ঋদ্ধ সংলাপ

‘ঋদ্ধ সংলাপ’ বইটির কন্টেন্ট প্রতারণা প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য

আলী আহমদ মাবরুরের ফেসবুক স্ট্যাটাস | ২৫ মে, ২০১৯

গত ২৫ মে ২০১৯ তারিখে জনাব আলী আহমাদ মাবরুর ফেসবুকে ‘ঋদ্ধ সংলাপ’ নামে একটি অনুবাদ বই প্রকাশনার ঘোষণা দেন। ফেসবুকে বইটির সূচিপত্র ও একটি আর্টিকেলের প্রথম পৃষ্ঠার ছবি দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। কিন্তু বইটি হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেই। গতকাল দুপুরে বইটি আমাদের হাতে এসে পৌঁছে।

অত্যন্ত হতাশা ও উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করি, বইটিতে সংকলিত ৬টি অনূদিত আর্টিকেলের ৩টিই ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের’ ওয়েবসাইট হতে নিয়ে ছাপানো হয়েছে। অথচ, এ ব্যাপারে বইটির প্রকাশক ‘নাফিয়ান পাবলিকেশন্স’ বা বইটির সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হওয়া জনৈক নূরুল আলম– কেউই আমাদের নিকট হতে লিখিত বা মৌখিক অনুমতি নেয়নি। উল্টো, দুটো আর্টিকেলে আমাদের অনুবাদকদের পরিবর্তে আলী আহমাদ মাবরুরের নাম ছাপানো হয়েছে। যা স্রেফ চৌর্যবৃত্তি। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অন্যায় এবং বিদ্যমান কপিরাইট আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এমতাবস্থায় আমরা গতকালই তাদেরকে ইমেইল করে আমাদের আপত্তি জানিয়েছি। আমাদের দাবি হলো: অবিলম্বে বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে হবে, ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু ফিরতি মেইলে নাফিয়ান কর্তৃপক্ষ জানায়– তারা এতেকাফে ব্যস্ত রয়েছে। ঈদের পর আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। অথচ তাদের বই বিক্রির কার্যক্রম বহাল রয়েছে।

এমতাবস্থায় প্রাথমিকভাবে আমরা পাঠকদের দারস্থ হয়েছি। সচেতন পাঠকদের সামনে আমরা নাফিয়ান পাবলিকেশন্স ও আলী আহমাদ মাবরুরের চৌর্যবৃত্তি তুলে ধরতে চাই। আমাদের যে ৩টি আর্টিকেল তারা বিনা অনুমতিতে এবং ভিন্ন অনুবাদকের নামে ছাপিয়েছে, সেগুলো এখানে তুলে ধরছি:

(১) আগামী দিনের ইসলাম:

গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে ‘আগামী দিনের ইসলাম’ শিরোনামে ড. তারিক আল সোয়াইদানের একটি বক্তৃতার অনুবাদ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি (অনুবাদটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)। এটি অনুবাদ করেছেন আমাদের তৎকালীন গবেষণা সহকারী মো: হাবিবুর রহমান হাবীব। অথচ আলী আহমাদ মাবরুর এটি নিজের অনুবাদ হিসেবে ‘আগামীদিনের সম্ভাবনায় ইসলাম’ শিরোনামে বইটির ৭-৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপিয়েছেন।

কীভাবে বুঝবেন এটি নকল করা হয়েছে?

১। পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে অনুবাদটিতে আমরা প্রচুর উপশিরোনাম/পয়েন্ট ব্যবহার করেছি, যা ভিডিও বক্তব্যে নাই। ‘ঋদ্ধ সংলাপ’ বইটিতেও আমাদের ব্যবহৃত উপশিরোনামগুলোই যথাস্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় আমাদের কিছু কিছু উপশিরোনাম তারা বাদ দিয়েছে বড়জোর।

২। আমরা রাসূলের (সা) নামের পর দরুদ লিখেছি সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে এভাবে– (সা)। তারা এটি পূর্ণাঙ্গ ফরম্যাটে ব্যবহার করেছে। এছাড়া কোনো কোনো বাক্যে তারা ক্রিয়াপদ, অব্যয় ইত্যাদি মাইনর যোজন-বিয়োজন করেছে। কোথাও বানান ঠিক করেছে, কোথাও বানান ঠিক করতে গিয়ে উল্টো ভুল বানান বসিয়েছে। এসব ছোট-খাটো বিষয় বাদে প্রতিটি তাদের প্রতিটি বাক্য আমাদের সাথে লাইন বাই লাইন মিলে যায়।

৩। এই আর্টিকেলটির অনুবাদক দাবিকারী আলী আহমাদ মাবরুর ফেসবুক স্ট্যাটাসে দাবি করেছেন, এটি তিনি দেড় থেকে দুই বছর আগে অনুবাদ করেছেন। অথচ, একই অনুবাদ আমরা ছাপিয়েছি দুই বছরেরও বেশি সময় আগে। তাহলে কে কাকে নকল করলো?

পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে এই আর্টিকেলটির তুলনামূলক দুটি চিত্র তুলে ধরছি:

চিত্র-১

চিত্র-২

(২) সফল নেতৃত্ব গঠনে সুন্নাহসম্মত বাস্তব কর্মপন্থা:

২৫ জুলাই ২০১৪ তারিখে ‘সফল নেতৃত্ব গঠনে সুন্নাহসম্মত বাস্তব কর্মপন্থা’ শিরোনামে ড. সোয়াইদানের আরেকটি বক্তৃতার অনুবাদ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি (অনুবাদটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)। এটিও অনুবাদ করেছেন আমাদের তৎকালীন গবেষণা সহকারী মো: হাবিবুর রহমান হাবীব। অথচ আলী আহমাদ মাবরুর এটি নিজের অনুবাদ হিসেবে একই শিরোনামে বইটির ৭৩-৮৮ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপিয়েছেন।

কীভাবে বুঝবেন এটি নকল করা হয়েছে?

১। শুরুতেই অনুবাদটির শিরোনামের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। মূল ভিডিও বক্তব্যটি ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে সর্বপ্রথম ইউটিউবে ‘Leadership Challenges For The New Millenium’ শিরোনামে আপলোড করে TVSUNNAH নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল। একই ভিডিও আমরা আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ১২ জুন ২০১৪ তারিখে ‘Leadership Challenges From Islamic Perspective’ শিরোনামে আপলোড করি। এর বাইরে ইউটিউবে আমরা এই ভিডিওটি পাইনি। খেয়াল করে দেখুন, আমরা ইংরেজি শিরোনামটির অনুবাদ বাংলায় রাখিনি। বরং কন্টেন্টের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আমরা শিরোনাম দিয়েছি– ‘সফল নেতৃত্ব গঠনে সুন্নাহসম্মত বাস্তব কর্মপন্থা’। ‘ঋদ্ধ সংলাপ’ বইটিতেও একই বাংলা শিরোনাম ব্যবহৃত হয়েছে!

২। স্বভাবতই ভিডিও বক্তব্যটিতে মূল আলোচনার বাইরে কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা ছিলো। অসম্পূর্ণ বাক্য ছিলো। যা একটি স্বার্থক অনুবাদের অন্তরায়। এ কারণে বাংলা অনুবাদের আগে আমাদের অনুবাদক ইংরেজি বক্তৃতাটির একটি পরিমার্জিত ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করেছিলেন (এটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)। বুঝার সুবিধার্থে আলোচনাটিকে কয়েকটি সেকশনে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেকশনে আবার বেশ কিছু উপশিরোনাম ব্যবহার করা হয়। স্বভাবতই যা ভিডিও বক্তব্যে এভাবে সাজানো ছিলো না। সেই ট্রান্সক্রিপ্টটিই পরে তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। অবাক করা ব্যাপার হলো, আলী আহমাদ মাবরুরের দাবিকৃত অনুবাদটিও হুবহু সেইসব সেকশন ও উপশিরোনামসহ বইটিতে ছাপা হয়েছে! আমরা মিলিয়ে দেখেছি, দুয়েকটি বানান সংশোধন (তাও কোনো ক্ষেত্রে সঠিক বানানকে ‘সংশোধন’ করে ভুল বানানে লেখা হয়েছে) ছাড়া বইটির অনুবাদ হুবহু আমাদের সাথে মিলে যায়!

৩। এই লেকচারটিও আলী আহমাদ মাবরুর দেড় থেকে দুই বছর আগে অনুবাদ করেছেন বলে দাবি করেছেন। অথচ আমরা একই অনুবাদ ছাপিয়েছি প্রায় ৫ বছর আগে। তাহলে কে কার অনুবাদ নকল করলো?

পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমরা এই অনুবাদটির দুটি তুলনামূলক চিত্র দিচ্ছি, যেখান থেকে তাদের প্রতারণার মাত্রা বুঝা যাবে।

চিত্র-১

চিত্র-২

(৩) সালাফী ইসলাম প্রসঙ্গে

১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘সালাফী ইসলাম প্রসঙ্গে’ শিরোনামে ড. ইয়াসির ক্বাদীর একটি আর্টিকেলের অনুবাদ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি (এটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)। এটি অনুবাদ করেছেন সিএসসিএসের নির্বাহী পরিচালক মাসউদুল আলম। তারা এটি একই অনুবাদকের নামে ‘সালাফী প্রসঙ্গ’ শিরোনামে বইটির ১০১-১৩২ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপিয়েছে। কিন্তু কোথাও লেখাটির সূত্র উল্লেখ করেনি, কিংবা অনুবাদকের পরিচিতিও উল্লেখ করা হয়নি। কোনো পর্যায়েই তারা মূল অনুবাদটির প্রকাশক বা অনুবাদকের সাথে যোগাযোগ করেনি। এর মাধ্যমে তারা অনুবাদটি অবৈধ, অন্যায়ভাবে কপি করার মতো অনৈতিক কাজে নিজেদেরকে সংযুক্ত করলো।

