মানবতাবাদ প্রসঙ্গে (শেষাংশ)
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপের র্যাডিক্যালিস্টরা ছিলো ‘নব্য মানবতাবাদের’ প্রবক্তা। ১৮০০ সালে প্রকাশিত এক মেনিফেস্টোতে তারা আহ্বান জানায়, “নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ঈশ্বরের পরিবর্তে বিবেককে গ্রহণ করো।” তারা মনে করে– মানুষ এমন এক সত্তা, যার মাঝে সহজাতভাবেই একটি নৈতিক চেতনা বা বিবেক থাকে। মানব প্রকৃতির অপরিহার্য শর্ত হিসেবে মানুষের চরিত্রগত মৌলিক বৈশিষ্ট্য থেকেই এটি উৎসরিত হয়।[1] মানব প্রকৃতি ও নৈতিক চেতনার উপর এই নির্ভরতাই এখনকার পাশ্চাত্য নাস্তিক্যবাদী মানবতাবাদের মূল ভিত্তি।
বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের যুগ শুরুর সাথে সাথে, বিশেষত সমাজতত্ত্বের বিকাশের সময় (সাইকোলজির পঙ্গুত্ববরণ ও পিছিয়ে পড়ার জন্য যেটি দায়ী) থেকে ‘মানব প্রকৃতির’ মতো একটি মৌলিক বিষয়কেও সন্দেহ করা হয়েছে এবং এক পর্যায়ে এটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ফলত, মানব প্রকৃতির গভীর থেকে উৎসরিত নৈতিক বিবেক পর্যবসিত হয়েছে ‘সামাজিক বিবেকে’। মানুষের সমাজ যেহেতু অপরিহার্যভাবেই পরিবর্তনশীল, সামাজিক বিবেকও তাই পরিবর্তিত হতে বাধ্য। যার ফলে ঐশ্বরিক মূল্যবোধ হিসেবে নৈতিকতা যে ধারণাটি, সেটির পতন ঘটে।
এতদসত্ত্বেও, পশ্চিমা বুর্জোয়া লিবারেলিজমের ভিত্তি হিসেবে এই নব্য মানবতাবাদ মনে করে, মানুষ শাশ্বত নৈতিক গুণের অধিকারী, মহৎ ও অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধসম্পন্ন সত্তা। স্বয়ং মানুষই হচ্ছে এর কেন্দ্রবিন্দু। এই কারণে, নব্য মানবতাবাদের এই ধারণা প্রকৃতি বা অতি প্রাকৃতিক শক্তির পরিবর্তে মানুষের মহত্ত্বের উপরই গুরুত্বারোপ করে।
এই নব্য মানবতাবাদ সামগ্রিক অর্থে ধর্ম থেকে মানবনৈতিকতা গ্রহণ করলেও এর ধর্মীয় ভিত্তিকে অস্বীকার করে। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ছাড়াই আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক গুণাবলির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা সম্ভব বলে দাবি করে।
এই প্রসঙ্গে এসে মার্ক্সবাদের দুটি ভিন্ন দিক আমরা দেখতে পাই। একদিকে, কার্ল মার্ক্স তাঁর সময়ের অন্যান্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রবল বিরোধিতা করছেন। অন্যদিকে, তিনি সত্যিকার অর্থে একটি সাম্যবাদী তথা কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ মার্ক্সবাদের ‘ইতিবাচক’ দিকটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয়– রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতি কমিউনিজমের মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাতের আড়ালে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি মার্ক্সের দারুণ সংবেদনশীলতার বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে। এই প্রবণতা তাঁকে নিছক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সফলতার জন্য উদগ্র বাসনাসম্পন্ন আরেকজন রাজনৈতিক নেতায় পরিণত করেছে।
যা হোক, এই ‘জটিল’ প্রেক্ষাপটে তিনি পুঁজিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হাজারো মানুষের হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছিলেন। তিনি যখন বিদ্যমান ব্যবস্থা ‘মানুষের উচ্চমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে’ বলে পুঁজিবাদী কাঠামোকে আক্রমণ করেন, তখন তাঁর এই সংবেদনশীলতা স্পষ্টত বুঝা যায়। এক ‘আধ্যাত্মবাদী’ (mystical) স্বরে তিনি যেন তখন সেই মানবতার কথাই বলেন, যেই মানবতাবাদ গভীর অনুভূতিসম্পন্ন, আত্মসচেতন, সৎ, গর্বিত, স্বাধীন, অর্থবহ এবং নৈতিক গুণাবলির অধিকারী। যেন সেই মানবতাবাদ ‘নির্দয়, নিষ্পেষণমূলক ও অনূভূতিহীন’ সিস্টেম এবং পুঁজিতন্ত্রের ‘শোষণ, নৈতিক অবক্ষয় ও স্বার্থপরতার’ ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে। তিনি উৎকণ্ঠার সাথে বলেছেন, “শ্রম মানুষের জন্য দরকারী, কিন্তু পুঁজিবাদ শ্রমকে শুধু একটি বস্তুগত পণ্য হিসেবেই দেখে এবং নিছক আর্থিক মূল্যে একে বিবেচনা করে। ফলে এখানে শ্রমিকরা পেটের গোলামে পরিণত হয়।”
কিন্তু সেই মার্ক্সই যখন উৎপাদনের নীতিমালা, উৎপাদন উপকরণের মূল্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নীতিমালা নিয়ে কথা বলেন, বিশেষত সমাজতন্ত্রের অধীনে সকল সমাজের জন্য প্রযোজ্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ফর্মুলা দেন, তখন তাঁর সেই আধ্যাত্মবাদী স্বর পরিবর্তিত হয়ে যায় বস্তুবাদী স্বরে!
মার্ক্সবাদ কর্তৃক মানবতার স্তুতিমূলক কথাবার্তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মার্ক্সবাদের নেতিবাচক দিক বলতে গিয়ে অ্যারন, ডুভারগার, এমনকি হেনরি লেফেভ্রের মতো স্কলার পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন– মার্ক্সের জটিল ও দার্শনিক কাজগুলোতে ‘আধ্যাত্মবাদী মানবতাবাদের’ (mystical humanism) কথাই বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, অস্তিত্ববাদ এক অদ্ভূত দার্শনিক প্রস্তাব, যেখানে মানবতাকে জগতের এক বিচ্ছিন্ন ঝুলন্ত সুতা (separately spun cord loose in the world) বলে মনে করা হয়। অস্তিত্ববাদ অনুসারে, মানুষ এমন এক সত্তা, যার নাই ঈশ্বর বা প্রকৃতি কর্তৃক ঠিক করে দেয়া কোনো বৈশিষ্ট্য, কিংবা ঈশ্বর বা প্রকৃতির প্রতি নাই কোনো দায়বদ্ধতা। বরং তার আছে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, যার মাধ্যমে সে নিজস্ব বাস্তবতা নির্মাণ করে এবং একে নিজের মতো করে গড়ে তোলে।
অপরদিকে, প্রাচ্যের মহান ধর্মগুলোতে ঈশ্বরের সাথে মানুষের এক বিশেষ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম মতে– মানুষ হচ্ছে আহুরামাজদার সঙ্গী। এমনকি জগতের শুভ-অশুভ সৃষ্টির সংগ্রামে মানুষ তাকে সমর্থন দিয়েছে, যাতে আহুরামাজদার প্রতিপক্ষ অংগ্র মৈন্যু ও তার বাহিনীর উপর শুভশক্তি জয়ী হয়। আধ্যাত্মবাদী ধর্মগুলোর ভিত্তি হলো অস্তিত্বের ঐক্য। হিন্দু ধর্ম এর সবচাইতে বড় উদাহরণ। এই ধর্মে ঈশ্বর, মানুষ ও প্রেমের ধারণা– সবকিছুই যেন বিদ্যমান জগতকে নতুন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক ধরনের প্রকল্প। এতে মানুষ ও ঈশ্বর এত নিবিড়ভাবে পরস্পর অবিবেচ্ছদ্য হয়ে আছে যে, তাদেরকে শেষ পর্যন্ত আলাদা করা অসম্ভব। আমাদের মহান সুফীদের কর্মের মধ্যেও অনেকটা এ ধরনের ব্যাপার দেখা যায়।
ইসলামে যদিও মানুষের দিক থেকে বান্দার সাথে আল্লাহর দূরত্ব অসীম, কিন্তু আল্লাহর দিক থেকে মানুষের সাথে তাঁর মোটেও কোনো দূরত্ব নেই। সৃষ্টিজগতে একমাত্র মানুষকেই দেয়া হয়েছে ঐশী চেতনা, অর্পণ করা হয়েছে ডিভাইন ট্রাস্ট। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আল্লাহর সিফাতী গুণগুলো অর্জন করার।
মানবতাবাদীদের সাধারণ ঐক্যমত্য অনুযায়ী মানুষের মৌলিক মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হলো–
১। মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা। সমস্ত প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক সত্তাগুলোর মধ্যে মানুষই হলো স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন সত্তা।
২। মানুষের আছে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এটি তার সবচাইতে অসাধারণ ও ব্যাখ্যাতীত একটি ক্ষমতা। এর মাধ্যমে কার্যকারণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় মৌলিক ও স্বাধীন কর্তা হিসেবে মানুষ নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছে। যার ফলে বিশ্বপ্রকৃতি, ইতিহাস এবং সমাজ হয়ে পড়েছে তার উপর নির্ভরশীল। স্বভাবতই মানুষ বিশ্বপ্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং এর নির্ণায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি– এগুলো মানুষকে দিয়েছে ঈশ্বরসুলভ ক্ষমতা।
৩। মানুষ সচেতন সত্তা। এটি তার অন্যতম গুণ। এই সচেতনতা তাকে চিন্তাভাবনা করার অসাধারণ ও বিস্ময়কর ক্ষমতা প্রদান করেছে। ফলে সে বহির্জগতের বাস্তবতা বুঝতে পারে, জগতের দুর্বোধ্য রহস্যের সমাধান করতে পারে এবং প্রতিটি ঘটনা ও বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে পারে। সে কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় ও ফলাফলের উপর সন্তুষ্ট থাকে না, বরং ইন্দ্রিয়াতীত বাস্তবতাকেও বুঝতে চায় এবং অন্তর্নিহিত কারণ উদঘাটন করতে চায়। এইভাবে সে তার বোধের সীমানা ছাড়িয়ে যায় এবং অতীত ও ভবিষ্যতের সাথে তার সাময়িক বন্ধনকে অতিক্রম করে এমন এক সময়ে গিয়ে হাজির হতে পারে, যেখানে বস্তুগতভাবে তার উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে সে তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে বিশুদ্ধ, বিস্তৃত এবং গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
প্যাসকেলের ভাষায়, “মানুষ নরম কাশফুলের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য একটি সামান্য কিছুই যথেষ্ট। সমগ্র জগতও যদি তাকে ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়, তবুও সে সমগ্র জগতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ক্ষেত্রে জগত বুঝতে পারে না যে সে মানুষকে ধ্বংস করছে। কিন্তু মানুষ জানে সে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।” তাই বলা যায়, অস্তিত্বের চেয়ে চেতনা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
৪। মানুষ আত্মসচেতন সত্তা। এর মানে, মানুষই একমাত্র জীবিত সত্তা, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে যার জ্ঞান রয়েছে। নিজেকে পর্যালোচনা করতে সক্ষম হওয়ায় সে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে পারে, নিজের সম্পর্কে জানতে পারে ও মূল্যায়ন করতে পারে। এর মাধ্যমে সে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে এক স্বাধীন সত্তায় নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে। সমকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের দার্শনিক টয়েনবি বলেছেন, “আজকের মানব সভ্যতা এর ঐতিহাসিক উৎকর্ষতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছে। কারণ, একমাত্র বর্তমান সভ্যতাই জানে যে তার ক্রমশ পতন ঘটছে!”
৫। মানুষ সৃজনশীল সত্তা। এই গুণটি তাকে প্রকৃতি থেকে একেবারে আলাদা করে দিয়েছে, আর তাকে স্থান করে দিয়েছে ঈশ্বরের পাশে। এ গুণটি তাকে দৃশ্যত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করে দিয়েছে। ফলে মানুষ তার অস্তিত্বের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। তার অস্তিত্ব অসীমে বিস্তৃতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে সে প্রকৃতিকে অতিক্রম করে এক মহত্তর অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে।
এই সৃষ্টিশীলতা তাকে প্রকৃতির উপর পর্যন্ত ক্ষমতাবান করে তুলেছে। সে যা চায় তা যদি প্রকৃতির মধ্যে না থাকে, তাহলে সে তা তৈরি করে নেয়। এইভাবেই মানুষ সৃজনশীল ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তার ডেভেলপমেন্টের প্রথম পর্যায়ে তৈরি করেছে যন্ত্রপাতি, তারপর দক্ষতা দেখিয়েছে কলাবিদ্যায়।
৬। মানুষ আদর্শবাদী সত্তা, আদর্শের পূজারি। এ কথার মানে হলো– যা কিছু বিদ্যমান আছে, তা নিয়ে সে কখনো তর্ক করে না। বরং যা হওয়া উচিত, বিদ্যমান অবস্থাকে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে চেষ্টা করে যায়। এ কারণেই সে নিত্যনতুন সৃষ্টিকর্মে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকে। এর মাধ্যমে সে প্রমাণ করে– সে হলো একমাত্র সত্তা, যে তার পরিপার্শ্ব দ্বারা সৃষ্ট নয়; বরং সে নিজেই তার পরিপার্শ্ব নির্মাণ করে। সহজ কথায়, সে তার আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যায়। তাই, নিরন্তর গতিশীল থাকা, বা পরিপূর্ণতার দিকে যাত্রা করাই মানুষের মূল লক্ষ্য নয়। বরং অন্যান্য জীবিত সত্তার সাথে মানুষের মৌলিক পার্থক্য হলো– মানুষ পথ চলতে চলতে নিজের পথ নিজেই ঠিক করে নেয় এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারে আগে থেকেই ভাবতে পারে।
মানুষের বিকাশ ও উন্নতির ক্ষেত্রে আদর্শবাদ বা ভাববাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর ফলে মানুষ (প্রকৃতি কিংবা জীবনযাত্রার প্রণালীর) বিদ্যমান বাস্তবতায় আটকে থাকার মধ্যে সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে না। এটি সেই শক্তি, যা মানুষকে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক পরিসরে ক্রমাগত চিন্তাভাবনা, গবেষণা, আবিষ্কার, উপলব্ধি, উদ্ভাবন ও নতুন কিছু সৃষ্টি করার প্রণোদনা দিয়ে যায়।
শিল্প, সাহিত্য, কলা এবং সমৃদ্ধ সকল মানবিক-সংস্কৃতি এই আদর্শবাদী প্রেরণার ফসল। এটি এমন এক প্রেরণা, যা তাকে প্রকৃতির দেয়া সুযোগ-সুবিধাটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে দেয় না।
৭। মানুষ নৈতিক জীব। এখানে আবার সেই তাৎপর্যপূর্ণ মূল্যবোধের বিষয়টি চলে আসে। মূল্যবোধ হচ্ছে যে কোনো প্রপঞ্চ বা ঘটনা, আচরণ, কাজ, বা পরিস্থিতির সাথে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক। মূল্যবোধের প্রশ্নে উপযোগিতার চাইতে উদ্দেশ্যটা মহৎ কিনা, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় ৷ যেহেতু মূল্যবোধের সাথে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও পূজনীয়তার সম্পর্ক আছে এবং সম্পর্কটা এতদূর যে, এর জন্য মানুষ জীবন দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত থাকে, তাই এটাকে একটা পবিত্র সম্পর্ক বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় বিবেচ্য: যদিও মানুষের এই প্রবণতার পেছনে কোনো স্বাভাবিক, যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, কিন্তু ইতিহাসের সমস্ত কালপর্বে সকল ধর্ম ও সংস্কৃতিতে মানুষের এই ভাবপ্রবণতা (sentiment) মানবজাতির সবচেয়ে মহত্তম অস্তিত্ববাদী বহিঃপ্রকাশ হিসেবে স্বীকৃত। কারণ, এই অনুভূতি মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, সর্বাধিক সমুন্নত গৌরব, সবচেয়ে পরিশীলিত আবেগ এবং অতি অলৌকিক ঘটনাবলির উৎস।
শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের জন্য যারা জগতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ গণ্য করেছে, তাদের থেকে শুরু করে ধর্মের জন্য শহীদ, সত্যসন্ধানী ব্যক্তিগণ ও প্রতিটি জাতির মহান বীরপুরুষগণ; বিয়ে করতে গিয়ে যারা নিজের স্বার্থ-সুবিধার চেয়ে ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সেইসব ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে বিশ্বাস, দেশ, মানবতার জন্য যারা জীবন দিয়েছে; অথবা যারা নিজের ব্যক্তিগত ভালোবাসার পেছনে, কিংবা একান্ত নিজের মতো করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে– এরা প্রত্যেকেই মানবজীবনের জন্য মূল্যবোধ তৈরিতে অবদান রেখেছে। মূল্যবোধ এবং উপযোগিতা দুটি বিপরীতমুখী পরিভাষা। মূল্যবোধকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণেই মানুষ অ-বস্তুগত জীব এবং অন্য সকল প্রাকৃতিক সত্তা থেকে স্বাধীন। সবার উপর শ্রেষ্ঠ।
প্রকৃতির মধ্যে মূল্যবোধের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর কোনো বাহ্যিক ও বস্তুগত ভিত্তিও নেই। সেই কারণে বাস্তববাদ (রিয়ালিজম) মূল্যবোধের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। যদিও মানুষ না থাকলে থাকে না কোনো মূল্যবোধ। এখানে আমরা একটা নিশ্চিত উপসংহারে পৌঁছতে পারি যে, মানুষের ভেতর থেকেই মূল্যবোধ উৎসরিত হয়। অতএব, এটি ভাবগত বা ব্যক্তিনির্ভর বিষয়ও বটে। এ কারণেই বাস্তববাদীগণ এগুলোকে অস্বীকার করে। কিন্তু মানব অস্তিত্বের এই মহত্তম প্রকাশকে কীভাবে অস্বীকার করা সম্ভব? একে অস্বীকার করা নিশ্চয় অত্যন্ত কঠিন, লজ্জাজনক ও মারাত্মক কাজ। কিন্তু বাস্তববাদীদের সামনে এছাড়া আর কোনো পথও খোলা নেই। অবশ্য তারা যদি বস্তুগত বাস্তবতার উপর মানুষকে গুরুত্ব দেয়, কিংবা বস্তুর চেয়ে মনকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে তাদের পক্ষে এগুলো স্বীকার করে নেয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে স্বয়ং বাস্তববাদই খণ্ডিত হয়ে যায়।
তারপরও বাস্তববাদী দার্শনিকগণ (যেমন– সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল ব্স্তুবাদী ও প্রকৃতিবাদীগণ) মূল্যবোধের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে কসুর করে না। তারা মূল্যবোধকে কুসংস্কার, কষ্টকল্পনা, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অভ্যাস, বা বস্তুগত ব্যাপার থেকে উদ্ভূত সামাজিক রীতিনীতি, কিংবা মানুষ নামের এই ‘কথা বলতে পারা পশুর’ (!) মনস্তত্ত্বের আবেগপ্রবণ অবস্থা বলে মনে করে।
এই নির্দয়, অনুভুতিহীন, ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তববাদীরা মূল্যবোধের পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য নষ্ট করে দেয়। জীবন্ত প্রাণীকে ব্যবচ্ছেদ করার মতো মূল্যবোধ নিয়ে তারা এমনভাবে কাটাছেঁড়া করে যে একটি সুকুমার ব্যবস্থা অবশেষে একটি প্রাণহীন ও নিছক বস্তুগত উপাদানে পরিণত হয়।
তাই, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেশায় যিনি জীবনভর ছুটে চলছেন, দেশের জন্য যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে মহত্তর আদর্শকে যিনি বেছে নিয়েছেন, ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার চেয়ে বৃহত্তর মূল্যবোধ ও কল্যাণকে যিনি বড় মনে করেন– এমনসব বিষয়ে বাস্তববাদীদের ব্যাখ্যা শুনলে মনে হয় তারা যেন নিছক একটি খৎনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার বিষয়ে কথা বলছে (the realists explain his feelings just as they would explain participation in a rite of circumcision)!
এতক্ষণের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো– মার্ক্সবাদ এমন এক জায়গায় এসে হোঁচট খেয়ে পরে আছে, যেটি কোনো আদর্শের জন্য অত্যন্ত দুর্বল একটি অবস্থান। জঁ-পল সার্ত্র যেমন বলেছিলেন, “স্বাধীনতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং সৎ উদ্দেশ্য থেকে তুমি যা কিছুই করো না কেন, তা-ই মূল্যবোধ তৈরি করে, সেটাই কল্যাণকর” (সেই মূল্যবোধ যতই অশুভর পক্ষে থাকুক বা আত্মস্বার্থবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠুক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না), মার্ক্স নিছক এ ধরনের দার্শনিক বস্তুবাদী ছিলেন না– এক দিক থেকে এ কথা বলা যায়। মার্ক্স ছিলেন সামাজিক আদর্শবাদী, যিনি তাঁর সময়ের প্রলেতারিয়েতদের রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন এবং ‘কাজের এক পর্যায়ে’ তিনি একটি দলও গঠন করেছিলেন। এসব কিছুর মাধ্যমে তিনি একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচির প্রবক্তা ছিলেন। যিনি সার্ত্রের বিপরীতে গিয়ে বলেছেন, “তোমাকে এ বিষয়গুলোই করতে হবে।” আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, “(তুমি যা কিছু বেছে নিয়েছো) সেগুলোর জন্য তোমার দায়-দায়িত্ব রয়েছে এবং এই দায়-দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তোমাকে অবশ্যই এই বিশেষ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।” এর অর্থ হচ্ছে, “তোমাকে অবশ্যই যাবতীয় পার্থিব আকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক প্রয়োজন, জৈবিক বাসনা, ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি পরিত্যাগ করতে হবে। এমনকি সংগ্রামের স্বার্থে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হবে।”
কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি একগুচ্ছ মূল্যবোধের কথাই বলছেন। এমন মূল্যবোধ, যা ব্যক্তিস্বার্থের পরিপন্থী এবং মানুষের বস্তুগত অস্তিত্বকে ছাড়িয়ে যায়। তিনি যখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও বুর্জোয়া মানসিকতার সমালোচনা করে বলেন– তারা অর্থ দিয়ে মানুষের মূল্য পরিমাপ করছে, যা মানুষকে নৈতিক অধপতনের দিকে নিয়ে যায় এবং তৈরি করে একটা অনৈতিক সমাজ; তখনও কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়েই তিনি কথা বলেন।
কিন্তু তারপর তিনি যখন তাঁর চিন্তার কাঠামো প্রসঙ্গে কথা বলেন, বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিয়ে আলোচনা করেন; তখন তিনি নিজেকে বাস্তববাদের সমর্থক হিসেবে প্রমাণের জন্য প্রাণপন প্রচেষ্টা চালান। তখন তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাণিবিদ্যাগত ও বস্তুগত মূলনীতিসমূহের যেটুকু বাস্তববাদের সাথে মিলে যায়, সেটুকুই কেবল গ্রহণ করেন। তিনি মানবিক মূল্যবোধকে একটা ভিত্তিহীন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে গিয়ে বাস্তববাদের বিভিন্ন ধরণকে মাত্রাভেদে গ্রহণ করে নেন।
মার্ক্স গর্বভরে একটা বৈজ্ঞানিক চাতুর্যের আশ্রয় নেন, যা তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রায়শই উল্লেখ করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, মানবিক মর্যাদা রক্ষার স্বার্থেই তিনি তার তত্ত্বকে গড়ে তুলেছেন। প্রকৃতিবাদ ও বস্তুবাদের অপরাপর ধারাগুলো মানুষকে জড়বাদী জগতের একটি নিশ্চল বস্তুগত সত্তা বলে মনে করে। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরা বিয়ষটিকে সেভাবে দেখার পরিবর্তে মানুষকে বিবর্তনশীল সত্তা বলে মনে করে। যে সত্তা এগিয়ে চলেছে এক ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতার সূত্রকে অনুসরণ করে। এই চাতুর্যপূর্ণ কৌশল ব্যবহার করে মার্ক্স মানুষকে প্রকৃতির আওতা থেকে বের করে ইতিহাসের আওতায় নিয়ে আসেন।
কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে মানুষের কোনো মাহাত্ম্য লাভ ঘটছে না। যেহেতু মার্ক্সের মতে, ইতিহাস হচ্ছে “বস্তুগত প্রকৃতির গতিশীলতারই ধারাবাহিকতা,” তাই ইতিহাসের আলোকে দেখলে, মানুষ দিনশেষে প্রকৃতিবাদীদের বস্তুবাদী বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে এবং নিজেকে একটি জড়বস্তু হিসেবেই বিবেচনা করে। এইভাবে, মার্ক্স মানুষকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেসব মূল্যবোধসম্পন্ন বলে দাবি করেছিলেন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের হাত দিয়ে তিনি আবার সেগুলোকেই নাকচ করেছেন। (এ প্রসঙ্গে স্যান্ডেলের (Chandel) অত্যন্ত যুৎসই একটি মন্তব্য মনে পড়ে গেলো: “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অন্ধ ট্রাকের নিচে চাপা দিয়ে দার্শনিক মার্ক্স মানুষের অত্যাবশ্যকীয় সকল মূল্যবোধ ধ্বংস করেছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদ ও লিডার মার্ক্স এসব মূল্যবোধের ঐকান্তিক ও প্রেরণাদায়ক প্রশংসা করে মানুষকে ক্ষমতা ও বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করেছেন।”)
যেসব মূল্যবোধের সত্যতায় মার্ক্স বিশ্বাস করেন না, সেইসব মূল্যবোধের উপর নির্ভর করা কি স্রেফ চাতুর্যপূর্ণতার নীতি ও কৌশল মাত্র নয়? যদি তাই হয়, তাহলে এটি হলো রাজনৈতিক প্রতারণার সবচেয়ে বড় একটি উদাহরণ।
***
বিদ্যমান আধুনিক চারটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার মৌলিক ও গ্রহণযোগ্য সকল দাবিকে বিবেচনায় রেখেই, অর্থাৎ যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা সম্ভবত মানুষ সম্পর্কে এই সংজ্ঞাটির ব্যাপারে একমত হতে পারি: প্রকৃতির জগতে মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা, যার রয়েছে অনন্য স্বকীয়তা এবং সৃষ্টি হিসেবে মানুষ হলো মহৎ ও অসাধারণ। কারণ, সে হলো ইচ্ছাশক্তির অধিকারী, স্বাধীন কর্তা হিসেবে প্রকৃতিকে পরিবর্তনকারী। তার রয়েছে বাছাই করার ক্ষমতা। প্রকৃতি আরোপিত নিয়তির বিপরীতে নিজের জন্য নতুন লক্ষ্য ঠিক করে নিতেও সে খানিকটা সক্ষম। এই ব্যাপারটি তাকে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি পালনে উদ্বুদ্ধ করে। তার মধ্যে তৈরি করে দায়িত্ববোধ। কিন্তু কোনো মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যবস্থার অধীনে না থাকলে এগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে।
একইসাথে মানুষ এমন এক আদর্শবাদী সত্তা, যে প্রকৃতি, সমাজ বা ব্যক্তি তথা সর্বক্ষেত্রেই বাস্তবতাকে সত্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়। অর্থাৎ বাস্তবে ‘যা আছে’ তাকে ‘যা হওয়া উচিতে’ পরিণত করতে চায়। এই রূপান্তর ব্যক্তিকে তার অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার দিকে নিয়ে যায়। তাছাড়া, মানুষ এমনও এক সত্তা, যে বিশ্বপ্রকৃতি ও নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রকৃতির উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃতি ও নিজেকে আরো বেশি উন্নত হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। একইভাবে, সৌকর্য, কলা ও সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বস্তুগত জগতকে এমন কিছু দেয়, যা আগে ছিলো না। আর নানা ধরনের শিল্পচর্চার মাধ্যমে সে নিজেকে এমন কিছুর যোগান দেয়, যা প্রকৃতি তাকে দেয়নি।
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণীও বটে। ইন্দ্রীয় ক্ষমতার ঊর্ধ্বতন এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তার মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয় জগত ও নিজের সম্পর্কে সচেতনতা। পাশাপাশি এই জগত, সমাজ ও স্বীয় কালপর্বে নিজের মানবীয় অবস্থা নিয়েও সে সচেতন হয়ে ওঠে।
চিন্তার করার ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যক্তি তার স্বীয় শারীরিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যায়। তখন তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর ইন্দ্রিয়ের গভীর তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং বস্তুগত জগতের ছোট ছোট উচ্চতার সীমানাগুলো ছাড়িয়ে যায়। এ ধরনের উন্নত সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের কারণে নিজের ভেতর সে এক সীমাহীন জগতে বিচরণ করে, যদিও তার পারিপার্শ্বিক জগত হলো স্থূল ও সীমাবদ্ধ।
সর্বশেষ কথা হলো, মানুষের রয়েছে এক পবিত্র সত্তা। সেখান থেকে প্রবহমান পবিত্রতার এই ধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ইবাদতের মাধ্যমে। এটি হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়। একে আমরা অতি প্রাকৃতিক কিংবা অতি-যৌক্তিক ধাপ হিসেবেও বিবেচনা করতে পারি। এই সবকিছুর মাধ্যমে গড়ে ওঠে মানবীয় মূল্যবোধের নানা বিষয়। যেমন– ভালোবাসা ও ত্যাগ-কুরবানী। আধ্যাত্মিক ধাঁচের এই মূল্যবোধগুলোই সমস্ত মানবতার গৌরব ও সমৃদ্ধির মূল কারণ। মানবিক মূল্যবোধগুলো পবিত্র। যদিও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এটি হতে পারে বিভিন্ন রকমের। মানবজাতির র্ধ্বংস সাধন হওয়ার আগ পর্যন্ত এগুলোর কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। কেননা, এগুলো হলো স্বয়ং শাশ্বত ও চিরন্তন।
বিখ্যাত দার্শনিক নিটশে একটা মালবাহী ঘোড়াকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। এই ধরনের কাজকে বস্তুবাদী মন কেবল অর্থহীন বলেই বিবেচনা করে না, বরং একে নিন্দাযোগ্য ও ধ্বংসাত্মক কাজ বলেও মনে করে। কারণ, তাদের কাছে এটি নিছক একটি পশুর জন্য একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা। আসলে, মানব প্রকৃতির মধ্যে এমন বিস্ময়কর কিছু ব্যাপার রয়েছে, যে কারণে মানুষ নিজের দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ঘোড়াকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে নিটশে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, নৈতিক মূল্যবোধের চেয়ে মহৎ কিছু নেই। নৈতিক মূল্যবোধ হলো মানুষের দৈহিক অস্তিত্বের চেয়েও বড় কিছু, এমনকি ব্যক্তিটি যদি প্রতিভাবানও হয়ে থাকেন।
মানব অস্তিত্বের যে অতিবর্তী দিক রয়েছে, তা মানুষের মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ তৈরি করে। এ বিষয়টিকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বস্তুবাদ, বিশেষ করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মানুষের স্বয়ং সত্তাকেই অস্বীকার করেছে। এর মাধ্যমে তারা আসলে নিজেদেরকেই খারিজ করে।
(চলবে)
[মূল: আলী শরিয়তী, অনুবাদ: এন এইচ আব্দুল্লাহ]
অন্য পর্বগুলো পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
নোট:
[1] দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই নব্য দর্শন শিক্ষাব্যবস্থায় এতদূর প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে, নৈতিকতার ভিত্তি সংক্রান্ত পূর্ববর্তী ধারণাটি সরকারীভাবেও পরিত্যাগ করা হয় এবং স্কুলগুলোতে এগুলো পড়ানো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ইসোলে (Isoulet) বলেছেন, এর ফলে ফ্রান্সে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। সক্রেটিসের সময় থেকে ঈশ্বরকে নৈতিক কাঠামোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখার সকল উদ্যোগকে এটি ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়।”