মক্কা নগরীর ইতিহাস নিয়ে ভিন্ন স্বাদের একটি বই
লেখক জিয়াউদ্দিন সরদার কাবায় গিয়েছেন। তিনি এবং তার বন্ধু রাতের আঁধারে পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কাছেই দেখলেন একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন আর রশির মতো দাড়ি পাকানোর চেষ্টা করছেন। তার বন্ধু এগিয়ে গিয়ে পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন– শয়তান কোথায় ?
পুলিশ উত্তর দিলেন– শয়তানের কথা জানতে চাচ্ছেন? পুরো সৌদি আরবই তো শয়তানে ভর্তি। দুনিয়া ভর্তি শয়তানেরা শয়তানি শেষ করে এখানে হজ্জ্ব করতে আসে, মাফ চাইতে আসে। আপনি যেদিকেই যান শয়তান খুঁজে পাবেন।
জিয়াউদ্দিন সরদার এগিয়ে গিয়ে বললেন– আমরা বিশেষ একটাকে খুঁজছি (যেটাতে হাজীরা ঢিল ছুড়ে মারে)।
পুলিশ বলল– ও আচ্ছা, ঐ দিকে যান, ঐ দিকে দুইটা আছে।
Mecca: The Sacred City by Ziauddin Sardar বইয়ের ভূমিকা পড়লাম।
হাজার বছর আগে ইবনে বতুতা বা অন্যান্যরা দূর থেকে কীভাবে হজ্জ্ব করতে আসতেন জিয়াউদ্দিন সরদার সেটা একটু পরখ করে দেখতে চেয়েছেন। এ জন্য ভদ্রলোক অনেক চড়া দামে একটা গাধা কিনে বন্ধুর সাথে ইয়েমেনি গাইডসহ রওনা দিয়েছেন ইয়েমেনের দিকে। গাধার নাম দিয়েছেন চেঙ্গিস।
কিছুদূর গিয়েই দেখলেন শাসক চেঙ্গিসের মতই তার প্রিয় কাজ কারণে অকারণে মেজাজ দেখানো এবং লাথি মারা। তাকে নিয়ন্ত্রণ করা চেঙ্গিস খানের সাথে যুদ্ধ করারই শামিল। সে কোনোভাবেই হাঁটে না। কথা শোনে না। একবার থেমে গেলে জায়গা থেকে নড়ানোই মুশকিল। অনেক দৌড়ঝাপ শেষে চেঙ্গিস একেবারে হোটেল শেরাটনের সামনে গিয়ে উঠল। সবাই তো চেঙ্গিসকে দেখে একেবারে হতভম্ব! হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের অনেক ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার ট্রেনিং ছিল। কেবল গাধাকে আথিতেয়তা করার পূর্বাভিজ্ঞতাটাই বোধহয় তাদের বাকি ছিল। চেঙ্গিসের উছিলায় সেদিন বাকি ট্রেনিংটুকুও যেন সারা হলো।
শেষমেশ চেঙ্গিসে চড়ার আশা বাদ দিয়ে উল্টো চেঙ্গিসকেই গাড়িতে চড়িয়ে মিনায় পাঠানো হলো। তার সাথে অন্য কোনো যাত্রী উঠতে পারেনি দেখে গাড়ি ভাড়া বাবদও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খরচ হলো। ঠিক যেন শাসক চেঙ্গিস খান! ভদ্রলোক গাধার কাণ্ডকীর্তিতে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ আর গেলেন না। ভাবলেন হেঁটে তো বেশিদূর যেতে পারলেন না, অন্তত ফিরতি পথটা গাড়ির বদলে হেঁটেই ফিরবেন। হেঁটে আসার সময়ও অনেক কষ্ট হলো। একে তো গরম, তার উপর ব্যস্ত সড়ক। কয়েকবার গাড়ির নিচে পড়ার অবস্থা হয়েছে। গাড়ির ধোঁয়াতেও বেশ কিছুটা কষ্ট হলো।
সব মিলিয়ে সরদারের মনে হলো ইবনে বতুতার অভিজ্ঞতা বর্তমান সময়ে আর নেয়া সম্ভব নয়। যে সময়টা চলে গেছে সেটা আসলেই চলে গেছে। মানুষ যে সময়ে বাস করে, চাইলেও সে সময়ের প্রভাব কাটাতে পারে না। শুধুমাত্র সে সময়ের সমস্যাগুলোকে সবচেয়ে এফিশিয়েন্ট উপায়ে মোকাবেলার কথা চিন্তা করতে পারে!
এরপর লেখক খুব মজার কয়েকটা পয়েন্ট বলেছেন। ব্যর্থ মনোরথে যখন তাবুতে বসে আছেন, তখনই তাবুতে তার বন্ধু প্রবেশ করলেন। সাথে একজন সোমালিয়ান। সাত বছর হেঁটে হজ্জ্ব করতে এসেছেন এ সোমালিয়ান ভদ্রলোক।
লেখকের মনে হলো এ ভদ্রলোকের বিশাল কষ্টের কাছে তার নিজের কষ্ট তো নস্যি!
লেখক বলেছেন এটাই হলো স্পিরিচুয়াল মক্কা, যার দিকে সারা দুনিয়ার মানুষ মুখ ফেরায়। হাজার মাইল হেঁটে আসে। এটাই হলো তাদের স্পিরিচুয়াল কম্পাস, স্বপ্নের নগরী। এত মানুষের ভিড়েও সবাই যেন আলাদা, সবার অভিজ্ঞতা যেন আলাদা। শহরটাকে একবার দেখা, একবার স্পর্শ করা, একবার এখানে শ্বাস নেয়ার ইচ্ছা কত মানুষের বুকে, এরপরও বেশিরভাগ মানুষেরই সামর্থ্যের বাইরে থেকে যায় এ মক্কা নগরী!
তবে এ মক্কার কাহিনী বইয়ের পাতায় যেন স্থবির হয়ে থাকে। সবার লেখাতেই হজের রিচুয়ালের বর্ণনা ফুটে উঠে। হজ্জ্ব তো একই রকম। তাই মক্কার বর্ণনা পড়লেও মনে হয়, সব যেন একই রকম। কে কীভাবে এসেছে সেটা মুখ্য নয়, আসার পর কীভাবে হজ্জ্ব পালন করেছে সেটাই যেন সবার কাছে মুখ্য ।
তবে লেখকের এ বইয়ের বিষয় স্পিরিচুয়াল মক্কা নয়, বরং ফিজিক্যাল মক্কা। এ মক্কার একটা ইতিহাস আছে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ইতিহাস আমাদের সাধারণ কল্পনার সাথে যায় না। তাই পড়তেও স্বাচ্ছন্দ্য লাগে না। হজ্জ্বের পবিত্র নগরী মক্কায়ও ভালো-খারাপ মানুষ আছে, লোভ আছে, হিংসা আছে, জিঘাংসা আছে। এখানেও রক্তপাত হয়েছে। এ বইয়ের উদ্দেশ্য হলো সেই মানবিক ইতিহাস তুলে ধরা।
পৃথিবীতে এত শত বছর অতিবাহিত হলো, কত শত মুসলিম শাসক বদল হলো, মক্কা সবার স্পিরিচুয়াল রাজধানী হলো, কিন্তু একবারও প্রশাসনিক রাজধানী হলো না। মদিনা, বাগদাদ, দামেস্ক ঘুরে খিলাফত ইস্তাম্বুল গিয়ে শেষ হলো। কত শত শাসক-শাসিতরা এসব জায়গা থেকে আসল, কিন্তু মক্কা একবারও যেন শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হলো না।
লেখক বলেছেন, মক্কার স্কলাররা বরং সবকিছুতেই রক্ষণশীল মনোভাব দেখিয়েছেন। তারা যেন পরিবর্তনে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কালচারাল এবং অন্যান্য পরিবর্তনে কেন ফিজিক্যাল মক্কার এ অনাগ্রহ, এর কী ইতিহাস ঢাকা পড়েছে– সেটা নিয়ে আলোচনাই এ বইয়ের মূল লক্ষ্য।
ভূমিকা পড়ে এটাই বুঝলাম।
একটা কথা না বলে পারছি না। এ রকম একটা শুকনো বিষয়কে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে হলে একটা শক্তিশালী লেখনীর দরকার ছিল, যেটা সরদারের আছে। তিনি প্রায়ই সুন্দর সুন্দর কৌতুক করেছেন। বেশ মজার সব প্রশ্ন করেছেন এবং চমৎকার ভাষাদক্ষতা দেখিয়েছেন।
ভূমিকা পড়ে আমার মন্তব্য হলো– সরদার এট হিজ বেস্ট! পড়ার আমন্ত্রণ থাকল!
লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ এরকম একটি বইকে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনার লেখাটি পড়ার পরে বইটি পড়ার বিষয়ে আমার ব্যপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি বইটির হার্ড কপি বা সফট কপি ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়েছি। বইটি কোনোভাবেই ডাউনলোড করতে পারছিনা্। তাই সিএ্সসিএস এর মাধ্যমে লেখকে অনুরোধ করছি, আপনার কাছে যদি এটির সফট কপি থাকে তাহলে অবশ্যই আমার ই-মেইলে (rahidul93.ru@gmail.com) পাঠাবেন। জাযাকুমুল্লাহু খয়রান।