো কুরআনের প্রয়োগ। কুরআনের প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতেন, তাকেই আমরা সুন্নাহ হিসেবে জানি। তার মানে কুরআন এবং সুন্নাহ আসলে একত্রেই কাজ করে, এ দুটির মাঝে কোনো বিরোধ নেই। সাহাবীরা সুন্নাহকে তেমনভাবেই গ্রহণ করতেন, যেমন দ্বিধাহীনভাবে তাঁরা কুরআনকে মেনে নিতেন। রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী কুরআনকে বিন্যাস্ত করে গেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর কুরআন একই থাকলেও সুন্নাহ কিন্তু আর তৈরি হয়নি। কারণ, মানুষের পক্ষে তাঁকে কিছু করতে দেখা, কিংবা তাঁর কথা শোনার সুযোগ আর ছিলো না। মানুষ তাঁদের কাছ থেকেই শুনতো, যারা তাঁকে দেখেছিলো। সাহাবীরাই পরবর্তী মানুষের কাছে সুন্নাহকে এভাবে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এভাবেই সুন্নাহ ক্রমান্বয়ে হাদীস হয়ে ওঠে।

অনেকেই হাদীস এবং সুন্নাহর পার্থক্য বোঝেন না। সুন্নাহ হলো আল্লাহর রাসূল (সা.) কর্তৃক কুরআনের অনুশীলন। আর হাদীস হলো এই অনুশীলনের তথ্যগুলোকে পরের জেনারেশনের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বর্ণনা করা। এই বর্ণনা সাহাবীরা দিয়েছেন তাবেয়ীদের কাছে, তাঁরা আবার পৌঁছে দিয়েছেন পরবর্তী যুগের মানুষের কাছে। তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন, সুন্নাহ নির্ধারিত। কিন্তু হাদীসের প্রসঙ্গে আসলে আপনি অনেক ধরনের ঘটনা দেখবেন। হাদীস সহীহ হতে পারে, সহীহ নাও হতে পারে, বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য বা অনির্ভরযোগ্য হতে পারেন, ইত্যাদি। এজন্য হাদীস সংকলকগণ অনেক কিছু বিবেচনা করেছেন— বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি কেমন, দ্বীন সম্পর্কে তাঁর বুঝ কেমন, তিনি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য ইত্যাদি। এভাবে হাদীসকেও বিভিন্ন রকম শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন সহীহ হাদীস হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা, হাসান হাদীস কিছুটা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা, কিছু হাদীস আবার মুনকার, ইত্যাদি। এমনকি এমনও হাদীস পাওয়া যায় যেগুলোর বর্ণনাকারী আসলে সত্যবাদীই ছিলেন না। এখানে একটু চমকপ্রদ কথা বলছি। আমার লেখা বইটিতে দশ হাজারেরও বেশি নারী হাদীসচর্চাকারীর কথা এসেছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। আপনি যদি আসমাউর রিজাল অর্থাৎ হাদীসের রাবীদের জীবনীশাস্ত্র দেখেন, তাহলে কয়েক‌ শত বর্ণনাকারী পাওয়া যাবে যাঁরা হাদীসকে বিকৃত করেছে। এগুলোকে বলা হয় মওজুয়াত, অর্থাৎ মনগড়া হাদীস। অথচ বিপুল সংখ্যক নারী হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজনকেও পাওয়া যায়নি যিনি হাদীস বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন বা মনগড়া হাদীস বর্ণনা করেছেন। ভুল হতে পারে সবারই, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীস বিকৃত করার অভিযোগ একজন নারীর নামেও নেই। নারী হাদীস বর্ণনাকারীদের এটি একটি বড় গুণ।

আরজু আহমেদ: এই পার্থক্যের কারণ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

আকরাম নদভী: এর একটা কারণ হতে পারে, জ্ঞানের প্রতিযোগিতা। পুরুষদের জন্য জ্ঞান ছিলো মর্যাদা বাড়ানোর মাধ্যম, যার মাধ্যমে তাদের সামাজিক অবস্থান, প্রতিপত্তি, এমনকি উপার্জনও বাড়তে পারতো। এজন্য হয়ত তাঁরা কিছু বানানো কথার প্রচার করতেন। আমি এখানে একটি ঘটনা বলতে চাই। হাদীসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বড় স্কলার ছিলেন আবু যূরা আর-রাজী। তাঁকে ইমাম বুখারীর সমকক্ষ ভাবা হয়। কে বেশি হাদীস জানেন— এই নিয়ে আরেক হাদীস বিশারদ শাদ কূনী’র সাথে একবার তাঁর বিতর্ক হচ্ছিলো। ৩/৪ দিন ধরে এই বিতর্ক চললো। কিন্তু দুইজনই সমানভাবে এগিয়ে ছিলেন। কোনো মিমাংসা হচ্ছিলো না। একদিন শাদ কূনী একটি হাদীস বললেন, যেটি আবু যূরা জানতেন না। তার মানে, আবু যূরা হেরে যাচ্ছেন। তিনি ভাবছিলেন, কেন এ হাদীসটি তাঁর জানা নেই? তখন লোকজন তাঁকে জানালো, আসলে এ হাদীসটির অস্তিত্ব নেই, শাদ কূনী মিথ্যা বলেছেন। এজন্য শাদ কূনীকে একমাত্র ‘হাফিজে হাদীস’ বা হাদীস বিশারদ বিবেচনা করা হয় যিনি একবার মিথ্যা বর্ণনা করেছেন। তাহলে দেখুন, মিথ্যা বর্ণনার ব্যাপারগুলো কতটা স্পর্শকাতর!

আব্বাসীয় খলিফা মামুনের অনেকগুলো কবুতর ছিলো। তিনি এগুলোর সাথে খেলতেন। তো, তাঁর একজন মন্ত্রী একটি হাদীস বানালেন— অমুক অমুক বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কবুতর দেখাশোনা করবে তাকে এই এই পুরষ্কার দেয়া হবে।’ মামুন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সবগুলো কবুতর জবেহ করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার আদেশ দিলেন। তিনি বললেন, ‘এই লোকটি আমাকে খুশি করার জন্য কবুতর নিয়ে মিথ্যা হাদীস বলছে।’ এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে। কেউ হয়তো এসে বললো, ‘আমি কাজউইন থেকে এসেছি, রাসূল (সা.) বলেছেন কাজউইনের লোকদের এই এই গুণ আছে;’ ইন্ডিয়ার মানুষ বলেছে রাসূল ইন্ডিয়া নিয়েও কথা বলেছেন, ইত্যাদি। অর্থাৎ নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তারা মিথ্যা হাদীস ব্যবহার করতো।

এই যে জ্ঞানের প্রতিযোগিতা দিয়ে নিজেদের সম্মান, অর্থ, অবস্থান উঁচুতে নেয়ার যে ক্ষেত্র, নারীরা কখনোই এ প্রতিযোগিতায় নামেনি। নারীদের কাছে হাদীস বর্ণনার কাজটি ছিলো কেবল ধার্মিকতার অংশ, দ্বীনের খেদমত। আমার মনে হয়, মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করা থেকে নারীদের দূরে থাকার এটা একটা কারণ।

আরজু আহমেদ: এই গবেষণা উপলক্ষ্যে আপনার সুদীর্ঘ যাত্রার কথা শুনতে ভালো লাগছে। আপনি যত মানুষের সাথে দেখা করেছেন, যত জায়গায় গিয়েছেন, যত জায়গায় অনুসন্ধান করেছেন, সবই। এখন আমি জানতে চাইবো আপনার কাজের পদ্ধতি বা মেথডলজি নিয়ে। কী কী গুণাবলি কিংবা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আপনি নারীদের তালিকা তৈরি করেছেন? তাঁদেরকে কেমন করে বাছাই করেছেন?

আকরাম নদভী: শুরুতে বিখ্যাত হাদীস সংকলনগুলো থেকে হাদীস নিয়েছি। বুখারী, মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা— এইসব গ্রন্থে যে সকল নারী বর্ণনাকারীদের সূত্রে হাদীস এসেছে, সেগুলো সংগ্রহ করেছি। এরপর গবেষণায় আরও অগ্রসর হই। আমি হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনী দেখতে শুরু করলাম। বিশেষ করে যেখানে প্রত্যেক হাদীসবেত্তা তাঁদের শিক্ষকদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন, যাদের থেকে তাঁরা হাদীস শিখেছেন বা বর্ণনা করেছেন। সেখান থেকেও আমি প্রচুর নাম পেয়েছি। এজন্য সিরিয়া, হিজায, ইন্ডিয়া, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন লাইব্রেরি এবং পাণ্ডুলিপি আমাকে ঘাঁটতে হয়েছে। এতো বেশি নারীর নাম পেয়েছি যে অনেক নাম বাদ দিয়ে দিতে হয়েছে। কারণ, আমার কাছে গবেষণার জন্য যথেষ্ট সময় ছিলো না। আমার মনে হয়, আরও দশ বছর সময় পেলে আরো অসংখ্য নারী বর্ণনাকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারবো। কারণ, এখন আমার অভিজ্ঞতা যেমন বেড়েছে, আবার অনেক তথ্যও আমার কাছে আছে। এজন্য সাধারণ সূত্রগুলোকেই আমি ব্যবহার করেছি। ফার্সীসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনেক তথ্য আছে, সেগুলো খুঁজতে পারিনি। আমি মূলত আরবী ভাষার সূত্রগুলোতেই খুঁজতে পেরেছি।

আরজু আহমেদ: ৪৩ খণ্ডের এই বইয়ে উল্লেখিত নারী স্কলারদের ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

আকরাম নদভী: মুসলিম অধ্যুষিত সব অঞ্চলেই তাঁরা ছিলেন। যেমন: স্পেন, আন্দালুসিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মিশর, সৌদি আরব, শাম, ইরাক, বাগদাদ, কুফা, বসরা, ইরান, আফগানিস্তান, ইন্ডিয়া ইত্যাদি। তবে আমি ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক বা মালয়েশিয়ার ভাষা জানি না। নিশ্চয় সেখানকার নারীরাও হাদীস চর্চা করেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি। আসলে এটি একটি প্রাথমিক প্রচেষ্টা মাত্র। এটাও বুঝতে হবে। দেখুন, প্রায় সাড়ে সাত শ বছর পরে এসে ইমাম মিজ্জী ‘তাহজীবুল ক্বামাল ফি আসমাইর রিজালে’র মতো গ্রন্থ লিখতে পেরেছিলেন। যা কেবল মূল হাদীস চর্চাকারীদের তথ্যের সংকলন ছিলো। এখন আমি যা শুরু করেছি, তারও পূর্ণতা আসতে অন্তত ৭/৮ শ বছর অপেক্ষা করতে হবে। মানুষ এখনই নারীদের স্কলারদের সংখ্যা জানতে চাইছে— কতজন হাফিজা ছিলেন, কতজন বর্ণনাকারী ছিলেন, ইত্যাদি। আমি বলতে চাই, আমাদের হাতে যা তথ্য আছে তার ভিত্তিতে কিছুই করা যাবে না। আমাদের প্রচুর তথ্য প্রয়োজন, ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তাঁদের জীবনী সংগ্রহ করা প্রয়োজন। তারপর হয়তো আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছবো, যখন এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারবো।

আরজু আহমেদ: দর্শক-শ্রোতাদের জন্য কি কয়েকজন নারী মুহাদ্দিসের নাম বা জনপ্রিয় কোনো ঘটনা উল্লেখ করবেন? এমন ঘটনা যাতে আপনি মুগ্ধ হয়েছেন, অথবা যে ঘটনা আপনার বইয়ের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ বাড়াতে পারে?

