সেক্যুলার তুরস্কে ইসলামপন্থীদের অভিজ্ঞতার বয়ান

‘ফর দ্যা পিপল, ডিসপাইট দ্যা পিপল’– শ্লোগান নিয়ে শুরু হওয়া কামাল আতাতুর্কের আধুনিকীকরণের অগ্রযাত্রা বেশ প্রভাব ফেলে তুর্কির শহুরে অঞ্চলের মানুষের কাছে। ইউরোপীয় আধুনিকতার আদলে তুরস্ককে গড়ে তোলার জন্যে সেক্যুলারিজমের আবরণে তিনি নজিরবিহীনভাবে ধর্মহীনতাকে চাপিয়ে দেন। এই প্রক্রিয়াটি সে সময় ‘কামালিজম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশটিতে একদলীয় শাসন চলতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মেরুকরণ শুরু হলে তুরস্কও তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে নি। তুরস্কের তৎকালীন ডেমোক্রেট সরকার পশ্চিমাদের রাজনৈতিক বলয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চা শুরু হয়। ন্যাটোর সদস্যপদ গ্রহণ করে। সে সময় তুরস্কের ইসলামী চিন্তাবিদগণ ধর্মহীন সমাজতান্ত্রিকতার বিপরীতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোতে সমর্থন দান করেন। পরবর্তী ইসলামপন্থী দলগুলোও আদর্শিক কারণে কমিউনিস্ট বিরোধী অবস্থানে অটল থাকে। অপরদিকে বামপন্থী রাজনীতিতে কুর্দিরা বেশ জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে। আর সমাজের এলিট ও সেক্যুলার ধারাকে জোরালো সমর্থন দিতে থাকে কামাল আতাতুর্কের আদর্শবাহী সেনাবাহিনী। যারা সেক্যুলারিজমের ব্যানারে ধর্মহীনতাকে টিকিয়ে রাখতে চার চারটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে।

স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তুরস্কের জাতীয় পরিচয়ের সংকট তীব্র হয়ে উঠে। রাজনৈতিক মেরুকরণ জাতিকে বিভক্ত করে ফেলে। ‘হয় তুমি তুর্কি নয়তো কুর্দি, হয় তুমি ইসলামপন্থী নয়তো সেক্যুলার’– অবস্থা যখন এ পর্যায়ে দাঁড়ায়, তখন তুরস্কের ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গাগুলোতেও পক্ষ-বিপক্ষের আওয়াজ ওঠে। সেনাবাহিনীর চাপে কোয়ালিশন সরকারগুলোর অবস্থাও হয়ে পড়ে নড়বড়ে। পাশাপাশি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সরকারগুলোকে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয় পুরো দশক জুড়ে। ফলে অর্থনীতিতে বিরাজ করতে থাকে টালমাটাল অবস্থা। এসবের মাঝেও দিন দিন ইসলামপন্থীরা রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়।

৯৭ সালে ইসলামপন্থী এরবাকান সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হলেও তুরস্কের মূলধারার রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা ধারাবাহিকভাবে তাদের অবস্থান দৃঢ় করে তোলে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে উদার ইসলামপন্থী দল একেপিকে তুরস্কের জনগণ এককভাবে নির্বাচিত করে। উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কারণে দলটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। পরবর্তী সব নির্বাচনে জয়লাভ করে দলটি। যা দেশটির বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

তিন প্রভাবককে নিয়ন্ত্রণ

একেপি সরকারের সগৌরবে টিকে থাকার ফলে তুরস্কের সমাজ তো বটেই রাজনীতিতেও ইসলাম ক্রমে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। তুলনামূলক উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক সাফল্য ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ইসলামপ্রীতির কারণে একেপি সরকারকে নানা সময় বেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে বেশ দৃঢ়তার সাথে একেপি’র প্রাজ্ঞ নেতারা তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে তুরস্কের সেনাবাহিনী, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনীতি– এই তিনটি প্রভাবক গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য।

১। সেনাবাহিনী

কামালবাদী মূলনীতির ধারক তুরস্কের সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। যারা ৬০ সালে ডেমোক্রেট ও ৭১ সালে সুলেমান ডেমিরেলের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে সরাসরি নেতৃত্ব দেয়। শুধু তাই নয়, ৮০ ও ৯৭ সালে আরো দুটো নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে সেনাবাহিনী। ২০০২ সালে একেপি ক্ষমতায় এসে সেনাবাহিনীর ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নেয়। শুরু থেকেই নিজেদের সেক্যুলারিস্ট ও গণতান্ত্রিক হিসেবে দাবি করা একেপি ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়। আর এতে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যপদ লাভের বিষয়টিকে ব্যবহার করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদের জন্যে সঙ্গত কারণেই ‘কোপেনহেগেন ক্রাইটেরিয়া’র শর্ত পূরণ আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। ক্রাইটেরিয়াতে বলা হয়েছিল, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ রাখতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বেসামরিক ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন হতে হবে এবং বছরে ছয়বারের বেশি বৈঠকে মিলিত হতে পারবে না। তাছাড়া প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব ব্যয় ‘কোর্টস অব অ্যাকাউন্টসের’ নজরদারিতে রাখতে হবে।

