আলেম শব্দের টুকিটাকি
সংজ্ঞা
‘আলিম আরবি শব্দটি উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এসে ‘আলেম হয়ে গেছে। এর শাব্দিক অর্থ: জ্ঞানী, বিদ্বান, পণ্ডিত ইত্যাদি।
আল-কুরআনে শব্দটি আল্লাহর একটি বিশেষ গুণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে (আল-আন’আমঃ ৭৩; আত-তাওবাঃ ৯৪, ১০৫; আর-রা’দঃ ৯; আল-মু’মিনূনঃ ৯২; আস-সাজদাঃ ৬; সাবাঃ ৩ ইত্যাদি)। সেটি হলো: ‘আলিমুল গাইব বা অদৃষ্ট সম্পর্কে জ্ঞানী। এছাড়া আল-কুরআনে ‘আলেম শব্দটিকে রেপ্রেজেন্ট করছে এমন চারটি সমার্থক পরিভাষা হলো – আর-রাসিখূন ফীল ‘ইল্ম বা জ্ঞানের মধ্যে পারদর্শী (আল-‘ইমরানঃ ৭), উলুল ‘ইল্ম বা জ্ঞানবান ব্যক্তিবর্গ (আল-‘ইমরানঃ ১৮), আল্লাযিনা উতুল ইল্ম বা যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে (আল-মুজাদালাহঃ ১১), আল-উলামা (এটি ‘আলিম শব্দের বহুবচন) বা জ্ঞানীগণ (ফাতিরঃ ২৮)। এছাড়া আহলুয যিক্র (আন-নাহলঃ ৪৩) এবং উলুল আম্র (আন-নিসাঃ ৫৯)শব্দ দু’টোর ব্যাখ্যায় তাফসীর স্কলারগণ জ্ঞানী বা স্কলারদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
পাশাপাশি বেশ কিছু হাদিসে এই শব্দটি বা এর সমার্থক কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন একটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন: “‘আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী” (সুনান আবী দাউদ, সুনান আত-তিরমিযী, সুনান ইবনে মাজাহ; শায়খ আলবানী হাদিসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন)। এসব হাদিসের অধিকাংশগুলোই জ্ঞানের মাহাত্ম্য সম্পর্কিত।
আমার সীমাবদ্ধ সামর্থ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে বুঝলাম যে, উপরোক্ত আয়াতগুলো এবং ‘আলেম শব্দটি রিলেটেড হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্কলারগণ সেটুকু ব্যাখ্যা করেছেন, যেটুকু ঐ নির্দিষ্ট আয়াত বা হাদিসের আলোচ্য বিষয় হিসেবে তাদের সময়ের দাবী ছিল। এর বাইরে গিয়ে পরিভাষা হিসেবে ‘আলেম শব্দটির সংজ্ঞায়ন, ক্রাইটেরিয়া, যোগ্যতার মাপকাঠি নিয়ে বিশেষ কোন আলোচনা আমার চোখে পড়েনি।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমা ও প্রয়োজনীয়তায় “ফিক্হ” শব্দটির মতো ‘আলেম শব্দটিও পরিভাষা হিসেবে একটি বিশেষ অর্থ পরিগ্রহ করে। আল-কুরআন বা হাদিসের মধ্যে ফিক্হ শব্দটি যখন এসেছে, তখন এটি দিয়ে মূলত গভীর জ্ঞান ও বোধকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় শব্দটি একটি আলাদা পরিভাষায় শুধু পরিণত হয়নি, বরং ইসলামিক সাইন্সের একটি স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিনে পরিণত হয়েছে।
‘আলেম শব্দটির বেলায়ও প্রায় সেইম ব্যাপারটি ঘটেছে। শব্দটি দিয়ে ইসলামিক সাইন্সে পারদর্শিতা অর্জন করা একটি বিশেষ গ্রুপকে বোঝানো শুরু হয়, যাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা রয়েছে। এই পর্যায়ে এসে ‘আলেম শব্দটি “ফকীহ” ও “মুজতাহিদ” শব্দের সমার্থক হিসেবে পরিণত হয়। স্পেসিফিকলি ‘আলেম পরিভাষাটির সংজ্ঞা, ক্রাইটেরিয়া ইত্যাদি নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা পাওয়া না গেলেও (এটি নিতান্তই আমার মত। কেউ যদি জানেন এমন স্বতন্ত্র আলোচনার কথা তাহলে কাইন্ডলি জানাবেন) “ফকীহ” বা “মুজতাহিদ” টার্ম দু’টো নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা পাওয়া যায়। বিশেষ করে “ইজতিহাদ” বা “মুজতাহিদ” টার্ম নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা উসূলুল ফিক্হের বইতে অহরহ পাওয়া যায়।
ক্রাইটেরিয়া
এখন ‘আলেম পরিভাষাটিকে “মুজতাহিদ” পরিভাষার সমার্থক হিসেবে মেনে নিয়ে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়া নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো:
১ – ইসলামের প্রথম মৌলিক উৎস আল-কুরআন সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থাকা। এর মানে হলো, উলূম আল-কুরআন বা কুরআনের পরিভাষা সংক্রান্ত বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো জানা থাকা।পাশাপাশি আহকামের আয়াতগুলো আয়ত্ত্বে রাখা [১] এবং সাধারণভাবে কুরআনের আয়াতগুলোর অর্থ ভালোভাবে বুঝা [২]। এক্ষেত্রে পুরো কুরআন মুখস্ত থাকাটা শর্ত নয় [৩] কিন্তু মুখস্ত থাকলে ভালো হয়। পাশাপাশি সাবাব আন-নুযূল বা কুরআন বর্ণনার প্রেক্ষিত নিয়েও ভালো ধারণা থাকা চাই [৪]। কুরআনের আয়াতগুলোর নাসিখ-মানসূখ নিয়েও বিস্তারিত জানাশোনা থাকাটা বাঞ্ছনীয় [৫]।
২ – ইসলামের দ্বিতীয় মৌলিক উৎস আস-সুন্নাহ সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। স্পষ্ট জ্ঞানের মধ্যে ব্যাখ্যাসহ আহকামের হাদিসগুলো [৬] এবং সাধ্যমত অন্যান্য হাদিসগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকতে হবে। পাশাপাশি উলূম আল-হাদিস বা হাদিসের পরিভাষা সংক্রান্ত বিজ্ঞান, ‘ইলম আর-রিজাল, জারহ-তা’দীলের স্তরসমূহ, সহীহ হাদিস থেকে দূর্বল হাদিসকে আলাদা করার পদ্ধতি, হাদিস গ্রহণযোগ্য হবার শর্তসমূহ, হাদিস অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণসমূহ জানতে হবে এবং এগুলোকে বাস্তবে ঠিকঠাক প্রয়োগ করার সক্ষমতা থাকতে হবে [৭]। হাদিসের মধ্যে নাসিখ-মানসূখ এর স্বরূপ কেমন হবে সে সম্পর্কে জানতে হবে এবং কুরআন-হাদিস ও হাদিস-হাদিস এর মধ্যে আপাত বৈপরীত্যের মধ্যে সমন্বয় করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে [৮]। এছাড়া আসবাব উরূদ আল-হাদিস বা হাদিসের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকতে হবে [৯]।
৩ – আরবি ভাষায় যথাসাধ্য দক্ষ হতে হবে। দক্ষ হওয়ার জন্য এটি জরুরি নয় যে একজন ব্যক্তিকে খলীল বা মুবাররিদ এর পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে [১০]। তবে ন্যুনতম যেটুকু না হলে নয়, সেটুকু জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে। কারণ, কুরআন-হাদিস বোঝার জন্য অ্যারাবিক ফিলোলজির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে।
৪ – এরপর ইজ্মা’ এর সম্পর্কে কম্প্রিহেন্সিভ জ্ঞান অর্জন থাকতে হবে। যাতে করে একজন মুজতাহিদের ফাতওয়া কোন অকাট্য ইজ্মা’ এর বিপরীতে না যায় [১১]।
৫ – এরপর উসূল আল-ফিকহ সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে [১২]। আমাদের স্কলাররা বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি উসূল মিস করলো, সে সঠিক সিদ্ধন্তে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলো” [১৩]। কারণ উসূল হলো এমন জ্ঞান কাঠামো যার মাধ্যমে কুরআন-হাদিসের টেক্সট থেকে সঠিক, নিরাপদ ও যুক্তিসঙ্গত বিধান বের করে আনা যায়। এই ডিসিপ্লিনটির আলোচ্য বিষয় হলো: রেফারেন্সের সর্বসম্মত উৎস (কুরআন, হাদিস, ইজ্মা’, কিয়াস), মতবৈচিত্রপূর্ণ উৎস (আমাদের পূর্ববর্তীদের শারী’আহ, ইস্তিহসান, মাসালিহ মুরসালাহ, উরফ, ইস্তিসহাব ইত্যাদি), নস বা টেক্সটের আভ্যন্তরীণ আম্র (আদেশসূচকতা)-নাহী (নিষেধাজ্ঞা), ‘আম-খাস, মুতলাক-মুকায়্যাদ, মানতুক-মাফহূম, যাহির-মুয়াওয়াল ইত্যাদি।
