ইসলামী চিন্তার সংস্কার: কোথায়, কেন ও কীভাবে
[এডিটর’স নোট: অধ্যাপক তারিক রমাদানের বিখ্যাত বই ‘Radical Reform: Islamic Ethics and Liberation’ এর ভূমিকার উপর গত ২৮ নভেম্বর সিএসসিএস-এর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়স্থ অস্থায়ী কার্যালয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো: আবদুল মান্নান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটি তুলে ধরা হলো।]
*****
ইসলামের ব্যাপারে যখন ‘সংস্কার’ শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখন নিষ্ঠাবান মুসলমানরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এর কারণ তিনটি: (১] ইসলামের সংস্কার বলতে ইসলামের আমূল পরিবর্তন বলে মনে করা; (২] মনে হতে পারে যে সংস্কারপন্থীরা আসলে পশ্চিমা চিন্তা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন (অনৈসলামী) উপাদান ইসলামের মধ্যে সংযোজন করতে চান; (৩] আল্লাহ প্রদত্ত সার্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ জীবনবিধান ইসলামের ব্যাপারে ‘সংস্কার’ কথাটি স্ববিরোধী। এই ধরনের উদ্বেগের ফলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে দৃশ্যত সংস্কারবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়।
সংস্কার কোথায় ও কেন?
সংস্কারবাদীরা যেসব বিষয়ে কথা বলছেন সেসবের দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায়, উপর্যুক্ত উদ্বেগগুলোর কোনোটিই সংস্কারের কুফল নয়। বরং কথিত সংস্কারবাদীগণ এমন কিছু জায়গায় সংস্কারের কথা বলছেন যা উপর্যুক্ত ঈমানী চেতনার সাথে শুধু সংগতিপূর্ণই নয়, বরং অনুরূপ সংস্কারকার্য এহেন চেতনার জন্য অপরিহার্য দাবি।
এ ক্ষেত্রে ‘বৃষ্টি ও ছাতা’র উদাহরণটি বিবেচ্য। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মাথার উপর ছাতা ধরা হয়। কোনো সময় বৃষ্টির পানি যদি খাড়াভাবে না পড়ে তীর্যকভাবে পড়ে, আর তখনও যদি ছাতাটি বৃষ্টির অবস্থা বুঝে হেলিয়ে না ধরে মাথার উপর খাড়াভাবেই ধরে রাখা হয়, তাহলে ছাতা ব্যবহারের উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থ হবে। বৃষ্টির অবস্থা বুঝে ছাতার এই দিক পরিবর্তনের সাথে ছাতার নিজস্ব গঠন-প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন হয় না।
ইসলামের নয়, ইসলাম ও জগৎ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে মুসলিম মানসের পরিবর্তন
সংস্কার প্রস্তাবনামাত্রই ইসলামের চিরন্তন কাঠামোর সংস্কার নয়; বরং ইসলামের প্রকৃত রূপ অনুধাবন করে মানবজীবনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামের অধিকতর উপযোগিতা প্রমাণ করার জন্য মুসলিম মানসের পরিবর্তন। মুসলমানদের চিন্তার মধ্যে এক পদ্ধতিগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হয় এই সংস্কারের মাধ্যমে। কোরআন-সুন্নাহর চিরন্তন সত্য ও সুন্দরের অনুসন্ধানে কোনো প্রকার কুসংস্কার (prejudice) ও স্থবিরতা (stagnancy) যেন ইসলামের প্রকৃত রূপ তুলে ধরার পথে বাধার কারণ হতে না পারে। যে নদীর স্রোত সতত প্রবহমান, সে স্রোত যেন থেমে না যায়।
ইসলাম হলো জীবন সমস্যার সমাধান। জীবন এগিয়ে চলছে। জীবনের সমস্যাগুলোও ক্রমে রূপান্তরিত হচ্ছে। এমন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামকে জাগতিক যোগ্যতা ও প্রশ্নাতীত সক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। চিরন্তন ইসলামের যুগোপযোগী প্রয়োগ উপস্থাপন করার দায়িত্ব এর অনুসারীদের উপরই বর্তায়।
খেলাফতের দায়িত্ব কেবল বিধিবদ্ধ ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জীবনের নানা দিক ও বিভাগ খোদা অনর্থক সৃষ্টি করেন নাই। তাই আল্লাহর পছন্দের এক মানব সভ্যতা গড়ে তোলাও খেলাফতের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মর্মার্থ এ দায়িত্বের কথাই বলে। যেমন: জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড়া, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এটাও মনে রাখতে হবে, কাউকে গোমরাহ বলে দূরে সরিয়ে দিলে, কেবল নিজের লোক ও পরিবেশের মাঝে বিচরণ সীমাবদ্ধ রাখলে, যে কারো চিন্তা সংকুচিত হয়ে আসবে। এর বিপরীতে যখন মনে করা হয়, ইসলাম নিয়ে ঐ ‘গোমরাহ’ লোকদের কাছেও যেতে হবে, কেবল তখনই সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক প্রাণান্তকর চেষ্টা চালু হবে— কীভাবে সেই বিভ্রান্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছা যায়। ফলে তাকে বুঝার জন্য, তার জগতে প্রবেশ করার জন্য, তাকে জয় করার জন্য দাওয়াত দানকারী ও সংশোধন প্রচেষ্টায় নিয়োজিতদের চিন্তায় নমনীয়তা ও বিকল্প চিন্তা আসতে থাকবে। এটি হলো innovative thought।
ইসলাম ও ইসলামী চিন্তা যখন কতক আনুষ্ঠানিক ইবাদত ও আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং জীবনের বৃহত্তর অংশে যখন ইসলামের বলার কিছু নাই মনে করা হয়, তখন সহজেই বুঝা যায় যে মুসলিম মানসের কোথায় সংস্কার প্রয়োজন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের আলো ফেলার ক্ষেত্রে যে মন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তার সংস্কার জরুরি। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী বলেন, ‘প্রবাহমান স্রোতস্বিনী নিস্তব্ধ উপত্যকায় হঠাৎ গতিরুদ্ধ হয়ে যেন ক্ষুদ্র সরোবরে পরিণত হয়ে গেলো।’ এই অচলায়তন ও স্থবিরতাকে প্রগতির স্রোতে পরিণত করাই ইসলাম প্রসঙ্গে চলমান ও সম্ভাব্য সংস্কারের লক্ষ্য।
স্পষ্টতই এ ধরনের সংস্কারকে ইসলামের সংস্কার না বলে মুসলিম চিন্তা ও মননের সংস্কার বলাই শ্রেয়। কারণ, ইসলাম বা যে কোনো মতাদর্শের অনুসারীদের চিন্তা ও চরিত্রের মধ্যে বিচ্যুতি থাকা অসম্ভব নয়। যেমন একজন মার্ক্সবাদীর চিন্তা কার্ল মার্ক্স থেকে ভিন্ন (চিন্তার পরবর্তী বিবর্তনের কারণে) হওয়া সত্ত্বেও তার চিন্তাকে মার্ক্সবাদী চিন্তাই বলা হয়। তেমনিভাবে ইসলাম হলো তাই যা এর অনুসারী তথা মুসলমানরা তুলে ধরে (portrait)। কাগজের পৃষ্ঠার কালো অক্ষরগুলো তো আর কথা বলে না, কথা বলে মানুষ। বস্তু থেকে বস্তুর রং যৌক্তিকভাবে আলাদা করে চিন্তা করা যায়, কিন্তু বাস্তবে আলাদা করা যায় না। তেমনই সম্পর্ক ইসলাম ও মুসলিমচিন্তার মধ্যে।
মনে করুন, কোনো ঈমানদারকে বর্তমান সময়ে ইসলামসম্মত জীবনের রূপ কেমন হবে মর্মে প্রশ্ন করা হলো। তিনি বুঝালেন, এটি হবে P1। আরেকজন ঈমানদারকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, P2 হবে। আমরা ধরে নিচ্ছি, এ দুজনই কোরআন-সুন্নাহর টেক্সট থেকে জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের জবাব একই লাইনের অর্থাৎ P কাঠামোর মধ্যকার হলেও এতদুভয়ের গুণগত পার্থক্য লক্ষণীয়। এ পার্থক্য কোরআন-সুন্নাহর পার্থক্য নয়। বরং পাঠকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণেই একই উৎস অনুসরণ করা সত্ত্বেও জবাব ভিন্ন হয়েছে। একই কোরআন-হাদীস পড়ে কোনো কোনো আলেম বলেছিলেন, রাজনীতি হারাম। আবার কোনো কোনো আলেম বলেছিলেন, এটি ফরয। এক সময় ওলামাগণ মনে করতেন, ইজতিহাদের দরজা বন্ধ। আবার শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর চিন্তার প্রভাবে এখনকার ওলামাগণ মনে করেন, ইজতিহাদের দরজা খোলা। এভাবে সুফীবাদ ও সুফীবাদবিরোধী কথাও আমরা এই প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে পারি।
জবাব নয়, প্রশ্নই প্রথমত জরুরি
যা হোক, কোরআন ও সুন্নাহর মতো প্রত্যাদিষ্ট (revealed) টেক্সটসমূহ সীমিত অক্ষরের মাঝে সীমাহীন ভাব, জ্ঞানের বহুমাত্রা এবং চেতনার অসীম শক্তি ধারণ করে থাকে। পাঠক তার সামর্থ্য ও জীবনবোধ অনুসারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশিকা ঐ পাঠ্য থেকে গ্রহণ করে থাকে। মানুষের জীবনবোধের পরিবর্তনের সাথে সাথে কোরআন-সুন্নাহ থেকে আহরিত জ্ঞানও ভিন্ন রকম হয়। জীবন সম্বন্ধে সব মানুষের জিজ্ঞাস্য বিষয় এক রকম নয়। তাই জীবন সম্বন্ধে সঠিক প্রশ্ন উপলব্ধি করাটাই সবচেয়ে বড় জ্ঞান। হাজারো পরিবর্তনের মাঝে কোনটি সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু তা অনুধাবন করতে আমাদের গবেষণা যেন কোনো কিছুর দ্বারাই সীমাবদ্ধ হয়ে না যায়।
এ প্রসঙ্গে ড. তারিক রমাদান বলেন, আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ‘আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য যথার্থ জিজ্ঞাস্য বিষয় কোনটি’। বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোন প্রশ্নটি আগে চিন্তা করতে হবে তা অনুধাবন করাটা কেবল নিরলস বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। এভাবে সমস্যার কেন্দ্র চিহ্নিত করতে না পারলে এর সমাধানও ফলপ্রসূ হবে না। ব্যক্তি যে ধরনের প্রশ্ন নিয়ে অগ্রসর হবে, কোরআন তাঁকে সে প্রশ্নেরই জবাব সরবরাহ করবে।
গানের সুরের যেমন শেষ নাই, তেমনি জীবনের সমস্যারও অন্ত নাই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘লাকাদ খালাকনাল ইনছানা ফি কাবাদ’, অর্থাৎ, আমরা মানুষকে সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছি সমস্যার মধ্যে। জীবন সমস্যার যেমন শেষ নাই, কোরআনের সমাধান প্রদানের ক্ষমতারও তেমন শেষ নাই। তাই সেখানেই সংস্কার দরকার যেখানে মুসলিম-মানস থেমে যেতে চায়। নিয়ত যতই সহীহ হোক না কেন, চলমান জীবনকে থামিয়ে দেয়াটা সৎকাজ হতে পারে না। বরং একদৃষ্টিতে তা একটি অপরাধ। কোরআন শরীফে আছে, ‘ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কাহা ওয়াক্বাদ খা-বা মান দাছ্ছাহা’, অর্থাৎ, যে প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করলো সে সফল হলো, আর যে কলুষিত করলো সে ব্যর্থ হলো।
কোরআন পাঠের পদ্ধতি
অতএব, একজন মুসলমানের দৃষ্টিতে কোরআনের স্থায়িত্ব প্রশ্নাতীত হলেও তাঁর এবং অপরাপর মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানে স্থবিরতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই দিকনির্দেশনা দানকারী সঠিক চেতনা নিয়ে কোরআন না পড়লে উল্টো ‘গোমরাহ’ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু কে বলবে কার পাঠ সঠিক চেতনাভিত্তিক? এখন তো নবী নাই, সাহাবী নাই, তাই এ ব্যাপারে কেউই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নয়। এহেন পরিস্থিতিতে মুসলিম চিন্তাবিদগণকে ক্রিটিক্যাল ডায়ালগের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। ‘ডায়ালগ’ একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ। যার কথা দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন এবং বর্তমান জামানায় দার্শনিক রিচার্ড রর্টি বলছেন। ‘ডায়ালগ’ বা ‘কনভার্সেশন’-এর যৌক্তিক ভিত্তি হলো, কোনো মানুষই জ্ঞানের দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ নয়; এমনকি একই বিষয়ে দুজন মানুষের জ্ঞান এক রকম হয় না। আবার একই বিষয়ের উপর বহু দৃষ্টিভঙ্গি বহুভাবে দেখলেও খোদার সৃষ্টির রহস্য শেষ হবার নয়। এমতাবস্থায় মুসলিম চিন্তাবিদগণ ডায়ালগের মাধ্যমে অগ্রসর হলে উভয় পক্ষই প্রান্তিকতা থেকে বেঁচে যাবে। এভাবে মুসলিম মানসের যে বিকাশ হবে তাকে তারিক রমাদানের ভাষায় ‘more soul’ বলা হয়। ডায়ালগের তাগিদ হাদীসেও আছে। যেমন: ‘জ্ঞান হলো জ্ঞানী লোকের হারানো ধন, যেখানেই তা পাওয়া যাবে সে তার অধিকারী হবে।’
সংস্কার কীভাবে?
এ ধরনের সংস্কার মুসলিমচিন্তার কোথায় ও কীভাবে সম্ভব হবে— এ ব্যাপারে এখন আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক ব্যক্তি একটি ফতোয়া জিজ্ঞাসা করতে চায় বা একটি প্রশ্ন করতে চায়। আমরা যদি কোনো প্রকার সংস্কারের ধারণা গ্রহণ না করি, তাহলে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে আমরা কোনো এক মাদ্রাসার কম্পাউন্ডে যাবো এবং জেনে নেবো এই মাদ্রাসার মুফতি কে। তখন তাঁর কাছে গিয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবো। অপরপক্ষে, আমাদের যদি সংস্কারের ধারণা পরিস্কার থাকে তাহলে আমাদের ফতোয়া সম্বন্ধে প্রথম বিবেচ্য হবে, এই সমস্যাটি জীবনের কোন দিক বা বিভাগের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ এটা কি ইবাদত সম্বন্ধে, না মুয়ামালাত বা সামাজিক আচরণের কোনো দিক সম্বন্ধে। যদি ইবাদতের মধ্যে পড়ে, ধরুন ইসতিস্কার নামাযের নিয়ম সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন হয়, তবে আমরা ঐ মুফতির কাছে যাবো যিনি ইবাদতের নিয়ম কানুন (rituals) সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু আমার জিজ্ঞাস্য বিষয়টি যদি হয় ব্যাংকিংয়ের কোনো জটিলতা সম্বন্ধে, তাহলে আমরা এমন এক ব্যক্তির কাছে যাবো যিনি মানুষের অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশগুলো যেমন জানেন ও মানেন, তেমনি ব্যাংকিংয়ের বিষয়েও তিনি বিশেষজ্ঞ। ব্যাংকিংয়ের জ্ঞান তাকে সমস্যার সঠিক বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে এবং কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান তাকে ঐ সমস্যার এমন সমাধান বের করতে সাহায্য করবে ।
Knowledge of text এবং Knowledge of context
তারিক রমাদানের ভাষায়, এ দুই প্রকার জ্ঞান হলো Knowledge of text (কোরআন ও সুন্নতে রাসূলুল্লাহ) এবং Knowledge of context (জীবন ও জগতের বাস্তব অবস্থার জ্ঞান)। যেমন, কমার্স ও ব্যাংকিং, সমাজ ও সমাজবিজ্ঞান, মানুষ ও মানববিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি। Knowledge of text যদি ঔষুধ হয়, তাহলে Knowledge of context হলো রোগের বিশ্লেষণ। রোগের বিশ্লেষণ ছাড়া কোনো ঔষুধই প্রয়োগ করা যায় না। কমার্স ও ব্যাংকিং, সমাজ ও সমাজবিজ্ঞান, মানুষ ও মানববিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি হলো জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যার জায়গা। অতএব, উক্ত ফতোয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকিংয়ের জ্ঞান সমস্যার সঠিক বিশ্লেষণে সাহায্য করবে এবং কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান সমস্যার সবোর্ত্তম সমাধানে উপনীত হতে সাহায্য করবে।
এখানে আরো একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। অর্থনীতি বা সংস্কৃতির জ্ঞান গতিশীল বা পরিবর্তনশীল। কারণ, সমস্যার প্রকৃতি যুগে যুগে পরিবর্তনশীল। তবে সমস্যার প্রকৃতি পরিবর্তনশীল হলেও নতুন রূপে আগত সমস্যার সমাধানও কোরআনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে তারিক রমাদান বলেন, সমস্যার প্রকৃতির পুনঃপুন বদলের সাথে কোরআনের পুনঃপুন পাঠোদ্ধারই (repeated reading) যুগের প্রয়োজন মেটাবে। প্রতিটি পরিবর্তনের সময় পরিবর্তিত অবস্থাকে মনের মধ্যে নিয়ে কোরআনের পাতায় নজর দিলে, পাঠক অনুধাবন করবে যে কোরআন তার সমস্যারই সমাধান উপস্থাপন করেছে। যা কিনা অবস্থা পরিবর্তনের আগে ও বর্তমান পাঠের পূর্বে তার কাছে অনুধাবনযোগ্য ছিল না। এটাই আল-কোরআনের অন্যতম চিরন্তন মুজিজা। সংশ্লিষ্ট যে কোনো সমস্যা সমাধানে কোরআনের এরূপ বহুমুখী যোগ্যতা সম্বন্ধে অনেকেই অবগত নয়। এই অজ্ঞতার এমন প্রতিক্রিয়া হয়েছে যে পাশ্চাত্যে নতুন কোনো জ্ঞান আবিষ্কৃত হলে মুসলমানদের একটা অংশ বলে বসে— কোরআনে বহু আগেই এসব বলা হয়েছে! তাহলে সদা-সর্বদা কোরআন তেলাওয়াতকারী মুসলমানেরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সেই আবিষ্কার আগেভাগেই কেন করতে পারলো না? হরহামেশাই দাবি করা হয়, অমুক অমুক বা সব বিশেষায়িত জ্ঞান ইতোমধ্যেই কোরআনে আছে। যদিও মুসলমানেরা সেটি বুঝে ওঠতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ব্যাখা-বিশ্লেষণের পরেই!
স্পষ্টতই মুসলমানেরা কোরআনকে সেইভাবে পড়ে না, যেভাবে পড়লে তারা ঐ জ্ঞানের সন্ধান আগেভাগেই পেতো। তারিক রমাদান তাই বলেন, টেক্সট ও কনটেক্সটের একটিকে অপরটির সমমূল্যায়ন করে অগ্রসর হলে তারা মৌলিক ও নব নব জ্ঞানের সন্ধান পাবে। অন্যভাবে বলা যায়— আধ্যাত্মিকতা, অর্থনীতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান, কিংবা মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্য যে কোনো শাখায় যিনি বিশেষজ্ঞ তিনি যদি কোরআনের মূল পাঠ ও প্রেক্ষিতবিবেচনার জ্ঞানে সমৃদ্ধ হোন, তাহলে তিনিই হবেন ঐ বিষয়ের ইসলামী সমাধান প্রদানের প্রকৃত কর্তৃপক্ষ।
অতএব, Knowledge of context-এর ক্ষেত্রে যদি কেউ innovative expertise-এর সাথে সাথে Knowledge of revealed text-এর ক্ষেত্রেও প্রজ্ঞাবান হয়, তাহলেই কেবল মুসলমানরা ‘কোরআনের আলোকে’ নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দিয়ে বিশ্বের মাঝে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হবে। গড়ে উঠবে শক্তিশালী ইসলামী সভ্যতা, যার কথা কোরআনে বলা হয়েছে: “তিনিই সেই সত্তা যিনি নবীকে পাঠিয়েছেন বাস্তবসম্মত দ্বীন ও পথ-নির্দেশসহ যাতে সেটি অন্য সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়।”
উসূলে ফিকাহর সংস্কার
এ ধরনের সংস্কারের ব্যাপারে খোদ সনাতনী ফিকাহর কিতাবগুলো তাগিদ দিয়ে থাকে। ইসলাহ ও তাজদীদ শব্দ দুটি নতুন নয়। প্রথমটি ইসলাম অনুসারে জীবন ও সমাজকে সংশোধন করার কথা বলে। দ্বিতীয়টি খোদ ইসলাম সম্পর্কিত চিন্তার সংশোধনকে বুঝায়। যেমন শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) ইজতিহাদের বন্ধ দরজা খুলে দেয়ার মাধ্যমে চিন্তার সংশোধনের কথা বলেছেন।
ইবাদতের পদ্ধতি জানার জন্য কেবল Knowledge of the text-ই যথেষ্ট, কিন্তু ইবাদতের তাৎপর্য (হাকিকত) ও উদ্দেশ্য (মাকাসিদে শরীয়াহ) জানার জন্য Knowledge of the context-ও দরকার। যেমন, যার কোরআন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান উভয়েরই জ্ঞান আছে তিনি হজ্বের তাৎপর্য ভালোভাবে বুঝবেন ঐ ব্যক্তির চেয়ে, যার জ্ঞান কেবল কোরআনের আক্ষরিক ও ফিকহী পাঠেই সীমাবদ্ধ। তেমনিভাবে যাকাতের সাথে অর্থনীতির, নামাযের সাথে সংস্কৃতির, আকীদার সাথে দর্শনের অনুরূপ ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান।
রাসূলের (সা.) জীবনে ইবাদতের সাথে Knowledge of context-এর সম্পর্ক
পবিত্র কাবার ভেতর মূর্তি থাকা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) একটি পর্যায় পর্যন্ত সেটিকে সামনে রেখে নামায পড়েছেন, মানুষের অবস্থা বিবেচনা করে রমযানের রাতে স্ত্রী সহবাসের উপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন, বাস্তবতার কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্ব পালন করতে এসেও তা না করে সন্ধি করে ফিরে যান, হুদায়বিয়ার সন্ধিতে নবীজির নাম থেকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন। এ ধরনের বহু উদাহরণ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পুরো জিন্দেগীতে দেখা যায়। ইবাদতের ক্ষেত্রে অবস্থা বিবেচনা করে রুখসতের (ছাড় দেয়া) প্রশ্ন গ্রহণযোগ্য। যদিও ইবাদতের নির্দিষ্ট পদ্ধতিসমূহের সব ক’টিকে বাতিল করা বা এসবের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আনার কোনো সুযোগ নাই। যেমন পরিস্থিতির কারণে মূর্তি সামনে রেখে নামায পড়েছিলেন নবীজি। কিন্তু এটি নামাযের নিয়ম হিসাবে গণ্য হয়নি। তুরস্কে বহু বছর পর্যন্ত আরবী ভাষায় আযান দেয়ার উপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন মানুষ তাদের পরিস্থিতি মোতাবেকই আমল করেছে। কিন্তু এতে আযানের নিয়মের কোনো পরিবর্তন হবে না।
এখানে আরো একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা হলো ইবাদতের সাথে মুয়ামালাতের সম্পর্ক। যেমন: রোযার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি রোযা রাখলো কিন্তু মিথ্যা ছাড়তে পারলো না, তার উপোস থাকা খোদার কোনো দরকার নাই। নামাযের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে নামায ফাহেশা ও মুনকার কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখে। এখানে মুনকার বলতে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারকে বুঝায়। নামাযের মধ্যে মানুষ যেভাবে রুকু সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করে বাস্তব জীবনেও সেরকম আনুগত্যের ভাবধারার মধ্যে মানুষ থাকবে— এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যদি সে খোদার বিদ্রোহী হয় তাহলে তার আনুষ্ঠানিক আনুগত্যের কি মূল্য থাকে? কারণ, বাস্তব আচরণ আনুষ্ঠানিক আচরণের সত্যায়ন বলে পরিগণিত হয়। বিপরীত পক্ষে, আনুষ্ঠানিক আচরণ (formal behavior) বাস্তব আচরণের (practical or real behavior) সত্যায়ন নয়। বাস্তব আনুগত্য না থাকলে আনুষ্ঠানিক আনুগত্য কতটুকু অর্থপূর্ণ? ইবাদত মানুষের মনে আল্লাহর আনুগত্যের ভাবধারা সৃষ্টি করে। আর বাস্তব জীবন সেই আনুগত্যেরই প্রকাশ ও প্রমাণ।
আধ্যাত্মিকতা ও কর্মতৎপরতা
এভাবে আধ্যাত্মিকতা ও কর্মতৎপরতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আত্মা যদি পরিশুদ্ধ হয় তাহলে তার প্রভাব কর্মের উপর অবশ্যই পড়বে। আত্মা দূষিত হলে সেটিও কর্মের মাঝে প্রকাশ পায়। যে ব্যক্তি রুকু-সিজদার মাধ্যমে কেবল আল্লাহরই আনুগত্য প্রকাশ করে এবং কেবল তাকেই ভয় করে; সে যদি বাস্তব জীবনেও কেবল আল্লাহরই আনুগত্য করে, কেবল তাঁকেই ভয় করে, বিপদে কেবল তার উপরেই ভরসা রাখে; তাহলে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে তার কোনো দ্বিধা থাকে না। তার আত্মিক পরিশুদ্ধি প্রমাণিত হলো। আর তা যদি না হয় তাহলে বুঝতে হবে তার আধ্যাত্মিক সাধনা তথা তার ইবাদত, যিকির, নামায তার অন্তরকে মানুষের ভয় থেকে পরিশুদ্ধ করতে পারে নাই; অন্যের আনুগত্যের মোহ থেকে পরিশুদ্ধ করতে পারে নাই। তাই তারিক রমাদান বলেছেন, If you are not spiritually strong, you cannot be politically courageous. অতএব, প্রকৃত ইবাদত বা আধ্যাত্মিকতার যেমন রয়েছে বাস্তব প্রকাশ তেমনি বাস্তব জীবনের সফলতা নির্ভর করে আধ্যাত্মিকতার উপর।
এ পর্যন্ত যেসব আলোচনা করা হলো তা মূলত আত্মসমালোচনামূলক কথা বা critical thinking। এরূপ আত্মসমালোচনামূলক চিন্তা একেক জনের জন্য একেক রকম। জীবনের নানাবিধ কর্মযজ্ঞে কে কী ধরনের দায়িত্ব পালন করে, তার উপর এটি নির্ভর করে। একজন কৃষক আর একজন ফকীহ সমান নয়। তাদের আত্মসমালোচনার বিষয়ও সমান নয়। যদিও কৃষক ও কৃষি কাজ, ফকীহ ও ফিকাহ, গবেষক ও গবেষণা পদ্ধতি— কেউই বা কিছুই আত্মসমালোচনা ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে নয়।
Outward looking knowledge এবং inward looking knowledge
এই বিষয়টিকে স্টিফেন টুলমিন এভাবে বলেন, মানুষের জ্ঞান ও চিন্তাপদ্ধতি দুটি ধারার সমন্বয়ের মাধ্যমে অগ্রসর হয়। এই ধারা দুটি হলো outward looking knowledge এবং inward looking knowledge। প্রথম প্রকার জ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো জীবন ও জগৎ (objects out there)। আর দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো জ্ঞানের কর্তা ও জ্ঞানের পদ্ধতি (subjects and methods of knowledge)। এতদুভয়ের একটি বহির্মুখী চিন্তা অপরটি অন্তর্মুখী চিন্তা। প্রথমটি জ্ঞানের ব্যাপ্তি ঘটায়, দ্বিতীয়টি জ্ঞানের গভীরতা সৃষ্টি করে। জ্ঞানের ব্যাপ্তিতে নতুন কিছু যুক্ত হলে তা জ্ঞানের গভীরতার ক্ষেত্রে নতুন জিজ্ঞাসার সূচনা করে। আবার জ্ঞানের গভীরতার ক্ষেত্রে নতুন কিছু যুক্ত হলে তা ব্যাপ্তির ক্ষেত্রেও নতুন জিজ্ঞাসার সূচনা করে। এভাবে পারস্পরিক প্রভাবের দ্বারা একে অন্যের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসে। এভাবে জ্ঞান সৃষ্ট ও বিকশিত হয় ।
জ্ঞানের আধিক্যের সাথে যথার্থতার ভারসাম্য
জ্ঞান আহরণ বা উৎপাদনের সাথে সাথে এর বৃদ্ধি ও পরিমার্জন একটি অন্তহীন চলমান প্রক্রিয়া। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘সঠিকতা’ বিনা ‘অধিকতা’ বিপদজনক! অধিক জ্ঞান কাম্য নয় যদি তা সঠিক না হয়। এটি ইসলামের জন্য সর্বাধিক প্রযোজ্য। কোরআনে আছে, ‘ইউদ্বিল্লু বিহী কাছীরান, ওয়া ইয়াহদী বিহী কাছীরা’, অর্থাৎ একই পাঠ অনেককে বিভ্রান্ত (গোমরাহ) করতে পারে, আবার অনেককে সঠিক পথেও (হেদায়াত) আনতে পারে। তাই আত্মসমালোচনা তথা সংস্কারমূলক চিন্তা ইসলামী চিন্তাবিদদের জন্য সর্বাধিক ও সার্বক্ষণিকভাবে প্রয়োজন।
কার্ল পপারের ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথড
একই কথা ভিন্নভাবে বলেছেন দার্শনিক কার্ল পপার। তিনি বলেছেন, মানুষের জ্ঞান trial and error method-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। পুরাতন ধারণার ত্রুটি খুঁজে তা পরিহার করতে হবে এবং তদস্থলে নতুন জ্ঞান উপস্থাপন করতে হবে। এই নতুনের মাঝে যদি পূর্বেকার মতো ত্রুটি বের হয় তাহলে আরো নতুন জ্ঞান উপস্থাপন করতে হবে। এভাবে পুনঃপুন সংশোধনের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের ‘বৃদ্ধি’ এবং ভ্রান্তির নিরসন ঘটবে।
একটি ট্রায়াল হতে পারে এভাবে: ধারণা করা হলো, খোদার ওয়াদা অনুসারে যারা যথাযথভাবে ঈমান অর্জন করবে তাদেরকে তিনি খেলাফত প্রদান করবেন। দেখা যাচ্ছে, মুসলমানেরা ঈমানের দাবি করছে অথচ তাদের কাছে খেলাফত নাই। এমতাবস্থায় আত্মসমালোচনা করে দেখতে হবে, তাদের ঈমানের মধ্যে কোথায় এবং কী এরর আছে। সেই এরর সংশোধন করে আবারও ট্রায়াল করতে হবে যে ঈমানের ফলে তারা খেলাফতের দিকে এগুচ্ছে কিনা। যদি হয় তবে তাদের ঈমান ও ইলম আপাতত ফলপ্রসূ। আরো দেখতে হবে, ভবিষ্যতের কতদূর পর্যন্ত এই জ্ঞান ও কর্মপ্রচেষ্টা ফলপ্রসূ। ভবিষ্যতে যখন এতে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হবে তখনই আবার সংস্কারের প্রসঙ্গকে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে (incorporate) হবে। এক কথায়, ইসলামসহ যে কোনো সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
ইসলামে বাধ্যবাধকতা ও স্বাধীনতার সীমারেখা
এ পর্যায়ে ইসলামে বাধ্যবাধকতা ও স্বাধীনতার সীমারেখা বুঝতে হবে। বিষয়টি সংস্কার ও সংরক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব হিসাবে প্রতীয়মান। কোন বিষয়ে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আছে আর কোন বিষয়ে সংস্কারের স্বাধীনতা আছে, তা বুঝতে হবে। ইসলাম মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য কতক মৌলনীতি প্রদান করেছে, যার ভিত্তিতে জীবন ও সভ্যতা গড়ে তোলার দায়িত্ব মানুষের। যেমন: মানুষের অর্থনীতির ব্যাপারে খোদা কেবল কয়েকটি কথা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। যথা: যাকাত, সুদ, মজুতদারি, হালাল, হারাম, আল্লাহ সম্পদের মালিক আর মানুষ তার আমানতদার ইত্যাদি হাতেগোনা কয়েকটি মৌলনীতি দিয়ে দিয়েছেন। এসব হলো বাধ্যবাধকতা। আর এর ভিত্তিতে কোনো দেশের অর্থনীতি কীভাবে গড়ে তুলতে হবে তা বিবেচনা করার স্বাধীনতা সংশ্লিষ্টদের থাকবে। বিষয়টি বুঝার ক্ষেত্রে ফুটবল খেলার উদাহরণ দেখা যেতে পারে। একজন ফুটবলারকে কিছু বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। যেমন, দাগের বাহিরে যাবে না, হাত বলে লাগবে না ইত্যাদি। এই কয়েকটি বাধ্যবাধকতা মেনে চলা সাপেক্ষে একজন খেলোয়াড় মাঠে স্বাধীনভাবে খেলতে পারেন। তাই দেখা যায়, একেক জন খেলোয়াড় একেক রকম খেলে। তাদের সফলতা তাদের প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে।
একই ধরন বা প্যাটার্ন ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইসলাম কেবল মৌলনীতির দ্বারা একটি চৌহদ্দি নির্ধারণ করে দেয়, আর সেই সীমারেখার ভিতরে থেকে বাকি সকল কাজের ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীন। মানুষের সফলতাও তার যোগ্যতার উপর নির্ভর করে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফুটবল যিনি খেলেন তার জন্যই ফুটবলের নিয়মগুলো প্রযোজ্য। যিনি খেলেন না তার জন্য নয়। তেমনি কোরআনে আধ্যাত্মিকতা, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে খোদার মৌলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে শুধুমাত্র তাদের জন্য, যারা নিজেদের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার জন্য দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই দায়িত্বের জন্যই মানুষকে আল্লাহর খলিফা বলা হয়। খেলাফতের এই দায়িত্ব কোনো ইচ্ছাধীন ব্যাপার নয়। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের ক্ষমতা দিয়েছেন এই দায়িত্ব পালন করার জন্যই। ইবাদতের সাথে সাথে খেলাফতের এ দায়িত্ব অবশ্য পালনীয়।
সংস্কারের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র
১। কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান ব্যতিরেকে অন্য যে কোনো প্রকার জ্ঞানকে চিরস্থায়ী মনে না করা।
২। ফিকাহসহ অন্য সকল শাখার জ্ঞান, জ্ঞানের কর্তা ও জ্ঞানের পদ্ধতিকে পর্যালোচনামূলক অনুধাবনের (critical understanding) অন্তর্ভুক্ত মনে করা।
৩। ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে টেক্সট ও কনটেক্সটকে সমগুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা।
৪। আধ্যাত্মিকতা ও কর্মতৎপরতাকে পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে গ্রহণ করা।
৫। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার জন্য পুনঃপুন পাঠ অব্যাহত রাখা।
৬। নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্মের পাশাপাশি জ্ঞানের ক্ষেত্রেও নেতৃত্বদানের যোগ্যতা অর্জনের জন্য সচেষ্ট হওয়া। বিশেষত, সৃজনশীল চিন্তা ও মানব উন্নয়নের লক্ষ্যকে সমুন্নত রাখা আবশ্যক।
৭। মুসলমানদের সাধনা হতে হবে সকল মত ও পথের মানুষের কল্যাণ চিন্তা। একে নিছক কৌশল হিসেবে গ্রহণ না করে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।
৮। সকল প্রকার প্রান্তিকতাকে পরিহার করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার নীতি গ্রহণ করতে হবে।