ইইউ’র সদস্যপদ অর্জনের লক্ষ্যে গৃহীত এব পদক্ষেপের কারণে গণতান্ত্রিক ভাবাপন্ন ব্যবসায়ী, উদারবাদী বুদ্ধিজীবী ও কর্মতৎপর মধ্যবিত্ত সমাজের সমর্থন একেপি সরকারের দিকে ঝুঁকতে থাকে। এছাড়া বিষয়টিকে একেপি সরকার কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্ক গড়ার স্বপ্নের সাথে একই সূত্রে গাঁথা হিসেবে তুলে ধরে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জন করতে পারলে তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আরো বাড়বে বলেও মত দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হোসেইন কিভরিকোগলু। এজন্যে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কট্টর সেক্যুলার ও প্রধান বিরোধীদলের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে জনগণ রায় দেয়। যথারীতি একেপি সরকার ‘কোপেনহেগেন ক্রাইটেরিয়া’ অনুসারে সংবিধান সংশোধন করে নেয়। এর ফলে প্রায় ৮৭ বছর ধরে দাপিয়ে বেড়ানো সেনাবহিনীর মুখে লাগাম পড়াতে সক্ষম হয় কৌশলী একেপি সরকার।

২। বিচার ব্যবস্থা

তুরস্কের বিচার ব্যবস্থায় সবচেয়ে প্রভাবশালী অঙ্গটি হলো ‘সাংবিধানিক আদালত’। ১৯৬১ সালে গঠিত এই সাংবিধানিক আদালতকে ৮২ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আরো ক্ষমতাশালী করা হয়। সেক্যুলারিজমের সাথে সংঘর্ষিক যে কোনো রকম কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ ও রদ করতে সুপ্রিম কোর্টের এই প্রভাবশালী অঙ্গটি পুলিশিংয়ের কাজ করে থাকে। বিভিন্ন সময় ইসলামপন্থী রাজনীতিক ও দলসমূহকে নিষিদ্ধ করে এই সাংবিধানিক আদালত। এছাড়া ৯৭ সালে এরবাকান সরকারকেও ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে।

হেডস্কার্ফ ইস্যুতে ২০০৮ সালে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে সৌভাগ্যক্রমে বিচারক ট্রায়ালে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে তখন টিকে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া সাংবিধানিক আদালত কুর্দিদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে তুরস্কের সাংবিধানিক আদালতের কর্মকাণ্ড অনেকটা অগণতান্ত্রিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ মানুষের ব্যক্তিগত মতামত ও সংস্কৃতির উপরও নাক গলাতে দেখা গেছে এই সাংবিধানিক আদালতকে। ইইউ’র সদস্যপদ পেতে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল সেখানে সুপ্রিমকোর্ট ও সাংবিধানিক আদালতের বিচারক নিয়োগে প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার ও ভূমিকা বাড়ানোর কথা উল্লেখ ছিল।

২০১০ সালের গণভোটের রায় অনুযায়ী কিছুটা হলেও এখতিয়ার সরকারের অনুকূলে আসে। সে অনুসারে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি আইন পাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের নিয়োগের দায়িত্বে থাকা ‘হায়ার কাউন্সিল অব জাজেজ অ্যান্ড প্রসিকিউটরস’ বা HSYK’র নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে এসেছে। তবে এপ্রিল মাসে এই আইনের কিছু অংশ বাতিল করে দেয় সাংবিধানিক আদালত, যেখানে নিয়াগের ক্ষেত্রে বিচারমন্ত্রীকেও কিছুটা ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।

৩। অর্থনীতি

সেনাবাহিনীর অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অস্থিতিশীল গণতন্ত্র, কুর্দি আন্দোলনসহ নানা কারণে এক সময় ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বেকারত্বের দেশ ছিল তুরস্ক। বিভিন্ন সময় তুরস্কের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ২০০০-০১ সালের দিকে তা চরম আকার ধারণ করে। এসব বিপর্যয় সত্ত্বেও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী তুরস্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসে একেপি। ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বছরে ৭.৫ শতাংশ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় দেশটি। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সুদের নিম্নমুখী হারের কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে পূর্বের তুলনায়। সাথে সাথে অর্থনীতিতে বেসরকারীকরণের ব্যাপ্তিকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার কারণে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগও (FDI) বেড়ে যায়। অর্থনীতিকে আরো গতিশীল ও জনকল্যাণমুখী করতে একেপি’র পদক্ষেপগুলো সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে। ফলে দেখা যায়, ২০০৮ সালে যেখানে গড়ে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৮’শ মার্কিন ডলার, ২০১১ সালে তা ১০ হাজার ডলার ছুঁয়ে যায়। যেটা সে সময় তুলনামূলকভাবে ইইউভুক্ত কয়েকটি দেশকেও ছাড়িয়ে যায়। এসব সফলতার কারণে জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাগুলো অনুভব করতে থাকে।

২০০২ সালে জনকল্যাণে খরচ করা হয়েছিল জিডিপির ০.৫%, যা ২০১৩ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ১.৫%। এসব খরচের সুবিধাভোগীদের মধ্যে নারীদের হার ছিল ৬০ শতাংশ। প্রায় ৩ মিলিয়ন পরিবার সরাসরি সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। যার বেশিরভাগ ছিল গ্রামাঞ্চলের লোকজন। দেখা যায়, ২০০২ সালে দৈনিক ৪ ডলারের নিচে আয় করা লোকের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। আর ২০১২ সালে সেই সব লোকের হার চলে আসে ৩ শতাংশের নিচে। ফলে লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়, বেড়ে যায় চাহিদা ও উৎপাদনের পরিমাণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকারের চুক্তি, তুর্কি লিরার মূল্য পুনর্নিধারণ, সুদের নিম্নমুখী হার ও বৈদেশিক বিনিয়োগের কারণে বিশাল পরিমাণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হয়। তুরস্কের অর্থনীতি পূর্বের তুলনায় যে অনেক বেশি স্থিতিশীল অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেছে তা সাম্প্রতিক সময়ের আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতেও স্বীকার করা হয়েছে। এই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই একেপি সরকারের সগৌরবে টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকগণ। বিরোধীপক্ষের দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও সর্বশেষ নির্বাচনে একেপি’র প্রাপ্ত ভোটের হার অতীতের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি

অতীতের সরকারগুলোর মতো এরদোয়ান সরকারও পশ্চিমা শক্তির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ঐতিহাসিকভাবে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। উভয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, জ্বালানী নিরাপত্তা বৃদ্ধি, পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, উদার গণতন্ত্রের বিস্তার ইত্যাদি ইস্যুতে একসাথে কাজ করে আসছে। পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র এখনো তুরস্কের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশেষ করে ন্যাটোর মুসলিম সদস্য রাষ্ট্র তুরস্কের সেনাবহিনীর সংখ্যা সেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম। কৃষ্ণসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও ‘বাকু-তিবিলিসি-সাইহান’ পাইপলাইনের নিরাপত্তায় তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অংশীদার। একেপি সরকার কর্তৃক ইরানের উপর অবরোধ আরোপে বিরোধিতা, ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির কঠোর সমালোচনা ও হামাসের প্রতি অনুকূল নীতি গ্রহণ সত্ত্বেও ওয়াশিংটন একেপি’র উপর আস্থা রেখেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আইএস দমনে তুরস্ক কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সিরিয়ায় কুর্দি নিয়ন্ত্রিত কোবানি শহরটি আইএস’এর দখলে চলে যাওয়ার পর তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ ব্যাপারে একসাথে কাজ করতে সম্মত হয়। কারণ কোবানি শহরটি তুরস্কের সীমান্তে অবস্থান করায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে আঙ্কারা আরো কঠোর হয়ে ওঠে। তবে এই সুযোগ ব্যবহার করে আইএস দমনে যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি যোদ্ধাদের নিকট পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতা তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের সাথে চলমান শান্তি আলোচনাকে প্রভাবিত করবে বলে দাবি করে তুরস্ক। কুর্দিদের হাতে অস্ত্র চলে গেলে তা এ অঞ্চলের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরো দীর্ঘয়িত করবে। অন্যদিকে, আইএস’এর মতো কট্টরপন্থীদের উত্থানের ফলে একেপি’র ‘ইসলাম এজেন্ডা’র বাস্তবায়নও অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিকভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশংকা থাকে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে ‘জিরো প্রবলেমস উইথ ন্যেইবরস’ নীতি মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে। তবে সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে আসাদ সরকারকে সরানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্ক নীতিগতভাবে একমত। অন্যদিকে, ২০০৩ সাল থেকেই ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্কের ভূমি ব্যবহারে অসহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে একেপি সরকার।

কোপেনহেগেন ক্রাইটেরিয়া অনুসারে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ফলে ইইউ’র কাছে একেপি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা পূর্বের সরকারগুলোর তুলনায় বেশি। যদিও হেডস্কার্ফ ও ওসমানীয় সময়ের আর্মেনিয়ার গণহত্যা ইস্যুতে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের সম্পর্কে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আর্মেনিয়ার গণহত্যা ইস্যুটিকে ইইউ’র সদস্যপদ অর্জনে অন্যতম বাধা হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকগণ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে গুলেন ইস্যুতে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে একেপি সরকারের কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। যদিও গুলেনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গ্রুপকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করেছে সরকার।

অতীতের তিক্ততাকে এড়িয়ে গিয়ে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়ন, দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ নিরসনে মধ্যস্ততা ও বিশ্বমহলে নেতৃস্থানীয়, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তিকে মূল লক্ষ্য রেখে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন, বিরোধী বিক্ষোভকারীদের সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কারণে বিশ্বমহলে এরদোয়ান প্রশংসিত হয়েছেন।

আদর্শিক ডিলেমা

সত্তরের দশকের শেষের দিকে তুরস্কের বিভিন্ন প্লাটফরমের ইসলামপন্থীদের সমন্বয়ে শুরু হয় ‘মিল্লি গুরুশ’ বা ন্যাশনাল ভিশন মুভমেন্ট। তবে তাদের সবাই স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে মিল্লি গুরুশের চেতনাকে কাজে লাগাতেন। মিল্লি গুরুশের অগ্রপথিক ছিলেন এরবাকান। যার ওপর নানা সময়ে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ করা হয় ইসলামপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও। তুর্কি সমাজে ইসলামের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কামালিস্ট সেক্যুলার আদর্শের প্রভাব বলয়ে ইসলামের অনুকূলে যে কোনো চিন্তা বা পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সবসময়।

সর্বশেষ ফজিলেত পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলগত কারণে ন্যাশনাল ভিশন মুভমেন্টে বিভক্তি দেখা দেয়। একটি ধারা রয়ে যায় রক্ষণশীল ইসলামপন্থী হিসেবে, আর অন্য একটি ধারা গড়ে উঠে তুলনামূলক উদারবাদী ইসলামপন্থীদের নিয়ে। শেষোক্তদের নিয়ে এরদোয়ান ও আবদুল্লাহ গুল গড়ে তোলেন ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলাপমেন্ট পার্টি’ বা একেপি। বিগত সময়ে নিষিদ্ধ হওয়া সচরাচর ইসলামী দলগুলো থেকে তুলনামূলক উদারমনা জনশক্তিদের নিয়ে গড়ে ওঠে এই দলটি। প্রথম দিকে কিছুটা রক্ষণশীল ইসলামী দলগুলোর সাথে একেপি’র রাজনৈতিক ও আদর্শিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তবে তুরস্কের কট্টর সেক্যুলার রাজনৈতিক পরিবেশে একেপি’র ইসলাম সম্পর্কে ক্রমধারা নীতির কার্যকরী পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেছে ইসলামপন্থীরা।

একেপি নিজেদেরকে তুরস্কের ঐতিহ্য ও মানুষের ধর্মীয় অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে দাবি করে। রাজনৈতিকভাবে মধ্য-ডানপন্থী এই দলটি দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্যে প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা ও উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ধর্মানুসারী নয় এমন জনগণেরও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয় দলটি। এক সময় ওয়েলফেয়ার পার্টিতে সক্রিয় থাকা এবং বর্তমানে একেপি’র নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান ছিল। কিন্তু একেপি তাদের পদক্ষপে অন্যান্য ইসলামপন্থীদের চেয়ে পরিপক্কতার কারণে সফলভাবেই তুরস্কের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান করে নেয়।

ক্ষমতায় এসে একেপি’র রাজনৈতিকভাবে ইসলামীকরণের পথ পরিহার করার বিষয়টিকে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীরা আদর্শের সাথে কম্প্রোমাইজ হিসেবে ধরে নেয়। আদর্শ নাকি জনস্বার্থ? এমন প্রশ্নে দেখা যায়, সরাসরি ইসলামীকরণের দিকে না গিয়ে বরং জনকল্যাণ ও মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে একেপি। এক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অব্যহত রাখতে ইউরোপীয় মানদণ্ডকে (কোপেনহেগেন ক্রাইটেরিয়া) কাজে লাগাতে সক্ষম হয় একেপি সরকার।

তাছাড়া সেক্যুলার আদর্শে ব্যক্তি অধিকার সুরক্ষিত রাখার যুক্তি অনুযায়ী হেডস্কার্ফ ব্যবহারে নারীদের স্বাধীনতা প্রদানে একেপি সরকারের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী ও ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে ঢেলে সাজানো, ওসমানীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আরবিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণাসহ নানা ইস্যুতে পশ্চিমা গণমাধ্যম এরদোয়ানকে ‘নব্য সুলতান’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। সমালোচকরা এসব পদক্ষেপকে এরদোয়ানের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল হিসেবে অবহিত করছে। অথচ বিষয়গুলো এতোটাই ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয় যে, গুলেন প্রভাবিত মিডিয়া কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগ করার পরও জনসমর্থনের পাল্লা একেপি সরকারের দিকেই ঝুঁকে আছে।

সাংগঠনিক কাঠামো

তুরস্কের সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ দৃঢ় হওয়ার সাথে সাথে ইসলামপন্থীরা রাজনৈতিক ভাবে তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠে। নিজেদের গড়ে তোলা রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বারবার নিষিদ্ধ হওয়ায় সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা গড়ে ওঠে। একবিংশ শতকের শুরুতে প্রচলিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক কর্মসূচিকে এড়িয়ে গিয়ে গড়ে তোলা হয় একেপি’র মতো উদারপন্থী দলকে। ফলে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে প্লুরালিস্টিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটে। রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি উদার মনোভাবাপন্ন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। তবে ইসলামকে ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করতে তারা অনিচ্ছুক। ফলে প্র্যাকটিসিং মুসলিম নয় এমন জনগণও এসব দলকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। কারণ এসব উদারপন্থী দলগুলো তুরস্কের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় এমন যে কোনো ধারা ও কার্যপ্রণালীকে এড়িয়ে নিজেদের দলীয় সংবিধান প্রণয়ন করে। এক্ষেত্রে একেপি একটি প্রকৃষ্ট উদারহণ।

নেতৃত্বের ক্যারিশমা

ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি, ইসরাইল আক্রমণ করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা প্রদানসহ পশ্চিমা বিরোধী বক্তব্য দিয়ে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন এরবাকান। DYP’র নেতা তানসু সিলারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত না করার শর্তে এরবাকানের সাথে তারা কোয়ালিশন সরকার গঠনে রাজি হয়। সমালোচকগণ ওই সময় দুই বিপরীতমুখী আদর্শের রাজনৈতিক মিত্রতায় বেশ কৌতুক অনুভব করে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এরবাকানের নীতিতে নমনীয়তার ছাপ পাওয়া যায়। ক্ষমতায় আসার আগে ইইউ’কে খ্রিস্টানদের ক্লাব হিসেবে অবহিত করলেও পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ অর্জনের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখেন। এছাড়া পশ্চিমা বা ইসরাইলের সাথে পূর্ববর্তী সরকারগুলো মতো সম্পর্ক ধরে রেখেছিলেন। অর্থনৈতিক দুঃসময়েও আইএমএফ’এর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া এবং ইরাকের সাথে সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টার কারণে সে সময় বেশ সমালোচিত হন তিনি। এসব বিষয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করতে পারায় সেক্যুলারপন্থী তো বটেই, অন্যান্য ইসলামপন্থীদেরও সমালোচনার সম্মুখীন হন। অনেকে মনে করেন ক্ষমতায় থাকাকালে নমনীয় মনোভাবের কারণে সেনাবাহিনী এরবাকানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

এরবাকানের মতো জনপ্রিয় নেতৃত্বের পতনের পর তুরস্কের ইসলামপন্থীদের মধ্যে তখন এক ধরনের জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। বিশেষ করে তুরস্কের মতো কট্টর সেক্যুলার পরিবেশে নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, তা-ই ছিল আলোচ্য বিষয়। পরবর্তীতে ফজিলেত পার্টি গঠনের সময় দলের দৃষ্টিভঙ্গি রেফাহ পার্টির চেয়ে তুলনামূলক উদার ও সদস্যপদের ক্ষেত্রে আরো সহজীকরণের কথা বলা হলেও নেতৃত্ব নিয়ে সংকট দেখা দেয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এরবাকান সরকারের সময়ে উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আবদুল্লাহ গুল ও ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় মেয়র রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দিকে। কারণ উভয়ে উদারবাদী ও বিচক্ষণ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এ দুজনকে এড়িয়ে গিয়ে এরবাকান তাঁর পুরোনো বন্ধু ও সিনিয়র নেতা রেকাই কুতানকে নেতৃত্ব নিয়ে আসেন। ফলে ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদার ইসলামপন্থীদের কৌশলী চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই ফজিলেত পার্টির পাশাপাশি আবদুল্লাহ গুল ও এরদোয়ান মিলে গড়ে তোলেন ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলবমেন্ট পার্টি’ বা একেপি।

এরদোয়ানের নেতৃত্ব

তুরস্কের ইসলামপন্থী রাজনীতিতে শুরু হয় আরেক অধ্যায়। দলের নেতৃত্বে উঠে আসেন এরদোয়ান। প্রথমদিকে ইসলামপন্থী ব্যক্তিদের নিয়ে দল গঠন করলেও তিনি একেপি’কে ইসলামপন্থী হিসেবে প্রকাশ করতে দেননি। আদর্শিকভাবে দলটিকে সামাজিক রক্ষণশীল ও অর্থনৈতিক উদারবাদী হিসেবে তুরস্কের রাজনীতিতে তুলে ধরতে সক্ষম হন। বহুদলীয় গণতন্ত্র সূচনা হওয়ার পর তুরস্কের গণতন্ত্রে সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল তীব্রভাবে। পাশাপাশি ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপেরও দরকার ছিল। ঠিক এসব সংকটজনক পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় আসে একেপি। নিজের উপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরদোয়ান। দায়িত্ব পেয়ে এরদোয়ান মনোযোগ দেন দেশের সংকটজনক পরিস্থিতিগুলো মোকাবেলায়। জাতীয় ও জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারের নীতি প্রণয়ন করা হয়। প্রাথমিক এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে একেপিকে তুলে আনেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

শুরুর দিকে সেক্যুলারপন্থী সামাজিক আন্দোলন যেমন ফেতুল্লাহ গুলেনের মতো ব্যক্তিও সমর্থন দেন এরদোয়ানকে। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাও এরদোয়ান আমলে তুরস্কের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেন। ফলে সংবিধান সংশোধনসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও উন্নয়ন পদক্ষেপে এরদোয়ান উদার ও মধ্যপন্থী সেক্যুলাদেরও সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হন। স্বাধীনভাবে ধর্মীয় মূলবোধ ও গণতন্ত্র চর্চার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিচিত সেনাবাহিনীকে জনসমর্থনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা এবং সাংবিধানিক আদালতকে আরো গণতান্ত্রিক করার পদক্ষেপের বাস্তবায়ন জনগণ সমর্থন করে। তবে বিচারক নিয়োগে সরকারের ক্ষমতাবৃদ্ধিকে অগণতান্ত্রিক ও সুশাসন পরিপন্থী বলে অভিযোগ করে থাকে এরদোয়ানের সমালোচকগণ। অন্যদিকে এসব কার্যক্রমকে রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নের মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে একেপি সরকার।

উন্নয়ন নাকি সুশাসন

উন্নয়ন ও সুশাসনের প্রশ্নে অনুন্নত, উন্নয়নশীল, উন্নত– এই তিনটা পর্যায়ের রাষ্ট্রগুলোর শাসন প্রণালী কি একই ধরনের হবে? যে দেশগুলো এখনো তার নাগরিকদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারে না বা কোনো কোনো দেশ পারলেও তা টেকসই হয়ে ওঠেনি– এমন দেশগুলোতে উন্নত রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য ‘সুশাসন’ ফর্মুলা বাস্তবসম্মত নয়। অপরদিকে, উন্নত রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ‘গণতন্ত্র ও সুশাসনের’ সাথে সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ চাপিয়ে দেয়ার বহু নজির রয়েছে। জাতিকে উন্নয়নের শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানোর জন্যে শাসক কখনো কখনো স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত সে সব ‘অগণতান্ত্রিক’ পদক্ষেপ রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে মজবুত ভিত্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সফলতার জন্যে শাসকের দেশপ্রেমও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এ বিষয়গুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় বর্তমান সময়ের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর যে সব নেতা সুশাসনের চেয়ে উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের সাথে আজকের তুরস্ককে তুলনা করা যেতে পারে।

এরদোয়ান ক্যারিশমা

জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে নানা সময় গৃহীত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তুর্কি সরকার প্রধান রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সময়ে সময়ে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ উঠা মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের পদচ্যুত করে এক্ষেত্রে অনমনীয় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। এক সময়ের উন্নয়নশীল দেশ তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতির ১৮তম রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পেছনে এরদোয়ানের সময়োপযোগী পদক্ষেপগুলো কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রের উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে নানা সময় পালন করতে হয়েছে কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা। সমালোচনা সত্ত্বেও অগ্রাধিকার বিবেচনায় ‘উন্নয়ন অথবা সুশাসন’– এমন ডিলেমায় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন কর্মসূচিতে। অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন উদারহরণ পাওয়া দুস্কর। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়াতেও রাষ্ট্রের তৎকালীন ছয়টি মূলনীতিতে ‘গণতন্ত্র’কে স্থান দেয়া হয়নি। জনসমর্থনের মাধ্যমে উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের স্বার্থে এরদোয়ান কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। এটি সমালোচকদের দৃষ্টিতে ‘সুশাসন’ পরিপন্থী মনে হলেও দৃশ্যত তা তুরস্কের উন্নয়নকে টেকসই করেছে। ফলে এক সময়ের বৈদেশিক ঋণনির্ভর তুরস্ক বর্তমানে পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে ।

তুরস্কের মতো উন্নয়নমুখী রাষ্ট্রকে শীর্ষস্থানীয় উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাতারে নিয়ে যেতে অর্থনীতিকে আরো গতিশীল ও সরকার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এরদোয়ান জনগণের ঐক্যের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তুরস্কে কুর্দিদের জাতিসত্তা ও ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে অতিরক্ষণশীল ইসলামপন্থা বা কট্টর সেক্যুলারপন্থার বাইরে উদার ও মধ্যমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে । তুর্কির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে সম্মান প্রদর্শনকারী দল হিসেবে পরিচিত একেপি। এদিক বিবেচনায় এরদোয়ান তুর্কির অতীত সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন। এতে করে তিনি উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজের নিকট চমকপ্রদ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। অনুকূলে পেয়েছেন কর্মোদ্দীপ্ত মধ্যবিত্ত সমাজের বৃহদাংশকে। প্রায় ৯০ বছর ধরে কামালবাদী কট্টর সেক্যুলার পরিবেশে এরদোয়ানই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি আতাতুর্কের পর দীর্ঘমেয়াদে তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন।

ইসলামী ঐতিহ্য

তুরস্কের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী। এক সহস্রাব্দ আগে সূচিত ওসমানীয় খিলাফতের সমৃদ্ধ ইতিহাসের নানা উপাদান তুর্কি জাতীয় জীবনে এখনো প্রভাবশালী।

রাজনৈতিক ঐতিহ্য

সেলজুক তুর্কিদের দ্বারা এ অঞ্চলে ইসলামের রাজনৈতিক ভাবধারার সূত্রপাত হয়েছিল। পরবর্তীতে বুশরা নগরীর ওসমান বংশের হাত ধরে তা খিলাফতে রূপ নেয়। কালের পরিক্রমায় তৎকালীন আনাতোলিয়া ছাড়িয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকাসহ বিশাল এক ভূখণ্ডের ওপর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। বিভিন্ন ধর্ম ও মতের জনগোষ্ঠী এই খিলাফতের অধীনে ছিল। মুসলিম মিল্লাতের ধারণা নির্ভর ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে ‘কসমোপলিটন’ ধারণার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। যেখানে জনগোষ্ঠীগুলোর নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ ছিল। খিলাফত পরিচালনায় নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। শাসন কাঠামোতে প্রাদেশিক ব্যবস্থা ও পৃথক বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি ওসমানীয় খিলাফতে প্রচলিত ছিল। এসব ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতিগুলোকে মোটামুটি মেনে চলা হলেও নেতৃত্বে বংশানুক্রমিকতা রক্ষা করাটা মূলনীতির বিপরীতমুখী বটে।

প্রতাপশালী এই খিলাফত ব্যবস্থা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সমসাময়িক অন্যান্য সাম্রাজ্যগুলোর তুলনায় ওসমানীয় খিলাফত কিছু দিন বেশিই টিকে ছিল। বিংশ শতকের শেষাংশে তুরস্কের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের উত্থান, বর্তমানে তুলনামূলক উদারপন্থী একেপি’র রাজনৈতিক ভিশনের সাথে ওসামানীয় ঐতিহ্যের উপাদান লক্ষ করা যায়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

ছোট ছোট স্বতন্ত্র রাজ্যে বিভক্ত তৎকালীন আনাতোলিয়ার জনগোষ্ঠী বিদ্যমান বিভক্তিগুলো মূলত ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে কমিয়ে আনার সুযোগ পায়। খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত মুসলিমদেরকে ‘মিল্লাত’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ওসমানীয় সময়ে তুর্কি সমাজের মূল্যবোধ ইসলামী শিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। শরীয়াহভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজে আলেমগণের আধ্যাত্মিক প্রভাবের সাথে সাথে সুফিদেরও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ছিল। পুরো খিলাফতের মধ্যে সুন্নী, শিয়া, আলাভী ধারার মুসলমানরা বসবাস করলেও মূল আনাতোলিয়া ভূখণ্ডে হানাফী ও শাফেয়ী ব্যাখ্যার প্রভাব বেশি ছিল। তিনটি মহাদেশের মাঝামাঝিতে অবস্থান করায় ইসলাম ধর্মের মানুষ ছাড়াও খৃষ্টান, ইহুদী, জরথুস্ত্রীয়সহ নানা ধর্মানুসারী জনগোষ্ঠী এই খিলাফতের অধীনে বসবাস করতো। বিচারিক সুবিধার জন্যে বেসামরিক আদালত দুটো ধারায় বিভক্ত ছিল। মুসলিমদের জন্যে বিচার ব্যবস্থা ছিল শরীয়াহভিত্তিক। আর অন্যান্য ধর্মানুসারীদের জন্যে তাদের নিজস্ব আইন অনুসরণ করা হতো।

বহু রকমের সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন জনগোষ্ঠী ওসমানীয় খিলাফতের অধীনে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। যাকে বর্তমানে ‘মাল্টি কালচার’ সমাজের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভ্ন্নি সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল। জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশের ভাষা ছিল আরবি। প্রশাসনিক কাজে আরবি প্রাধান্য পেলেও পাশাপাশি তুর্কি, হিব্রু, গ্রীক, পার্সিয়ান, স্লোভেনিয়ান, কুর্দিসহ বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত ছিল। সার্বিকভাবে এ সকল জাতিগোষ্ঠীর মুসলিমদের জীবনযাপনে ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। তুরস্কে বর্তমানে যে ফেজ টুপি দেখা যায় তা মূলত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সময়ে ইসলামী ঐহিত্যকে নির্ভর করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির অংশ। এছাড়া সেখানকার স্থাপনাগুলোতে যে শৈল্পিকতার ছাপ পাওয়া যায় তা মূলত খিলাফত সময়ের ইসলামী শিল্পের অন্যতম নিদর্শন।

ইসলামপন্থীদের ঐক্য

প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সময় হতে ডি-ইসলামাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রায় সকল মুসলমান নিপীড়নের শিকার হয়। ডেমোক্রেট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর মূলধারার রাজনীতিতে ইসলাম চর্চার সুযোগ বাড়তে থাকে। তবে জনজীবনে ইসলামের উপস্থিতি ছিল মূলত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক নয়। সমাজে আলেম, সুফি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ধর্মীয় ও নৈতিক পুনর্জাগরণের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তাদের অধিকাংশই ছিল অরাজনৈতিক। সুফিদের ভ্রাতৃসংঘগুলো (নকশবন্দী, কাদেরী প্রভৃতি) স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে। যাদের অনেকই আবার সাঈদ নুরসীর দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুসরণ করতো।

সংগঠনগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্যও ছিল। তবে তারা সবাই কামালবাদের চাপিয়ে দেয়া ধর্মহীনতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। কারণ সবার আদর্শিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইসলামকেই ঘিরেই। অন্যদিকে শহুরে অভিজাত শ্রেণী সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের গঠনমূলক প্রভাব রয়ে গিয়েছিল। ষাটের দশক নাগাদ দ্রুত শিল্পায়ন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় এবং বামপন্থী রাজনীতি ও কমিউনিস্টদের ক্রমবর্ধমান উত্থানজনিত ভীতির ফলে তুরস্কের মুসলিমরা রাজনীতিতে অংশ নেয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করে। এক্ষেত্রে এমন একজন ব্যক্তি মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন, যিনি একাধারে সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রকৌশলী এবং ব্যবসায়ীও বটে। নেজিমুদ্দিন এরবাকানই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি মুসলিমদের মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনা ভেতর থেকে তীব্রতর হচ্ছিল তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তার সমমনা ও সমপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে অন্যান্য ইসলামপন্থীদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ‘মিল্লি গুরুশ’ নামে একটি ইশতেহার ঘোষণা করেন। এর ফলে তুরস্কের আলেম সমাজে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৬৯ সালে আলেমদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ড. এরবাকান স্বতন্ত্রভাবে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। পরবর্তীতে ‘ন্যাশনাল অর্ডার পার্টি’ গঠিত হলে তুরস্কের মুসলিমরা দীর্ঘদিন পর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার প্লাটফরম খুঁজে পায়।

পরিশেষ

সময়োপযোগী চিন্তা ও পদক্ষেপের অভাবে প্রতাপশালী ওসমানীয় খেলাফত এক সময় দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তুরস্কে যার স্থান দখল করে প্রতিক্রিয়াশীল সেক্যুলারপন্থীরা। প্রতিক্রিয়াশীলদের নিষ্পেষণের ফলে মুসলিমদের মধ্যেও পাল্টা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অসহনশীলতা। মুসলিম সমাজকে সংকীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে বের করে আনতে প্রাজ্ঞ কিছু ইসলামপন্থী ব্যক্তি নানা মাত্রায় গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সময়ের ব্যবধানে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে প্রতিক্রিয়াশীলতার নেতিবাচকতা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে উঠে সাধারণ তুর্কি জনগণের মাঝে। মুসলিমদের অধিকাংশের কাছে তো বটেই, তুরস্কের সমাজেও ইসলামের সময়োপযোগিতা সম্পর্কে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়তে থাকে।

সমসাময়িক পরিবেশ-পরিস্থিতি এক সময় ইসলামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের জনগণের সামনে উন্মোচিত করে। তুর্কি সমাজের মূল্যবোধের পরিবর্তন, বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন, বৈশ্বিক অর্থনীতি– এসবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ইসলামপন্থীরা প্রথম দিকে ব্যর্থ হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইসলামপন্থীদের মধ্যে প্রাজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়। মৌলিক অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে আদর্শিক ও ঐহিত্যবাহী মূল্যবোধও যে সময়ের প্রেক্ষিতে সহায়ক হতে পারে, তা বর্তমান সরকার অনুধাবন করতে পেরেছে।

এটুকু পথ পেরিয়ে আসতে ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কট্টর সেক্যুলারদের আধিপত্যের মুখে বার বার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। দলীয় নেতৃত্বের সংকটে পড়ে সাংগঠনিক ভাঙ্গনের সুরও বেজেছে সময়ে সময়ে। তারপরও ইসলামপন্থীদের মাঝে উদার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। সাংগঠনিক বহুত্ববাদিতার প্রচলন ঘটেছে। বেড়েছে সহনশীলতা এবং কমেছে প্রতিক্রয়াশীলতা। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিবেচনা করতে শিখেছে। সর্বোপরি তারা ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব পেয়েছে।

মুসলিম বিশ্ব বলতে যা বুঝায়, সে সব দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত। সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধানে ইসলামপন্থীদেরকে নিজ নিজ দেশের পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনা করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পারিপার্শ্বিক উপায়-উপাদনের ভিন্নতাকে বিবেচনায় রেখে তুরস্কের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে।

তথ্যসূত্র

১. Yavuz, M. Hakan. 2003, Islamic Political Identity in Turkey, Oxford University Press.
২. Öniş, Ziya. Sharing Power: Turkey’s Democratization Challenge in the Age of the AKP Hegemony.
৩. Mango, Andrew.1999, Atatürk, John Murray Publishers Ltd.
৪. Multi-Culturalism in the Ottoman Empire and its Effects on the Ottoman Social and Intellectual Life
৫. Welfare Policies are the Key to the AKP’s Electoral Successes
৬. Turkey’s rise from aid recipient to mega-donor
৭. Turkey’s Military Is a Catalyst for Reform: The Military in Politics
৮. এসপাসিতো, জন এল। অনু. শওকত হোসেন, দ্য ইসলামিক থ্রেট: মিথ অর রিয়েলিটি?, রোদেলা প্রকাশনী।

এ ধরনের আরো লেখা