অনুবাদের দিক-বিদিক

অনুবাদের দিক-বিদিক

এডিটর’স নোট: বিভিন্ন আর্টিকেল, বই, লেকচার, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি অনুবাদ ও সম্পাদনা করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে– একটি সার্থক ও সাবলীল অনুবাদের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখা উচিত, সে ব্যাপারে একটা গাইডলাইন থাকা জরুরি। এই তাগিদ থেকে সিএসসিএসের পরিচালক জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) ও জনাব ইব্রাহিম হোসেন (সহযোগী অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এ বিষয়ে খোলামেলাভাবে মতবিনিময় করেন। সে আলোচনাটি পরিমার্জন করে অনুবাদ সংক্রান্ত এই গাইডলাইনটি প্রস্তুত করা হলো। আমাদের ধারণা, যে কোনো অনুবাদকের জন্য এই গাইডলাইনটি সহায়ক হবে।

*****

অনুবাদ কেমন হলে ভালো হয়?

অনুবাদ কেমন হওয়া উচিত– এই প্রশ্নের ‘সাদা-কালো’ কোনো জওয়াব নাই। মোটের উপর বলতে গেলে অনুবাদ সংক্রান্ত মূল বিরোধ বা প্রশ্ন হলো অনুবাদ আক্ষরিক হবে না ভাবানুবাদ হবে।  কোনো আইনগ্রন্থের অনুবাদ হলে সেটা যথাসম্ভব আক্ষরিক হওয়া উচিত। আবার কনসেপ্ট বা আইডিওলজি হলে আক্ষরিক অনুবাদ না করে ভাবানুবাদ করাই বাঞ্ছনীয়। Sense for sense। কেউ যদি বলে “আমার রেফ্রিজারেটরের মধ্যে কিছু রাইনো (Rhino) আছে। প্রতিদিন সকালবেলা এর কয়েকটি নিয়ে রস বের করে খাই।” রাইনো শব্দের অর্থ গণ্ডার হলেও এখানে রাইনো বলতে কোনো রসালো ফল বুঝতে হবে। হতে পারে কমলালেবু কিম্বা অনুরূপ ধরনের কোনো ফল।

দূরবর্তী অর্থ

মূল টেক্সটে লেখক নির্দিষ্ট একটি শব্দ বা বাক্য দিয়ে যা বুঝিয়েছেন, তা তুলে আনতে গিয়ে অনুবাদক যদি প্রচলিত শব্দের চেয়েও একটু দূরবর্তী অর্থের কোনো শব্দ দিয়ে ওই সেন্সটা ক্লিয়ার করতে পারেন, তাহলে সেটাই করা উচিত। অর্থাৎ অনুবাদ যত বিশ্বস্ত এবং আক্ষরিক হবে সেটা ততটাই দুষ্পাঠ্য হবে। সুখপাঠ্য এবং সাবলীল অনুবাদ হতে হলে সেটা ভাবানুবাদ হওয়া উচিত।

টীকা এবং প্যারা

অনুবাদক যদি মনে করেন কোনো বক্তব্য স্পষ্ট করার জন্যে মূল লেখকের আরো বিস্তারিত লেখা দরকার ছিল, তাহলে তিনি টীকা দিয়ে তা স্পষ্ট করতে পারেন। আরেকটা লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, মূল লেখায় থাকুক বা না থাকুক অনুবাদের মধ্যে খুব দীর্ঘ প্যারা না থাকাই ভালো। এক পৃষ্ঠায় কমপক্ষে ৩/৪টা প্যারা থাকা দরকার। প্রতিটা পয়েন্টের আগে টাইটেল-সাবটাইটেল দিলে আরো ভালো হয়।

অনুবাদের যোগাযোগ সক্ষমতা (communicability)

অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘How communicative is the translation?’ প্রশ্নটি সবিশেষ গুরুত্ববহ।  এর উত্তর হচ্ছে, অনুবাদের মাধ্যমে মূল লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। অনুবাদকে আয়নার সাথে তুলনা করা যায়। আয়নার সামনে যা থাকে, সেটা তেমনভাবেই রিফ্লেক্ট করে। অনুবাদের ইতিহাসে বিভিন্ন দিকে গুরুত্বারোপের হদিস পাওয়া যায়। একেবারে শুরুর দিকে, বাইবেল অনুবাদের সময়, আক্ষরিক অনুবাদকে অনুসরণ করা হতো। এক পর্যায়ে দেখা গেলো, শুধু শব্দকে গুরুত্ব দিলে অর্থ ঠিক থাকে না বা অর্থটা  সাবলীল হয় না। সমাধান হিসাবে সাবলীল অর্থের উপর জোর দিতে গিয়ে দেখা গেলো বাক্য কাঠামোতে অনেক ধরনের পরিবর্তন আসছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে এখন এটাই ধারণা করা হয়, word translation, meaning translation, syntax  translation, semantics translation, এমনকি phonetics translation-ও যদি সম্ভব  হয়, তাহলে সেটাও করতে হবে। বলা হচ্ছে, সম্ভাব্য সব ধরনের অনুবাদই হতে পারে। যদিও semantic translation তথা অর্থগত অনুবাদ বা ভাবানুবাদ এবং syntactic translation তথা কাঠামোগত বা শাব্দিক অনুবাদ আসলে একই টেক্সটে ধারণ করা সম্ভব হয় না।

অনুবাদকার্য হলো আয়নার মতো

অনুবাদককে যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে যেন অনুবাদটা কৃত্রিম না হয়ে যায়। যেমন অনেক আয়নার মধ্যে ঢেউ থাকে এবং ওই ঢেউয়ের কারণে মনে হয় এটা আয়না। কিন্তু এটা যদি একেবারেই মসৃণ হতো তাহলে এটাকে আর আয়না বলে মনেই হতো না। তারমানে অনুবাদটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে মূল সোর্স সম্পর্কে অবহিত না থাকলেও পাঠকের যেন মনে না হয় যে এটা একটা অনুবাদ। এজন্য অনুবাদকার্যকে স্বচ্ছ ও মসৃণ কাচের সাথেও তুলনা করা যায়।

সংশ্লিষ্ট ভাষাদ্বয়ের গঠনগত ভিন্নতা

মনে করুন, ইংরেজিতে আড়াই লাইনের একটা বাক্যকে বাংলা অনুবাদেও আড়াই লাইনের একটা বাক্য করা হলো। তাতে জিনিসটা তো জটিল হয়ে গেলো। হতে পারে অনুবাদকের ইংরেজিতে যতটা দক্ষতা আছে, বাংলা ভাষার উপর তার ততটা দক্ষতা নেই বা বাংলা লেখার হাত তত ভালো না। একজন অনুবাদককে দুইটা ভাষায়ই সমান পারদর্শী হতে হবে। অনুবাদকের দক্ষতা না থাকলে লেখকের সাথে পাঠকের যোগাযোগের ব্যাপারটা আর হয়ে ওঠে না। ফলে যে উদ্দেশ্যে অনুবাদটা করা হয় সে উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। একটা অনুবাদের সফলতা নির্ভর করছে অনুবাদটা লেখকের সাথে পাঠকের কতটা যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারছে, তার ওপর।

এছাড়া একটা বাক্যকে অনুবাদের সময় ভেঙ্গে কয়টা বাক্য বানানো হচ্ছে, তাও একটা বিষয়। আরেকটা ব্যাপার হলো, ইংরেজি থেকে বাংলা অথবা বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের সময় বাক্যের গঠন ঠিক না থাকা। কারণ, এই দুইটা ভাষার বাক্যের গঠনই (syntax) আলাদা। ইংরেজিতে যেমন ‘পিরিয়ডিক সেনটেন্স’ থাকে, বাংলায় সাধারণত তেমনটা থাকে না। যে বাক্যগুলো অনেক লম্বা, অনেকগুলো বাক্যাংশ (clause) নিয়ে গঠিত হয়, সেগুলোকে ‘পিরিয়ডিক সেনটেন্স’ বলে। এ রকম বাক্য ইংরেজি থেকে হুবহু অনুবাদ করতে গেলে সাধারণত জিনিসটা ততটা স্পষ্ট ও গতিশীল হয় না। সেক্ষেত্রে এটিকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পুনঃউপস্থাপন (reproduction) করাটা জরুরি।

উদ্দিষ্ট ভাষাভাষীদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য

অনুবাদকর্মের সাথে সাংস্কৃতিক ব্যাপারগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা অনুবাদে কোকাকোলা কালচারকে অনুবাদক ডিজ্যুস কালচার হিসেবে লিখেছেন। অথচ মূল লেখায় ডিজ্যুস কথাটাই নাই, তাহলে অনুবাদে এটি কীভাবে এল? কোকাকোলা কালচার মানে হলো একটু কোকাকোলা টানো আর একটু ফুর্তি করো, টিজ করো, এটা করো, সেটা করো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো আমাদের দেশে কোকাকোলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নাই। বরং মোবাইল ফোন অপারেটরদের যে ডিজ্যুস প্যাকেজ – প্যাকেজ নাও, কথা বলো – একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানে কোকাকোলাকে শুধুমাত্র একটা আইটেম বা পানীয় হিসেবে বুঝানো হয় নাই, বরং তারুণ্যের প্রতীক হিসেবেই বুঝানো হয়েছে। তাই ‘কোকাকোলা কালচারের’ বাংলা ‘ডিজ্যুস কালচার’ লেখাটা যথার্থই হয়েছে।

যদি সেখানে wine culture বলা হতো, তাহলে এর তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা ভিন্ন হতো। সেটা কিন্তু তারুণ্যের সাথে মানানসই হত না। কারণ এই ওয়াইন কালচারটা সেক্ষেত্রে একটা ধর্মীয় বা সামাজিক  মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হতো। কারণ পশ্চিমে একটা ওয়াইন কালচার আছে। সে কারণে একে হয়তো ডিজ্যুস কালচার হিসেবে অনুবাদ করলে সঠিক হতো না। বরং অন্য কিছু অনুবাদ করতে হতো।

অনুবাদকের হীনম্মন্যতাবোধ

অনুবাদকর্মের আর একটা লক্ষ্যণীয় দিক হলো অনুবাদকরা সাধারণত এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তারা মনে করেন, মূল লেখক যা বলেছেন অনুবাদক হিসেবে আমার পরম নৈতিক কর্তব্য হলো তা যথাসম্ভব হুবহু তুলে ধরা। এটি করতে গিয়ে অনুবাদক মূল বিষয়ের প্রতি সামগ্রিকভাবে আন্তরিক থাকার চেষ্টা না করে বরং সেখানে word to word, clause to clause, sentence to sentence পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুবাদের প্রয়াস পান। এটা করতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যে ভাবটা প্রকাশ পাওয়ার কথা সে ভাবটা বাধাগ্রস্ত হয়।