***

এই নাতিদীর্ঘ বর্ণনা থেকেও কেউ যদি কনভিন্স হতে না পারেন, তাহলে তাদের জন্য আমরা ‘ঋদ্ধ সংলাপ’ বইটির একটি প্রিভিউ ভার্সন তৈরি করেছি। এই তিনটি আর্টিকেলের প্রথম ও শেষ দুই পৃষ্ঠা বই থেকে স্ক্যান করে আমরা এই পিডিএফ ফাইলে সংযুক্ত করেছি। আগ্রহী পাঠকগণ সেগুলো আমাদের মূল লেখার সাথে মিলিয়ে পড়লেই তাদের চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়ে যাবেন। প্রিভিউ কপিটি ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

আমরা হিসাব করে দেখেছি, ১৬০ পৃষ্ঠার বইটিতে আমাদের থেকে চুরি করা এই তিনটি আর্টিকেলের পরিমাণ ৯০ পৃষ্ঠা, যা বইটির মোট কন্টেন্টের ৫৬ শতাংশ।

এই কুম্ভীলকবৃত্তিকে জাস্টিফাই করার জন্য তারা আগেভাগেই বইটির ভূমিকার শেষদিকে লিখেছে– “জ্ঞান প্রচারের একটি উম্মুক্ত ঠিকানা থেকে সংগৃহীত বিধায় লেখাগুলোর উৎস-সম্মতির প্রয়োজন ছিলো না।” এটি ভুল ও অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা। বাংলাদেশের প্রচলিত কপিরাইট আইন অনুসারে, কারো বক্তৃতা অন্য কেউ ট্রান্সক্রিপ্ট করে ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করলে সংশ্লিষ্ট অনুলেখক এবং অনুবাদক উক্ত কন্টেন্টের কপিরাইট লাভ করেন।

একই ভূমিকাতে তারা আবার লিখেছে– “ত্রিমুখী এ সংকটের মোকাবিলায় বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই। আদর্শিক সংহতির জন্য জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টা প্রচেষ্টা অগ্রাধিকার পাওয়া প্রয়োজন।”

আমাদের প্রশ্ন হলো– বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার মাধ্যমে কি এই সংকট মোকাবেলা করা যাবে? নাকি সংকট আরো ঘনীভূত হবে?

শেষ কথা:

আমরা প্রত্যেকটি আর্টিকেল দীর্ঘ সময় নিয়ে মনোযোগের সাথে অনুবাদ করেছি। তারপর খুঁটে খুঁটে সম্পাদনা করেছি। পুনরায় চূড়ান্ত সম্পাদনা শেষে আর্টিকেলটি ওয়েবসাইটে দিয়েছি। প্রত্যেকটি অনুবাদের সাথে মিশে আছে আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সময়। ব্যয় হয়েছে প্রচুর অর্থ। আর সেই অনুবাদই যখন মাউসের কয়েকটি ক্লিকে কপি করে কেউ নিজের নামে বই ছাপিয়ে বাণিজ্য করতে নেমে যায়, তখন আমরা মর্মাহত হই।

ইসলামী মতাদর্শের আলোকে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার যে স্বপ্ন আমরা দেখি, এগুলো হলো সেই আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত্তি। নিছক বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

আপনারা জানেন, ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আমাদের চিন্তা ছিলো ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কন্টেন্টগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে পারলে প্রকাশনা আয় থেকে কেন্দ্র পরিচালনার কিছু ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। কিন্তু নাফিয়ান পাবলিকেশন্স আমাদের কন্টেন্টগুলো চুরি করে বই ছাপিয়ে আমাদেরকে আর্থিক ক্ষতিরও সম্মুখীন করেছে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনী ও পাঠকদের সাথে প্রতারণাপূর্ণ কাজ।

পাঠকদের নিকট আমাদের আহ্বান, আপনারা ‘ঋদ্ধ সংলাপ’ নামের এই বইটি বর্জন করুন। বইটির সাথে সংশ্লিষ্ট অনুবাদক, সম্পাদক ও প্রকাশকের নিকট জবাবদিহিতা দাবি করুন।

ইনশাআল্লাহ, শীঘ্রই আমাদের কন্টেন্টগুলো বই আকারে ছাপিয়ে পাঠকদের নিকট তুলে ধরবো। সে পর্যন্ত আপনারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। আমীন।

One Comment

  1. খুব দু:খজনক এবং লজ্জার বিষয়। এ লেখক আরো অনুবাদ করেছেন বলে শুনেছি।
    এক তরুণ এ ঘটনার প্রেক্ষিতে এক মজার মন্তব্য করেছে । ওর কথা হলো, মবরুরের অনুবাদে ভুল থাকলে বুঝতে হবে সেটা নিজে করেছে । শুদ্ধ হলে এর মানে নকল করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *