কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র: লেখকের ভূমিকা

فقه الغناء والموسيقى في ضوء القرآن والسنةসমস্ত প্রশংসা মহিমাময় মর্যাদাবান ও অসীম কর্তৃত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য। অজস্র দুরুদ ও সালাম বিশ্বজাহানের জন্য রহমত ও মানবজাতির উপর সাক্ষ্য হিসেবে প্রেরিত আমাদের নেতা, আদর্শ, বন্ধু ও শিক্ষক মোহাম্মদের (সা) প্রতি। তাঁর পরিবারর্গ ও সাহাবীদের  প্রতিও দুরুদ ও সালাম। আরো দুরুদ ও সালাম তাদের প্রতি, কেয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁর দেখিয়ে যাওয়া পথ ও পদ্ধতির অনুসারী।

আমার বন্ধু শায়খ সালেহ কামিল (যিনি দাল্লাহ আল বারাকা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান) এমন একজন মানুষ, ইসলামী শিক্ষার প্রসারে যার বেশ ভালো কিছু উদ্যোগ রয়েছে। প্রায় বিশ বছর আগে তিনি চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। সেটি হলো– প্রতি বছর অর্থনীতির ফিকাহ সংক্রান্ত সেমিনার আয়োজন করা, যেখানে অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ে বিশেষজ্ঞ একদল ফিকাহবিদ এবং অর্থনীতি ও ম্যানেজমেন্টের বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি সেমিনারেই এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ থাকে, যেগুলো নিয়ে প্রচুর তাত্ত্বিক আলোচনা ও পর্যালোচনার পর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে একটা ফয়সালায় উপনীত হওয়া প্রয়োজন। যাইহোক, সেমিনারগুলোতে এসব ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা হয় এবং সেমিনার শেষে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এসব সেমিনার থেকে সাধারণ মুসলমানরা উপকৃত হন। বিশেষ করে ইসলামী অর্থনীতি, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ইসলামী ব্যাংকিং জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উপকৃত হয়।

গত প্রায় বছর তিনেক ধরে শায়খ সালেহ কামিল (আল্লাহ তাঁকে হেফাজত করুন এবং আরো বেশি করে ভালো কাজ করার সুযোগ দান করুন) এমন একটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, যার গুরুত্ব অর্থনীতি থেকে কোনো অংশেই কম নয়। বরং বাস্তবতা বিবেচনা করলে সমসাময়িক ফিকাহর আলোকে বিষয়টির সমাধান করা অতীব জরুরি। বিষয়টি হলো মিডিয়া এবং মিডিয়া সংক্রান্ত ফিকাহ। বিশেষ করে শায়খ সালেহ এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার পর এটি আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি ‘আরব রেডিও ও টেলিভিশন নেটওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠার পর চারদিকে ব্যাপক হইচই পড়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি ইসলামিক টিভি চ্যানেল হিসেবে ‘ইকরা’ প্রতিষ্ঠা করেন।

এরপর থেকেই আমার বন্ধুরা প্রতি রমজানে মিডিয়া সংশ্লিষ্ট নানা জটিল বিষয়ের ফিকহী দিক নিয়ে সেমিনার আয়োজন করতে থাকেন, যেখানে প্রচুর আলোচনা ও গবেষণা হতো। এ ধরনের প্রথম সেমিনারটি ছিল বিনোদন প্রসঙ্গে। সেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল গান ও বাদ্যযন্ত্র, এসবের কী কী জায়েজ কিংবা নাজায়েজ, যেসবকে জায়েজ বলা হচ্ছে সেসবের  শরিয়তী ভিত্তি কী ইত্যাদি।

একদিন সেমিনার কর্তৃপক্ষ আমার কাছে এই বিষয়ের উপর একটা গবেষণামূলক নিবন্ধ চেয়ে বসলেন। কারণ তারা জানতেন, আমি অনেক আগে থেকেই এসব বিষয়, বিশেষত মিডিয়ার বিধানের উপর গুরুত্বারোপ করে আসছি। ‘ইসলামে হালাল হারামের বিধান’, ‘সমসাময়িক ফতোয়া’, ‘মুসলিম সমাজের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য’ এবং ‘ইসলাম ও শিল্পকলা’ শিরোনামের বইগুলোতে আমি এসব বিষয়ে লিখে এসেছি।

১৪১৯ হিজরীতে অনুষ্ঠিত ‘আল-বারাকাহ আল-ফিক্‌হিয়্যাহ আল-ই’লামিয়্যাহ’ শীর্ষক প্রথম সেমিনারের জন্য যে গবেষণা পত্রটি লেখা হয়েছিল, সেটিই মূলত এই বইয়ের ভিত্তি। আমার কিছু সুহৃদ পাঠককে দেয়া কথা রাখতেই গবেষণা পত্রটিকে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে বই আকারে ঢেলে সাজিয়েছি।

নিশ্চয় এই বইটি পরস্পর বিপরীতধর্মী কিছু প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিবে। কেউ কেউ বইটি পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হবে।

আবার কেউ কেউ বইটির সমালোচনায় মোটেও ছেড়ে কথা বলবে না। এই বই এবং এর লেখকের প্রতি তাদের প্রবল আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। গান ও বাদ্যযন্ত্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যে কোনো একাডেমিক লেখালেখির ক্ষেত্রে যেমনটা সচরাচর ঘটে থাকে।

কিন্তু আল্লাহ নিশ্চয় ভালো করে জানেন, আমি প্রথম গ্রুপকে খুশি করা কিংবা দ্বিতীয় গ্রুপকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য বইটি রচনা করিনি। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি বিষয়ে সত্য ও বাস্তবতাকে তুলে ধরা এবং সমসাময়িক শরীয়াহভিত্তিক ইজতিহাদের অবস্থা বর্ণনা করা, যে বিষয়ে সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচুর মতবিরোধ ও শক্তিশালী মতানৈক্য হয়ে আসছে।

সত্যি বলতে কি, গান (হোক তা মিউজিকসহ কিংবা মিউজিকবিহীন) ছাড়া আর কোনো বিষয়ে স্কলারদের ভেতর এতো বিরোধ, মতানৈক্য ও বিপরীতধর্মী বিধান দেয়ার ঘটনা আমি দেখিনি। ইমাম ইবনে জামায়াহ, বিদগ্ধ শাফেয়ী ফকীহ ইবনে হাজার আল-হাইতামীসহ অনেকেই এ প্রসঙ্গে জড়িয়েছেন।

অতীতে স্কলারগণ গানকে ‘আস-সামাউ’ (السماع – শোনা বা শ্রবণ করা) হিসেবে অভিহিত করতেন। কারণ, শ্রবণ করার বিষয়টি গানের একটি অপরিহার্য উপাদান। যেহেতু একজন গায়ক সচরাচর শোনানোর জন্যই গেয়ে থাকেন।

বিভিন্ন মাজহাবের ফকীহগণ গান ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন, সেসবের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করেছেন।

কখনো কখনো তাঁরা ‘বেচাকেনা’ অধ্যায়ের গানবাজনার যন্ত্র বেচাকেনা সংক্রান্ত হাদীস প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এ ধরনের  বেচাকেনা বৈধ নাকি অবৈধ, সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

আবার কখনো কখনো ‘বিবাহ’ অধ্যায়ের গান করা ও দফ বা সমজাতীয় কিছু বাজানো সংক্রান্ত হাদীস প্রসঙ্গে এ সংক্রান্ত আলোচনা করেছেন।

কখনো বা ‘সাক্ষ্য গ্রহণ’ অধ্যায়ের সাক্ষ্য প্রদানকারীর শর্তগুলো কী কী এবং গায়ক ও গানের শ্রোতার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে কি না, সে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গানের বৈধতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

অন্যায় বা অসৎ কাজ হাত দিয়ে পরিবর্তনের হাদীস, পরিবর্তনের শর্তসমূহ, গান করা অন্যায় বা অসৎ কাজের অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, সে প্রসংগে কথা বলতে গিয়েও তারা বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছেন।

স্কলারগণ প্রাচীনকালের ‘আস-সামাউ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করে গান ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রচুর আর্টিকেল ও বইপত্র লিখেছেন। এসব বইপত্র ও আর্টিকেলগুলোতে তাঁদের অবস্থান ছিল পরস্পর বিপরীতধর্মী এবং তাদের প্রদত্ত একেকটা রায় ছিল অন্যটার বিপরীত। কোনো শর্তযুক্ত না করে নির্বিচারে গানকে কেউ মুস্তাহাব বলেছেন, কেউ বলেছেন মুবাহ, কেউ মাকরুহ কিংবা হারাম পর্যন্ত বলেছেন। অবশ্য কেউ কেউ এ সম্পর্কে রায় দেয়ার ক্ষেত্রে শর্তযুক্ত করেছেন। প্রতিটি পক্ষই স্বীয় মাজহাবের আলোকে রেফারেন্স দিয়ে বিধান বর্ণনা করেছেন।