আকরাম নদভী: খুব ভালো প্রশ্ন। হ্যাঁ, এমন কিছু বলা যায়। যদি পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের সাথে তুলনা করি, তাহলে এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে আর কোনো ধর্মে নারীরা ধর্মীয় গবেষণায় এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। হিন্দু, খ্রিষ্টান কিংবা ইহুদী ধর্মের কয়েক শ বছরের ধর্মীয় ইতিহাসেও এমন তথ্য পাওয়া যাবে না।

অথচ ইসলামের অন্তত এক চতুর্থাংশ জ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে কেবলমাত্র নারীদের বর্ণনার ওপর, বাকি তিন চতুর্থাংশ আছে নারী ও পুরুষদের যৌথ বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে। ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি ধারা, যেমন ইবাদত, কেনাবেচা সংক্রান্ত বিধান ইত্যাদির ওপর নারী সাহাবীদের বর্ণনা আছে। এমনকি মাযহাবভেদেও অসংখ্য কাজ পাওয়া যায়। হানাফী, মালেকী ইত্যাদি মাযহাবের অনেক বিধিবিধানের ব্যাখ্যা কোনো নারীর বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়েছে। এবং মানুষ সেগুলোকে সশ্রদ্ধভাবে মেনেও নিয়েছে।

একটা উদাহরণ দিই। কুরআনের পরে ইসলামী শরীয়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো সহীহ বুখারী। এর আবার বিভিন্ন সংস্করণ আছে, বিভিন্ন স্থানে সেগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনি যদি প্রশ্ন করেন, কোন সংস্করণটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য? মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কপিটি যাঁর কাছে সংরক্ষিত ছিলো, তিনি একজন নারী। তাঁর নাম কারীমা আল-মারজিয়্যাহ। মক্কার বাসিন্দা এই নারী ৪৬৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদ, মধ্য এশিয়া থেকে মানুষ তাঁর কাছে যেতো এবং এই বিশুদ্ধতম কপিটি থেকে হাদীস সংগ্রহ করতো। কেন এটিকে এতো নির্ভুল ধরা হতো? কারণ, তিনি কাউকে এর বেচাকেনা করার অনুমতি দিতেন না। কেউ হাদীস সংগ্রহ করতে চাইলে তাকে নিজ হাতে ওই কপিটি থেকে হাদীস লিখে নিতে হতো। এরপর তিনি আবার তা যাচাই করে দিতেন। হাদীস সংগ্রহের ইতিহাসে আমরা এত সাবধানী ও সতর্ক আর কাউকে পাইনি। এখন আমরা বুখারীর যে সংস্করণটি পাই তা তুরস্কের সুলতান আব্দুল হামিদের সংকলন করা ‘নুসখা সুলতানিয়্যা’। এই সংস্করণটি ছিলো কারীমা আল-মারজিয়্যার কপিটি থেকে সংগৃহিত ‘নুসখা ইউনিনিয়্যাহ’র সরাসরি কপি। এই কাজটি করেছিলেন মদীনার বিখ্যাত শিক্ষক শেখ জুহায়ের নাসীর। চিন্তা করে দেখুন, কতটা বিশুদ্ধতার সাথে এটিকে সংরক্ষণ করেছিলেন একজন নারী! আমাদের উচিত তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।

অথচ আমি যখন মুহাদ্দিসাতদের নিয়ে ইংরেজি বইটি প্রকাশ করি, তখন এ অঞ্চলের বহু আলেম আমাকে বলেছেন, ‘কী দরকার নারীদের কাজ নিয়ে আলাদা লেখার? কেন আপনি পুরুষদের কাজ রেখে নারীদের কাজ নিয়ে বই লিখছেন, তাদের উৎসাহিত করছেন? বাদ দেন এই কাজ। পুরুষদের কাজ থেকেই তো সব ফতোয়া, ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব!’ কী অকৃতজ্ঞতা! অথচ শুধু বুখারী নয়, অসংখ্য হাদীস গ্রন্থ আমাদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে কেবল নারীরা সেগুলোকে সংরক্ষণ করেছিলেন বলে। অনেক উদাহরণের মধ্য থেকে আমি কারীমা আল-মারজিয়্যার উদাহরণটিই শুধু তুলে ধরলাম। আমরা ফাতহূল বারীতে বুখারীর যে সংস্করণ পাই, তা অবিকল কারীমা আল-মারজিয়্যার সংরক্ষিত গ্রন্থের কপি।

আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। আপনি জেনে থাকবেন, হাদীস বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা তথা সনদ থাকে। সর্বশেষ বর্ণনাকারী থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারী থাকে, বিশুদ্ধতার বিচারে হাদীসটির অবস্থান তত উঁচুতে। হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মর্যাদার বিশুদ্ধ হাদীস এসেছে নারীদের থেকে। ইমাম বুখারী মৃত্যূবরণ করেন ২৫৬ হিজরীতে। তাঁর পরের ১২০০ বছরে দেখুন, একজন বর্ণনাকারী এবং ইমাম বুখারীর মধ্যে মাত্র রয়েছেন ১৪জন মানুষ। এর মধ্যে রয়েছেন নারীরা। ভেবে দেখুন, কী গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের বর্ণনাগুলো।

তাবেয়ীদের প্রথম যুগে মদীনায় এক বিচারকার্যে বিচারক এক খ্রিষ্টান চোরের শাস্তি হিসেবে হাত কাটার রায় দিয়েছিলেন। একজন নারী আমারা বিনতে আব্দুর রহমান আস-সারিয়্যাহ লোক মারফত বিচারকের কাছে খবর দিলেন যে এ বিচার সঠিক হয়নি। হাত কাটার জন্য সুন্নাহ অনুযায়ী যে ন্যুনতম পরিমাণ সম্পদ চুরি যেতে হবে, এখানে সে পরিমাণ সম্পদ চুরি হয়নি।

উম্মে দারদা নামের অপর একজন নারী, মক্কা এবং মদীনার উভয় মসজিদে হাদীস শেখাতেন। আমি আরও কয়েকজন নারীর কথা পেয়েছি, যাঁরা মদীনায় মসজিদে নববীতে রওজার পাশে বসে হাদীস শেখাতেন। এখন ভাবুন, আজকের ইংল্যান্ডে (ড. আকরাম ইংল্যান্ড থেকে বলছেন, তবে আমাদের দেশেও একই বাস্তবতা বিরাজমান। — অনুবাদক) মানুষ বলছে, মেয়েরা মসজিদে কেন আসবে?

যাহোক, তাঁদের মাঝে একজন ছিলেন ফাতেমা। তাঁর ছাত্রদের বর্ণনা থেকে জেনেছি, তিনি রাসূলের (সা.) রওজার একদম পাশে বসে হাদীস শেখাতেন। এমনকি মাঝেমাঝে রওজায় হেলান দিতেন। মানুষ তাঁর কাছ থেকে হাদীস শিখতো, ইযাযাহ নিতো। অথচ এখন রওজার ধারেকাছেই ঘেঁষা যায় না। অথচ তাঁরা কত মর্যাদা এবং সম্মানের অধিকারী ছিলেন যে তেমন জায়গায় বসতে পারতেন!

কিছু নারী কাবার হাতীমে বসতেন, যেখানে এখন আমাদেরও প্রবেশাধিকার নেই। নারীরা মক্কা, মদীনা এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে বসে হাদীস শেখাতেন। বেথেলহেমের এক নারীর কথা জেনেছি। আমি তাঁর হাদীস শেখানোর দরসের উপস্থিতি হিসেব করে দেখেছি। এটা হিজরী ৮ম শতকের কথা, অর্থাৎ ইমাম যাহাবীর সময়কাল। আমি ৩৯৬ জনের বর্ণনায় তাঁর নাম পেয়েছি, যাদের অধিকাংশ ছিলেন পুরুষ। যিনি এই সংখ্যা গুনেছিলেন তিনি লিখেছেন, সময়ের অভাবে আমি আর অগ্রসর হইনি। অর্থাৎ আরও তথ্য যাচাই বাছাই করলে সংখ্যাটা আরো বড় হতো। ভাবুন একবার, একজন নারী স্কলার সিরিয়া থেকে ফিলিস্তিন এসেছেন। লোকজন তাঁর কাছ থেকে হাদীস শোনার জন্য দরসের আয়োজন করেছে। আর তাতে উপস্থিত ছিলো চার শ’র মতো মানুষ!

এমনই আরেকজন নারী ছিলেন যাআ বিনতে কামার। তিনি ৭৪০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম যাহাবী লিখেছেন, এই নারী যে গ্রন্থগুলো পড়াতেন, সেগুলোতে অসংখ্য ফিকহী মতামত সংকলিত ছিলো এবং তিনি প্রায় ৪০০টি বিষয়ে হাদীস শিখিয়েছেন। আমাদের সময়ের কথা ভাবুন, কয়জন মানুষ এমনকি দশটি হাদীসগ্রন্থ পড়েছে?

আরেকজন নারীর কথা বলি, ফাতেমা আত-তানুহিয়্যাহ। তাঁর সংরক্ষিত সহীহ বুখারীর কপিটি তুরস্কে আছে। আমি সেই কপিটি দেখেছি। ৮৯ বছর বয়সে তিনি যেদিন মারা যান, সেদিনও তিনি হাদীস পড়িয়েছেন।

আর একজন নারী ছিলেন ফাতেমা সামারকান্দিয়্যাহ। তিনি বিয়ে করেছিলেন আবু বকর কাসানীকে। কাসানী ছিলেন হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর লেখক। ফাতেমার ফিকাহর জ্ঞান ছিলো কাসানীর চেয়ে বেশি। কাসানীর ছাত্ররা লিখেছেন, মাঝেমাঝে তিনি ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা জানাতেন। তারপর তিনি বাড়ির ভেতরে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে এর জবাব জেনে এসে ছাত্রদের জানাতেন। কাসানী হানাফী মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ এবং শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ‘বাদায়িউস সানায়ি’ লিখেছেন, এ কথা সর্বজনবিদিত। ভাবুন তো, হানাফীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে বইটি একজন নারীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় লেখা, যিনি তাঁর স্বামীর চেয়ে বেশি ফিকহী জ্ঞান রাখতেন, সেই আমরা আজ নারীদেরকে জ্ঞান থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি।

মধ্য এশিয়ার স্কলারদের নিয়ে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক ছিলেন আব্দুল কাদের আল-কোরেশী। তিনি লিখেছেন, এ অঞ্চলের কোনো আলেমের ঘর থেকে যখন ফতোয়া আসতো, তখন তাতে ঘরের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি তাঁর বোন, স্ত্রী কিংবা মেয়েদের স্বাক্ষরও থাকতো। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরে ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা ছিলেন। ভেবে দেখুন, ইতিহাসকে আরও কত গভীরে গিয়ে জানার বাকি আমাদের!

হিজরী সপ্তম শতকের প্রথমদিকের ইতিহাসবিদ ইবনে নাজ্জার লিখেছেন, একেকজন নারীর সূত্রে একাধারে ৪০০ জন নারীও হাদীস বর্ণনা করেছেন। আমার বইয়ে এই বিপুল সংখ্যক নারীর মধ্য থেকে অল্প কয়েকজন নারীর কাজই উঠিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

আরজু আহমেদ: ড. আকরাম, আপনার এই বর্ণনাগুলো সত্যিই অসাধারণ। মুসলিম নারীরা তাঁদের সমাজে কী ধরনের ভূমিকা রাখতেন, আমরা তার খানিকটা শুনলাম। এখন ভাবছি, আপনার এই কাজটি আসলে কীভাবে গৃহীত হবে। আপনি নিশ্চয় জানেন, নারী হাদীসবেত্তাদের কাজের পরিধি ও পরিমাণ নিয়ে প্রকাশিত আসমা সাঈদের কাজগুলোকে কী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে।

যা হোক, এই সুযোগে আরেকটি প্রশ্ন করে ফেলি। নারীরা কি আসলে শুধু হাদীসের সংরক্ষক এবং প্রচারক ছিলেন, নাকি তাঁরা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞও ছিলেন? এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

আকরাম নদভী: আপনি জানেন আমার বইটি এখনও প্রকাশিত হয়নি। আমার গবেষণা অনুযায়ী, প্রথম তিন হিজরী শতকে প্রচুর নারী এ কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে খুব অল্প কাজ পাওয়া যায়। আবার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম হিজরীতে ব্যাপক কাজ দেখা যায়। শেষ তিনশত বছরে আবার এর পরিমাণ কমে এসেছে।

এমতাবস্থায় একটি প্রশ্ন চলে আসে, তৃতীয় শতকের শেষে কেন এই নারীদের সংখ্যা কমে এসেছিলো? জবাবে বলা যায়, তখন ইসলামী জ্ঞানের চর্চার কেন্দ্র আরব থেকে মধ্য এশিয়ায় স্থানান্তরিত হচ্ছিলো। মধ্য এশিয়া থেকে যে ছাত্ররা আসতেন, তাঁরা নারীদের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি পেতেন না। তারা কেবল পুরুষদের থেকে হাদীস শিখতেন। ইমাম বুখারীর শিক্ষক ইব্রাহীম আলা ফারাহদী বলেন, আমি শুধু বসরাতেই ৭০ জন নারীর কাছ থেকে হাদীস শিখেছি। অথচ ইমাম বুখারী সেই নারীদের কারো কাছ থেকে হাদীস শেখার সুযোগ পাননি। সুতরাং, মধ্য এশীয় নারীরাও এ চর্চা থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

ষষ্ঠ হিজরীতে ক্রুসেড ইত্যাদি কারণে হাদীস শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে সিরিয়া। তখন আমরা আবার নারীদের মধ্যে হাদীস চর্চা হতে দেখি। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম হিজরীতে এজন্য বিপুল সংখ্যক নারীর নাম পাওয়া যায়। আপনি জানে থাকবেন, মিশরে হাদীসের চর্চা শুরুই হয় সেখানে আগত নারীদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে মিশর হাদীস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তারপর দশম শতকে আবার হিজাযে এ চর্চা শুরু হয়।

ফলে বলা যায়, হাদীস শেখানো যখনই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, নারীদের কাজগুলো তখন বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু যখন হাদীসের দর্শন নিয়ে চর্চাকারীদের আমরা দেখি, খুব কম নারীকেই সেখানে পাই। কারণ, আমাদের দার্শনিকরা ভাবতেন, নারীরা আসলে দর্শনচর্চার জন্য উপযুক্ত নয়। এরিস্টটল যেমন নারীদের খুব অবমাননা করেছেন, গাযালীও নারীকে অবজ্ঞা করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো নারীর সাথে যেন পরামর্শ না করা হয়। করলেও নারী যা পরামর্শ দেবে, তার উল্টোটা যেন করা হয়। এমনকি তিনি এটাও বলেছেন, সকল সমস্যার মূলে হলো নারী। একই রকম পরিস্থিতি ইন্ডিয়াতেও উদ্ভূত হয়েছিলো। তাই ইসলামী দার্শনিকদের কাজে নারীদের খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়।

এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। আমি কেবল আমার পাওয়া কিছু তথ্যের ভিত্তিতে এসব তুলে ধরেছি। আমাদের আরও অনেক জানতে হবে এবং তথ্য-প্রমাণ লাগবে। হয়ত এমন তথ্যও আমরা পাবো যাতে এতদিন ধরে আমরা যা ভেবে এসেছি, তার বিপরীত চিত্র ফুটে উঠবে।

আরজু আহমেদ: জেন্ডার নিয়ে প্রচলিত ধারণা কিংবা নারীদের পৃথক করে রাখা— এসবের কোনো প্রভাব কি হাদীস চর্চার ক্ষেত্রে পড়েছে?

আকরাম নদভী: এসব বিষয়ে বিভিন্ন অঞ্চল বা সংস্কৃতির চিন্তাচেতনা এক নয়। মদীনা বা অন্য যে কোনো স্থানের কথাই বলেন, ফিতনার আশংকা ইত্যাদি কারণে নারীরা সবসময় সমান সুযোগ পায়নি। স্বামী কিংবা ভাইয়েরা নারীদেরকে বিভিন্ন সময় নিরুৎসাহিত করেছে। সামআনী ছিলেন ষষ্ঠ শতকের একজন বড় স্কলার। তিনি লেখাছেন, ‘আমি মারভ গিয়েছিলাম। কারীমা নামের একজন হাদীস বিশারদ নারীর কাছে হাদীস শেখার ইচ্ছা পোষণ করি। কিন্তু কারীমার ভাই নানা অজুহাত পেশ করতে শুরু করেন, আমার বোন ব্যস্ত ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেই পারিনি। কয়েকজন প্রতিনিধি মারফত কিছু হাদীস শিখতে পেরেছি মাত্র।’ দেখুন, পরিবারে যদি একজন পুরুষ মুহাদ্দিস থাকতেন, তাহলে তার নাম প্রচার হতো। অথচ বিপরীত ঘটনা ঘটতো যদি নারী মুহাদ্দিসাত থাকতেন। তাঁর নাম গোপন করা হতো। এ কারণেও এই শতকগুলোর অনেক তথ্য গোপন থেকে গেছে। কারণ, মানুষ নারীদের কাজ নিয়ে আলোচনাই করতে চাইতো না।

আমি এই ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা করি। আমি চাই, এ ধরনের ভাবনাগুলো যেন আমাদের আটকে না দেয়। তাঁদের জ্ঞান অর্জনের পথে যেন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। বরং তাঁদেরকে উৎসাহিত করা দরকার। তাঁদের কাছে তো আমরা কৃতজ্ঞ।

এখনকার সময়ের আরও একটি ব্যাপার নিয়ে কথা বলি। আজকাল নারীদের পর্দার আড়াল থেকেও হাদীস শাস্ত্র শেখাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। জিলবাব পরিহিত কোনো নারী জ্ঞান অর্জনের জন্য যে কোনো স্থানে বসতে পারার চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের এই অনুপস্থিতির দরুণ তাঁদের নামও আর হাদীসের উৎস হিসেবে গ্রন্থিত হচ্ছে না। আমরা তো এমন বর্ণনাও পাই যে অমুক নারীর সন্তান কান্না করায় তিনি দারস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে কিছু হাদীস তিনি শুনতে পারেননি। অর্থাৎ তখন নারীদের চেনা যেতো, তাঁরা সন্তানসহ হাদীস শেখার ক্লাসে আসতেন। এবং এইসব লিখে রাখার কাজ করতেন খুব বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীরা। যাতে হাদীসের বর্ণনায় পরিশুদ্ধতা যাচাই করা সম্ভব হয়।

আরজু আহমেদ: আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছিলাম, নারী স্কলারদের নিয়ে এরকম একটি কাজ করতে আপনি কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন? মুসলিম সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যদি আমাদের কিছু জানান।

আকরাম নদভী: আপনি এই ঘটনাগুলো জানেন। কারণ, আপনি আমাকে এ কাজে সহায়তা করেছেন। আপনার মনে আছে হয়তো, আমরা যখন মরক্কোতে গেলাম তখন সেখানকার একজন প্রকাশক এর একটি খণ্ড প্রকাশ করেন। কিন্তু সেটির মান ভালো হয়নি। এরপর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশে তারা প্রায় এক বছর সময় নেয়। বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি-আপনি দুজনেই তাদেরকে কয়েকবার তাগাদা দিয়েছি, লিখেছি। এক পর্যায়ে সেখান থেকে প্রকাশের ইচ্ছাই বাদ দিই। তারপর একজন বন্ধু খুব উৎসাহ নিয়ে দারুল মিনহাজের প্রকাশককে বইটির কথা বলেন। তখনই আমি আপনাকে বলেছিলাম, মরক্কোর প্রকাশকের সাথে যেন চুক্তি বাতিল করা হয়।

যদিও দারুল মিনহাজ কাজটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলো, কিন্তু এই বিশাল কাজ আঞ্জাম দেওয়ার আর্থিক সঙ্গতি তাদের ছিলো না। পরে কেউ একজন এগিয়ে আসেন, যার নাম আমি জানতে পারিনি। আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে তারা ভালোভাবেই বইটি প্রকাশ করতে পেরেছে।

আপনি ঠিকই বলেছেন, মানুষের কাছ থেকে উৎসাহের বদলে বাঁধা পেয়েছি অনেক। বেশিরভাগ স্থানেই অধিকাংশ আলেম এর বিরোধিতা করেছেন। বিশেষ করে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এ নিয়ে বক্তব্য দিলাম, তখন একজন অধ্যাপক দাঁড়িয়ে বললেন, “নারী স্কলারদের নিয়ে এই পুরো কাজটি পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র। আপনি নিজেও পশ্চিমে থাকেন। এই ষড়যন্ত্র হলো নারীদেরকে পুরুষের চেয়ে উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে চাওয়া।” এরপরে শায়খ ইউসুফ আল কারজাভী দাঁড়িয়ে বললেন, “ড. আকরাম নারীদেরকে পুরুষদের চেয়ে উত্তম দেখাতে চাইছে না। সে দেখিয়েছে, নারীদের কথা কখনো বলাই হয়নি। ড. আকরাম নারীদের ইতিহাসই বলতে চাচ্ছে। এর অর্থ নারীকে শ্রেষ্ঠ দেখানো নয়।”

মানুষের ভাবনায় ব্যাপারটার পরিণতি নেতিবাচক।

একজন বললেন, “আপনার এই কাজ ইসলামকে বাদ দিয়ে দিবে।” আমি বলেছি, “আমি যেসব তথ্য এনেছি এগুলো ইসলামের মূল গ্রন্থগুলোতেই আছে। আমাকে বলুন তো এই উৎসগুলোতে কি কোনো সমস্যা আছে?”

অনেকে বলেছেন, নারী স্কলারের এই সংখ্যা আসলে বাড়াবাড়ি। আমার জবাব হলো, এই দাবি একেবারেই সত্যি নয়। আমাদের কাছে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য নেই। শুধু ইমাম মুসলিমেরই ৭০ জন নারী শিক্ষিকা ছিলেন, আমি কেবল চার/পাঁচ জনের তথ্য পেয়েছি। ইবনে নাজ্জার চারশত নারীর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, আমাদের কাছে সবার তথ্য নেই। প্রত্যেকের সাথে অসংখ্য নারী যুক্ত ছিলেন, যাঁদের তথ্য আমাদের বইয়ে নেই।

এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, মধ্য এশিয়ার প্রতিটি ঘর থেকে নারীদের দস্তখতকৃত ফতোয়া আসতো। অর্থাৎ প্রতি ঘরেই ফতোয়া দেয়ার যোগ্য ও উপযুক্ত নারীরা ছিলেন।

অনেকে বলেন, এই নারীরা কেবল হাদীস বর্ণনা করেছেন কিন্তু তারা হাদীস বুঝতেন না। অথচ দেখুন, এই নারীরা মুফতী ছিলেন, তাঁরা নিয়মিত ফতোয়া দিতেন। এই তথ্য আমিও জানতে পেরেছি। সুতরাং, নেতিবাচক মানসিকতার আলোকে বিচার করবেন না, বরং আরও গবেষণা করুন।

কেউ যখন আমাকে প্রশ্ন করেন, মুহাদ্দিসাতের প্রকৃত সংখ্যা কত? আমি বলি, থামুন! এ তো কেবল শুরু মাত্র। আমরা এখনও পুরোপুরি জানি না। চূড়ান্ত সংখ্যা বলতে আরো সময় লাগবে। একসময় হয়ত আমরা এমন পর্যায়ে যেতে পারবো যখন মুহাদ্দিসাত ও রাবিয়াতের প্রকৃত সংখ্যা জানবো। এই কাজে অনেক সময় লাগবে। ঠিক যেমন পুরুষদের সংখ্যা জানতে সময় নিয়েছে ছয়শো বছর। নারীদের জন্যও ন্যূনতম কয়েক শতাব্দী লাগবে।

দর্শকদের প্রশ্ন

ইমাদ: চাঁদ দেখা কিংবা সাক্ষ্য দেয়ার ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য আলাদা নিয়ম কেন? অর্থাৎ দুইজন মহিলার সাক্ষী একজন পুরুষের সমান কেন? এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

আকরাম নদভী: আমার ভূমিকামূলক ইংরেজি বইটিতে এ নিয়ে আলোচনা করেছি। মূল ব্যাপার হলো, ‘খবর’ বা তথ্য নিয়ে সাক্ষ্য দেয়ার ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা। মূলত এক্ষেত্রে একজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ঠ। সে নারী হোক বা পুরুষ। যদি নারীটি সত্যনিষ্ঠ হন, সৎ হন, তাঁর স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকে, তাঁর থেকে হাদীস নেয়াতে কোনো বাঁধা নেই। বরং কখনও কখনও নারীদেরকে এক্ষেত্রে প্রাধান্যও দেয়া হয়। এখানে সংখ্যা নয়, বরং গুণগত বিচারই মূল কথা। এরকম কোথাও নেই যে হাদীস গ্রহণের সময় দুইজন নারীর সাক্ষ্য লাগবে, একজনের বর্ণনা নেয়া যাবে না। সহীহ বুখারী এবং মুসলিমের প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে শুধু একজন নারীর কাছ থেকে। হানাফী, মালিকী কিংবা শাফেয়ী মাযহাবে উসুল বা ফিকাহর ক্ষেত্রে একজন মহিলার বর্ণনাকে যথেষ্ট মনে করা হয়েছে।

তারিক: নারী স্কলারদের জীবনী ও কাজ সংগ্রহের জন্য আপনার পূর্বে খুব কম গবেষণা করা হয়েছে। এর কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

আকরাম নদভী: এ ব্যাপারে আগে কিছু কাজ হয়েছে, আমি সেগুলো খুঁজে পাইনি। যেমন ইবনে মানদা মুহাদ্দিসাতদের নিয়ে লিখেছেন, আরও অনেকে অনেক কাজ করেছেন। অনেকে আবার নিজের শিক্ষকদের জীবনী বর্ণনা করে তার শেষের দিকে নারী বর্ণনাকারীদের নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা লিখেছেন। কিন্তু নারীদের নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। এ কাজটি যদি ইবনে হাজার কিংবা ইমাম মিজ্জি করে যেতেন, তাহলে খুব ভালো হতো। কারণ, তাঁরা এ বিষয়ে বেশি জ্ঞান রাখতেন, তাঁদের সুযোগও বেশি ছিলো এবং তাঁদের কাছে অনেক তথ্যও ছিলো।

আমি কাজটি করেছি একেবারে আনাড়ি শিক্ষানবিশ হিসেবে। সত্যি বলতে কী, কাজ করতে করতেই আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই প্রজেক্টের কারণে এখন আমি অনেক বেশি হাদীস জানি। শুরুতে এতটা পারদর্শী ছিলাম না। এখন যদি আবার এই বইটির কাজ শুরু করি, এটি আগের চেয়েও ভালো হবে। যদিও এরকম করবো বলে আর ভাবছি না।

আমার আশা আছে, ভবিষ্যতে কাজটি আরও সমৃদ্ধ হবে। আরজু সবগুলো খণ্ডকে ইংলিশে অনুবাদের কথা ভাবছে। কেউ যদি এর ওপর কাজ করতে চায়, তাহলে আমিও অনেক বেশি শেখাতে পারবো। তারিক, আপনি সঠিক। আমি আসলে বুঝতে পারি না এই সকল নারী স্কলারদের জীবনী ও কাজ সংকলনের জন্য কেন প্রচেষ্টা চালানো হয়নি।

আরজু আহমেদ: একজন বোন জানতে চাচ্ছেন, জনসমক্ষে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মুসলিম নারীরা কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

আকরাম নদভী: মূলত ইসলামে কুরআনের দেয়া কর্মপদ্ধতি হচ্ছে ‘তাকওয়া’ ও ‘সবর’। আল্লাহকে মেনে চলুন, যদি বাঁধা আসে তবে ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ আপনাকে সামর্থ্য দেবেন।

এখানে আমি আমার কিছু কথা বলি। যখন আমি এ বিষয়ে কাজ শুরু করি তখন কেউ জানতো না। কার্লা পাওয়ার আমার সাক্ষাতকার নেয়া ও প্রকাশ করায় এটি প্রচার পায়। শুরুতে এটা কোনো প্রজেক্ট ছিলো না, আমি কেবল আগ্রহ থেকেই গবেষণা করছিলাম। যখনই কোনো আলেমকে এই রকম একটা কাজের কথা বলেছি, তাঁরা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। অধিকাংশই বলেছেন, এর কোনো দরকার নেই, এটি একেবারে অপ্রয়োজনীয় কাজ।

আলহামদুলিল্লাহ, আমি দমে না গিয়ে নিয়মিত কাজ করে গেছি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এ কাজের প্রয়োজন আছে, উপকারিতাও আছে। আপনি জানেন একজন প্রকাশক খুঁজে পেতে আমাকে কতটা বেগ পেতে হয়েছে। কোনো অর্থ, কোনো সাহায্য কিংবা প্রনোদনা ছাড়া এ কাজ এগিয়েছে, আমি শুধু সবর করেছি। আরজু, তারেক, আপনাদের হয়তো খেয়াল থাকবে, মাঝখানে কিছুদিন আমি ভাবতাম যে আমার জীবদ্দশায় বোধহয় এ কাজটি প্রকাশিত হবে না। মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী অনেক কিছু লিখে গেছেন, তাঁর মৃত্যূর আগে তাঁর কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি। এখন সেগুলো প্রকাশের কাজ চলছে।

আমি অন্তত কাজটি শেষ করেছি, এর প্রকাশ যখনই হোক। আলহামদুলিল্লাহ আমি বেঁচে থাকতেই এটি প্রকাশিত হয়েছে, এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।

আরজু আহমেদ: আলহামদুলিল্লাহ সারাবিশ্বে আমাদের অনেকের জন্যই এ কাজটি আনন্দ এবং উদযাপনের উপলক্ষ্য। আপনি কার্লা পাওয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন। আজ সকালে তিনি আমাকে একটি মেসেজ দিয়েছেন। আপনাকে প্রশ্ন করেছেন, পাঁচ বছর আগে আপনি এই কাজটিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভেবেছিলেন, আজও কি সেভাবেই ভাবেন?

আকরাম নদভী: প্রথম কথা হচ্ছে, আমি এতে খুব খুশি যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। কারণ ইংলিশে এর ভূমিকাটি এরই মধ্যে কয়েকটি সংস্করণ হয়েছে এবং মানুষ তা পড়ছে। কিন্তু আরবী ও উর্দূতে কিছু নেই। আমাকে আরব নারীরা লিখেছেন, প্রশ্ন করেছেন। আমি তাঁদের জন্য বক্তৃতাও দিয়েছি। এখন আরবীতে কিছু প্রকাশ হওয়া মানেই হলো, যে কেউ এখান থেকে বিস্তারিত জানতে ও দেখতে পারবে। কারণ, ইংরেজি বইটি সংক্ষিপ্ত। হ্যাঁ, একটা পার্থক্য আমি অনুভব করি যে আমি এ কাজে এখনকার মত দক্ষ হলে শুরু থেকেই বইটি অনেক সমৃদ্ধ ও উন্নত হতো। অবশ্য এটা সবসময়ই হয়। আলেমরা বলেছেন, যদি তুমি পরিপূর্ণতা চাও তাহলে আর বই লিখতে পারবে না।

শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বলতেন, ‘বইটা যেমন তেমন করেই লিখবে। কারণ, নিখুঁত করতে চাইলে এ বই আর লেখাই হবে না।’

যদি পরবর্তী সংস্করণের জন্য প্রকাশক সুযোগ দেন, আমি একে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবো। অনেক বিশ্লেষণ যোগ করতে পারবো এবং বইটি আরও বড় হবে। সমস্যা হলো, মানুষ বড় বই পছন্দ করে না। এমনিতেই এটি প্রথমে একান্ন খণ্ডের বিশাল বই হয়ে গিয়েছিলো। পরে আমি অনেক হাদীসের নমুনা সরিয়ে দিয়েছি। প্রকাশক বলেছিলেন, চল্লিশ খণ্ডে নামিয়ে আনতে। অবশেষে এটি তেতাল্লিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। মুসান্নাফে আবি শায়বা, তারীখে তারাবীতে নারীদের অনেক হাদীস আছে, আমি সেসব যুক্ত করিনি। অনেক নারীদের নাম দিলেও তাঁদের বর্ণিত হাদীস দিইনি কারণ তাতে এর কলেবর বেড়ে যাচ্ছিলো।

কার্লা ঠিকই বলেছে, বিশ বছর পর আমি অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। হয়ত এর ইংরেজি সংস্করণে আমি কিছু দিককে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবো।

আরজু আহমেদ: এক হিসেবে আপনিই আপনার সবচেয়ে বড় সমালোচক। এখানে অনেক কিছুই আছে যা নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। আপনার কাছে জানতে চাচ্ছিলাম, নারীরা কীভাবে আপনার এই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন? তাদের প্রতিক্রিয়া কী? তাঁদের দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য কী?

আকরাম নদভী: আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে পুরুষদের চেয়ে নারীরা আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। আট/দশ বছর আগে যখন আমেরিকায় গেলাম, সেখানকার এক নারী যিনি ইংরেজি ভূমিকাটা পড়েছেন, তাঁর বইটি আমাকে দেখালেন। তিনি পুরো বইটি দাগিয়ে পড়েছেন, নোট করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বইটি পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এবং অন্যদের পড়াচ্ছেন। তিনি বললেন, সুদানসহ আফ্রিকা এবং বিভিন্ন জায়গার অনেক নারী যারা ইসলাম ত্যাগ করেছিলো, এটি পড়তে শুরু করার পর থেকে তাঁদের অনেকেই ইসলামে ফিরে আসে। এতে আমি খুব উৎসাহী হই। অনেকেই বলেছেন, এ বই তাঁদের উৎসাহ দিয়েছে এবং ইসলামের প্রতি তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ, এটি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের যে এর উসিলায় অনেক নারী ইসলামে ফিরে আসছেন। তাঁদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর সন্তুষ্ট। তাঁরা ভাবছেন, তাঁদের ওপর হওয়া অবিচারগুলোর জন্য সমাজ দায়ী। ইসলাম, আল্লাহ কিংবা তাঁর রাসূল এজন্য দায়ী নন।

আমি মনে করি, এ বই যদি নারীদের ইসলামে ফিরিয়ে আনতে পারে, তাঁদের অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলের মোহাব্বত সৃষ্টি করে দেয়, ইসলামী জ্ঞানচর্চায় তাঁদের আগ্রহী করে তোলে, তাহলে এটি অনেক বড় পাওয়া।

আমার মনে হয়, অনেক দক্ষিণ এশীয়দের তুলনায় পশ্চিমা ও আরবরা এ বইটি নিয়ে অনেক খুশি। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা এ নিয়ে ইতিবাচক অনুভূতি জানিয়েছে। তাঁরা এ নিয়ে কথা বলেছেন, খুশি হয়েছেন।

যে কোনো কারণেই হোক, মাদ্রাসার লোকেরা এ নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। তাঁরা ভাবছেন, এ কাজে হয়তো তাঁদের কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হবে, হয়তো নারীরা ফতোয়া দেয়া শুরু করবে ইত্যাদি। এজন্য ভারত-পাকিস্তানে তাঁরা বইটির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীরা একে সানন্দে গ্রহণ করছেন। দুয়েকজন ছাড়া আরবদের কাছ থেকেও আমি বইটি নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য শুনিনি। সাধারণভাবে বলতে গেলে এই কাজটিকে ভালোভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে।

এ তো কেবল শুরু। ইনশাআল্লাহ, যখন মানুষ বইটি পড়বে, বুঝবে, এবং দেখবে এতে কতটা জ্ঞান আছে, আশা করি একে সানন্দে গ্রহণ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *