বিনোদন সংস্কৃতির সংকট প্রসঙ্গে

বর্তমান সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে, এমনকি বিশ্বব্যাপী ইসলামিস্টদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেশাগত উৎকর্ষতা অর্জন করা এবং সেসব ফিল্ডে ব্যবহারিক নীতিবিদ্যাকে (applied ethics) প্রাসঙ্গিক করে তোলা। আরেকটা সমস্যা হলো, সমকালীন সমস্যাবলি সমাধানে ব্যবহারিক নীতিবিদ্যার যথাযথ প্রয়োগের বিষয়কে কার্যকরভাবে বিবেচনা না করা। এ কাজটি একাধারে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও যোগ্যতাসাপেক্ষ ব্যাপার, যা কেবল ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হলেই সম্ভব নয়। কেননা আজকের পৃথিবীতে প্রতিটা বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি এতো ব্যাপক যে, কোনো একটি বিষয়ে গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে অন্য কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া অসম্ভব-প্রায়। একজন ইসলামী বিশেষজ্ঞের পক্ষে অর্থনীতি বা মেডিক্যাল সায়েন্স সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব। অতএব, কোনো বিষয়ের পেশাগত এথিকসের সীমারেখা নিরূপণ করতে হলে উভয় ধরনের বিশেষজ্ঞের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

যেসব ফিল্ডে ইসলামের ব্যবহারিক নীতিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হলো সংস্কৃতি। নিম্নমানের আর্ট-কালচার এবং বিনোদনের অগ্রহণযোগ্য উপাদানগুলোর নেতিবাচক প্রচারণাতেই ইসলামিস্টদের অধিকাংশ প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। অথচ আর্ট, কালচার এবং বিনোদনের বিভিন্ন ইসলামসম্মত উপায়-উপকরণ আছে। বিরোধী সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেবল নেতিবাচক সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। সমালোচনার পাশাপাশি সমাজের মূল স্রোতের মানুষদের আকৃষ্ট করার মতো মানসম্মত বিকল্প উপস্থাপন করতে হবে।

ইসলামিস্টদের মধ্যে যারা মূলধারার বিকল্প হিসেবে নাটক, গান, সিনেমা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাজগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব সীমিত পর্যায়ের উদ্দেশ্য পূরণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে আবেদন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। মানের দিক থেকেও তাদের এসব কাজ খুব সাধারণ মানের। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। সাদামাটাভাবে বলতে গেলে, এ সমস্যার মূলে রয়েছে পেশাগত উৎকর্ষতার অভাব। পাশাপাশি তারা এ ইসলামী নীতিমালা সম্পর্কে সচেতন নন। বিনোদন কী, এর উদ্দেশ্য কী, এর উপায় ও সীমারেখা কতটুকু- এসব তত্ত্বগত মৌলিক প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করতে  হবে। এর ফলে স্থানীয় প্রেক্ষিতের আলোকে এ সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালা তৈরি হবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্ট, কালচার ও বিনোদনের বিভিন্ন উপায়ের যে বৈধ সীমারেখা ইসলামে রয়েছে, এর সবটুকু ব্যবহার করা হচ্ছে না। অব্যবহৃত থাকার ফলে এ ফিল্ডে প্রতিযোগিতা করাও সম্ভব হচ্ছে না। যেমন- আর্টের কথা শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে- ‘ছবি আঁকা হারাম’। ফলে বর্তমান সময়ে খুব জনপ্রিয় এ ফিল্ডে বলার মতো ভালো কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি। ইসলামিক আর্ট বললেই আমাদের চোখের সামনে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি ভেসে ওঠে। অথচ ভিনসেন্ট ভ্যানগগের ‘সানফ্লাওয়ার‘ ছবিটাও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোপুরি ঠিক আছে।

আরেকটা আলোচ্য বিষয় হতে পারে সিনেমা। অনেকেই ইসলামী সীমারেখা মেনে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ভালো মানের সিনেমা তৈরি করতে চান। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা যদি উপরের উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত না থাকেন তাহলে দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে –

১। তিনি খুব সাধারণ মানের কিছু তৈরি করবেন। কারণ তার মনে ইসলামের বৈধ সীমারেখা অতিক্রমের আশংকা জেঁকে বসবে। এর ফলে তিনি হয়তো বৈধ সীমারেখার শতভাগ ব্যবহার না করে মাত্র ২০ ভাগ ব্যবহার করবেন। অথচ, ভালো চলচ্চিত্র তৈরি করার পরও প্যারিস-মেক্সিকোর মতো এককালের বিখ্যাত ইন্ডাস্ট্রিগুলো হলিউডের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাই এখন আর সেসব জায়গায় আগের মতো চলচ্চিত্র তৈরি হয় না। হলিউডের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের পাশাপাশি আমাদের পাশের দেশেই আছে বলিউড। আজকাল কলিউডের চাইনিজ সিনেমাও অনেক উপরে উঠে এসেছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানের সিনেমা প্রতিযোগিতায় কতটুকু টিকে থাকতে পারবে?

২। যদি কেউ ইসলামী নীতিমালা মেনে সিনেমা তৈরি করতে চায়, কিন্তু এ ফিল্ডে ইসলামী নীতিমালার বৈধ সীমারাখা সম্পর্কে সচেতন না থাকে; তাহলে চটকদার কিছু করতে গিয়ে বৈধ সীমারেখার বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এটি আর দশটা সিনেমার মতো একটা সাধারণ সিনেমায় পরিণত হবে।

কাজেই, বিনোদনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ইসলামিক রেসপন্স যারা তৈরি করতে চান, তাদেরকে প্রথমে সে বিষয়ের তত্ত্বগত দিক ও ব্যবহারিক নীতিমালা সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো পেশাগত দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। যেমন– প্রতিযোগিতামূলক সিনেমা বানাতে হলে প্যারিস-আমেরিকা না হোক, অন্তত ইরানে গিয়ে একাডেমিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচলিত মাধ্যম বা উপায়ের সামান্য সংযোজন-বিয়োজন করেই ইসলামী নীতিমালা তৈরি করা সম্ভব।

প্রফেশনাল এথিকস তৈরির ফিল্ডে CILE কাজ করা শুরু করেছে। সংস্থাটি বায়ো-এথিকস নিয়ে কিছু দূর অগ্রসরও হয়েছে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কাজ করছে। এসব কাজের উল্লেখযোগ্য ফলাফল হয়তো সামনে পাওয়া যাবে। এ অবস্থায় তরুণ প্রফেশনালদের নিজ নিজ ফিল্ডে ইসলামী নীতিমালা তৈরিতে ভূমিকা রাখা বা কমপক্ষে যারা কাজ করছে তাদের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। একইসাথে পরিবেশ, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, বিনোদন, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতির মতো আলোচিত বিষয়গুলোতে পেশাগত দক্ষতা অর্জন এবং ব্যবহারিক নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে সময়োপযোগী ভূমিকা রাখা জরুরি। ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

নিকট ভবিষ্যতে স্কলার এবং প্রফেশনালদের সমন্বয়ে এমন প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যা আধুনিক সময়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন এবং বিভিন্ন ফিল্ডে রেসপন্স তৈরির সামর্থ্য রাখে। নিজেরাই নিজেদের বাস্তবতা এবং সমস্যা সমাধানে স্থানীয়ভাবে এ রকম প্লাটফর্ম তৈরি  করা গেলে অন্যদের কাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।

এ ধরনের আরো লেখা