শরিয়া, এথিক্যাল গোলস ও মডার্ন সোসাইটি

[এটি মুইজ অ্যাকাডেমির দি অকেশনাল পেপারস সিরিজ থেকে ড. জাসের আওদার নিবন্ধের অনুবাদ]

কানুন

এটি শরিয়া ও ফতোয়া থেকে ভিন্ন জিনিস। শরিয়া হলো ব্যক্তি ও সমাজের নৈতিকতা, অন্যদিকে কানুন হলো যা কর্তৃপক্ষ ব্যক্তি ও সমাজের উপর শক্তিপ্রয়োগে বাস্তবায়ন করে। অধিকন্তু, শরিয়া আর কানুনের মধ্যে পার্থক্য হলো অনেকটা পাপ (গুনাহ) ও অপরাধের পার্থক্যের মতো। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেকটি পাপ রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।

বস্তুত, কোনো পাপ কিংবা নৈতিক ভুলকে অপরাধে রূপান্তরিত করতে একটা তাকনিন (আইনী প্রক্রিয়ার) প্রয়োজন। আইন প্রণয়ন রাজনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামোর একটি বিষয়।

অতীতে আমাদের রাষ্ট্রগুলো ছিল খুবই সাধারণ। সেখানে রাজা, ঈমাম, আমীর কিংবা খলিফা নামের একজন রাষ্ট্রপ্রধান থাকতেন আর তারা শরিয়া কিংবা ফিকহ থেকে কোনো বিষয় সংগ্রহ করে সেটাকে আইনে পরিণত করতেন। অর্থাৎ তারা কোনো বিষয়ে আদেশ জারি করতেন, জনগণ এটা করতে পারবে না। আর যখন জনগণ এই সীমা অতিক্রম করতো, তখন তাদেরকে জরিমানা পরিশোধ করতে হতো কিংবা গ্রেফতার করা হতো বা জেলে আটক করে রাখা হতো।

যাহোক, সকল পাপ ইসলামি আইনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়নি। খাঁটি ইসলামি আইন সমাজের শৃংঙ্খলা রক্ষার সাথে সম্পৃক্ত, সমাজের নৈতিকতার সাথে নয়। ইসলামে সামাজের নৈতিকতা মসজিদ, পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংরক্ষিত হওয়া উচিত, আইনের মাধ্যমে নয়; আর বিশেষ করে রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে নয়।

হযরত মুহাম্মদ সা. সবই ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বিচারক, একজন নেতা এবং একজন নবী। একজন নেতা হিসেবে তিনি জনগণের উপর তাঁর কর্তৃত্ব খাটাননি। যখন মানুষ নৈতিক ভুল করতো, তখন রাসূল সা. তাদের উপদেশ দিতেন এবং প্রতিবেশীদের সে ব্যক্তিকে বয়কট করতে বলতেন।

উদাহরণসরূপ, একব্যক্তি রাসূলের সা. নিকট এসে অভিযোগ করলেন, আমার প্রতিবেশী আমার ক্ষতি করে। আমি এখন কী করব? তিনি উপদেশ দিলেন, তোমার ঘরের ফার্নিচার বের করে রাস্তায় বসে পড়ো। অতএব, লোকটি তাই করল। ফার্নিচার ঘর থেকে বের করে তার দরজার সামনে বসে রইল। অতঃপর প্রতিবেশীরা দেখে তার কাছে জড়ো হলো এবং কারণ জিজ্ঞেস করলো। তখন সে ঘটনা খুলে বললো- আমার প্রতিবেশী আমার ক্ষতি করে, আর রাসূল সা. এ পরামর্শ দিয়েছেন।

ফলশ্রুতিতে এটা একটা পাবলিক অভিযোগে রূপ নিল এবং প্রতিবেশীরা সবাই একত্রিত হয়ে ক্ষতিকর ব্যক্তিকে বলল, তোমাকে প্রতিবেশীর সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। তখন সবাই মিলে উক্ত ব্যক্তির ফার্নিচার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এলো এবং সমস্যাটির সমাধান হয়ে গেল।

রাসূলের সা. জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে, যেখানে তিনি কর্তৃপক্ষসুলভ আচরণ করেননি। যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়েছিল তিনি তাকে ধরে এনে জেলে বন্দী করেননি কিংবা এটাকে কোর্টের মামলা বানিয়ে ফেলেননি। তিনি একজন শিক্ষকের মতো আচরণ করেছিলেন। কর্তৃপক্ষের মতো আচরণ করেননি, যতক্ষণ না পাপটি সমাজের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে।

যেমন, মার্কেটে সুদী কারবারের ক্ষেত্রে তিনি কর্তৃপক্ষসুলভ আচরণ করেছেন। কারণ, তিনি মনে করেছেন এটা সমাজের শৃংঙ্খলা বিনষ্ট করবে। যে সামজ গঠিত হয়েছিল ন্যায়বিচারের ধারণার উপর, সেখানে শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতে পারবে না।

তিনি সা. শক্তিশালীদের জুলমদের থেকে দুর্বলদের রক্ষা করতেন কর্তৃপক্ষের মতো। যদি পাপ, তা যাই হোক না কেন, প্রকাশ্যে হয়, লোকজন দেখে এবং সাক্ষ্য দেয়, তবে এটা অপরাধে পরিণত হতো এবং এর জন্য আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হতো। সুতরাং কানুন ও ফিকহের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে একটা পার্থক্য আছে। ফিকহের সবকিছুই আইনে পরিণত হয়নি।

আমি শুধু এখানে পরিভাষাসমূহ আলোচনা করছি। সম্ভবত এই ইস্যুগুলো আমরা পরে আলোচনা করব। শরিয়া আর ফিকহ এক জিনিস নয়, শরিয়া কানুনও নয়; যদিও এসবের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।

শরিয়া অন্যকিছুর সাথে তুলনীয় নয়, এবং এর সাথে আখলাকেরও কোনো সম্পর্ক নেই। আরবি আখলাক শব্দের অর্থ- সদগুণাবলি। এটা এথিক্স (নৈতিকতা) নয়। এথিক্সের যথার্থ কোনো আরবি প্রতিশব্দ নেই, আমার কাছে এথিক্সকে আরবি শরিয়ার কাছাকাছি মনে হয়। আল আখলাক শব্দের অর্থ সদগুণাবলি (ফাযায়েল), যেমন আর রাহমা(দয়াবান) ও আল কারাম(বদান্য)। অতএব, আখলাক হলো সদগুণাবলি যা একজন মুসলিমের ভেতর থাকে।

হ্যাঁ, আমাদের আখলাক শিখতে হবে রাসূলের সা. থেকে। কারণ, দুনিয়ার কোনো সাইন্টেফিক ল্যাবে তা পাওয়া যায় না। সদগুণ, সাহস ও দয়ার মতো যেসব বিষয়বালি মানুষের প্রয়োজন তা রাসূলের সা. জীবনে পাওয়া যাবে। এগুলো সদগুণ কারণ একজন আদর্শ মানবের সা. জীবনে এসব গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. সম্পর্কে বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ অর্থ : “অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।” আল্লাহ তায়ালা তাঁকে একজন যোদ্ধা, একজন বন্ধু, একজন পিতা বা একজন বক্তা কিংবা অন্যকোনো নামে আখ্যায়িত করেননি। যদিও তাঁর মধ্যে এসব গুণাবলি বিদ্যমান ছিল। তিনি তাঁকে একজন মহান নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর রাসূলের সা. এই নৈতিক চরিত্র তথা আখলাক আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করছেন। সুতরাং আখলাক হলো এমন বিষয় যা শরিয়া আমাদের অবহিত করে, কিন্তু আখলাক ও শরিয়া এক জিনিস নয়। তেমনি এটা কানুনও নয়, ফিকহও নয়।

অধিকন্তু, শরিয়ার একটি বিষয়ের সাথে নৈতিকতার (এথিক্স) সম্পর্ক রয়েছে। যে বিষয়টি আমরা প্রায়শ ভুলে যাই তা হলো আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দার সম্পর্কের এথিক্স তথা আধ্যাত্মিক নৈতিকতা। এটা শরিয়ার অংশও। আমরা যখন শরিয়া নিয়ে কথা বলি তখন এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটা প্রায়শ ভুলে যাই, মিস করি। এটা ইসলামি জ্ঞানে ‘তাসাউফ’ ডিসিপ্লিনে আলোচিত হয়েছে। যদি আপনার এই পরিভাষাটি পছন্দ না হয়, তবে আপনি তাকে ‘আস সুলুক’ বলতে পারেন। এটা নিয়ে অতো বিতর্ক করার প্রয়োজন নেই।

তাসাউফ (সুফিবাদ)

ইসলামি জ্ঞানে তাসাউফ ডিসিপ্লিনে আলোচিত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দা কেমন আচরণ করবে। তবে বান্দার সাথে বান্দার আচরণের বিবরণ এ নয়। এটা সুলুকের (আচরণ) সাথে সম্পৃক্ত। সুলুক হলো খুলুক (সচ্চরিত্র, আচরণ)। তবে এই আচরণ আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত। মূলত তারা আমাদের বলেছেন, কীভাবে আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করতে হবে, কীভাবে আল্লাহর শোকর করতে হবে (আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে), কীভাবে সবর করতে হবে (আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের সাথে ধৈয্যধারণ করতে হবে), কীভাবে খাওফ করতে হবে (আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করতে হবে), কীভাবে আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করতে হবে (আন্তরিক আশা নিয়ে মিনতি করতে হবে)। দোয়া করতে জানা মানে মুখের সামনে হাত তুলতে জানা নয়, এটা দোয়ার ফিকহ, দোয়ার বাহ্যিক নিয়ম।

কিন্তু সুফিরা আমাদের যা শিখিয়েছেন তা হলো কীভাবে নামাজের মধ্যে আন্তরিক আশা নিয়ে আল্লাহ তায়ালার নিকট মিনতি করতে হবে। আপনি দোয়া করবেন আর আপনার পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকবে, আল্লাহ তায়ালা আপনার দোয়ার জবাব দিবেন। আর যদি তিনি আপনার দোয়ার জবাব না দেন, তবে জেনে রাখবেন যে তিনি অপনার জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু মঞ্জুর করেছেন। এটা রাসূলের সা. হাদিস থেকে উদ্ভূত।

তবে এটা স্বীকার করতে হবে, ইসলামি জ্ঞানের অন্যান্য প্রায় সব শাখার মতো এতেও দুর্ভাগারা ভুল তথ্য অনুপ্রবেশ করিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সুফিবাদ আল্লাহর রাসূলের সা. হাদিস থেকে উদ্ভূত। সুফিবাদ আমাদের শিখিয়েছে যখন তুমি আল্লাহকে ডাকবে, যখন তুমি সালাত আদায় করবে তখন তুমি জানবে যে আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ সবচেয়ে দয়ালু। সুতরাং তুমি তাঁর সাথে সেভাবে যোগাযোগ করো। রাসূল সা. বলেন, “তুমি আল্লাহকে সাড়া পাওয়ার পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে ডাকো।”

এটা শরিয়ার অংশ, তবে এটা শরিয়ার সমান নয়। তবে হ্যাঁ, এটা শরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটা ইসলামের ফিকহ, হৃদয়ের ফিকহ। আর এটাই সুলুক কিংবা তাসাউফ।

এ সংক্রান্ত পূর্ববর্তী পোস্টের লিংক: https://cscsbd.com/blog/archives/561

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *