‌দুনিয়াবী শিক্ষাকে ইবাদতে পরিণত করা

পর্ব— এক

১.

কথা বলছিলাম মাতৃস্থানীয়া একজন মুরুব্বীর সাথে। প্রায় জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এই নারীর গভীর জীবনবোধ আমাকে প্রায়ই চমৎকৃত করে। অথচ তিনি পড়াশোনা করেছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। তাই জীবন নিয়ে উনার উপলব্ধিগুলো আমাকে ভাবিয়ে তোলে ‘উচ্চশিক্ষিত’ বিশেষণটি প্রকৃত অর্থ নিয়ে। প্রায়ই মনে হয়, আমরা এক অদ্ভূত সময়ে বাস করছি। আমাদের নামের পাশে বিশাল বিশাল ডিগ্রীর তকমা ঝুলছে, পড়াশোনাকে আমরা জীবনের ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে ফেলেছি; অথচ এই আমাদেরই জীবনের খুব ছোট ছোট ব্যাপারে ‘কমন সেন্সের’ খুব অভাব। পিএইচডি ডিগ্রীধারী মা-বাবাকে আপনি দেখবেন পরীক্ষার আগে টাকা দিয়ে সন্তানের জন্য প্রশ্ন কিনতে। এটা যে কত ভয়ংকর আত্মঘাতী একটা কাজ, এই সামান্য বোধটুকু এইসব ডিগ্রী আমাদের দিতে পারছে না।

ঠিক একইভাবে জীবনের একটা বিশাল অংশ অনেক ডিগ্রী অর্জনের পিছনে ব্যয় করে হঠাৎ করে কেউ যখন নিজের ‘মুসলিম’ আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে, তখন অবাক হয়ে উপলব্ধি করে যে ইসলামের ন্যূনতম বেসিক জ্ঞানটুকুও তার নেই। সে জানে না কিসে অযু ভংগ হয় কিংবা কিসে ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই তখন এক অজানা আক্রোশে মনটা তার ছেয়ে যায়। রাগ হয় নিজের উপর, আশেপাশের মানুষগুলোর উপর, এই সিস্টেমের উপর। যা কিছু পড়েছি, যা কিছু পড়ছি সব কিছুকে কেবল ‘দুনিয়াবী শিক্ষা’ মনে হয়। ‘দুনিয়াবী’, কারণ এটা আমার পরকালে কোনো উপকারেই আসছে না। ইসলামের বুঝ আসার পর তাই আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়— “দুনিয়াবী পড়া ছেড়ে দিয়ে দ্বীনের পড়াশোনায় ব্যাপৃত হবো।” এর পিছনে প্রভাবক হিসেবে আরো কাজ করে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজমান পরিবেশ, যা কিনা ইসলাম পালনের জন্য খুবই প্রতিকূল।

২.

কিন্তু এই যে ইসলাম প্র্যাক্টিস শুরু করার পরই আমরা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাই, এটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত? যে উম্মাহর নবীর উপর প্রথম নির্দেশ ছিলো ‘পড়ো’, তাদের জন্য পড়াশোনাকে এইভাবে দুনিয়াবী আর দ্বীনী এই দু’ভাগে ভাগ করার চিন্তাটা কি ইসলামসম্মত?

আমাদের আজকের আলোচনা মূলত এটা নিয়েই। আমি নিজে যেহেতু অর্থনীতি নিয়ে পড়ছি এবং আমি একজন মেয়ে, তাই অনেক মেয়ের কাছ থেকে এই টপিক নিয়ে প্রশ্ন পাই। তাদেরকে আমার মতামত জানাতে গিয়েই এই টপিকের উপর একটা সিরিজ লেখার চিন্তা মাথায় আসে।

তবে শুরুতেই স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমি কোনো স্কলার নই। এখানে যা বলবো তা সম্পূর্ণরূপে আমার নিজস্ব মতামত, বলা যেতে পারে জীবন থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা। তাই দয়া করে কেউ মনে করবেন না যে আমি ফতোয়া দেয়া শুরু করেছি। তা করার প্রশ্নই ওঠে না।

আমি বিভিন্ন ফিল্ডে অধ্যয়নরত মেয়েদের থেকে প্রশ্ন পাই, যারা পড়াশোনা চালিয়ে নিতে দ্বিধান্বিত। আলোচনার সুবিধার্থে আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি—

‍“আপু, আমি অনার্সে ‘ল’ নিয়ে পড়েছি । আমি কর্পোরেট জবে আগ্রহী নই, লিগ্যাল প্র্যাকটিসও করবো না। আমি শিক্ষকতা পেশায় যেতে চাই, সেজন্য আমার মাস্টার্স করা জরুরী। কিন্তু আমি যেহেতু মেয়ে, অর্থ উপার্জন করা আমার জন্য জরুরী নয়, তাহলে মাস্টার্স করার জন্য কো-এডুকেশনে পড়তে যাওয়া কি আমার জন্য উচিৎ হবে?”

যখন এসব ব্যাপারে আমার মতামত দিতে চাই, তখন প্রথমেই বলে নেই যে অন্য কেউ আপনার জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে দেবে না, এটা কোনো কাজের কথাও না যে আপনি অন্যের কথা শুনে নিজের জীবনের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারাটা একটা অপরিহার্য দক্ষতা, যেটা আমাদের সবার অর্জন করতে পারা উচিৎ। আমি মোটা দাগে সবাইকেই তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর সাথে কনসাল্ট করতে বলি। তারপর নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ তাদের সাথে শেয়ার করি।

আমি প্রথমেই জানতে চাই, তিনি বিবাহিত কিনা, হলে বাচ্চা আছে নাকি। এগুলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন, সন্দেহ নেই, তারপরও প্রশ্নগুলো করি। কারণ, এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো অনেকটা নির্ভর করে আমি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত আছি নাকি নই। যদি আমার বাচ্চা থাকে তাহলে সমীকরণ এক রকম, যদি না থাকে তাহলে আরেক রকম। কারণ, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে একজন মেয়ে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বশীল তার পরিবারের ব্যাপারে। একটা মেয়ে লম্বা সময় বাইরে থাকলে আজকের সময়ে বেশ কিছু সমস্যা হয় বাচ্চার দেখভাল করা নিয়ে। আবারো বলছি, আজকের সময়ে, অর্থাৎ যখন আমরা যৌথ ফ্যামিলিতে থাকি না বললেই চলে। আর সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের ব্যাপারটা মহামারী আকার ধারণ করায় বাইরের কাউকে বাচ্চার দেখভালের জন্য বিশ্বাস করা খুব কঠিন এখন।

তাই আমার আজকের লেখা মূলত তাদের জন্য, যাদের ছোট বাবু নেই। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ডিসক্লেইমার।

৩.

এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার সেটা হলো ‘ফ্রি মিক্সিং’। কো-এডুকেশন হারাম, এটা আমরা হরহামেশা বলে থাকি। কিন্তু ফ্রি মিক্সিং আর কো-এডুকেশন কি সমার্থক? ফ্রি মিক্সিংয়ের পরিবেশে যাওয়ার প্রশ্ন যখন আসে, তখন প্রথমেই আমাদের কাজ হওয়া উচিৎ ফ্রি মিক্সিং বলতে কী বুঝাচ্ছি, সেটা বোঝা।

অবশ্যই ফ্রি মিক্সিং বলতে আমরা ছেলে ও মেয়ের একই জায়গায় অবস্থানকে বুঝাই না। তাহলে দুনিয়ার সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে, এমনকি মসজিদেও। ফ্রি মিক্সিং বলতে আসলে আমরা বুঝাই, ‘Intermingling among cross gender’, অর্থ্যাৎ ‘বিপরীত লিঙ্গের মধ্যকার অসঙ্গত আচরণ।’

এখানে এটা বোঝা খুব জরুরী যে আজকের ইন্টারনেটের যুগে ‘অসঙ্গত আচরণের’ ব্যাপ্তিটা একটু বিশাল বৈ কি। আপনি যদি আপনার পুরুষ সহকর্মীকে চোখ টিপ মারার ইমো পাঠান, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে অসঙ্গত আচরণ। লক্ষ্য করুন, এখানে আপনি ঘরে বসেই অসঙ্গত আচরণের গুনাহ করতে পারছেন, আপনাকে বাইরে যেতে হচ্ছে না। তাই আজকের সময়ে অসঙ্গত আচরণের গুনাহ আপনি ঘরে থেকেও এড়াতে পারছেন না। সময়ের এই পরিবর্তনটা আমাদের বুঝতে হবে।

কো-এডুকেশনের পরিবেশে থেকে কি অসঙ্গত আচরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব? আল্লাহ ভালো জানেন, কিন্তু আমার মনে হয় সম্ভব। কীভাবে?

ক. যদি আপনার শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা হালালভাবে মেটে। লক্ষ্য করুন, আমি এখানে শুধু শারীরিক চাহিদার কথা বলিনি, ইমোশনাল চাহিদার কথাও বলেছি। দাম্পত্য জীবনের অতৃপ্তি, হতাশা এগুলো যদি আপনার পুরুষ কলিগ কিংবা ক্লাসমেটের সাথে শেয়ার করেন, তাহলে সেটা আপনাকে এক পিচ্ছিল পথে নিয়ে যাবে, সেটা পরকীয়ার পথ।

খ. আপনার পোশাক যদি ইসলামিক কোড মেনে চলা হয়। আশা করছি, প্রোপার ইসলামিক ড্রেস কোড বলতে কী বুঝায়, এই লেখার পাঠকেরা তা জানেন। না জানলে উপযুক্ত উৎস থেকে জেনে নিবেন। আমি এই লেখার ফোকাস হারাতে চাই না।

গ. আপনার Non-Verbal communication যেন কোনো ভুল সিগন্যাল না পাঠায়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বোরকা পরে ছেলেদের সাথে হা হা হিহি করা টাইপের মেয়ে হন, তাহলে ছেলেরা বুঝবে যে পোশাকের মাধ্যমে আপনার সাথে যোগাযোগের যে বাঁধা সৃষ্টি হয়েছে, এটা দুর্ভেদ্য কিছু নয়। তখন ছেলেরা আপনাকে সহজলভ্য ভাববে।

ঘ. বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে প্রয়োজনীয় ইন্টার‍্যাকশনের আগে চিন্তা করুন যে এই কাজটার জন্য কোনো মেয়ে বিকল্প আছে কি না। যদি থাকে তাহলে তার কাছে যান। নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই Interaction আদতে আমার জন্য খুবই জরুরী কি না। লাভ-ক্ষতির মাঝে তুলনামূলক পর্যালোচনা করুন।

ঙ. বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে Interaction করার সময় মাথায় রাখুন যে ‘প্র্যাক্টিসিং’ কেউ যদি এই কথাবার্তা দেখে, তাহলে সে কী ভাববে। সে কি এটাকে নিছক সাধারণ কথাবার্তা ভাববে নাকি অন্য কিছু? সম্ভব হলে কোনো এক পক্ষের মাহরামের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।

চ. বিপরীত লিঙ্গের কারো কাছ থেকে অযাচিত সুবিধা নেয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনি যদি কারো প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যান, তাহলে সে সেটার সুযোগ নেবে, এটা মাথায় রাখবেন।

ছ. নিজেকে পরকীয়া থেকে নিরাপদ ভাববেন না। এটা একটা ভয়ংকর পাপ। কখনো ভাববেন না অমুক আমার ছোট, তমুক চার বাচ্চার বাপ, তমুকের বউয়ের সাথে আমার সুসম্পর্ক, তমুক তো বিদেশী ইত্যাদি। মনে রাখবেন, শয়তান অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং সে আমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া— প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত গুনাহ থেকে। আল্লাহর সাথে নিয়মিত কথোপকথনের কোনো বিকল্প নেই। নিশ্চয়ই বান্দা কোনো গুনাহ থেকে আপ্রাণভাবে বাঁচতে চাইলে আল্লাহ তাকে নিরাশ করেন না। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, শয়তানের চক্রান্ত বিশ্বাসীদের জন্য দুর্বল। আমরা যেন নিজেকে খুব নাজুক না ভাবি। আস্থা রাখতে হবে আল্লাহর সাহায্যের উপর।

আশা করি, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোতে সতর্ক থাকলে এবং আল্লাহর সাহায্য পেলে মেয়েরা কো-এডুকেশনে পড়েও Intermingling Avoid করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ ।

এখন এ কথা অনস্বীকার্য যে অনেকেই এইভাবে এইসব নির্দেশনা মেনে চলার মতো অবস্থায় থাকেন না। সব মেয়ের মাহরাম থাকে না, কেউ অবিবাহিত কিংবা ডিভোর্সি হতেই পারেন। তখন কী হবে? ফ্রি মিক্সিংয়ের ফিতনায় পড়ে যাওয়ার আশংকায় পড়াশোনা ছেড়ে দিবো?

আমি মনে করি— না, দিবো না। কারণ, চলমান অবস্থার উত্তরণে এভাবে কোনো ভূমিকা রাখা যায় না।

৪.

আজকাল অনেক বিখ্যাত মানুষেরই নারীঘটিত পদস্খলনের নানা খবর শোনা যায়। সেগুলার কতটুকু গুজব আর কতটুকু সত্যি, সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এগুলোর একটা মেজর কারণ হলো সব ক্ষেত্রে পুরুষদের বিকল্প হিসেবে নারী না থাকা। একটা সামান্য ফিকাহর জ্ঞান অথবা কাউন্সেলিংয়ের জন্য যদি নারীদেরকে পুরুষের কাছে যাওয়া লাগে, আর একজন পুরুষ স্কলার যদি এইভাবে শত শত ভালনারেবল নারীর (যেমন— ডিভোর্সড, নও-মুসলিম, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ইত্যাদি) মুখোমুখি হয়, তাহলে তাদের শয়তানের ধোঁকায় পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

আমি বিশ্বাস করি, ইসলামে ফ্রি মিক্সিং হারাম বলেই একটা প্রজন্মকে ফিতনার ভয়কে জয় করে দৃঢ়পদ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। অর্থ্যাৎ যে ময়লা পরিষ্কার করবে, তাকে ময়লার মাঝে নামতে হবে।

একজন মেয়ে যখন কো-এডুকেশনে পড়ে একটা রিসোর্স পারসন হিসেবে গড়ে ওঠবে, তখন সে তার ফিল্ডে কমপক্ষে একশটা মেয়ের ফ্রি মিক্সিংয়ের দরজা বন্ধ করছে। কারণ, তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এখন একজন ‘মহিলা বিকল্প’ আছে। এবং এটার একটা Domino effect আছে। কারণ, তার কাছ থেকে শিখে আরো ১০ জন মেয়ে রিসোর্স পারসন হতে পারবে ইনশাল্লাহ।

তাই আমি এমন একটা সময়ের স্বপ্ন দেখি যখন শরীয়াহ, আইন, অর্থনীতি, সাইকোলজি, এডুকেশন— সব ফিল্ডে নারী রিসোর্স পারসন থাকবে, যেন নারীরা কোনো প্রশ্ন বা দরকারে একজন নারীর কাছেই যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি মনে করে যে সে ময়লা পরিষ্কার করতে পারবে না, বরং ময়লার দুর্বিপাকে হারিয়ে যাবে, তাহলে এই কাজ অবশ্যই তাদের জন্য নয়।

আমি যে পথের কথা বলছি সেটা নিঃসন্দেহে একটা দুর্গম পথ। কারণ এই পথে হাঁটার অনেক সামাজিক উপকারিতা আছে— স্ট্যাটাস, টাকা পয়সা ইত্যাদি। তাই নিয়তটা কলুষিত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন পরিবারকে ফুল টাইম দেয়াকে ‘কিছু না করে’ ‘ঘরে বসে থাকা’ হিসেবে অবহেলা করা হয়। তাই হয়তো আমরা দাবি করি যে উম্মাহর জন্য বড় কিছু করতে চাই বলে পড়ছি, অথচ নিজের অজান্তেই হয়তো মূল কারণটা থাকে সমাজের চোখে ‘ভ্যালুলেস’ হিসেবে গণ্য না হওয়া। এই কাজে নিয়তের পরিশুদ্ধতা বজায় রাখা তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

পর্ব— দুই

এই পর্বে আমি একদম সুনির্দিষ্ট করে পয়েন্ট আকারে বলবো আইন বিষয়ে পড়ে একজন মেয়ে কীভাবে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখতে পারে। এখানে আবারো বলে রাখা ভালো, এটা আমার উর্বর মস্তিষ্কজাত চিন্তা। অনেক ডিসিপ্লিন নিয়েই আমার এরকম নিজস্ব চিন্তা আছে।

আইন পেশা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য দারুণ একটা পেশা, যার মাধ্যমে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখার বিশাল সুযোগ আছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য ন্যায্য বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বলে বুঝানোর কিছু নেই। একটি জাতিকে ধ্বংসের জন্য আইন ও শিক্ষাব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়াই যথেষ্ট— খুব সম্ভবত এটা লর্ড ক্লাইভের একটা উক্তি। তাই একজন মুসলিম একজন সৎ ও নিরপেক্ষ আইনজীবী বা বিচারক হওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

এত গেলো একটা আদর্শ পরিস্থিতি। বর্তমান বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আমরা যেহেতু এখন মানবরচিত আইনব্যবস্থার মাঝে বাস করছি, তাই ইসলামপন্থীরা নানা ধরণের জুলুমের শিকার। প্রচলিত আইনব্যবস্থার মাঝেই যতটুকু সম্ভব তাদেরকে ন্যায়বিচার দেয়াটা যেন সম্ভব হয় (অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হলে ইত্যাদি), সেজন্য আমাদের প্রচুর প্র্যাক্টিসিং আইনজীবী দরকার, যারা প্রচলিত সিস্টেমের ব্যাপারে খুবই দক্ষ।

কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, বর্তমানে কোর্টের যে পরিবেশ তা একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম নারীর জন্য মারাত্মক বৈরী। কিন্তু তাহলে কি একটা মেয়ে আইন নিয়ে পড়বে না?

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি— পড়বে, পড়া উচিৎ। আসুন দেখা যাক কীভাবে এই বিষয় নিয়ে পড়ে মেয়েরা অবদান রাখতে পারে।

১। শরীয়াহ আইনের ব্যাপারে প্রচলিত ভুল ধারণার অপনোদন:

একজন মেয়ে যখন ‘আইন’কে একটা শাস্ত্র হিসেবে পড়বে, তখন সে শরীয়াহ আইনগুলোকে একটা অন্য আলোয় দেখার সুযোগ পাবে। আমরা খেয়াল করলে দেখবো, ইসলাম নিয়ে যত আক্রমণ, বিতর্ক হয় সেগুলোর অধিকাংশেরই উৎস হচ্ছে শরীয়াহ আইন।

খুব কমন একটা উদাহরণ হচ্ছে হিল্লা বিয়ের আইনটা। ছোটবেলায় দেখা নাটক-সিনেমার একটা কমন দৃশ্য ছিলো— স্বামী এসে ভাত চেয়েছে, বউ বলেছে ভাত হয় নাই, স্বামী রেগে গিয়ে “যাহ তোরে আমি তালাক দিলাম” বলে তিন তালাক দিয়ে দিলো। আর মেয়েটা “আল্লাগো” বলে একটা চিৎকার দিলো। তারপর তাদের হিল্লা বিয়ে হলো ইত্যাদি নানা কিছু। আসলে কি তালাকের ব্যাপারটা এমন? IOU-তে Fiqh of Marriage কোর্সে যখন বিয়ে এবং তালাকের নিয়ম বিস্তারিত পড়েছিলাম, আমার এত অবাক হয়েছিলাম যে বলার মতো না! নিয়মটা কী, আর আমরা জানিটা কী!

এতো গেলো জাস্ট একটা উদাহরণ। আরো শত সহস্র দেয়া যায়। যেমন এটা খুব কমন কথা যে ইসলামে চোরের শাস্তি হাত কাটা। এটাকে বর্বর প্রথা হিসেবে আখ্যায়িত করে ইসলামকে পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আমার মনে আছে, হুমায়ুন আজাদের ‌‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইটাতে একটি বাচ্চা ছেলে গাছের নিচে পরে থাকা ফল না বলে কুড়িয়ে নিয়েছিলো বলে তার হাত কেটে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই?

আমাদের বিবিএ সিলেবাসে Business law একটা কোর্স ছিলো। সেখানে প্রথম ‘আইন’ বিষয়টার সাথে আমার পরিচয় হয়। তখন আমি সেখানে পড়েছিলাম, কখনোই কোনো একটা বিষয়ে ‘আইন বা শাস্তি অমুক’ এভাবে এক কথায় বলা যায় না। বিশেষ করে ‘ক্রিমিন্যাল ল’-এর ক্ষেত্রে। বিষয়টা জটিল এবং সূক্ষ্ম। যে কোনো কাজের শাস্তি অমুক সেটা বলার আগে কোন প্রেক্ষিতে, কোন শর্তপূরণ সাপেক্ষে এটার প্রয়োগ করা যাবে আর কখন যাবে না— এরকম বহু কিছু বলা থাকে। ঠিক এই ব্যাপারটা ইসলামী আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরে যখন IOU-তে ইসলামী আইনব্যবস্থার উপর কোর্স করেছি তখন এই হাত কাটার শাস্তি প্রয়োগের শর্ত, পরিস্থিতি ইত্যাদি সবকিছু বিস্তারিত পড়েছি। যেমন একটা শর্ত হচ্ছে, চুরিকৃত সম্পদের মূল্য ন্যূনতম চল্লিশ দিরহাম সমমানের হতে হবে। তাহলে এখন আপনারাই বলেন গাছের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া ফলের ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে?

তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের এমন দক্ষ মানবসম্পদ দরকার, যারা প্রচলিত আইন নিয়ে গভীরভাবে জানবে, সাথে শরীয়াহ আইন নিয়েও জানবে। তারপর ইসলামের তথাকথিত বিতর্কিত শরীয়াহ আইনগুলোর প্রজ্ঞা সাধারণ জনগণের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরবে প্রচলিত আইনের সাথে তুলনার মাধ্যমে।

কেউ যদি এমনিতে শুধু শরীয়াহ নিয়ে পড়ে তাহলে তার অ্যাপ্রোচ; আর যে প্রচলিত আইন নিয়ে পড়েছে, তারপর শরীয়াহ আইন নিয়ে পড়েছে তার অ্যাপ্রোচ স্বাভাবিকভাবেই আলাদা হবে। দ্বিতীয় গ্রুপের অ্যাপ্রোচ তুলনামূলকভাবে বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে আমার কাছে মনে হয় (আল্লাহই ভালো জানেন)।

২। ফতোয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য বুঝা ও বুঝাতে পারা:

যে ‘আইন’ নিয়ে পড়েছে সে খুব ভালো বুঝবে ফতোয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য। আমার ইদানিং মনে হয়, প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের মাঝে মহামারীর মতো ছড়িয়ে যাওয়া একটা সমস্যা হলো ফতোয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য বুঝতে না পারা। ফতোয়া বাই ডেফিনিশন একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট একজন মানুষকে দেয়া স্কলারের মতামত। এখন একজনকে দেয়া ফতোয়া আরেকজনের উপকারে লাগতে পারে ঠিকই, ঠিক যেমন আগে কোনো এক সময়ে কোনো কোর্টে দেয়া রায় পরবর্তীতে বিচার করার সময় আইনের একটা উৎস হতে পারে। কিন্তু সেটার সাথে তুলনা করে আজকে রায় দেয়ার সময় অবশ্যই সময়, পরিস্থিতির পরিবর্তন, পাশাপাশি আগের কেসের সাথে এই কেসের পার্থক্য বিবেচনা করতে হয়। একইভাবে একটি ফতোয়া আরেকজন মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে কিনা, সেটা বুঝতে হলে চেক করতে হবে দুজন মানুষের পরিস্থিতি, সময়, দেশ ইত্যাদি একই নাকি। এগুলো চিন্তা না করেই আমরা একটা ফতোয়ার ওয়েবসাইট থেকে ফতোয়া কোট করে দিয়ে দেই। আমি নিজে Islam QA থেকে প্রচুর ফতোয়া উদ্ধৃতি দেই, কিন্তু সেটাকে ঐশীবাণীর মর্যাদা দেই না, মানে সেটা মন দিয়ে পড়ি এবং আমি যে পরিস্থিতিতে আছি আর প্রশ্নকর্তার পরিস্থিতির মাঝে বিশাল কোনো পার্থক্য আছে নাকি সেটা বোঝার চেষ্টা করি। ফতোয়া শপিং করছি নাকি সেটাও খেয়াল রাখার চেষ্টা করি।

কো-এডুকেশন নিয়ে Islam QA-এর ফতোয়ার কথাই চিন্তা করুন। এখানে কিন্তু ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্যই কো-এডুকেশনে পড়া হারাম বলা হয়েছে, তারপর বেশ কিছু ব্যতিক্রমও দেয়া হয়েছে (https://islamqa.info/en/45883)। আমরা সাধারণত এই ব্যতিক্রমগুলার কথা বলি না। আমরা এই বিধান শুধু মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেই এটা বলে যে ছেলেদের জন্য আয় করা ফরয। অথচ এই ব্যতিক্রমের কথা কিন্তু ফতোয়াতে বলা নাই।

আমরা যদি এই ফতোয়াটার পক্ষে দেয়া শরীয়াতের দলীলগুলো চিন্তা করি, তাহলে দেখবো এখানে শুধু Intermingling নিষেধ এমন প্রমাণগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ কো-এডুকেশন তখনই হারাম হবে যখন সেটা ফ্রি মিক্সিংয়ের কারণ হবে। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা শুরুতেই তুলে ধরেছি।

Intermingling-এর বিপক্ষে উপস্থাপিত প্রধান প্রমাণ সম্ভবত সেই হাদীসটি যেখানে বলা হয়েছে, নারীরা পুরুষদের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীসের ব্যাপারে আমার মনে কোনো ধরনের দ্বিধা, ক্ষোভ নাই আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয়, এটা একটা মিসকোটেড হাদীস। আকর্ষণীয় কণ্ঠে নন-মাহরামদের সাথে কথা না বলার নির্দেশ সরাসরি কুরআনে এসেছে। আমি বলছি স্বাভাবিক স্বরে প্রয়োজনীয় কথার ব্যাপারে। সেটাতে কী সমস্যা আমার জানা নেই। মেয়েরা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে পূর্ণ পর্দা করেও (এমনকি চেহারা না দেখিয়েও বা নিকাব করেও) উপস্থিত হতে পারবেন না— এমন ধারণা যারা পোষণ করেন, তাদের পক্ষে কী প্রমাণ আছে, সেটা আমার জানা নেই। শুধু তাই নয়, কোনো মেয়ে কোনো বিষয়ে পাবলিকলি শিক্ষা দিচ্ছে এই ব্যাপারটিতেও তারা আঁতকে ওঠেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, অসংখ্য মুসলিম নারী স্কলারের কাছ থেকে অসংখ্য বড় বড় আলিম তৈরি হয়েছে।

৩। একজন স্কলারের বক্তব্যের মানবীয় অংশটুকু আলাদা করতে পারা:

আমি বিশ্বাস করি, একজন মেয়ে যখন আইন নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করবে তখন সে কোনো ফতোয়া পড়ে বুঝতে পারবে যে এটার কোন অংশ একজন স্কলারের মতামত আর কোন অংশ কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি এসেছে, অর্থাৎ কোন অংশটি মানতে আমরা বাধ্য আর কোন অংশটি নয়।

কো-এডুকেশন নিয়ে Islam QA-এর ফতোয়ার উদাহরণে আবার আসি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে কো-এডুকেশনে পড়া নিষেধ মর্মে যখন একটা ছেলেকে ফতোয়া দেয়া হচ্ছে, তখন ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে— There is no need for mixing. Studying in this school is not essential; so long as a woman can read and write and knows the teachings of her religion, that is sufficient, because she was created for that, i.e., to worship Allaah. Anything beyond that is not essential. (https://islamqa.info/en/8827)

এটা পড়ে মনে হচ্ছে, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুলে যাওয়ার কোনো দরকার নেই, যদি সহশিক্ষা ছাড়া বিকল্প কোনো অপশন পাওয়া না যায়। অক্ষরজ্ঞানই যথেষ্ট। এই মতটা আমাদের সময়ের জন্য কতটুকু উপযুক্ত তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে নিঃসন্দেহে এটা ফতোয়া প্রদানকারীর ব্যক্তিগত অভিমত। এখন এই সাইটে যারা ফতোয়া দেন আমি তাদের পায়ের নখের যোগ্য নই, কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্যি, ইসলামে কোনো পুরোহিততন্ত্র নেই। তাই কোনো স্কলারের কোনো ব্যক্তিগত মত, যেটার পক্ষে তিনি কোনো দলীল উপস্থাপন করেননি, সেটার সাথে দ্বিমত পোষণ করতেই পারি। এতে স্কলারদেরকে অসম্মান করা হয় না, বরং নিজেরা জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট না থেকে স্কলারদেরকে অন্ধ আনুগত্যের কালচারকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

৪। ইসলামী আইনের প্রজ্ঞা তুলে ধরা:

বেশ কিছু ব্যাপারে ইসলামী আইনের প্রজ্ঞা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাই কেন ইসলামী আইন কোনো একটা কিছুর বিধান দিয়েছে সেটা প্রচলিত আইনের সাথে তুলনা করে ইসলামী আইনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা যায়। যেমন ধরুন মৃত্যুদণ্ড প্রথাটা বর্বর মনে করে অনেক দেশই এখন এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে চিন্তা করলে এবং অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে মৃত্যুদণ্ড বেশি কার্যকরী পন্থা। এ বিষয়ের উপর আমার ইউনিভার্সিটির ইকোনোমেট্রিক্সের প্রফেসরের দুটি রিসার্চ পেপার আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা নিয়ে পেপার নাই বললেই চলে। মুসলিমদের তো প্রশ্নই উঠে না, নন-মুসলিমদের মাঝেও নাই। একজন মুসলিম এ ধরনের কাজ করতে পারে।

৫। আইনের বিবর্তনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ:

আইন শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ বা বিবর্তন নিয়ে কাজ করতে পারেন কেউ। দেখাতে পারেন যে আজকে যত মানবরচিত আইন আছে, সেটার উৎস কোনো না কোনোভাবে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থের (যেমন: বাইবেলের 10 commandments) সাথে সম্পর্কিত। তাই আজকে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, মানুষের পক্ষে একদম শূন্য থেকে শুরু করা আসলে সম্ভব নয়।

আরো দেখানো যেতে পারে যে ‘আইন’ করে সমাজের সব বিপর্যয় প্রতিরোধ করা যায় না, নৈতিকতার প্রসার অপরিহার্য। আর সেক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

৬। আইনের আক্ষরিক ও মর্মগত অর্থের মাঝে পার্থক্য করা:

আইন শাস্ত্রে খুব কমন একটা ধারণা হচ্ছে আইনের আক্ষরিক ও মর্মগত অর্থের মাঝে পার্থক্য করা। বর্তমান সময়েও আমরা ইসলামপন্থীরা আইনের মর্মগত অর্থের চেয়ে আক্ষরিক অর্থকে বেশি গুরুত্ব দেই বলে আমার কাছে মনে হয়।

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। একবার আমার এক পরিচিত আপুর আব্বা হঠাৎ করে মারা গেলেন কানাডার একটা শহরে, যেখানে তাঁরা শুধু স্বামী-স্ত্রী থাকতেন। এখন একা বাসায় আপুর আম্মা একদমই থাকতে পারছিলেন না। তিনি দেশে চলে আসতে চাচ্ছিলেন। তো আমি পণ্ডিত ভাবছিলাম, এইভাবে ইদ্দতকাল চলা অবস্থায় একা মাহরাম ছাড়া তাঁর ট্রাভেল করা উচিৎ হবে নাকি। আমি এটা নিয়ে IOU-এর একজন ফিকাহ টিচারের সাথে কথা বললাম। উনি বললেন অবশ্যই উচিৎ হবে। কারণ, একজন মহিলা একা একটা শহরে এভাবে থাকার চেয়ে ট্রাভেল করে হলেও নিজ দেশে মাহরামদের মাঝে থাকাটা বেশি শরীয়াহসম্মত। কারণ, নারীদের একটা নিরাপদ পরিবেশ দেয়াই মাকাসিদে শরীয়াহর (শরীয়াহর উদ্দেশ্য) বেশি কাছাকাছি। তখন আমার মনে হয়েছিল, এটা হচ্ছে আইনের আক্ষরিক অর্থের চেয়ে মর্মগত অর্থকে বেশি গুরুত্ব দেয়া।

ইসলামিক ইকোনমিক্সেও এটা একটা বিশাল সমস্যা। এটা নিয়ে গত ৫ বছরের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা থেকে আমি এটাই বুঝেছি যে আমরা আজকের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় letter of the law-কে spirit of the law-এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। তাই হয়তো পণ্যগুলোর বাহ্যিক রূপটা শরীয়াহসম্মত হয়েছে, কিন্তু সেটা সুদ নিষিদ্ধ করার যে উদ্দেশ্য, সেই উদ্দেশ্য সাধনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।

আমি আশা করি, একজন আইনের শিক্ষার্থী আইন নিয়ে তার ডাইভার্সিফাইড, গভীর পড়াশোনা থেকে ইসলামী আইনের এমন প্রয়োগ সম্পর্কিত গবেষণা করতে পারেন ইনশাল্লাহ, যেখানে প্রাধান্য পাবে Spirit of law।

আমি নিজে রিসার্চ করতে ভালোবাসি বলে নিজের অজান্তেই হয়তো উপরের পয়েন্টগুলো সবই রিসার্চের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। ধরুন আপনার এমন দিকে ঝোঁক নাই। তাইলে শুধু ইসলামী আইনগুলো নিয়ে ভালোভাবে জানুন, পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইনগুলো। এই আইনগুলা না জানার কারণে কত নারী যে Domestic Abuse-এর শিকার হচ্ছে, আমাদের ধারণাও নাই।

আজকাল প্রচুর ডিভোর্স হচ্ছে দ্বীনী সার্কেলেও এবং কারণগুলো অনেক সময়েই সঙ্গত। সেখানেও মেয়েদের অনেক হেল্প দরকার। মানুষের যে কী সীমাহীন অজ্ঞতা এসব বেসিক ব্যাপারে তা মানুষের সাথে কথা না বললে বোঝা যায় না। শুধু ইসলামী আইন নিয়ে পড়লে আপনার যে প্রজ্ঞা তৈরি হবে তা অনেকাংশে বাড়বে, যদি আপনি ঠিক মতো প্রচলিত আইন নিয়ে পড়েন এবং তারপর ইসলামী আইন নিয়ে পড়েন। উত্তরাধিকার আইন নিয়ে পড়াশোনা থাকলে মানুষকে অনেক হেল্প করা যায়। এভাবে তালিকা আরো বড় করা যাবে। এসব সাহায্য করার জন্য আপনার পিএইচডি করতে হবে না, কোথাও চাকরি করতে হবে না। ছোট্ট বাচ্চার মা হলেও সমস্যা নেই। সপ্তাহে কিছুটা সময় দিবেন বোনদের সাথে স্কাইপে কিংবা অনলাইনে বা বাসায়। মূল কথা হচ্ছে, Let’s try to be people of impact.

নিজে খাইলাম, ঘুমাইলাম, ক্যারিয়ার গড়লাম, মা-বাবা হইলাম, বাড়ি করলাম, গাড়ি করলাম, নাতি-নাতনীর মুখ দেখলাম, তারপর বুড়া বয়সে হজ্ব করলাম, দাড়ি রাখলাম, বোরখা পরলাম আর এমন বাচ্চা রেখে গেলাম যারা আমি মারা যাওয়ার পর হুজুর ডেকে কুরআন খতম দিলো আর এতিম খাওয়ায় দিলো। এই যে একটা বৃত্ত আমাদের চারপাশে অহরহ দেখি, সেটা থেকে আসুন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি, যেভাবে পারি।

পর্ব— তিন

১.

আমি যখন উচ্চশিক্ষার কথা বলেছি তখন ইচ্ছা করেই উদাহরণ হিসেবে আইন বিষয়টিকে রেখেছি। কারণ, যারা মেয়েদের কো-এডুকেশনে পড়া এক কথায় হারাম হিসেবে সাব্যস্ত করেন, তারা একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করেন মেয়েদের ডাক্তারী পড়া। তবে এক্ষেত্রেও আমি এক অদ্ভূত সাইকোলজি দেখতে পাই। দেখা যায়, আমরা নিজের মেয়েকে ডাক্তারী পড়তে দিতে চাই না; কিন্তু মেয়ে বা বউয়ের জন্য ঠিকই মেয়ে ডাক্তার খুঁজি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, সেক্যুলার বা অন্য ধর্মের মেয়েরা যদি ডাক্তার হয়, তাহলেও তো তারা প্রয়োজনীয় সার্ভিসটা পেয়ে যান। এই যুক্তি শুনলে মনে হয়, আমরা মুসলিমরা এক অদ্ভূত সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে ভুগি। আমি নিজের জন্য যা পছন্দ করি না, তা সেক্যুলার/নন-মুসলিম মেয়েদের জন্য চাই! আমি কি তাহলে কখনো চাই না যে তারা ইসলামের ছায়াতলে আসুক? সবচাইতে বড় কথা, আমরা কি জানি যে ইসলামিক বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ‘প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ডাক্তারদের’ মতামত লাগে? ধরুন, আপনি একজন নারী। আপনি দেখাচ্ছেন নন-মুসলিম নারী ডাক্তার। এখন আপনার শারীরিক সমস্যায় রোযা রাখতে পারবেন কি না, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য শুধু মুসলিম নয় বরং প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ডাক্তারদের মতামত লাগবে। এটা Islam QA-র ফতোয়া। আমি আমার নিজের জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, আমি জানি এই সময়ে কেমন অসহায় লাগে যদি ডাক্তার মুসলিম/ দ্বীন বোঝা না হয়।

যাই হোক, ডাক্তারী পেশার ব্যাপারে এই ভিন্ন চিন্তার কারণটা আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার না। কারণ, গুনাহের দিক থেকে চিন্তা করলে মেডিক্যাল ইস্যুতে পরপুরুষ কোনো নারীকে স্পর্শ করবে, তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ দেখবে— এরচেয়ে বহু গুণ বড় গুনাহ হচ্ছে সুদে লিপ্ত হওয়ার গুনাহ। আমার যুক্তি হলো, নারীদের পর্দা রক্ষার নিয়তে কো-এডুকেশনে হলেও মেডিক্যালে পড়া যদি জায়েজ হয়, তাহলে মানুষকে/নারীদেরকে সুদের গুনাহ থেকে বাঁচানোর জন্য একজন মেয়ের অর্থনীতিতে পড়া জায়েজ হবে না কেন?

২.

হয়তোবা পাল্টা যুক্তি আসবে, মেয়েদের যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার দরকার নাই, তাই ওদের এই ব্যাপারে জানা অর্থহীন। ছেলেরা পড়বে এবং ছেলেরা ছেলেদের কাছ থেকে জানবে। আমি বিনয়ের সাথে এই যুক্তির সাথে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ, সেটা বর্তমান বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। সুদের ব্যাপারে নারীদের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে সুদভিত্তিক সিস্টেম আমাদের দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তাছাড়া প্রতিটা পুরুষ মাত্রই জানে যে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে নারীরা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি ঠিকমতো, সহজ ভাষায় এই সুদভিত্তিক সিস্টেমের রক্তচোষা রূপটা নারীদের কাছে বুঝানো যায়, তাহলে ইসলামের বুঝ থাকুক বা না থাকুক, অধিকাংশ নারী এটাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখবে। তাদের ঘৃণা পুরুষদের সুদভিত্তিক লেনদেন থেকে বিরত থাকার পথে এক বিশাল প্রেরণা হবে ইনশাল্লাহ। কল্পনা করুন একটি প্রজন্মের, যেখানে নারীরা সুদী ব্যাংকে চাকরি করা ছেলেদের বিয়ের জন্য গণহারে প্রত্যাখ্যান করছে, ছেলের আয়ে যদি সুদ থাকে তাহলে মায়েরা তাকে দেয়া উপহার ফিরিয়ে দিচ্ছে, মেয়েরা বাবাকে ক্রমাগত বলছে— বাবা, সুদ থেকে ফিরে আসো। আমাদের মা, বোন, স্ত্রীরা যদি সুদ কোনটা সেটাই না চিনে, তাহলে কীভাবে তারা এই সামাজিক বিপ্লবটা ঘটাবে?

৩.

কিংবা ধরুন, আপনি চরমমাত্রায় প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তখন কার কাছে যাবেন? পুরুষ কাউন্সেলরের কাছে? তিনি কি কোনোদিনও এই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে গেছেন? চিকিৎসার মনস্তাত্বিক দিকটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন নারী কাউন্সেলর যদি আপনার হাত ধরে মোলায়েম স্বরে বলে, আমি জানি এই সময়টা কী তীব্র কষ্টের! তখন রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা যে কতটা ত্বরান্বিত হবে তা কি আমরা বুঝি? সেক্যুলার নারী কাউন্সেলরদের দিয়েও কি এই সার্ভিস পাওয়া সম্ভব? সে কি আপনাকে কোনোদিনও বলবে যে মন খুব খারাপ থাকলে একটু কুরআন শুনেন? নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে বলবে?

৪.

প্রত্যেকটা ফিল্ডের ব্যাপারে আসলে এমন উদাহরণ দেয়া যায়। সাইকোলজি, এডুকেশন, মার্কেটিং, ডাটা সাইন্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি। ইসলামের একটা সৌন্দর্য হচ্ছে, মোটামুটি সব ফিল্ডের জ্ঞানকেই ইবাদতে পরিণত করার সুযোগ আছে। একটা উদাহরণ দেই। সাহাবীদের উপরে একটা লেকচার সিরিজে শুনছিলাম, আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তৎকালীন আরবদের মাঝে সবচেয়ে বড় genealogist ছিলেন। Genealogy is the study of lineage. বংশ নিয়ে, সোজা বাংলায় চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে পড়াশোনা। বক্তা সেখানে বলছিলেন, এই সাবজেক্টটা সেক্যুলার এবং ইসলামিক দুই ক্ষেত্রেই একটা মিসিং ব্রাঞ্চ এখন। শুনে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। ইসলামিক এত শাখা থাকতে জিনিয়লজি নিয়ে পড়ার কী দরকার? আমাদের তো এখন আরবদের মতো এত গোত্রীয় সমাজব্যবস্থা নেই যে গোত্রের ইতিহাস দাওয়াতী কাজে লাগবে। দুই দিনের মাঝেই উত্তর পেলাম একটা ফেসবুক পোস্ট থেকে। যেখানে মুহাম্মাদ আসাদের (বিখ্যাত Road to Mecca বইটার লেখক) সাথে Dr Chaim Weizmann-এর (ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট) একটা কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। মুহাম্মাদ আসাদ সেখানে প্যালেস্টাইনের উপর ইহুদীদের অধিকারের হাস্যকর যুক্তি খণ্ডন করেছেন ইহুদীদের বংশ লতিকার উপর জ্ঞান দিয়ে। চিন্তা করুন, জিনিয়লজির মতো একটা বিষয়কে আজকের সময়ে ইসলামের খেদমতে কাজে লাগানো সম্ভব।

তাহলে আগে যেগুলোর কথা উল্লেখ করলাম সেগুলো কত দারুণভাবে সম্ভব! সত্যি কথা বলতে কী দুনিয়াবী শিক্ষার সংজ্ঞাই আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। এই সিরিজে আমি এই ব্যাপারটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে দ্বীন শিক্ষা আর দুনিয়াবী শিক্ষা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ নয়। দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জনকেও ইবাদতে পরিণত করা সম্ভব। তবে আমি অবশ্যই সবাইকে পিএইচডি বা রিসার্চ করতে বলছি না। রান্না করা, ঘরের কাজকে ছোট করেও দেখছি না। আমি শুধু Diffusion of responsibility-র কনসেপ্টটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। এটার মানে হচ্ছে, আপনার সামনে একটা ছিনতাই বা কোনো অপরাধ হচ্ছে, আপনি ভাবছেন আরেকজন এগিয়ে যাবে। সমস্যাটা হয় যখন সবাই ভাবতে থাকে যে আরেকজন এগিয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে Diffusion of responsibility। যখন নারী ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট, ইকোনোমিস্ট এসবকে Communal responsibility ভাবেন, মানে এসব সার্ভিস কারো না কারো কাছ থেকে চান, কিন্তু এই জীবনটা অনেক চ্যালেঞ্জিং বলে নিজের বা নিজের মেয়ে/স্ত্রীর জন্য বেছে নেন না, তখন একটা প্রজন্মের মাঝে আপনি দেখবেন এই সার্ভিস দেয়ার জন্য কেউ থাকছে না। কারণ, সবাই আপনার মতো করে ভাবছে।

তাই আসুন, আমাদের টার্গেটের লেভেলটা একটু বাড়াই। আমরা আসলে জানি না, কার মাঝে কী আগুন লুকিয়ে আছে। আমরা জানি না, কার সম্ভাবনা কতটুকু। আজকে যেমন আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে আমাদের বাচ্চারা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়বে, সেরকমভাবে আসুন আমরা এমন একটা সময় গড়ার টার্গেট করি যেখানে এটা অসম্ভব ব্যাপার হবে যে কারও শুধু ১০টা সূরা মুখস্থ। আমরা যদি পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইসলামের বেসিক জ্ঞান, হিফয, প্যারেন্টিং, ইকোনমিক্স, ল, সাইকোলজি এসব অ্যাপ্লাইড ফিল্ডের জ্ঞান নিয়ে নিজেদের মাঝে লেভেলটা বাড়াই, তাহলে খুব দ্রুত একটা বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাবো ইনশাআল্লাহ। সবাই যেন আমরা একই কাজ না করি, একজন আরেকজনের দক্ষতা থেকে যেন উপকৃত হই।

৫.

এই যে এতক্ষণ ধরে যা আলোচনা করলাম, এই সব কিছুই অর্থহীন প্রলাপ হিসেবে সাব্যস্ত হবে যদি আপনি ‌‘মেয়ে মানুষের এত পড়াশোনার দরকার কী’ তত্ত্বে বিশাসী হন। আমি অনেক প্র্যাক্টিসিং ভাইদের মাঝেই এহেন চিন্তাভাবনা দেখি। ইসলামের বুঝ আসার পরও তারা যদি মেয়েদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবে,ন তবে সেটা দুঃখজনক। আমি বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষ উভয়কেই আল্লাহ প্রাথমিকভাবে একই কারণে সৃষ্টি করেছেন— তার ইবাদতের জন্য। তাই কোনো নারী যদি শরীয়তের দেয়া সীমারেখা মেনে চলে বৃহত্তর পরিসরে কিছু করতে চান, আল্লাহ অবশ্যই সেটা মূল্যায়ন করবেন ইনশাআল্লাহ। এজন্য নিচের আয়াতটা আমার খুব প্রিয়—

“অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা নারী।” [সূরা আলে ইমরান (৩): ১৯৫]

যারা নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরোধিতা করেন, তারা মূলত এই কথাটাই বলে থাকেন, এতে পরিবারের হক নষ্ট হয়। অস্বীকার করবো না যে এমন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সেক্ষেত্রে পরিবারের বাকি সদস্যদেরও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিৎ। আমার সীমিত অভিজ্ঞতা বলে, আজকালকার প্র্যাক্টিসিং মুসলিম পুরুষরা যখন ঘরে থাকা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে অগ্রাধিকার দেন, তখন নিজের অজান্তেই এমন মেয়ে চান যে ঘরবাড়ি পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখবে আর নানা রকম মজার মজার রান্না করবে। এগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই, আমরা সেই নবীর উম্মত যার ঘরে মাস পার হয়ে যেতো কিন্তু চুলা জ্বলতো না। তাঁর ঘরে প্রয়োজনীয় জিনিসটাও ছিল না। আমাদের ঘর যদি তেমন হতো, তাহলে তো গুছানোর, পরিষ্কার করারই এত কিছু থাকতো না! সেই সাথে আমরা যেন নিচের হাদীসটাও একদমই উপেক্ষা না করে ফেলি—

“নিজ পাকস্থলীর চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারার মতো কিছু খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” (জামে তিরমিজি)

নারীদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের আরো মাথায় রাখতে হবে, একই প্রেসক্রিপশন সবার জন্য প্রয়োগ করা যাবে না। কিছু নারী থাকবে এবং ছিলো, যাদের জীবনটা আমাদের তৈরি করা ছকে ফেলা যাবে না। দুঃখজনক হচ্ছে, আমরা ইসলামপন্থীরা একটা মেয়ের জীবনের যে ছবি আঁকি, তাতে সব মেয়ের একদম ঠিক বয়সে বিয়ে হয়, বাচ্চা হয় এবং তাদের একজন আদর্শ স্বামী থাকে, যারা যথেষ্ট ইনকাম করে আর বউ ঘরে থাকে বলে বিগলিত হয়ে তাকে সম্মান করে। এই চিত্র যে কতটা অবাস্তব, তা একটু চারপাশে খোলা চোখ নিয়ে তাকালেই আমরা টের পাবো ইনশাআল্লাহ। আমার এক ফ্রেন্ড একবার বলেছিলো, সে ইসলামে নারীদের ভূমিকা নিয়ে লেখাগুলো পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, সে কারো স্ত্রী নয় এবং কারো মা নয়। তাই ওই লেখাগুলোতে ওর জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। কথাটা শুনে আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। আমরা সমাজ থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন যে ভুরি ভুরি অবিবাহিত, মা না হতে পারা, ডিভোর্সড নারীরা আমাদের সমীকরণের মাঝেই নাই! ইসলামে নারীর ভূমিকা শুধু মা বা স্ত্রী হতে পারার মাঝেই সীমাবদ্ধ— আমাদের এই পরোক্ষ প্রচারণার জন্যই সম্ভবত একটা বিশাল গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একজন প্রিন্স চার্মিংয়ের জন্য, যে তার সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিবে। ইন ফ্যাক্ট, আমি একাধিক মেয়ের কাছে শুনেছি যে তারা অপেক্ষা করছে তাদের বিয়ে হবে, তারপর জামাইয়ের টাকায় তারা দ্বীন শিক্ষা করবে। নিঃসন্দেহে এটা এক ধরনের পরজীবী মানসিকতা এবং যদি এমন স্বামী তাদের তাকদীরে না থাকে তাহলে তাদের মনে হবে জীবনটা ষোল আনাই মিছে। আমার মনে হয়, এভাবে আমরা দারুণ মেধাবী কিছু মেয়েকে চরম অপদার্থ বানিয়ে ফেলছি। যাদের এখনো বিয়ে হয়নি, মায়ের সংসারে কোনো দায়িত্ব নেই, বাচ্চা হয় নাই, ডিভোর্সড— এইসব মেয়েরা কিছু করছে না। কারণ, তারা কো-এডুকেশনকে শর্তহীনভাবে হারাম ভাবছে।

আবারো বলছি, আমরা যদি আমাদের কাজগুলোকে ইবাদতে পরিণত করতে চাই তাহলে অবশ্যই নিয়তের পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে সবচেয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সমাজের লোক কী বললো না বললো, সেটাকে অগ্রাহ্য করতে জানতে হবে।

নিয়ত পরিশুদ্ধ রাখার একটা উপায় হতে পারে অ্যাকাডেমিক বিষয় অধ্যয়নের সাথে সাথে কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ ইত্যাদির ফরয জ্ঞানটুকু আদায় করা। এই ফরয লেভেলের জ্ঞান অর্জন আর অ্যাকাডেমিক যে বিষয়ে পড়ছি সেটাতে এক্সিলেন্সি অর্জন— দুটি একসাথে চালানো কি সম্ভব? আমার নিজের এবং চারপাশের অনেককে দেখে বুঝেছি যে এটা সম্ভব, দরকার শুধু প্রচণ্ড ডিটারমিনেশন আর যথাযথ টাইম ম্যানেজমেন্ট, সাথে আল্লাহর কাছে অহর্নিশ সাহায্যের জন্য দোয়া করে যাওয়া।

আমার একটা খুব প্রিয় দোয়া হচ্ছে— O my Lord, choose me to serve your deen.

এটা খুব গভীর একটা দোয়া। কারণ, আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হবেই। সেই প্রক্রিয়ায় দর্শক না হয়ে সৈনিক হতে পারাটা একটা বিশাল সৌভাগ্য। আল্লাহর কাছে আকুলভাবে না চাইলে আল্লাহ এটা যাকে-তাকে দেবেন না।

তাই ‌‘ওরে বাবা! আমি ফিতনায় পড়ে যাবো’ ভেবে জ্ঞান অর্জনের ও সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উম্মাহর জন্য বড় কিছু করার স্বপ্ন বিসর্জন দিবেন না। আস্থা রাখুন আল্লাহর সাহায্যের উপর। সেই সাথে খেয়াল করতে হবে, বৃহত্তর পরিসরে উম্মাহর জন্য কাজ করতে গিয়ে আমরা আমাদের প্রাথমিক দায়িত্বে তথা পরিবারের প্রতি দায়িত্বে যেন অবহেলা না করে বসি।

আমার বক্তব্য এখানেই শেষ। আমি বারবার বলছি এই লেখা সেইসব মেয়েদের জন্য, যাদের আল্লাহ পড়ার অনুকূল পরিবেশ দিয়েছেন, যারা কো-এডুকেশনের ফিতনা এড়ানোর ক্ষমতা রাখেন, তবুও এটাকে শর্তহীনভাবে হারাম ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আল্লাহর সাথে নিয়মিত কথা বলার অভ্যাস করুন, তাহাজ্জুদের জন্য উঠুন। নিজের স্ট্রেংথ এবং উইকনেসের একটা লিস্ট করুন। বর্তমানে যা করছেন, কেন করছেন সেটা লিখে ফেলুন। সর্বোপরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আকুল হয়ে দোয়া করুন। আল্লাহর পথে সৈনিক হতে চাওয়ার আন্তরিক দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দিবেন না ইনশাআল্লাহ।

যা কিছু বলেছি তাতে যদি ভালো কিছু থেকে থাকে তবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যদি ভুল কিছু বলে থাকি তাহলে তা আমার নফসের এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।

এ ধরনের আরো লেখা