ইসলামে নারীর মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন
এডিটরস নোট: ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের ২৩তম উজ্জীবক প্রশিক্ষণে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে জনাব শাহ আব্দুল হান্নান ‘ইসলামে নারীর মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন’ নিয়ে একটি বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যটি পরিমার্জন করে সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
*****
সমাজে নারীর অবস্থান এবং অধিকার নিয়ে বর্তমানে যে কথাগুলো বলা হয়, তার মধ্যে অনেকগুলোই গ্রহণযোগ্য। আবার কিছু কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ আছে। নারী-পুরুষ সকলেরই অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া অনস্বীকার্য। কারণ সমাজ দিন দিন সামনে এগুচ্ছে। তাই শুধু নারী বা পুরুষের নয়, বরং সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
গত পঞ্চাশ বছরে সমাজ অনেকটা এগিয়েছে। এ সময়ে নারীরা পুরুষের সমানতালে না হলেও, এগিয়ে এসেছে। বেগম রোকেয়ার সময়ে যে সমাজ ছিল, সে সমাজকে আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। তিনি দেখেছিলেন, সে সময়ে মেয়েরা লেখাপড়ার কোন সুযোগই পেত না। ওই সময়ে বেগম রোকেয়ার জন্ম না হলে এবং নারী শিক্ষার ব্যাপারে তিনি সাহসী উদ্যোগ না নিলে নারীরা এখন ব্যাপকভাবে পড়ালেখা শিখতে পারত না।
সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে আমাদের দেশে নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে তার একটা প্রেক্ষাপট আছে। অত্যাচারটা আকাশ থেকে আসছে না। নারীর ওপর পুরুষেরযে অত্যাচার তার ‘আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশন’টা হলো, সাধারণভাবে মানুষ, বিশেষ করে পুরুষরা বিশ্বাস করে, নারী পুরুষের চেয়ে ছোট, তাদের যোগ্যতা কম এবং তারা নীচ। এই বিশ্বাস অবশ্য নারীদের মধ্যেও কিছুটা বিদ্যমান। মানুষের মধ্যে কতগুলো বিভ্রান্তি থেকে এ বিশ্বাসের জন্ম। আর এই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে নারীর উপর অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন।
বাংলাদেশে ইসলামকে বাদ দিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। যারা ইসলাম থেকে বিদ্রোহ করেছে তারা টিকতে পারেনি, পারছে না। ইসলামের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আমরা যদি এগুতে পারি, তবে তা সব চাইতে ভালো। ইসলামে এমন একটি ফ্রেমওয়ার্কআছে, যা নারীদের সামনে এগিয়ে দিতে পারে। তবে এ ব্যাপারে ইসলামের কোনো টেম্পোরারি ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। সত্যিকার অর্থেই ইসলাম নারীকে ক্ষমতা দিয়েছে, সম্মানিত করেছে।
কোনো দিক থেকেই দুজন মানুষ সমান নয়। ওজন, উচ্চতা, রঙ, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছুতে একজন থেকে আরেকজন মানুষ আলাদা। যদিও মৌলিক তথা অন্তর্গতভাবে প্রতিটি মানুষ আল্লাহর কাছে সমান। এর চারটি প্রমাণ নিম্নরূপ-
১.
আল্লাহ তায়ালা এ কথা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, মূল মানুষ হচ্ছে রূহ; যাকে আমরা আত্মা বলি। মূল মানুষ কিন্তু শরীর নয়। দেহ তো কবরে পঁচে যাবে। আমরা যারা ইসলাম বিশ্বাস করি তারা জানি, মূল মানুষ হচ্ছে রূহ। আল্লাহ সকল মানুষকে অর্থাৎ রূহকে একত্রে সৃষ্টি করেছেন, একই রকম করে সৃষ্টি করেছেন এবং একটিই প্রশ্ন করেছেন। নারী-পুরুষ সকলে আল্লাহর প্রশ্নের উত্তরও একই দিয়েছিল। সূরা আরাফে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
যখন আল্লাহ বনীআদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে [এটা একটা রূপক কথা] তাদের (পরবর্তী) সন্তানদেরকে (অর্থাৎ সকল আত্মাকে) বের করে আনলেন এবং তাদের ওপরে সাক্ষ্য নিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা সবাই (সকল পুরুষ ও নারী) বললো, হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি (আপনি আমাদের প্রভু)। [সূরা আরাফ : ১৭২]
তারমানে আল্লাহর সঙ্গে একটি পয়েন্টে সকল নারী-পুরুষের একটি চুক্তি হলো যে, আপনি আমাদের প্রভু; আমরা আপনাকে মেনে চলবো। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পৃথক চুক্তি হয়নি। সুতরাং আমরা দেখলাম, ইসলামের ideological foundation-এর প্রথম কথা হলো, মূল মানুষ হচ্ছে রূহ এবং তা সমান। এই সাম্যের পরে যদি কোনো অসাম্য থেকে থাকে তাহলে তা অত্যন্ত নগণ্য। তারমানে, মানুষের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এক এবং মানুষ হিসেবে সবাই সমান। এটি হলো নারী-পুরুষের সাম্যের প্রথম ভিত্তি।
২.
পুরুষরা গর্ব করে যে, তাদের শারীরিক গঠন নারীর তুলনায় ভালো, আল্লাহ বোধহয় পুরুষদের তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ করে বানিয়েছেন এবং মেয়েরা কম যোগ্যতাসম্পন্ন। কিন্তু আল্লাহ একটি কথা কোরআনে খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, সকল মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্তু প্রত্যেক মানুষই উত্তম। আল্লাহ বলেছেন,
নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম কাঠামোতে। [সূরা ত্বীন : ৪]
আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে শুধু পুরুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন নাই। অর্থাৎ, আমাদের গঠনে পার্থক্য আছে, আমরা এক নই, আমরা ভিন্ন ভিন্ন কাঠামোর; কিন্তু সবাই উত্তম হিসেবে সৃষ্ট। সুতরাং নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, নতুন নারী আন্দোলনের জন্য অথবা নতুন মানব আন্দোলনের জন্য পুরুষদের এ কথা বলা ঠিক নয় যে, মেয়েদের গঠন-কাঠামো খারাপ। আল্লাহ তাতে অসন্তুষ্ট হবেন। নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের এটা হলো দ্বিতীয় প্রমাণ।
৩.
আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, সকল মানুষ একই পরিবারের অর্থাৎ আদম এবং হাওয়া পরিবারের। আল্লাহ বলছেন,
হে মানব জাতি, সেই রবকে তুমি মানো যিনি তোমাদেরকে একটি মূল সত্ত্বা (নফস) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সত্ত্বা থেকে তার সাথীকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই দুজন থেকে তিনি অসংখ্য নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। [সূরা নিসা : ১]
তারমানে সবাই একই পরিবারের সদস্য তথা বনি আদম। আল্লাহ পাক কোরআন শরীফে অন্তত ২০/৩০ বার বলেছেন, ‘ইয়া বনি আদামা’ (হে আদমের সন্তানেরা)। বাবা-মা এবং সন্তানেরা মিলে যেমন পরিবার তৈরি হয়, তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জাতি একটি পরিবার। সব পরিবারের ওপর হলো মানব জাতির পরিবার। তারমানে, সকলের মৌলিক সম্মান ও মর্যাদা সমান। ছোট-খাটো কারণে মানুষের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। তদুপরি জাগতিক মর্যাদা আসল মর্যাদা, এমন নয়।
যেমন বলা হয়, আইনের চোখে সকল মানুষ সমান, তেমনি আল্লাহর কাছেও সবাই সমান। আল্লাহর কাছে সম্মানের একমাত্র ভিত্তি হলো তাক্বওয়া। আল্লাহ বলেননি যে, তার কাছে পুরুষ সম্মানিত কিংবা নারী সম্মানিত। আল্লাহ বলেছেন,
আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই মর্যাদাবান, যে আল্লাহকে মেনে চলে। [সূরা হুজুরাত : ১৩]
আল্লাহ বলেছেন তিনি তাক্বওয়া ছাড়া (কে আল্লাহকে মানে আর কে মানে না) কোনো পার্থক্য করেন না। অতএব, আমরা এক পরিবারের সন্তান, আমাদের মৌলিক মর্যাদাও সমান। আরেক জায়গায় আল্লাহ বলেছেন,
এবং ভয় করো সেই আল্লাহকে, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে অধিকার দাবি করে থাকো। আর ভয় করো গর্ভ(ধারিণী মা)কে। [সূরা নিসা : ১]
আল্লাহ বলেছেন, তোমরা ‘গর্ভ’কে ভয় করো। কোরআন শরীফের এই আয়াতটির ব্যাখ্যায় সাইয়েদ কুতুব নামে মিশরের একজন বিখ্যাত আলেম লিখেছেন, কোরআনের আগে পৃথিবীর কোনো সাহিত্যে এই ভাষা প্রয়োগ হয়নি। আল্লাহ ‘গর্ভ’কে ভয় করতে বলে মা’কে সম্মান করার কথা বলেছেন, নারী জাতিকে সম্মান করার কথা বলেছেন। সুতরাং ইসলাম প্রদত্ত মৌলিক সামাজিক মর্যাদা এক্ষেত্রেও সমান বলে প্রতীয়মান হলো।
৪.
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সময় বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা সবাই খলিফা’। আল্লাহ বলেননি যে, খলিফা হিসেবে তিনি নারী বা পুরুষকে পাঠাচ্ছেন। এমনকি তিনি বলেননি, মানুষ পাঠাচ্ছেন! বরং আল্লাহ বলেছেন, তিনি খলিফা পাঠাচ্ছেন। পাঠালেন মানুষ, আর বললেন খলিফা। মানুষকে তিনি খলিফা হিসেবে অভিহিত করলেন। খলিফা মানে প্রতিনিধি। পুরো মানব জাতি হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকে তাঁর প্রতিনিধি।
এই খলিফার মর্যাদার মধ্যেই রয়েছে সকল ক্ষমতায়ন; যে ক্ষমতায়নের কথা সচরাচর আমরা বলি। ক্ষমতা ছাড়া কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না। খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রত্যেক নারী এবং পুরুষের কিছু ক্ষমতা লাগবে। নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি এই খেলাফতের মধ্যে রয়েছে। শুধু নারী নয়, ‘খেলাফত’শব্দের মধ্যে নারী, পুরুষ, গরিব, দুর্বল- সকলের ক্ষমতায়নের ভিত্তি রয়েছে। সুতরাং নারী-পুরুষ মৌলিক সাম্যের এটি হলো চতুর্থ প্রমাণ।
ইসলাম চায় every man, every woman, every person should be empowered। এই মুহূর্তে যদি নারীরা বঞ্চিত থেকে যায়, তাহলে তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। পুরুষরা কোনোদিন বঞ্চিত হলে তাদেরও ক্ষমতায়ন করতে হবে। তবে যে বঞ্চিত তার কথা আগে ভাবতে হবে; নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বর্তমানে আগে কাজ করতে হবে।
নারীদের আসল কাজ কি? তারা কি ঘরে বসে থাকবে? কোনো মেয়ে নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্তে ঘরে থাকতে চাইলে সে অধিকার তার রয়েছে। পুরুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। কিন্তু আল্লাহ কোথাও বলেননি যে, নারীদের ঘরে বসে থাকতে হবে, বাইরের কাজ নারীরা করতে পারবে না। বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আল্লাহ প্রদত্ত মূল দায়িত্ব একই। আল্লাহ বলেছেন,
মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক (ওয়ালী), একে অপরের বন্ধু, একে অপরের সাহায্যকারী। এরা ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। [সূরা তওবা : ৭১]
এই আয়াতে বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ একে অপরের অভিভাবক। অনেকে বলে, নারী অভিভাবক হতে পারে না। অথচ আল্লাহই বলেছেননারী অভিভাবক হতে পারবে। মূল কোরআনে এ ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। মনে রাখতে হবে, এই আয়াত কোরআন শরীফের সর্বশেষ সূরাগুলোর একটি। তাই উল্লেখিত বিষয়ে পূর্ববর্তী আয়াতগুলোকে এই আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই আয়াত অনুসারে নারী-পুরুষের নির্ধারিত ৬টি দায়িত্ব হলো:
ক. তারা ভালো কাজের আদেশ দিবে।
খ. মন্দ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করবে।
গ. উভয়ে নামাজ কায়েম করবে।
ঘ. যাকাত দিবে।
ঙ. আল্লাহকে মানবে।
চ. রাসূলকে মানবে।
এসব কথার মাধ্যমে আল্লাহ সকল ভালো কাজে নারীদের অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। এটাই ইসলামের নীতি। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন, যারা এই ৬টি দায়িত্ব পালন করবে তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করবেন। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাতে রাসূলে (সা) পুরোপুরি বিশ্বাসী যে কেউই স্বীকার করবেন, এই ৬টি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নারী-পুরুষ সবাই সমান। রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি যে কোনো কাজই এ ৬টি দায়িত্বের আওতা বহির্ভূত নয়।
ইসলামের মূল জিনিস পরিত্যাগ করে ছোট-খাটো ব্যাপার নিয়ে মুসলমানরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের তৈরি বিভিন্ন কিতাবের ওপর নির্ভর করছে। আল্লাহর মূল কিতাবকে সেই তুলনায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ইসলামকে যদি ইসলামের মূল পাঠ্য ও উৎসের বাইরে থেকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে তা হবে স্পষ্ট ভুল। অনেকে কোরআনের অনুবাদে নিজেদের কথা ঢুকিয়ে দেয়। ফলে পাঁচ-ছয়টি বই পড়লে বুঝা যাবে, কোথায় মানুষের কথা ঢুকেছে; আর প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বক্তব্য কি। কয়েক রকম ব্যাখ্যা পড়লে পাঠক ঠিক করতে পারবেন কোন ব্যাখ্যাটা সঠিক। নারীদের মধ্যে বড় তাফসিরকারক নেই। এটা নারীদের ব্যর্থতা। নারী তাফসিরকারক থাকলে হয়তো জেন্ডার বৈষম্য হতো না। তবে কোরআন শরীফের কিছু তাফসীর আছে যেগুলো জেন্ডার বৈষম্য থেকে মুক্ত, যেমন মোহাম্মদ আসাদের ‘দি ম্যাসেজ অব কোরআন’৷