মসজিদে শিষ্টাচারবিরুদ্ধ আচরণের বিষয়ে করণীয় কী?
সাহাবীদের সমাজ ছিলো মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ। যদিও তাঁরা রাসূলের (সা) মতো ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। সকল সাহাবীর ঈমান এবং একীনও এক পর্যায়ের ছিলো না। সেই সমাজের অনেকেই ইসলামের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন, এটি সত্য। কিন্তু সেই সমাজেরই কেউ কেউ আবার অন্যায় দৃষ্টি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এটিও সত্য। এমনকি মসজিদের মতো পবিত্র অঙ্গনেও এ ধরনের সমস্যা হয়েছে।
ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন:
“একজন সুন্দরী নারী, যাকে সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের একজন হিসাবে গণ্য করা হতো, তিনি মসজিদে নববীতে নারীদের কাতারে নিয়মিত নামায পড়তেন। ওই নারীর প্রতি দৃষ্টি পড়া থেকে বাঁচতে পুরুষদের অনেকে প্রথম কাতারে চলে যেতো; আবার কেউ কেউ ধীরেসুস্থে হাঁটতো, যেন শেষের কাতারে দাঁড়ানো যায়। শেষের কাতারের পুরুষরা যখন রুকুতে যেতো, তখন তাদের কেউ কেউ ওই নারীকে দেখার জন্য পেছনে তাকিয়ে থাকতো। তারা এমনটা করতে থাকলো, যতদিন না আল্লাহ এই মর্মে আয়াত নাযিল করলেন, ‘নিশ্চয় আমি জানি, তোমাদের মধ্যে কে সামনে চলে যায় এবং কে পিছনে থেকে যায়।’” (সূরা হিজর ১৫:২৪)[1]
হাদীসটি অনেকগুলো বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
এখানে খেয়াল করুন, কিছু পুরুষ যখন মসজিদে শিষ্টাচারবিরুদ্ধ আচরণ করলো, তখন তাদেরকেই দায়ী করে উপদেশ প্রদান করা হলো। এমন কোনো বর্ণনা নেই, যেখানে ওই সুন্দরী নারীটিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অথচ, একই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে বর্তমানে নারীদের সাথে সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ করা হয়। আজকাল ‘ফিতনা’ থেকে বাঁচার নামে নারীদেরকে মসজিদের পাশের কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি মসজিদ থেকে বেরও করে দেওয়া হয়। এটা স্পষ্ট যে রাসূলের (সা) যুগে সংঘটিত এ ধরনের সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার রীতির ক্ষেত্রে যেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি, তেমনি মুসল্লীদের একোমোডেশনেও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
কেউ কেউ যুক্তি দেখান, এ ধরনের স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার অনুমতি দিলে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। অথচ আমরা জানি, অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য মসজিদে আসে না। বরং তরুণদের নিয়ে কাজ করেন, এমন যে কেউ বলবে— বিয়েশাদিকে সহজ করার উদ্দেশ্যে তরুণ-তরুণীদের পরস্পরকে দেখা ও জানার সুযোগ দেওয়া জরুরি। তবে তা অবশ্যই শরীয়তের নিয়মনীতির মধ্যে হতে হবে। (এ ধরনের নির্দোষ ভালো লাগা ও বৈবাহিক প্রস্তাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে পছন্দ করার ব্যাপারটি সমাজের অন্যসব জায়গার মতো মসজিদেও ঘটতে পারে। ইসলামী শরীয়াহ এটি অনুমোদন করে। —সম্পাদক)
বিয়ের উদ্দেশ্যে পরস্পরের মাঝে শালীন কথাবার্তা বলার উপায় বন্ধ করে দেওয়াটা রাসূলের (সা) সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ। এ ধরনের সুযোগ দেওয়াই বরং রাসূলের (সা) সুন্নতের শিক্ষা। বর্ণিত আছে, মুগীরা ইবনে শুবা (রা) রাসূলকে (সা) বললেন যে তিনি একজন নারীকে বিয়ের করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি শুনে রাসূল (সা) বললেন, “তুমি কি তাকে দেখেছো?” তিনি বললেন, “না।” রাসূল (সা) বললেন, “দেখে নাও। এতে করে তোমাদের দুজনের মাঝে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি।”[2]
তরুণ-তরুণীদের পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে রাসূল (সা) যা করেছেন তা হলো, সৌহার্দ্যমূলক আচরণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সংশোধন করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হজের সময় রাসূলের (সা) সাথে তাঁর ভাই ফজলের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন:
“কুরবানীর দিন (হজ চলাকালীন সময় ১০ জিলহজ) রাসূল (সা) ফজল ইবনে আব্বাসকে (রা) তাঁর উষ্ট্রীর পেছনে বসান। ফজল ছিলো সুদর্শন পুরুষ। ইতোমধ্যে, রাসূল (সা) হজ সম্পর্কে লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অবসর হয়েছেন। এমন সময় খাছয়াম গোত্রের একজন সুন্দরী নারী রাসূলকে (সা) একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে আসলো। নারীটির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ফজল বার বার তার দিকে তাকাতে লাগলো। রাসূল (সা) পেছনের দিকে তাকালেন এবং আস্তে করে ফজলের মুখটি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।”[3]
[মূল: জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]
অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেফারেন্স:
[1] হাকিম বলেছেন, “এই হাদীসটির বর্ণনাসূত্রের পরম্পরা (ইসনাদ) বিশুদ্ধ, যদিও বুখারী ও মুসলিম এটি সংকলন করেননি।” আরো দেখুন সহীহ ইবনে খুজায়মা, ৮১৮/২; এবং সহীহ ইবনে হিব্বান, ২/১২৬।
[2] শরহে মায়ানী আল-আছার, ৩/১৪। এছাড়ও এটি লিপিবদ্ধ রয়েছে মুস্তাদরাকে, ২/১৭৯। হাকিম বলেছেন, “শায়খাইন তথা ইমাম বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী হাদীসটি বিশুদ্ধ, যদিও তাঁরা এটি সংকলন করেননি।” এছাড়া অন্যান্য সংকলনেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
[3] সুনানে নাসায়ী, ২৬৪২; মুসনাদে আহমদ, ২২৬৬; ইবনে হাযমের মুহাল্লা, ২/২৪৮।