মুসলিম, তোমরা কোনো দার্শনিক জন্ম দিলে না কেন?
প্রশ্নটা আমার কাছে করেছিলো সুদীপ্ত কবিরাজ। যখন তার সাথে আমি ২০০৯ সালে শরৎকালীন সেমিস্টারে দর্শনের উপর পাশ্চাত্যের নিরীক্ষামূলক কিছু পড়াশোনা করছিলাম। যদিও প্রশন্টা খুবই জটিল কিন্তু আমি এটাকে আক্ষরিক অর্থে নেই নি। কারণ, সুদীপ্ত নিজেই একজন উপনিবেশ পরবর্তী চমৎকার একজন চিন্তাবিদ। তবুও এই প্রশ্নটাতে, পাশ্চাত্যের চিন্তাগত ঐতিহ্যের সাথে মুসলিম দার্শনিকদের নিজেদের সম্পৃক্ত করার ব্যর্থতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
একই সাথে ,প্রশ্নটাতে হামিদ দাবাশীর আরেকটা মন্তব্য ফুটে উঠেছে, `নন-ইউরোপীয়ানরা কি চিন্তা করতে পারে?’ তাঁর এই প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন যে, কিভাবে নন-ইউরোপীয় চিন্তাধারা, আমাদের ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তাধারা- পশ্চিমা পন্ডিতরা ছুড়ে ফেলেছেন। মুসলিমরা চিন্তা করতে পারে কি , পারে না, সেটা আসল সমস্যা নয়, বরং বিবেচ্য হচ্ছে, কিভাবে মুসলিমদের চিন্তাধারাকে পশ্চিমা পন্ডিতদের দৃষ্টিকোন থেকে ঢেলে সাজানো যায়, যাতে এই চিন্তাধারা পৌরাণিক কাহিনী না বলে দর্শন বলা যায়।
একদিক দিয়ে , ‘মুসলিম দার্শনিক নেই কেন?’ প্রশ্নটা অযৌক্তিক। হামিদ দাবাশী এবং ওয়াল্টার মিনোলো , দুজনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ মাপের দুজন চিন্তাবিদ, কয়েকজন মুসলিম দার্শনিকের নাম উল্লেখ করেছেন ( সুলেইমান বছির দিয়াগনে, আযমী বিশারা, সাদেক জালাল আল আযম, ফাওয়য়াজ ত্রাবুলশী, আব্দাল্লাহ লারুই, আব্দুল করিম সোরৌশ এবং সায়েদ হোসেন নাসর) । আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ, ওয়ায়েল হাল্লাক তার রাজনীতি ও জ্ঞানসংক্রান্ত টীকায় মুহাম্মদা আরকৌন, এম আব্দেল আল জাবিরী, আলী হারব, হাসান হানাফী এবং মুহাম্মদ শাহরুরের নাম সংযুক্ত করেন।
মুসলিম চিন্তাধারা এবং পাশ্চাত্যের পন্ডিত সমাজ
পরে, আমি এমন কিছু প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে থাকি যেগুলো এই আলোচনার সাথে সম্পৃক্ত। এবং কয়েকটা একাডেমিক ফোরামে প্রশ্নগুলো তুলে ধরি যেখানে মুসলিমদের সংখ্যা মোটামুটি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি প্রশ্নগুলোর কোন সন্তোষজনক জবাব পাইনি। আমার প্রশ্নটা ছিলো“ পন্ডিত সমাজে মুসলিমরা ঠিক কোন পর্যায়ে মুসলিম হিসেবে চিন্তা করতে পারবে, এবং কিভাবে পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার মডেলের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে পারবে?
তাই মুসলিমদের চিন্তাধারা পন্ডিত সমাজে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য মুসলিমদের লেখাকে ইসলামী আদর্শ ও চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে এমন কোন কথা নেই, বরং এটার “প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি” টাই গুরুত্তপূর্ণ। অন্যভাবে বলতে গেলে, এ্যাকাডেমির প্রাথমিক ভূমিকা যদি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য নিবিষ্ট করাই হয়ে থাকে, এবং মুসলিম চিন্তাবিদদের যদি পশ্চাত্য পন্ডিতদের সমালোচনার সাথে নিজেদের কে খাপঁ খাইয়ে নিতে হয়, তাহলে তারা কি মুলত পাশ্চাত্যের ক্ষমতা/ জ্ঞানকে পুনুরুৎপাদন করছেন না?, কারণ মাইকেল ফকাল্ট আমাদের শিখিয়েছন যে, জ্ঞান এবং ক্ষমতা পরস্পরগ্রন্থিত, সম্পৃক্ত।
আমি আমার শুরর প্রশ্নটা এভাবে করেছিলাম, একাডেমিতে যে মুসলিমরা রয়েছেন, তারা “হাউজ মুসলিম” না কি “ফিল্ড মুসলিম”?
পাঠকদের মনে করে দেওয়া আবশ্যক মনে করছি যে, ভারতে ব্রিটিশদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা ছিলো যে ( ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অধীনে) ভারতীয়দের আধুনিক এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করা, যাতে এরকম কিছু প্রজা তৈরী করা যায় যারা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অধিক নমনীয় এবয় সহনশীল হবে। থমাস বেবিংটন ম্যাকাওলে , যিনি ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে অগ্রগণ্য ছিলেন, তার একটা স্বপ্ন ছিলো যে , এমন একদিন আসবে যেদিন ভারতীয়রা অন্যান্য ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে।
এই স্বপ্নটা এখন এতো বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়িত হয়েছে যে, যার কল্পনা ম্যাকাওলে এবং তার সহকর্মীরা চিন্তাও করতে পারেননি। ভারতীয়, মুসলিম এবং নন–ইউরোপীয়ানরা এখন বিশ্বব্যাপী অন্যান্য নন–ইউরোপীয়ানদের পাশ্চাত্য জ্ঞান শিখাচ্ছেন। এবং এই কারণে এ্যাকাডেমিতে ওরিয়েন্টালিজমের মতো শাস্ত্র সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামিক স্টাডিজ হচ্ছে আরেককটা পাশ্চাত্য শাস্ত্র।
আমি পূর্বেই ব্যক্ত করেছি যে, প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য আমি এখনও অপেক্ষা করছি। বাস্তবিকপক্ষে , যে সমস্ত জবাব পেয়েছি, তাও বৈরি। অবশ্য এতক্ষণ পর্যন্ত যতো আলোচনা আমরা করেছি তার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এটা যুক্তিসংগত। আমি আমার প্রাথমিক প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলাম যে, এ্যাকাডেমির ভেতরকার মুসলিমগুলো কি “হাউজ মুসলিম” না “ফিল্ড মুসলিম” । অবশ্যই আমি এখানে ম্যালকম এক্স এর হাউজ নিগ্রো বনাম ফিল্ড নিগ্রোর প্রকৃষ্ট উপমাটা ব্যবহার করেছি, নাগরিক অধিকার আন্দোলন( Civil Rights Movement) এর সময় প্রথম দল আফ্রো– আমেরিকান জনগোষ্ঠীর স্বার্থের চেয়ে শ্বেতাঙগ কর্তাদের তুষ্ট করতে ব্যস্থ ছিলো।
অবশ্য, আমার কাছে“ কৃষ্ঞাঙ্গ আর মুসলিমদের আলাদা বলে মনে হয় না। বরং তার অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পর সম্পৃক্ত। বিগত পঞ্চাশ বছরে প্রতিরোধের উপর যত গ্রন্থ লিখিত য়েছে, তার মধ্যে একজন অকৃষ্ঞাঙ্গ হওয়া স্বত্তেও ম্যালকম এক্স এর আত্মজীবনী আমাকে , আমার জীবনকে সবচেয়ে বেশি অনুরণিত করে। আরেকটা বই যেটা প্রায় একই রকম আবেদন রাখে সেটা হলো, ফ্রেনয ফেননের এর ইনিমিটএবল ব্ল্যাক স্কিন, ওয়াইট মাস্ক।
এখন পর্যন্ত যতগুলো জবাব আমি পেয়েছি, , তারা জোর দিয়ে বলেচেন যে, আমার দেওয়া উপমাটা এই ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না, কারণ আফ্্রো আমেরিকান আর মুসলিমদের মধ্যে অভিজ্ঞার পার্থক্য রয়েছে। আমি ভেবে আশ্চর্য হই যে, আমার প্রতি বৈরীতার কারণ কি শুধু এটাই যে বর্তমানে এ্যাকাডেমিক লেভেলে মুসলিমদের ভুমিকা নিয়ে আমার কথা আছে/ অবশ্য আমি েএই প্রশ্নটা দিয়ে তাদের রুজি নিয়েও প্রশ্ন তুলছি। ঈংগ–মার্কিন আলোচনা দ্বার মুসলিমদেরকে মডারেট বনাম চরমপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করে যে নয়া বর্ণবাদ ভিত্তিক দ্বৈততা সৃষ্টি করা হচ্ছে, এবং যেটা, ৯/১১ পরবর্তী সময়ে বৃহৎ পরিসরে প্রচার করা হচ্ছে, সেটা নিয়ে আমি সিরিয়াসলি উদ্বিগ্ন।
হাউজ মুসলিম
ঈংগ–মার্কিন জনগণ যখন মডারেট মুসলিমদের চরমপন্থী মুসলিমদের উপরে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছে, তখন আমি বলছি যে , কিভাবে মুসলিম একাডেমিশিয়ানরা এই রাজনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক ন্যারেটিভের সমন্বয়ে মডারেট ইসলামকে ইসলামের অন্যান্য দিকের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, এই দিকটাই অন্যান্য দিকের চেয়ে এতো অধিক পরিবর্তনশীল ও বৈচিত্র্যময় যে চিন্তাওকরা যায়। আমার যুক্তি হচ্ছে, মুসলিমদেরকে এই Racialised Binary বা বর্ণবাদভিত্তিক দ্বৈততায় বিভক্ত করে, মুসলিম পন্ডিতরা হাউজ মুসলিমের মতো আচরণ করছেন।
ইসলামী বুদ্ধিমত্তার ঐতিহ্য হচ্ছে শাসক এবং শস্যের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও সত্য উচ্চারণ করা।
যখনই আমি এই ব্যাপারে আলোচনা করেছি তখনই আমি খেয়াল করেছি যে, আলোচনা বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একজন তো বলেই ফেললেন যে আমি“ছদ্ম-ইন্টেলেকচুয়্যালিজম” এ ভুগছি, এটা এমন একটা নালিশ যেটার জবাব দেওয়ার দরকার পড়ে না, যখন এরকম নালিম প্রায় সময়ই কোন আলোচেনাকে বন্ধ করে দিবে, যেপ্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটার কোন যুক্তিসংগত জবাব ব্যতিরেকে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, যেহেতু মুসলিমরা ঔপনিবেশিক প্যারাডিজম বা নমুনার উপর ভিত্তি করে চিন্তা করেন নি সেহেতু মুসলিমরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন( যদিও আমার কাছে পরিষ্কার না যে , কাদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে মুসলিমরা আছেন?)
আমি যে ব্যাপারটা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি সেটা হচ্ছে, উপনিবেশগুলোতে পাশ্চাত্য শিক্ষার রুপায়ণের ফলে,পাশ্চাত্য শিক্ষা নিজেই একটা শিক্ষায় রুপ নিয়েছে, প্রাক-আধুনিক যুগথেকে জানার ও জ্ঞানার্জনের যে অসংখ্য পদ্ধতি ছিলো পাশ্চাত্য শিক্ষা তাদের প্রতিস্থাপিত করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেইজন্য, পাশ্চাত্য শিক্ষিা বলয়ে বাইরে আমরা চিন্তা করতে পারি অথবা চিন্তা করছি এই ভাবনাটাই দ্বিবাস্বপ্ন।
ভার্চূয়ালি আমি যে প্রতিক্রিয়াগুলো পেয়েছি ( অনলাইন ফোরামে আলোচনা চলাকালে) সেগুলো আমাকে বোঝাতে পেরেছে যে, মুসলিমরা রাজনৈতিক ও সামজিক অবস্থা বা Status Quo নিয়ে সমালোচনার পথ এবং ক্ষেত্র ঐতিহ্যগতভাবে উন্মুক্ত রেখেছে। ইসলামী বুদ্ধিমত্তার মজ্জাগত ঐতিহ্য হচ্ছে শাসকএবং রুজির বিপরীতে নিজের মতামত তুলে ধরা। ধারণা করা হয় যে, মুসলিমদের মাঝে সবসময় শাস্ত্র এবং পরিবেশকে বুঝার একের অধিক পদ্ধতি থাকরেতা। ইবনে আরাবী (১১৬৫-১২৪০) যার প্রভাব মুসলিম বিশ্বে বিশদ , যিনি তার ভক্তদের মধ্যে ‘শ্রেষ্ট শিক্ষক” হিসেবে সমাদৃত, তাকেও তার বিরোধীরা কাফের অ্যাখ্যা দিয়েছে, মুসলিমদের মাঝে সবসময় বুদ্ধিবৃত্তিক দন্দ্ব চলে এসেছে।
ফেরাউন, যাকে কোরআন ও বাইবেলে স্বমূর্তি পূজারী হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে, ইবনে আরাবীর মতে সে একত্ববাদী ছিলো। গাযযালা(১০৫৮-১১১১) ইসলামী চিন্তাধারার আরেকজন মহারথী, যুক্তি দিয়ে যে, তাওহীদ বা একত্ববাদ শিখতে হবে, শয়তানের কাছ থেকে। একটি জীবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যই পারে এরকম আপাতবিরোধী ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে চ্যালেঞ্জিং ব্যক্তিত্ব জন্ম দিতে।
এরকম উন্মুক্ত এবং স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ছাড়া , কোন ঐতিহ্যই দার্শনিক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার দাবি করতে পারে না। সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে সবসময় পুনর্বিাচারের উন্মুক্ত রাখতে হবে । এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রে এই সামাজিক অবস্থা বা STATUS QUO , বৃহৎ পরিসরে বলতে গেলে চিন্তার জগতে তাদের অবদানের ক্ষেত্রে করুণায় পর্যবসিত হয়েছে।
তাই ,কেন কোন মুসলিম দার্শনিক জন্ম নেননি? আমি স্বীকার করি যে , এই প্রশ্নটা আগামীর অনাগত চিন্তাশীলদের গভরিভাবে ভাবাবে।
~~ লেখাটি হাসান আজাদের । যিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পি. এইচ. ডি করছেন।
আলজাজিরায় তার লেখা Why are there no Muslim philosophers এর রুপান্তর।
চমৎকার
সালামুন আলাইকুম,
আশা করি আমার এই লেখাটি পড়ে মতামত দিবেন ।
http://www.somewhereinblog.net/blog/AliNowazkhan/30232516#c12136795