ইসলামের মূলতত্ত্ব
[বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলাম তাত্ত্বিক, ইসলামী গবেষণা ও শিক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আল -মাওরিদের প্রতিষ্ঠাতা জাভেদ আহমদ গামিদী কর্তৃক উর্দু ভাষায় রচিত ইসলাম পরিচিতিমূলক গ্রন্থ ‘মীযান’ থেকে শুরুর কয়েক পৃষ্ঠার অনুবাদ ‘ইসলামের মূলতত্ত্ব’ শিরোনামে প্রকাশ করলাম। উল্লেখ্য, ‘আল -মাওরিদ’ কর্তৃক ‘মীযান’-এর একটি ইংরেজি সংস্করণ ‘Islam: A Comprehensive Introduction’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।]
দ্বীন হলো মহান আল্লাহর হিদায়াত বা পথনির্দেশ— যা তিনি প্রথমে মানুষের সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অনুপ্রেরণ (ইলহাম) করেছেন, এরপর উহার প্রয়োজনীয় বিশদ রূপসহ স্বীয় নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে দান করেছেন। এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ রাসূল হলেন মুহাম্মদ (তাঁর উপর সালাত ও সালাম)। অতএব, দুনিয়াতে দ্বীনের চূড়ান্ত গ্রহণস্থল কেবলমাত্র মুহাম্মদ স.; তিনিই একমাত্র সত্তা — ক্বিয়ামাত পর্যন্ত যার কাছ থেকে স্বীয় প্রতিপালকের দিকনির্দেশনা পাওয়া আদমসন্তানের পক্ষে সম্ভব হবে এবং এ একমাত্র তাঁরই পদমর্যাদা — স্বীয় কথা, কাজ, সিদ্ধান্ত ও সম্মতির মাধ্যমে তিনি যে বিষয়কে দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা-ই অবশিষ্ট সময়কালের জন্য দ্বীন সাব্যস্ত হবে।
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ. –سورة الجمعة: 2
“তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি নিরক্ষরদের মাঝে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে রাসূল তাদের নিকট তাঁর (আল্লাহর) আয়াতসমূহ পাঠ করে, তাদেরকে পূতঃপবিত্র করে এবং তাদেরকে বিধি–বিধান ও পথ–পদ্ধতি শিক্ষা দেয়।” –আল–কুরআন
এই বিধি-বিধান ও পথ-পদ্ধতিই হলো সত্যদ্বীন-“ইসলাম”। ইসলামের উৎসস্থলের বিবরণ হলো: আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ স. থেকে এই দ্বীন তাঁর সাহাবিগণের ঐকমত্য (ইজমা’) এবং বক্তব্যগত ও ব্যবহারিক নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরা (মুতাওয়াতির ক্বাওল ও আমল) সহযোগে দুইটি বাহনে আমাদের কাছে পৌঁছেছে; তা হলো: ১) কুরআন ও ২) সুন্নাহ।
কুরআন:
পবিত্র কুরআনের বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিম এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত আছে যে, ইহা সেই কিতাব যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর শেষনবী মুহাম্মদ স.-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন; ইহা নাযিলের পর থেকে অদ্যাবধি মুসলমানদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বয়ং মুসলমানদের কাছে এই সুস্পষ্টতা সমেত বর্তমান আছে যে, এই কুরআন সেই কিতাব যা মুহাম্মদ স.-এর উপর নাযিল হয়েছিল এবং যাহা তাঁর সাহাবিগণ তাঁদের ঐকমত্য (ইজমা) ও বর্ণনাগত নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরার (ক্বাওলী তাওয়াতুর) মাধ্যমে নিখুঁত আমানতদারীতার সাথে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ব্যতিরেকে পৃথিবীবাসীর নিকট পেশ করেছেন।
[অন্য কথায়, আল-কুরআন তা-ই যা মুহাম্মদ স.থেকে তাঁর সাহাবীগণ ইজমা ও মুতাওয়াতির পন্থায় এবং তাঁদের পরবর্তী মুসলমানগণ অদ্যাবধি প্রজন্মের পর প্রজন্ম অভূতপূর্ব ইজমা ও মুতাওয়াতির পন্থায় আল-কুরআন হিসেবে সংরক্ষণ ও বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করে এসেছে। — অনুবাদক]
সুন্নাহ:
এখানে সুন্নাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইবরাহীমীয় ধর্মের সেই ঐতিহ্যিক ধারা — মুহাম্মদ স.যার নবায়ন, সংস্কার ও সংযোজন করে স্বীয় উম্মাহর মাঝে দ্বীন হিসেবে প্রচলিত করে গেছেন। আল-কুরআনে মুহাম্মদ স.কে ইবরাহীমী ধর্মের অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং এই সুন্নাহও সেই দ্বীনে ইবরাহীমীর অন্তর্ভুক্ত। ইরশাদ হয়েছে:
ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ. – سورة النحل: 123
“অতঃপর আমি তোমাকে প্রত্যাদেশ করলাম যে, তুমি ইবরাহীমের ধর্ম অনুসরণ কর, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের মধ্যকার ছিল না।” – আল–কুরআন
এই সুন্নাহর মাধ্যমে যে দ্বীন আমরা পেয়েছি তা হলো –
ইবাদাত: ১) সালাত ২)যাকাত ও সাদাকায়ে ফিতর ৩) রোযা ও ইতিকাফ ৪) হজ্ব ও উমরাহ ৫) কুরবানী ও আইয়ামে তাশরীকের তাকবীর।
মুআশারাত: ১) বিবাহ ও তালাক এবং এতদ্বসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ২) হায়েজ ও নিফাস কালীন যৌনসংগম থেকে বিরত থাকা।
পানাহার সংক্রান্ত: ১) শুকর, রক্ত, মৃত জন্তু এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহকৃত জন্তুর নিষিদ্ধতা ২)পশু যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নামোচ্চারণ।
রীতি ও শিষ্টাচার: ১) আল্লাহর নামে ও ডানহাতে পানাহার করা ২) দেখা-সাক্ষাতে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা ও এর উত্তর দেয়া ৩) হাঁচির পর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা ও এর উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা ৪) গোঁফ খাটো রাখা ৫) নাভির নিচের পশম কাটা ৬) বগলের পশম পরিস্কার করা ৭) নখ কাটা ৮) ছেলেদের খতনা করা ৯) নাক, মুখ ও দাঁত পরিস্কার করা ১০) ইসতিনজা করা (শৌচকর্ম) ১১) হায়েয ও নিফাসের পর গোসল করা ১২) জানাবাতের গোসল (বীর্যস্খলন কিংবা যৌনসংগমের পর আবশ্যক গোসল) ১৩) মৃতের গোসল ১৪) কাফন ও দাফন প্রস্তুতি ১৫) দাফন ১৬) ঈদুল ফিতর ১৭) ঈদুল আযহা।
এগুলোই সুন্নাহ; ইহা পরিপূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, সাব্যস্ত হওয়ার দিক থেকে এই সুন্নাহগুলোর এবং কুরআনের মাঝে কোন তফাৎ নাই। যেভাবে সাহাবিগণের ঐকমত্য ও বর্ণনাগত নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরার (ইজমা ও ক্বাওলী তাওয়াতুর) মাধ্যমে আমরা আল -কুরআন পেয়েছি, ঠিক তেমনি এই সুন্নাহসমূহও সাহাবিগণের ইজমা ও ক্বাওলী তাওয়াতুর মারফত আমরা পেয়েছি। আর আলকুরআনের মতোই প্রত্যেক যুগে মুসলমানদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সুন্নাহসমূহ সাব্যস্ত হয়েছে। একারণে এই সুন্নাহর বিষয়ে কোন প্রকার বাদানুবাদ ও তর্কের সুযোগ নাই।
নিঃসন্দেহ দ্বীন-ইসলাম এই দুই (কুরআন ও সুন্নাহ) রূপেই বর্তমান। ইহা ব্যতীত অন্য কোনকিছু না দ্বীন হতে পারে, আর না দ্বীন সাব্যস্ত করা যেতে পারে। আল্লাহর রাসূল স.-এর কথা-কাজ ও সিদ্ধান্ত-সম্মতি সংক্রান্ত ‘খবরে ওয়াহেদ’ সম্ভার- যাকে সাধারণতঃ হাদীস বলা হয় — এ বিষয়ে কথা হলো: এ ধরণের হাদীস থেকে যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা কখনোই ‘ইয়াক্বীন’ তথা নিশ্চয়তামূলক জ্ঞানের মানে উন্নীত হয় না। একারণে খবরে ওয়াহেদের মাধ্যমে দ্বীনের মধ্যে কোন বিশ্বাস ও কর্মের সংযোজন হয় না। এই আখবারে আহাদের মধ্যে দ্বীন-সংশ্লিষ্ট যাকিছু আছে, তা মূলতঃ কুরআন ও সুন্নাহর পরিসীমায় সুনিবন্ধিত দ্বীন-ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং দ্বীনের উপর আমলের জন্য মুহাম্মদ স. কর্তৃক আচরিত আদর্শ পদ্ধতির বর্ণনা। হাদীসের আওতা এতটুকুই। সুতরাং এই আওতার বহির্ভূত কোন বর্ণনা না দ্বীনের মধ্যে গ্রহণযোগ্য ‘হাদীস’ হতে পারে, না কেবল হাদীসের ভিত্তিতে কোন কিছু দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা যেতে পারে।
[অন্য কথায়, কুরআন ও (এখানে বিবরিত) সুন্নাহ-ই হলো দ্বীন-ইসলাম। আখবারে আহাদ প্রকারের হাদীসের গ্রহনযোগ্যতা হলো, শুধুমাত্র কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হিসেবে এবং মুহাম্মদ স. কর্তৃক দ্বীন চর্চার আদর্শ পদ্ধতির বর্ণনা হিসেবে। কুরআন ও সুন্নাহর আওতা বহির্ভূত কোন বিষয় এই আখবারে আহাদের ভিত্তিতে দ্বীনের মধ্যে সংযোজন করা যাবে না। — অনুবাদক]
হাদীসের এই আওতার মধ্যে, কোন হাদীসের প্রামাণিকতা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য আবশ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন সে ঐ হাদীসের বিশুদ্ধতার বিষয়ে স্থির নিশ্চিত হয়ে উহাকে রাসূল স.-এর কথা-কাজ কিংবা সিদ্ধান্ত-সম্মতি হিসেবে গ্রহণ করে নেবে। এরপর উহা অগ্রাহ্য করা তার জন্য বৈধ থাকে না। বরং ঐ হাদীসে আল্লাহর রাসূল স.-এর কোন নির্দেশ কিংবা সিদ্ধান্ত বর্ণিত হয়ে থাকলে উহার সামনে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়বে।
কুরআন, সুন্নাহ ও হাদীস — এই তিনটি বিষয়ই গবেষণার ক্ষেত্র; এ বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের লক্ষ্যে জ্ঞানগ্রাহীগণের পক্ষে যে বিষয়াবলী বিবেচনা করা প্রয়োজন, তা এক বিশেষ ধারাবাহিকতার সাথে সামনে আলোচনা করা হলো।…
মূল: জাভেদ আহমদ গামিদী
অনুবাদ:মুহাম্মদ মুনির উদ্দীন
One Comment