চাই বিশ্বাস চর্চার অধিকার, চাই বিশ্বাস চর্চার স্বাধীনতা
মানুষ আদতে বিশ্বাসী; বিশ্বাসী হতে পারে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে, বিশ্বাসী হতে পারে যুক্তি-দর্শন-বিজ্ঞান কিংবা প্রাকৃতিক কোনো বিষয়ে। আবার প্রচলিত ধর্মে যদি কেউ আস্থাশীল না হয়ে সমাজের অপরাপর মত-পথকে সম্মান করে নিজের বিশ্বাসে পথ চলে, তাও তো তার বিশ্বাস। আর তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে আজ বিশ্বাস চর্চার স্বাধীনতাই জরুরি বিষয়।
বাংলাদেশেও আসলে আজ দরকার ‘বিশ্বাস’ চর্চার স্বাধীনতা, আর তাতে মানুষ প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারেন, নাও হতে পারেন কিংবা যে কোনো যুক্তি-দর্শন-বিজ্ঞান অথবা প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু/তন্ত্রে-মন্ত্রেও আস্থাশীল হতে পারেন। সবাই তো একই রূপে ধর্ম চর্চা কিংবা বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাসেরও রয়েছে রূপভেদ, একই ধর্ম চর্চা করেও কিংবা যুক্তি-দর্শন-বিজ্ঞানের চর্চা করেও মানুষ কতভাবে কতরূপে তা ধারণ করেন এবং চর্চা করেন।
আমরা যা চর্চা বা বিশ্বাস করি তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবার লক্ষ্যে অন্যের উপর জবরদস্তি করি কিংবা গায়ের জোর খাটাই। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে এ কর্মটি যে মন্দ তাও অনেক সময় উপলব্ধি করি না; চাপিয়ে দেয়ার, জবরদস্তি করার এ মানসিকতার পরিবর্তে অপরের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াটা আজ জরুরি বিষয়। আমাদের নিজের ধর্ম-বিশ্বাস-সংস্কৃতি যেমন মানব সভ্যতারই অংশ এবং সম্পদ; সমাজের অপরাপর মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস-সংস্কৃতিও মানব সভ্যতার ঐতিহ্যেরই অংশ এবং সম্পদ – এটা আমাদের মানতে হবে। কিন্তু যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেন তারা ধর্মকে প্রয়োজন সাপেক্ষে কখনো রক্ষাবর্ম, কখনো জবরদস্তির হাতিয়ার বানিয়ে থাকেন। তাই সমস্যার মূলে দায়ী ক্রিয়াশীল সমাজ-রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক শক্তি – ক্ষমতা দখলের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মনোভাব। রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষ আইনের চোখে সমান বলে বিবেচিত হবে, বিশেষ কোনো গোত্র কিংবা সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত আথবা বৈষম্যের আচরণও রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।
ধর্মবিশ্বাস-ভাবনা-সংস্কৃতি মানব সভ্যতারই অংশ, আমাদের মনে রাখা উচিত, তাই বলে দুনিয়ার সব মানুষ তো এক ধর্মের চর্চা করে না, একরূপ বিশ্বাসে পথও চলে না। আমাদের সম্মিলিত মানব সভ্যতা বহু-মত-পথ ও বৈচিত্রময় বিশ্বাস-ভাবনার আলোয় আলোকিত হয়ে আগামীর পথে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা সকলেই তার অনুঘটক। তাই পরমতসহিষ্ণুতা পরমতের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ আমাদের করতেই হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সংখ্যার বিবেচনায় তাবৎ দুনিয়ার প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী, বাকি ৭৭ শতাংশ মানুষ তো অপরাপর ধর্মের এবং বিশ্বাসের। আবার আক্ষরিক অর্থে এ ২৩ শতাংশের মত/পথও এক নয়। নানা তরিকায়, গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীতে মুসলিম সম্প্রদায় বিভক্ত। তারপরও এ দুনিয়াটা তো শুধুমাত্র ২৩ শতাংশের নয়, বাকি ৭৭ শতাংশ মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও মতামতের হিস্যার কথা বিবেচনায় তো থাকতে হবে! সমাজে রাষ্ট্রে ধর্মের নামে, ধর্মের গায়ে কালিমা লেপন করে কিছু মানুষকে খুন করলেই বিজয়ের পতাকা উড্ডিন হবে – এমনটি ভাববার কোনো কারণ নেই। বরং এ কর্ম তাবৎ দুনিয়ায় বসবাসরত স্বধর্মের মানুষজনকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে, নিরাপরাধ স্বধর্মের মানুষজনকে বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
‘মানুষ তো মানুষই’। কিন্তু আজকাল দেশে দেশে ধর্ম-পরিচয়ের তবকটি বড্ড বেশি মুখ্য হয়ে উঠছে। মানুষকে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার মানদণ্ডে মূলত মানুষ হিসেবে নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল হিন্দু, কেবল মুসলিম, কেবল খৃষ্টান, কেবল ইহুদি ইত্যাদি পোশাকি আলখেল্লার পরিচয়ে উপস্থাপন করা হয়। এটি কোনোভাবে মানুষের জন্য, মানুষ পরিচয়ের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। সম্মানজনকও নয়।
বৈশ্বিক আর দৈশিক রাজনীতির নানা কূটচালে – হাতিয়ার হিসেবে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজন, অবিশ্বাস, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাস-জঙ্গি-তৎপরতায় দেশে দেশে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও জনপদ আজ বিপন্ন। তবু আমাদের প্রত্যয়ী হতে হবে, আশাবাদী হতে হবে। কারণ এ পৃথিবী মানুষের। এ পৃথিবী প্রজ্ঞাবান মানুষের। আমাদের। সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বেষ-বিদ্বেষ উৎপন্নকারী সাম্প্রদায়িকদের নয়।
আজকের এ আত্মপ্রত্যয়হীন বিপন্ন সময়ে বাঙালির গর্ব বৈষ্ণব কবি চণ্ডিদাসের অমোঘ সত্যবাণী বারবার উচ্চারিত হোক:
“শুন হে মানুষ ভাই,
সবার উপর মানুষ সত্য
তাহার উপর নাই।”