৬ – এছাড়া মাকাসিদ আশ-শারী’আহ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। ইমাম শাতেবী একে ইজতিহাদের জন্য একটি শর্ত হিসেবে দেখিয়েছেন [১৪]। এছাড়া ইমাম ইবনুল কায়্যিম দাবি করেছেন যে, বান্দার দুনিয়া এবং আখিরাতের কল্যাণই শারী’আহর মূল ভিত্তি। যে বিধান তাই বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতের অকল্যাণ ডেকে আনবে সেটি শারী’আহর অংশ হতে পারে না [১৫]। ওনার এই স্টেইটমেন্ট থেকে মাকাসিদের গুরুত্ব ফুটে ওঠে।
৭ – মানুষ ও তার যাপিত জীবন সম্পর্কে সচেতন জ্ঞান থাকা। এর মানে হলো, মানুষের মানসিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন থাকা [১৬]। ইমাম ইবনুল কায়্যিমের বরাতে জানা যায় যে, ইমাম আহমাদ মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান থাকাকে মুফতিদের জন্য একটি শর্ত হিসেবে দেখিয়েছেন [১৭]। একজন মুজতাহিদকে যেহেতু ফাতওয়া দেয়ার মতো দায়িত্ব পালন করতে হয়, সে কারণে এই বিষয়ে জ্ঞান থাকাটাও তার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
৮ – একজন মুজতাহিদকে আদালাহ ও তাকওয়া সম্পন্ন হতে হবে। অর্থাৎ, একজন মুজতাহিদ ন্যায়নিষ্ঠ ও আল্লাহ সচেতন হবেন। তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের সাথে থাকবেন। তিনি দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করবেন না [১৮]।
এই ক্রাইটেরিয়াগুলোর ব্যাপারে উসূলবিদগণ মোটামুটি সবাই একমত। এই আলোচনা থেকে ‘আলেম হওয়ার একটি প্রাথমিক ধারণা হয়তো পাওয়া যাবে। আর যারা এই ফিল্ডে কনট্রিবিউট করতে চায়, তাদের জন্য একেবারে প্রাথমিক লেভেলের দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
রেফারেন্স:
[১] আল-মুস্তাসফা, আবু হামিদ আল-গাযালী, খন্ডঃ ০২, পৃষ্ঠাঃ ৩৫০.
[২]আল-ইজতিহাদ ফীশ শারী’আতিল ইসলামিয়্যাহ, ড. ইউসুফ আল-কারাদাওয়ী, পৃষ্ঠাঃ ২০.
[৩] আল-মুস্তাসফা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৩৫১.
[৪] আল-মুওয়াফাকাত, আবু ইসহাক আশ-শাতেবী, খন্ডঃ ৩, পৃষ্ঠাঃ ৩৪৭.
[৫] আল-ইজতিহাদ ফীশ শারী’আতিল ইসলামিয়্যাহ, ড. ইউসুফ আল-কারাদাওয়ী, পৃষ্ঠাঃ ২২.
[৬] আল-মুস্তাসফা, প্রাগুক্ত.
[৭] আল-ইজতিহাদ ফীশ শারী’আতিল ইসলামিয়্যাহ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৫-২৭.
[৮] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৮.
[৯] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৩২.
[১০] আল-মুস্তাসফা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৩৫১, ৩৫২.
[১১] আল-মুস্তাসফা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৩৫১.
[১২] ইরশাদুল ফুহূল, মুহাম্মাদ বিন ‘আলি আশ-শাওকানী, পৃষ্ঠাঃ ২৫২.
[১৩] আল-উসূল মিন ইল্মিল উসূল, মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসায়মীন, পৃষ্ঠাঃ ১৫.
[১৪] আল-মুওয়াফাকাত, আবু ইসহাক আশ-শাতেবী, খন্ডঃ ৪, পৃষ্ঠাঃ ১০৫-১০৭.
[১৫] ই’লাম আল-মুয়াক্কি’ঈন, ইবনু কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, খন্ডঃ ০৩, পৃষ্ঠাঃ ১১.
[১৬] আল-ইজতিহাদ ফীশ শারী’আতিল ইসলামিয়্যাহ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৪৭.
[১৭] ই’লাম আল-মুয়াক্কি’ঈন, প্রাগুক্ত, খন্ডঃ ০৪, পৃষ্ঠাঃ ১৫৭.
[১৮] আল-ইজতিহাদ ফীশ শারী’আতিল ইসলামিয়্যাহ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৪৯.