অনুবাদ একটা সহ-সৃষ্টি

আরেকটা ব্যাপার হলো, কোনো অনুবাদের পাঠক তার মাতৃভাষার নিজস্ব শব্দমালা, বাক্যশৈলী, উপমা ও উৎকর্ষতার সাথে পরিচিত। কিন্তু বিদেশি ভাষার মধ্যে এমন ধরনের কিছু বিষয় আছে যেগুলোর সাথে পাঠক পরিচিত নয়। কারণ, সেগুলো তার ভাষায় প্রচলিত নয়। অন্যদিকে, বাংলা ভাষায় এমন অনেক উচ্চমার্গীয় শব্দ, বাক্যশৈলী, উপমা ও উৎকর্ষতা রয়েছে যেগুলো সাধারণ পাঠকের কাছে পরিচিত নয়। অনুবাদ করার সময় এ ধরনের উচ্চমার্গীয় ভাষাশৈলী ব্যবহার করলে অনুবাদটা সব ধরনের পাঠকের জন্য উপযোগী হবে না। এটি অনুবাদকের এক ধরনের ‘নির্দোষ ভুল’। এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সততা থেকেই এটি হয়। অতএব, অনুবাদককে co-creator-এর মানসিকতা পোষণ করতে হবে। হীনম্মন্যতায় ভুগলে চলবে না।

নির্দেশিত অর্থ বনাম আরোপিত অর্থ

অনুবাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, একটা পর্যায় পর্যন্ত অনুবাদকদের এক প্রকার পিউরিটানিজম তথা পরম-শুদ্ধতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে একটা অক্ষর, শব্দ বা বাক্যের কোনো মূল্য নাই, যদি এর semantic ব্যাপারটা না আনা হয়। যেমন কেউ যদি ডিকটেশন দেওয়ার সময় বলে– I am hungry, তখন এ বাক্যের এক রকম অর্থ হবে। কিন্তু সত্যিই কেউ ক্ষুধার্ত অবস্থায় যদি বলে– I am hungry, তখন কিন্তু এর অন্য রকম অর্থ হবে। আবার ধরুন, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে Go শব্দটির বিভিন্ন রকমের অর্থ হতে পারে। তারমানে, একটা শব্দের মূল্য হচ্ছে শব্দটা কী অর্থ প্রকাশ করছে, তারমধ্যে। শব্দের অবস্থানের মধ্যেই তার মূল্য নির্ধারিত নয়। অনুবাদক যদি শব্দের অবস্থান থেকে সঠিক অর্থটা বের করে আনতে না পারেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট শব্দ বা বাক্যে নির্দেশিত অর্থ ও মূল্যকেই অবমূল্যায়ন করা হয়। অনুবাদকের সততার দৃষ্টিভঙ্গির ফলে লেখক-নির্ধারিত অর্থ ও প্রকাশিত শব্দ/বাক্য মূল্য পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের আরোপিত অর্থ বা মূল্য সংযোজন যাতে না ঘটে, অনুবাদককে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাগধারার অনুবাদ

অনুবাদকের ভালোমানের ভাষাগত দক্ষতা না থাকলে অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক  ভুল হতে পারে। যেমন,  প্রত্যেকটা ভাষাতেই বাগধারার প্রচলন (idiomatic expression) আছে। বাগধারায় যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর পৃথক পৃথক শাব্দিক অর্থের বাইরে ভিন্ন কোনো সমন্বিত অর্থেই উক্ত শব্দসমষ্টিকে ব্যবহার করা হয়। যেমন ‘pull up your socks’ একটি ইংরেজি বাগধারা। মনে করুন, একজন অনুবাদক তার প্রাথমিক স্তরের ভাষাদক্ষতা থেকে pull-এর অর্থ জানেন, pull up-এর মানেও বুঝেন, sock-এর মানেও বুঝেন। এখন তিনি এটার অনুবাদ করতে পারেন, ‘তোমার মোজা টেনে ধর’। অথচ এর প্রকৃত মানে হবে, ‘তোমার আচরণ সংশোধন কর’ (improve your behaviour)।

লেখকের সৃজনশীলতা বেশি, নাকি অনুবাদকের?

অনুবাদ হলো এক ধরনের সহ-সৃষ্টি। মূল লেখক হলেন প্রথম সৃজনশীল ব্যক্তি। অনুবাদক হলেন তার সহ-স্রষ্টা। আপাতদৃষ্টিতে অনুবাদকে সহজ কাজ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা মোটেও সহজ নয়। কারণ, মূল লেখক লেখার সময়ে কোনো চৌহদ্দির তোয়াক্কা না করেই লিখে থাকেন। কিন্তু অনুবাদকের জন্য তা অবারিত থাকে না। মূল লেখক কোনো একটা বিষয় তার নিজস্ব ভাষায় সরাসরি তুলে ধরেন। তাই তার দেখার বিষয় হলো সংশ্লিষ্ট উপজীব্য বা field ও ব্যবহৃত ভাষা। অন্যদিকে, অনুবাদকের কাজ হলো মূল লেখকের সংশ্লিষ্ট field ও ব্যবহৃত ভাষা পর্যবেক্ষণ করা। তারপর বাংলা ভাষার পাঠকরা বিষয়টাকে যেভাবে দেখেন তা বিবেচনা করে তাকে উপযোগী ভাষায় উপস্থাপন করা। এই দৃষ্টিতে অনুবাদ নিজেই স্বতন্ত্র একটা ধারা ও স্বাধীন শিল্প। সর্বোপরি, অনুবাদ হলো একটি দুরূহ কাজ।

অনুবাদ হলো সহজীকরণ

সাধারণত যত কম শিক্ষিত ব্যক্তি অনুবাদ করেন, সেটা ততটাই বাজে হয়। তাই যিনি অনুবাদ করছেন, সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে তার যথাসম্ভব ভালো জ্ঞান তথা বিষয়-দক্ষতা থাকা দরকার। অথচ উচ্চশিক্ষিত লোকেরাই ‌‌তথাকথিত সঠিক অনুবাদের দোহাই দিয়ে এমনসব বিদঘুটে, অপ্রচলিত ও বুৎপত্তিগত শব্দ, পরিভাষা ও বাক্যের অবতারণা করেন, যা নিতান্তই অগ্রহণযোগ্য। এ জন্য দেখা যায়, যে শব্দ বা পরিভাষার অনুবাদ করা হয় তা পাঠকের কাছে মূল শব্দ বা পরিভাষার চেয়েও কঠিন হিসেবে প্রতীয়মান হয়! দর্শন বিষয়ক বাংলা পাঠ্যপুস্তকসমূহে Universal শব্দটির বাংলা করা হয়েছে ‘সামান্য’। অথচ এর যথার্থ পরিভাষা হতে পারে ‘সাধারণ’। Universalization বুঝানোর জন্য ‘সামান্যীকরণ’কে পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর অনুবাদ করা উচিত ছিল ‘সর্বজনীনকরণ’ বা ‘সাধারণীকরণ’।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ দৃশ্যত বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সংস্কৃতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার পক্ষপাতী। এটি ভুল। এক্ষেত্রে বিদেশি কোনো শব্দ বাংলা ভাষায় প্রচলিত হয়ে গেলে সেটিকে অনুবাদের সময় প্রতিবর্ণায়ন করে দেয়াই যথেষ্ট। তা না করে সংশ্লিষ্ট শব্দ বা পদটির (term) ইতোমধ্যেই প্রচলিত অর্থের পরিবর্তে সেটির বুৎপত্তিগত অর্থকে অনুবাদের মধ্যে নিয়ে আসাটা সমীচীন নয়। সারকথা হলো, মূল রচনা কিম্বা অনুবাদ – উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ভাষার নিয়মাবলি জানা থাকাটা যত জরুরি, মেনে চলা ততটা নয়। অনুবাদক যদি যান্ত্রিকভাবে ব্যাকরণ-বিশ্বস্তই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাহলে তাঁর জন্য ‘ম্যানুয়েল অনুবাদে’র ঝামেলায় না গিয়ে Google translator-এর সহায়তা নেয়াই যথার্থ হবে! ব্যাকরণের কাজ নির্দেশনামূলক, নির্দেশ করা নয়।

অনুবাদ করাটা বড় কথা নয়; অনুবাদটি কতটা সহজবোধ্য হলো, তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এ ধরনের আরো লেখা