আল্লামা কাত্তানী তাঁর লেখা ‘আত-তারাতীব আল-ইদারিয়্যাহ্‌’ কিংবা ‘আল-হুকুমাহ্‌ আন-নাবাউইয়াহ্‌’ নামের মূল্যবান বই দুটিতে গানবাজনা বিষয়ে কে কী লিখেছেন, সেসব বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।

আমাদের সমসাময়িক কালেও অনেকে এ বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। এদের কেউ গানবাজনাকে হারাম বলেছেন, কেউ শুধু বাদ্যসহ গানকেই শুধু হারাম বলেছেন, কেউ গান ও বাদ্যযন্ত্র উভয়কে বৈধ বলেছেন, কেউ মাকরুহ বলেছেন। তবে তারা বিষয়ের গভীরে খুব একটা যাননি। আবার কেউ কেউ এ বিষয়টির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে শর্তসাপেক্ষে একে বৈধতা দিয়েছেন। আমি হলাম এই শেষোক্ত দলের ব্যক্তি।

আসলে বিষয়টি বিস্তৃত ও গভীর আলোচনার দাবি রাখে। বিশেষত রেডিও-টেলিভিশন আবিস্কার হওয়ার পর। এসব যন্ত্র মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে। ফলে সংকট আরো বেড়েছে। এছাড়া উম্মাহর জন্য এমন একটা বিষয়কে সহজ করার প্রয়োজন রয়েছে, যে বিষয়ে কোরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কোনো রেফারেন্স নেই। কারণ, ইসলামের আহবান তো পুরো বিশ্বের জন্য এবং সব সময়ের জন্য। ইসলাম পৃথিবীর কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট নয়। কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত নয়। কিংবা কোনো একটি প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ কারণেই ইসলামের সার্বজনীন বিধানগুলো মানুষের বিশেষ প্রেক্ষাপট-পরিস্থিতি, স্বভাব-প্রকৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠানকে বিবেচনায় রেখেছে। যেমন রাসূল (সা) বলেছেন– “নিশ্চয় গানবাজনা মদীনাবাসীকে আনন্দ দেয়…।” তিনি মসজিদে নববীতে হাবশীদেরকে তাদের বর্শাসমেত নাচার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই সাথে আয়েশার (রা) ঘরে দুজন বালিকার গান গাওয়ার অনুমতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন– “যাতে করে ইহুদীরা এটা জেনে নেয়, আমাদের দ্বীনের মাঝে নিশ্চয় প্রশস্ততা রয়েছে এবং আমাকে উদারতাসমেত প্রেরণ করা হয়েছে।”

তাই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে ফিকাহবিদদের উচিত সব পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রাখা। এর পাশাপাশি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ করে ফেলা উচিত নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে, শুধু আফ্রিকাই নয়, বরং ইউরোপ, এমনকি পুরো পশ্চিমা বিশ্বই গানবাজনার কাছে চরমভাবে মুখাপেক্ষী। তারা মিউজিককে (বিশেষত মিউজিকের কিছু প্রকারকে) আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উন্নতির মাধ্যম মনে করে।

কিন্তু এরমানে এই নয়, আমরা আমাদের দ্বীনকে মানুষের চাহিদা বা সন্তুষ্টির আলোকে পরিবর্তন করে ফেলবো। সে রকম কাজ করা হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। বরং এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, গান বা বাদ্য– যা সব মানুষকেই কমবেশি টানে ও ভাবায় – সেটি নিয়ে যখন আমরা গবেষণা করবো, তখন যেন উপরে বলা দৃষ্টিভঙ্গি ও বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনায় থাকে।

আমার ব্যাপারে কেউ কেউ রটিয়েছে, আমি নাকি শর্তহীনভাবে সব ধরনের গানকেই বৈধ বলেছি! নিঃসন্দেহে এটি একটি নির্ভেজাল মিথ্যা রটনা। মৌখিক বা লিখিত– কোনোভাবেই এমন কথা আমি কখনো বলিনি। কেউ যদি আমার ইতোপূর্বে প্রকাশিত বই ‘ইসলামে হালাল হারামের বিধান’, ‘সমসাময়িক ফতোয়া’, কিংবা ‘মুসলিম সমাজের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য’ বইয়ের বিনোদন ও শিল্পকলা অধ্যায়, অথবা ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বরূপ নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্য থেকে ‘ইসলাম ও শিল্পকলা’ বইটি পড়েন কিংবা উপরের সবগুলো বই পুরোপুরি পড়ে থাকেন; তাহলে তিনি নিশ্চিত দেখতে পাবেন, আমি কখনোই গানবাজনাকে শর্তহীনভাবে জায়েজ বলিনি। বরং বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে একে বৈধ বলেছি। গানের গুণগত মান কেমন, এর পেছনে অত্যাধিক সময় ব্যয় হচ্ছে কিনা, বিষয়বস্তু কী, গানের মাঝে কোনো অশ্লীল ইঙ্গিত রয়েছে কি না এবং বাস্তবে এর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে– এইসব বিষয় বিবেচনা করার কথা বলেছি। এছাড়া কোন বিষয়গুলো একটি হালাল গানকে হারামে পরিণত করে এবং বৈধতা থেকে নিষেধাজ্ঞার দিকে নিয়ে যায়, সেসব নিয়েও কথা বলেছি।

আমি শুরু থেকেই বলে আসছি, আরব দেশগুলোর টিভি চ্যানেলগুলোতে আজকাল সাধারণত যেসব গান দেখানো হয় সেগুলোতে বেহায়াপনা, অশ্লীল নাচ এবং আবেদনময়ী, প্রায় উলঙ্গ বা একেবারে নগ্ন নারীদের উপস্থিতি ইত্যাদি থাকে। আধুনিক কালের গানগুলোতে এই অশ্লীল উপাদানগুলো একেবারে নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। তাই এ ধরনের গানগুলো নিঃসন্দেহে অবৈধ। তবে এ জাতীয় গানগুলো গান হওয়ার কারণেই যে অবৈধ হয়েছে, ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। বরং এসব গানের ভেতর অশ্লীলতা ও ভ্রান্ত উপাদান বিদ্যমান থাকার কারণেই তা অবৈধ হয়েছে। ফলে গান এখন শোনার পরিবর্তে দেখার বিষয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, গানগুলো এখন অশ্লীল নাচে রূপান্তরিত হয়েছে।

শায়খ আলবানীর উপদেশ ও তার পর্যালোচনা: 

বিশিষ্ট স্কলার ও প্রসিদ্ধ হাদীসবেত্তা শায়খ মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন আল-আলবানী (আল্লাহ তাঁর প্রতি দয়াশীল হোন) আমার লেখা ‘ইসলামে হালাল হারামের বিধান’ বইয়ের হাদীসগুলোর পর্যালোচনা হিসেবে ‘গায়াতুল মারাম’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি ৩৯৯ নম্বর হাদীসটির প্রসঙ্গ তুলেছেন। এই হাদীসটিতে ঈদের দিন আল্লাহর রাসূলের ঘরে দুজন বালিকার গানবাজনা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসটি যাচাই-বাছাই, আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে  শায়খ আলবানী বলেছেন– লেখকের কাছে আশা করবো, গানবাজনা প্রসঙ্গে ইবনে হাযম এবং ইবনুল আরাবীর যে মতামত তিনি উল্লেখ করেছেন সেটিকে পুনর্বিবেচনা করবেন এবং বিষয়টি নিয়ে আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে একাডেমিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা করবেন। কারণ, যে বিষয়টি হারাম হওয়ার ব্যাপারে চার মাজহাবই একমত এবং এর সমর্থনে বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে, সে বিষয়টিকে সমর্থন করা কোনো সম্মানিত স্কলারের জন্য শোভনীয় নয়।[1]

এরপর আমি শায়খ আলবানীর অনুরোধ রক্ষায় নেমে পড়ি। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে এ বিষয়ে আরো গভীর ও খুঁটিনাটি পড়াশোনা করি। কিন্তু শায়খ আলবানী যেমনটি চেয়েছিলেন আমার এই পড়াশোনার ফলাফল তেমনটি দাঁড়ায়নি।

শায়খ আলবানী যেসব কথা বলেছেন, সেগুলোর উপর বেশ কিছু পর্যালোচনা উপস্থাপন করছি:

প্রথমত, সুনিশ্চিতভাবে গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে চার মাজহাব কখনোই একমত ছিল না। বিশেষত শাফেয়ী মাজহাব। এ প্রসংগে বলতে গিয়ে ইমাম গাজ্জালী উদ্ধৃত করেছেন, “আমোদ-প্রমোদ, গানবাজনা হলো মাকরুহ। কেননা, এসব জিনিস অনর্থক কাজের অনুরূপ।” কামাল আল-আদফাভী ‘আল-ইম্‌তাউ’ গ্রন্থেও চার ইমামের মতামত সম্পর্কে ঠিক এমনটাই উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, ফিকাহবিদদের ইজমা বা সার্বজনীন ঐক্যমতকে লংঘন না করাই উচিত, যেহেতু উম্মাহ সম্মিলিতভাবে ভ্রষ্টতার উপর একমত হবে না। পক্ষান্তরে, চার মাজহাব বা আট মাজহাবের কোনোটিই সম্পূর্ণ নির্ভুল হবার শতভাগ সম্ভাবনা রাখে না। যেমনটা আমরা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার তৎপরতা থেকে দেখতে পাই। তিনি তালাকসহ বেশ কিছু বিষয়ে চার মাজহাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। এজন্য তাকে জেলে  যেতে হয়েছিল এবং শাস্তি পেতে হয়েছিল। আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ, গানবাজনা একটি মতবিরোধপূর্ণ বিষয়। বরং এটি সবচেয়ে বেশি মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। ইমাম ইবনে জামআহর বরাতে আমরা তা উল্লেখ করেছি।

তৃতীয়ত, মাজহাবের বশ্যতা স্বীকারে যারা সবচেয়ে বেশি অনিচ্ছুক, মাজহাবপন্থীদের বিরোধিতায় যারা কঠোর, শায়খ আলবানী স্বয়ং তাঁদের একজন। তাঁর নিজেরই অনেক মতামত রয়েছে, যেগুলো চার মাজহাবের সম্পূর্ণ বিপরীতে যায়। এমনকি তাঁর এমন অনেক মতামতও আছে, যেগুলো ইজমার সম্পূর্ণ বিপরীত। মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত স্বর্ণ হারাম হওয়ার প্রসঙ্গসহ আরো কিছু ইস্যুতে তার প্রদত্ত মতামতকে  উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, যিনি নিজেই মাজহাবের বিপরীতে গেলেন, তিনিই যদি এ বিষয়ে অন্য কারো বিরোধিতা করেন, তখন আর কী বলার থাকে?

তাই আমি এই বইটি লিখতে বসেছি এই আশায়, আল্লাহ চাইলে এর মধ্য দিয়ে সত্যকে তুলে ধরা, দ্বীনের সেবা করা, দ্বীনকে মানুষের কাছে প্রিয় করা তোলার মতো কাজগুলো সম্পন্ন হবে। পাশাপাশি দ্বীনের বিশ্বজনীনতা, স্থায়িত্ব, মধ্যমপন্থা, সহজতা এবং প্রশস্ততাও ঠিকঠাকভাবে রক্ষা করা যাবে। তাই আল্লাহর কাছে সবিনয় মিনতি, তিনি যেন আমাকে অনুগ্রহ করেন এবং তৌফিক দান করেন। আমি যদি সঠিক হই, তাহলে আমাকে যেন দুটো বিনিময়ই প্রদান করেন। আর যদি ভুল করি, তাহলে আমাকে যেন একটি বিনিময় পাওয়া থেকে বঞ্চিত না করেন। আল্লাহই একমাত্র সফলতা প্রদানকারী, তাঁর উপরই ভরসা করছি এবং আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।

[মূল: ইউসুফ আল-কারযাভী, অনুবাদ: শাইখুল আবরার]

অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

রেফারেন্স:

[1] গায়াতুল মারাম, ১ম সংস্করণ, প্রকাশনী: আল-মাকতাব আল-ইসলামী, পৃষ্ঠা: ২২৭।

এ ধরনের আরো লেখা