শরীয়াকে ইসলামী আইন অর্থে অনুবাদ করা সঠিক নয়

মূল: ড. জাসের আওদা

শরীয়া টার্মটি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কারণ জনসাধারণ শরীয়া নিয়ে কথা বলে, কিন্তু শরীয়া মানে কী তা বোঝে না।

শরীয়ার বইসমূহে এভাবে সজ্ঞায়ন করা হয়, “শরীয়া এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা সমাজে ন্যায়বিচার, দয়া, জনকল্যাণ ও প্রজ্ঞা বয়ে আনে।”

ফিকহ শাস্ত্রে শরীয়া বলতে প্রধানত জাস্টিস (ন্যায়বিচার) বোঝানো হয় আর সাধারণত সকল দয়া, প্রজ্ঞা ও জনকল্যাণকে বোঝায়।

আমরা জানি, ফিকহ শাস্ত্রে কারো কোনো অভিমত যদি শরীয়ার কোনো অনুশাসন বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, কিন্তু তা দ্বারা অবিচার সংগঠিত হতে পারে। তবে তা শরীয়ার লক্ষ্য বা স্পিরিট থেকে উদ্ভূত বলে বিবেচিত হতে পারে না। তখন এই অভিমতকে কেবল ব্যক্তিক অভিমত হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। কারণ, শরীয়া মানেই ন্যায়বিচার।

যারা ইসলামিক স্টাডিজের নতুন ছাত্র তাদের জন্য আমি কিছু টার্ম (পরিভাষা) ব্যাখ্যা করব।

শরীয়া: শরীয়া একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ হলো পথ। মূলত শরীয়া বলতে উট মরুভুমিতে যে পথে পানির অন্বেষণে যায় সে পথকে বুঝানো হত। শরীয়া মানে সর্বোচ্চ কল্যাণের পথ। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে শরীয়া শব্দটি ‘একটি সুস্পষ্ট পথ’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং এটাই শরীয়ার অর্থ, আপনারা টেলিভিশনে শরীয়ার যে বিকৃত অর্থ শুনেন তা এর সঠিক অর্থ নয়।

আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদকে সা. লক্ষ্য করে বলেন,

ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِّنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَاَ

অর্থাৎ, “অতপর হে নবী, আমি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাকে ‘একটি সুস্পষ্ট পথের’ (শরীয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং তুমি তার ওপরেই চলো।” (সূরা আল জাসিয়া: ১৮)

‘আমি তোমাকে শরীয়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি’ এর অর্থ শরীয়া হলো মূল সড়ক, পথ, ঐশি পথ বা ঐশি আলো। আল্লাহ তায়ালা একটি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যদি তুমি এর অনুসরণ কর, তবে এটা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুখের পথে পরিচালিত করবে। আর এটাই শরীয়ার সংজ্ঞা।

কুরআন মাজীদ ও হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সজ্ঞায়ন অনুসারে, শরীয়া হলো কুরআন আর লিভিং এক্সামপল হলেন মুহাম্মদ সা., যিনি কুরআন মাজীদ ব্যাখ্যা করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদকে সা. কুরআনে ‘বায়ান’ তথা ব্যাখ্যা, দৃষ্টান্ত নামে অবহিত করেছেন। যখন আমি একটি থিওরি দেই, তখন যৌক্তিকভাবে আমি এর একটি উদাহরণও দেই। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ

অর্থ: “আর তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দাও, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে।” (সূরা আন নাহল: ৪৪)

অর্থাৎ, আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি একজন ব্যাখ্যাকারক হিসেবে। অতএব, শরীয়া হলো কুরআন। আর কুরআনের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে। শরীয়া হলো ইসলামি জীবন ধারণ পদ্ধতি।

আমি আমার বইয়ে শরীয়া শব্দের অনুবাদ করেছি, ইসলামি জীবন ধারণ পদ্ধতি।

শরীয়াকে ইসলামি আইন অর্থে অনুবাদ করা সঠিক অনুবাদ নয়। কারণ, শরীয়া ও আইনের মধ্যে পার্থক্য আছে। শরীয়া আইন নয়, বরং এটা একটি নৈতিক জীবন ব্যবস্থা। আইন শব্দের আরবি অর্থ হলো কানুন।

‘কুরআন মানে আইন’ এটা ভুল সূচনা। শরীয়ার যথার্থ অর্থ হলো ‘পথ’।

(মুইজ অ্যাকাডেমির দি অকেশনাল পেপারস সিরিজ থেকে অনুবাদ করেছি)

* জাসের আওদা ইসলামি আইন ও মাকাসিদে শরীয়ার উপর বিশ্বের একজন প্রসিদ্ধ স্কলার। পড়াশোনা করেছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটি ও যুক্তরাজ্যের ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে। অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর লিখিত বইসমূহ বিশ্বের ২৫টির অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি মাকাসিদ ইন্সটিটিউট নামক একটি থিংকট্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *