ইসলামী আইন ও মুসলিম নারী: কল্পকথা বনাম বাস্তবতা

নাতানা জে. ডিলং-বাস একজন আমেরিকান স্কলার। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের থিওলজি ডিপার্টমেন্টে ১৫ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে তিনি Muslim Women and Islamic Law: Myths and Realities শিরোনামে একটি আলোচনা উপস্থাপন করেন। এতে তিনি পাশ্চাত্য মিডিয়ার স্টেরিওটাইপের বিপরীতে ইসলামী আইন ও পর্দা সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিভাষা ব্যাখ্যা করেছেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বক্তব্যটির সারসংক্ষেপ তৈরি করেছেন সৌরভ আব্দুল্লাহ

***

ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে মিডিয়াতে আমরা বিভিন্ন রকম ভয়ংকর ছবি ও হেডলাইন দেখে থাকি। যেমন: এক মেয়ে তার বাবার ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তার মুখে এসিড ঢেলে দেয়া হয়েছে। আরেকটা ছবিতে দেখা যায়, কয়েকজন মেয়ে আপাদমস্তক বোরকা আবৃত হয়ে গাধায় টানা গাড়িতে চড়ে যাচ্ছে। কিংবা একজন মহিলাকে পাথর মেরে হত্যা করার খবর। ইসলামী আইন বাস্তবায়নের নামে এসব নিপীড়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এসব খণ্ডচিত্র দেখে আপনার মনে হতে পারে, দুনিয়ার অগ্রগতির জন্য ইসলাম তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। বরং এটি হলো ভয়ানক উগ্রবাদী একটি ধর্ম। এবং ইসলামে থাকতে চাইলে আপনাকে এসবের ভিতর দিয়েই যেতে হবে।

ইসলাম সম্পর্কে মিডিয়ার এইসব স্টেরিওটাইপ খতিয়ে দেখা এবং ইসলামের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হলো আমাদের আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য।

কোরআন কোনো আইনী গ্রন্থ নয়

আপনি যদি বাইবেলের মতো করে কোরআন পড়তে যান এবং আশা করেন যে এখানে বিভিন্ন আইনের বিস্তৃত ব্যাখ্যা থাকবে, তাহলে হতাশ হবেন। কোরআনে আনুমানিক ৬২০০টি আয়াত রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন আইনী বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে মাত্র ২৬০টির মতো আয়াতে। অপরদিকে মুসলিমদেরকে চিন্তাভাবনা করতে এবং বিবেক-বুদ্ধি খাটাতে বলা হয়েছে এর প্রায় তিন গুণ অর্থাৎ সাড়ে সাতশর মতো আয়াতে। ফলে আমরা বুঝতে পারি, কোরআন চায় মানুষ কোরআনের ব্যাখ্যাসাপেক্ষ কোনো নির্দেশ বা নির্দেশনাকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে, বরং বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক।

মুসলিমরা ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা মনে করে। স্বভাবত আপনি যা বিশ্বাস করবেন তাই আপনার কাজে প্রতিফলিত হবে। আপনি সেভাবেই মানুষের সাথে আচার-ব্যবহার করবেন। এই দিকটি খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারি, ঐতিহাসিকভাবে ইসলামী আইনের যে সম্প্রসারণ ঘটেছে তা মূলত এই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার প্রয়োজনেই ঘটেছে। এ পর্যায়ে ইসলামী আইনের কিছু মৌলিক পরিভাষা আমি আপনাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে চাই—

ন্যায়বিচার

ইসলামপূর্ব আরবে মানুষজন পরকালে বিশ্বাস করতো না। তাদের ধারণায় ইহকাল তথা বর্তমানের জীবনই সব। ফলে আপনি কোনো অন্যায্যতার শিকার হলে দুনিয়াতেই এর প্রতিবিধান আপনাকে করতে হবে। এর বাইরে আর কোথাও প্রতিবিধানের কোনো আশা আপনার নাই। ফলে সেখানে প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। মুহাম্মদ (সা.) যখন পরকালের ধারণা নিয়ে আসলেন তখন তিনি মূলত ন্যায়বিচারের একটা স্কেলের কথা বললেন। মৃত্যুবরণের মাধ্যমে আপনি বরং আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে যাচ্ছেন। সেখানে আল্লাহ আপনার এই ইহকালীন কর্মকাণ্ডের বিচার করবেন। কিন্তু বর্তমান জীবনে আমরা তো পরকালীন জীবনের ন্যায়বিচারের আশায় বসে থাকতে পারি না। এই পর্যায়ে আসে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্বের কথা। ইহকালে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের এই দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একটি কর্তৃপক্ষ হিসেবে বৈধতা দেয়।

শরীয়াহ

ইসলামী আইন নিয়ে কথা বলতে গেলেই শরীয়াহর কথা আসবে। শরীয়াহর কথা শুনলে আমারা অনেকেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। অনেকর ধারণা, শরীয়াহ হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের উপর কতগুলো নিষেধাজ্ঞার সমষ্টি। সত্যিকার অর্থে শরীয়াহ হলো কোরআনে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট কিছু আইন। মুসলমানদের কাছে এগুলোর গুরুত্ব সর্বোচ্চ। কারণ, এগুলো সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হয়েছে। আপনাদের আগেই বলেছি, কোরআন কোনো আইনী গ্রন্থ হিসেবে নাযিল হয়নি। কোরআনে উল্লেখিত মাত্র ২৬০টির মতো আয়াতকে শরীয়াহর সাথে সম্পর্কিত বলে ধরা যায়। কোরআনিক বর্ণনার এই অপ্রতুলতার কারণে ইসলামী শরীয়াহকে বুঝার জন্য আমাদেরকে অন্যান্য সোর্স খুঁজতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে হাদীস।

হাদীস

হাদীস হচ্ছে মুহাম্মদের (সা.) কথা ও কাজের সংকলন। হাদীস খুবই গুরুত্বপর্ণ। কারণ মুসলিমরা বিশ্বাস করে, মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন কোরআনের বাস্তব উদাহরণ। ইসলামে হাদীসের অবস্থান কোরআনের সমপর্যায়ের নয়। কোরআন হচ্ছে সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে নাযিলকৃত এবং হাদীস হচ্ছে মুহাম্মদের (সা.) সঙ্গীদের স্মৃতি থেকে বর্ণনা। সঙ্গত কারণেই হাদীসের অবস্থান হচ্ছে কোরআনের পরে।

শরীয়াহ সংক্রান্ত কোরআনের ২৬০টি আয়াত এবং সপ্তম শতাব্দীর দুনিয়ায় বাস করা রাসূলের জীবনের কিছু দৃষ্টান্ত থেকে আজকের দুনিয়ার নতুন নতুন সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করবো? এ পর্যায়ে আমাদের প্রয়োজন হয় ফিকাহ তথা ইসলামী আইনশাস্ত্রের।

ফিকাহ

ইসলামী আইন তথা কোরআন-হাদীসের মানবীয় ব্যাখ্যাই হচ্ছে ফিকাহ। ফিকাহর অবস্থান শরীয়াহ তথা কোরআন বা হাদীসের মতো নয়। এটি হচ্ছে কোরআন বা হাদীস সম্পর্কে মানুষ কী বুঝেছে সেটার বিশ্লেষণ। ফিকাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সময়ের সাথে সাথে মানব সমাজের অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয় এবং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদেরকে অনেক সময় পুরাতন সমস্যারও নতুন সমাধান খুঁজতে হয়। বিশেষত কোনো আইনের প্রয়োগ ও ফলাফলের দিকে খেয়াল করলে যদি দেখা যায়, প্রচলিত ব্যবস্থার মাধ্যমে বরং সংশ্লিষ্ট আইনটির মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে, তখন সেটি সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। এমতাবস্থায় ফিকাহ শাস্ত্রের সহযোগিতায় এর সমাধান বের করা হয়। ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো কোনো ফকীহর মতামতকে এতটাই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যার ফলে শরীয়াহ এবং ফিকাহর সীমারেখা গৌণ হয়ে পড়েছে। এ কারণেই আমাদের পরবর্তী দুটি পরিভাষাকে ভালো করে বুঝার দরকার হবে। এই দুটি পরিভাষা হলো তাকলীদ ও ইজতিহাদ।

তাকলীদ

তাকলীদ হচ্ছে অতীতের কঠোর ধারাবাহিকতা। কিন্তু আপনি যদি আইন ব্যাখ্যার কোনো নির্দিষ্ট ধারাই বজায় রাখতে চান, তাহলে কখনো কখনো এর পরিণতি হয় ‘অন্ধ অনুকরণ’। আপনি হয়তো অতীতের এমন কাউকে অনুসরণ করছেন যিনি কোরআনের জ্ঞান, আরবী ভাষায় দক্ষতা, তাফসীর করার ক্ষমতা ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েক শতাব্দী আগে তাঁরা যা ব্যাখ্যা করেছেন বা যেসব সমাধান দিয়ে গেছেন তা আমাদের আজকের বাস্তবতায় কতটুকু প্রাসঙ্গিক? আমরা কি সেসবকে হুবহু অনুকরণ করবো? নাকি বর্তমান বাস্তবতায় ইসলামকে মেনে চলার জন্য আমরা নতুন সমাধান খুঁজবো? এক্ষেত্রে রক্ষণশীল কেউ হয়তো পূর্বের অনুকরণই করবেন, অর্থাৎ তাকলীদ করবেন। আবার কেউ হয়তো ইজতিহাদকে বেছে নিবেন।

ইজতিহাদ

ইজতিহাদ হচ্ছে স্বাধীনভাবে যুক্তিবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য নতুন সমাধান অনুসন্ধান করা।

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এখন আইনশাস্ত্রে মুসলিম নারীরাও নিজেদের মতামত তুলে ধরার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে ইসলামী আইনশাস্ত্রে সিংহভাগ অংশগ্রহণ ছিল পুরুষদের। কোরআন ও হাদীসশাস্ত্র চর্চায় নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও আইনশাস্ত্র ছিল মূলত পুরুষদের দখলে। জ্ঞানার্জন এবং গণপরিসরে নারীদের অবস্থান অতীতে পুরুষদের সমান না থাকলেও বর্তমানে অনেক দেশে এসব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের সমপর্যায়ের।

ফতোয়া

ফতোয়া হচ্ছে আইনী অভিমত। কখনো কখনো কোনো মুফতি ফতোয়া দিয়ে থাকেন। আবার কখনো কখনো বিশেষ কোনো কাউন্সিল যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ফতোয়া দিয়ে থাকে।

উদাহরণ হিসেবে মুসলিম নারী স্কলার এবং এক্টিভিস্টদের নিউইয়র্কভিত্তিক একটি সংগঠন Women’s Islamic Initiative in Spirituality and Equality (WISE)-এর কথা বলা যায়। তারা মুসলিম নারী স্কলারদের নিয়ে নিজস্ব শুরা কাউন্সিল গঠন করেছে, যাতে করে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইস্যুতে নারীদের অভিমত তুলে ধরা যায়।

হুদুদ

ইসলামী আইন সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা প্রায়শ আরেকটি ‘ভয়ংকর’ পরিভাষার কথা শুনে থাকি। তা হচ্ছে হুদুদ। হুদুদ নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক ভুল বুঝাবুঝি আছে। আরবীতে সাধারণত হুদুদ শব্দ দ্বারা কোনো কিছুর “সীমা” বুঝানো হয়ে থাকে। বিশেষত আচরণের গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য সীমা-পরিসীমা বুঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোরআনে বর্ণিত নির্দিষ্ট চারটি অপরাধ এবং এসবের শাস্তিকে পারিভাষিক দিক থেকে হুদুদ বলা হয়। এ চারটি অপরাধ হচ্ছে— ১। যিনা, ২। যিনার অপবাদ, ৩। চৌর্যবৃত্তি ও ৪। মদ্যপান। ইসলামে এগুলোকে অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে এসব অপরাধ প্রমাণের জন্য সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য ও প্রমাণ-প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।

১। যিনা

হুদুদের মধ্যে যে অপরাধটির কথা আমরা সবচেয়ে বেশি শুনে থাকি সেটি হচ্ছে যিনা। মিডিয়াতে এটিকে খুব সরলীকৃত অনুবাদ করে বলা হয় এডাল্ট্রি তথা ব্যভিচার। সত্যিকার অর্থে যিনা বলতে বৈবাহিক সম্পর্কবিহীন যে কোনো যৌন সম্পর্ককে বুঝানো হয়। এই অপরাধের কোনো অভিযোগ প্রমাণের জন্য আপনাকে চারজন স্বতন্ত্র পুরুষ সাক্ষী হাজির করতে হবে, যারা অপরাধটি সংঘটিত হতে দেখেছে।

২। যিনার অপবাদ

কিন্তু আপনি যদি কারো বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ করে চারজন পুরুষ সাক্ষী হাজির করতে না পারেন, তাহলে আপনি নিজেই যিনার অপবাদ প্রদানের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। এমন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে— পরিবারের মতো সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা ও যিনার মতো একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ রোধ করার পাশাপাশি নির্দোষ কাউকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হয়রানি করার মতো সামাজিক অসঙ্গতি দূর করা।

৩। চৌর্যবৃত্তি

তৃতীয় হুদুদ অপরাধ হচ্ছে চুরি করা। এটিও একটি বড় ধরনের সামাজিক সমস্যা। সম্পদের নিরাপত্তা মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন।

৪। মদ্যপান

চতুর্থ হুদুদ অপরাধ হচ্ছে মদ পান করা। কেন এটি সামাজিক অপরাধ? মদ্যপায়ীরা এমন সব আচরণ করে, যা সাধারণ লোকেরা করে না। তারা আচার-আচরণে অনেক বেশি এগ্রেসিভ হয়, যৌনতার ক্ষেত্রেও বিশৃঙ্খল আচরণ করে, যা অন্যদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

কোরআনে এই অপরাধগুলোর জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি বর্ণিত আছে। হুদুদ নিয়ে সাম্প্রতিককালে আমরা সবচেয়ে ভয়ংকর যে সংবাদটি শুনে থাকি তা হচ্ছে, যিনার অপরাধে কোনো নারীকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হয়েছে।

ইতিহাসে আমরা দেখি, যিনার অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো নারীর প্রেগন্যান্সিকে তার অপরাধের প্রমাণ হিসেবে নেয়া হতো না। শুধুমাত্র স্বতন্ত্র চারজন পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষীই যিনার অপরাধ প্রমাণের জন্য গ্রহণযোগ্য। আমি মনে করি, ধর্ষণের অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে নারীদেরকে পর্যাপ্ত আইনী সুরক্ষা দেয়া হলো এ ধরনের বিধান থাকার অন্যতম কারণ। বর্তমান সময়েও এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, কোনো নারী ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করার পর চারজন পুরুষ সাক্ষী হাজির করতে না পারায় নিজেই যিনার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড ভোগ করেছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে ইসলামী আইনে ধর্ষণকে অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং অপরাধীকেই শাস্তি দিয়েছে, ধর্ষিতা নারীকে নয়।

প্রসঙ্গক্রমে আপনাদেরকে নাইজেরিয়ার একটি বহুল আলোচিত ঘটনার কথা বলতে পারি। ২০০২ সালে আমিনা লাওয়াল নামে এক মহিলাকে ব্যভিচারের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর তাকে গর্ভধারণ করতে দেখা গিয়েছিলো। ধারণা করা হচ্ছিল, সে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার কারণে গর্ভধারণ করেছে। আমি আপনাদেরকে আগেই বলেছি, প্রেগন্যান্সি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। পরবর্তীতে আমিনার আইনজীবী উচ্চ আদালতে প্রেগন্যান্সি যিনার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কথা তুলে ধরেন। কেননা, ইসলামী আইনে ‘অবিকশিত ভ্রূণের’ ধারণা আছে। ইসলামী আইনানুযায়ী, মাতৃগর্ভে একটি ভ্রুণ বিকশিত হতে ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। যেহেতু আমিনা লাওয়ালের স্বামী মারা যাওয়ার দুই বছরের ভিতরেই সে গর্ভধারণ করেছে তাই তার আইনজীবী ‘অবিকশিত ভ্রুণের’ পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এতে করে আমিনা শাস্তি থেকে রেহাই পান।

উল্লেখ্য, গর্ভবতী কোনো নারী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে কর্তৃপক্ষ তার সাজা কার্যকর স্থগিত রাখবেন। সন্তান জন্মদান ও দুগ্ধপানের মেয়াদকাল অতিক্রান্ত হলে উক্ত সাজা কার্যকর হবে। এর উদ্দেশ্য হলো মায়ের অন্যায়ের জন্য সন্তান যাতে সাজা ভোগ না করে।

যা হোক, এমন অনেক অপরাধ আছে যা আমাদের কাছে হুদুদের চেয়েও মারাত্মক। যেমন: হত্যাকাণ্ড। ইসলামী আইনে এসব অপরাধ তা’যিরের পর্যায়ে পড়ে।

তা’যির

তা’যির হচ্ছে ঐ ক্যাটাগরির অপরাধ যেক্ষেত্রে বিচারক কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি প্রদানে বাধ্য নন। বরং তাঁর বিবেচনাবোধ কাজে লাগিয়ে শাস্তি প্রদান করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের জন্য শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করা হয়, বিশেষ করে অল্প বয়স্কদের (কিশোর) ক্ষেত্রে। এর উদ্দেশ্য হলো অপরাধী যেন সাজা ভোগের কারণে সমাজের প্রতি রূষ্ট না হয় এবং সমাজের মূল ধারায় নিজেকে ইন্টিগ্রেটেড করে নিতে পারে।

যা হোক, হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে ফিরি। হত্যাকাণ্ডকে কেন তা’যিরের পর্যায়ে অর্থাৎ বিচারকের বিবেচনার জন্য রাখা হলো— এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, ইসলামী আইনে হত্যাকাণ্ডকে সরাসরি সমাজের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। হত্যার শিকার প্রতিটি ব্যক্তি কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। ফলে বিচারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে সংযুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে বিচারিক অপশন থাকে তিনটি:

১। হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান
২। হত্যাকারী কিংবা তার পরিবারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রক্তপণ আদায়
৩। অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া।

ভিক্টিমের পরিবার বিচারকের কাছে এর যে কোনোটিই চাইতে পারে। রক্তপণ আদায়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করা হয়। রক্তপণের পরিমাণ কত হবে তা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আদালতে উত্থাপন করে। অপরাধী রক্তপণ আদায়ে অক্ষম হলে তার পক্ষ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র রক্তপণ আদায়ে বাধ্য থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে সবকিছুর উপরে মানুষের জীবনের মূল্য বেশি, এমনকি সে যদি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘৃণ্য অপরাধও করে থাকে। কেননা সেও আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি, তার জীবনেরও একটা স্বগত মূল্য আছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া হয়।

এরপরের অপশন হচ্ছে ক্ষমা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার চাইলে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিতে পারে। এটি মানুষের প্রতি দয়া করার সর্বোচ্চ পর্যায়। এটি একটি পূণ্যের কাজ এবং গভীর ধর্ম বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।

সারাবিশ্বে ক্ষমা করার এমন অনেক ঘটনা আছে। আমেরিকায়ও এমন একটি ঘটনার কথা আপনাদের বলতে পারি। ৯/১১’র পরের কথা। ৯/১১’র ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকান এক ইউনিভার্সিটির দুই ক্ষুব্ধ ছাত্র তাদের সহপাঠী এক সৌদি ছাত্রকে হত্যা করে, যদিও ৯/১১’র সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমেরিকান আদালতে এর বিচার চলাকালীন হত্যাকাণ্ডের শিকার সৌদি ছেলেটির বাবা উক্ত আদালতে উপস্থিত হন এবং তার ছেলের হত্যাকারীদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনি আদালতে বলেন, ৯/১১’র দুষ্কৃতিকারীরা দুনিয়ার সব মুসলিম বা সব সৌদিদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের অপকর্মের দায় শুধুমাত্র তাদের। ইসলামকে মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ইসলামে নানা ধরনের উপায়ের কথা বলা আছে। ক্ষমা এর মধ্যে অন্যতম।

যাহোক, এ ধরনের ঘটনা পাশ্চাত্যের লোকদেরকে আশান্বিত করে বটে। কিন্তু মুসলিম নারীদের ব্যাপারে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।

পর্দা

এই পর্যায়ে মুসলিম নারীদের পর্দা নিয়ে কথা বলতে চাই। ৯/১১’র পর পাশ্চাত্যে একটি বিষয় ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে— আফগানিস্তানে তালেবানদের কবল থেকে মুসলিম নারীদের উদ্ধার করতে হবে। পশ্চিমে পর্দা মাত্রই মুসলিম নারীর প্রতীক এবং এটিকে বৈষম্য, অনগ্রসরতা, নিষ্পেষণ, পুরুষের আধিপত্য এবং সর্বোপরি সমাজের জন্য একটা বাধা হিসেবে দেখা হয়। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে পুরুষরাও অনেকাংশে নারীদের মতো আপাদমস্তক পোশাক পরিধান করে, এমনকি মাথাও ঢেকে রাখে। এটি তাদের মরুময় পরিবেশের জন্য কার্যকরী। মুসলিম নারীদের কালো রঙের কাপড় দিয়ে পর্দা করাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকার মতো ব্যাপার বলে মনে করা হয়। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই নারীরা কালারফুল সব কাপড়ে পর্দা করে।

যা হোক, পর্দা মুসলিম সংস্কৃতি এবং আইনের সাথে এতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে আমরা প্রায়শ মনে করি, এর পিছনে সম্ভবত শক্তিশালী কোরআনিক এবং ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। কিন্তু কোরআনে পর্দা সংক্রান্ত আলোচনা থেকে আমরা যে পরিভাষাগুলো পাই সেগুলো হচ্ছে— হিজাব, জিলবাব ও খিমার।

হিজাব

এক্ষেত্রে প্রাক-ইসলামী আরব এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগ আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তখন হিজাব ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তখনকার সংস্কৃতিতে শুধুমাত্র স্বাধীন নারীদের জন্যই হিজাব অনুমোদিত ছিল। এমনকি একজন নারীর হিজাব পরাটা তার পরিবারের পুরুষদের জন্যও ছিল মর্যাদার ব্যাপার। তৎকালীন সিরিয়ায় মর্যাদাসম্পন্ন পুরুষদের স্ত্রী এবং কন্যাদের জন্য হিজাব পরাটা ছিল বাধ্যতামূলক। অপরদিকে, তাদের দাসীদের জন্য হিজাব করা ছিল আইনত শাস্তিযোগ্য। এটি তৎকালীন আরবের অবস্থা। অর্থাৎ হিজাবের একটি প্রতীকী ভূমিকা ছিল। যে নারী হিজাব পরতো তার সম্বন্ধে মনে করা হতো, সে একজন সম্মানিত নারী। চাইলেই তাকে এপ্রোচ করা যায় না।

আপনারা হয়তো জেনে অবাক হবেন, কোরআনে হিজাব শব্দটি মাত্র সাতবার এসেছে। আরবিতে মূলগতভাবে এটি ‘যে কোনো দুটি জিনিসের মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য বা ভিন্নতাকে’ নির্দেশ করে। যেমন: মানুষ ও খোদার পার্থক্য, বিপথগামী ও সুপথে পরিচালিতদের পার্থক্য, খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য, আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য। জেন্ডার বা পোশাকের সাথে এর কোনোটিরই সম্পর্ক নাই। ঐতিহাসিকভাবে আরবে ‘হিজাব’ শব্দের বহুল ব্যবহারের দিকে খেয়াল করলেও আমরা দেখি, লোকেরা কোনো কিছুর পার্থক্য নির্দেশ করতে বা কোনো কিছু থেকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহার করেছে, পরিধেয় কোনো কিছুর ক্ষেত্রে নয়।

কোরআনের সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াতকে সাধারণত ‘হিজাব বা পর্দার আয়াত’ বলা হয়। সেখানে আল্লাহ বলেছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَن يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَىٰ طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَـٰكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنكُمْ ۖ وَاللَّـهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ ۚ وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ ۚ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَن تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّـهِ وَلَا أَن تَنكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِن بَعْدِهِ أَبَدًا ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ عِندَ اللَّـهِ عَظِيمًا

‍“হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা খাবার-দাবার তৈরীর জন্য অপেক্ষা না করে খাওয়ার জন্য নবীর ঘরে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদেরকে ডাকা হলে তোমরা প্ৰবেশ করো তারপর খাওয়া শেষে তোমরা চলে যেও; কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। নিশ্চয় তোমাদের এ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়, কারণ তিনি তোমাদের চলে যেতে বলতে সংকোচবোধ করেন। কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচবোধ করেন না। যখন তোমরা তার পত্নীদের কাছে কিছু চাইবে, পর্দার (হিজাব) আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য বেশী পবিত্ৰ। আর তোমাদের কারো পক্ষে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া সংগত নয় এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিয়ে করাও তোমাদের জন্য কখনো বৈধ নয়। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে এটি গুরুতর অপরাধ।”

কোরআন পড়ার একটা দারুণ ব্যাপার হচ্ছে প্রতিটা আয়াত নাযিলের একটা প্রেক্ষাপট আছে এবং নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানার জন্য হাদীস গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা.) যয়নবকে (রা.) বিয়ে করার পর উনার ঘরে খাবার-দাবারের আয়োজন করেন। উপস্থিত কয়েকজন খাওয়াদাওয়া শেষে চলে না গিয়ে বরং বসে বসে গল্প করছিলেন। এটি আল্লাহর রাসূলের জন্য বিব্রতকর ছিল। এক কক্ষবিশিষ্ট ঘরের মধ্যে মেহমানদের উপস্থিতির কারণে তিনি তাঁর নব পরিণিতা স্ত্রীকে সময় দিতে পারছিলেন না, আবার ভদ্রতার খাতিরে তাদেরকে চলে যেতেও বলতে পারছিলেন না। এই প্রেক্ষাপটেই কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে আয়াতটি নাযিল হয়। এখানে আরো লক্ষ্যণীয়, আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। লোকেরা বিভিন্ন প্রয়োজনে উনার ঘরে আসতেন। উনার স্ত্রীদের ঘরসমূহ ছিল এক কক্ষবিশিষ্ট। যার কারণে আল্লাহ নবীর স্ত্রীদের প্রাইভেসির জন্য হিজাবের আদেশ দিলেন। লোকেরা যাতে পর্দার আড়াল থেকে রাসূলের স্ত্রীদের কাছে তাদের প্রয়োজনের কথা বলতে পারে।

এর বাইরে কোরআনে নারীদেরকে ইঙ্গিত করে ‌‘হিজাব’ শব্দটি মাত্র আর একবার এসেছে। হযরত মরিয়ম (আ.) যখন গর্ভধারণ করেন তখন তাঁকে তার পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার নির্দেশ দিতে ‌‘হিজাব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

জিলবাব

কোরআনে ‌সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّـهُ غَفُورًا رَّحِيمًا

‍“হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিন নারীদের বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত (জিলবাব) নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং হয়রানি না করা হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং করুণাময়।”

কোরআনে শুধুমাত্র এই আয়াতেই ‌‘জিলবাব’ শব্দটি এসেছে। এটি দ্বারা এক ধরনের বহিরাবরণের কথা বলা হচ্ছে। এর কোনো স্পষ্ট বর্ণনা নাই। ফলে আয়াত থেকে আমরা ঢিলেঢালা পোশাকের কথাই ধরে নিতে পারি, যাতে ভালোভাবে ঢেকে নেয়া যায়। কিন্তু এটি স্পষ্ট, এটি দ্বারা ‌‘হিজাব’ কিংবা veil বুঝানো হয়নি। আয়াতটি নাযিলের সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখি, তখন মদীনায় নারীরা প্রায়শই হয়রানির শিকার হতো। এমনকি রাতের বেলা প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেলেও নারীদের হয়রানির শিকার হওয়ার আশংকা ছিলো। ফলে জিলবাব পরিধানের মাধ্যমে যাতে সমাজে মুসলিম নারীদের আলাদা পরিচয় ও মর্যাদা তৈরি হয় এবং হয়রানির শিকার হতে না হয়, তা ছিলো এই আয়াতের উদ্দেশ্য।

আয়াতটির উদ্দেশ্যের দিকে খেয়াল করলে আমরা আরো বুঝতে পারি, শালীন পোশাক পরিধানের মাধ্যমে আসলে নিজেকে নিরাপদ করা হয়। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, কেন বর্তমান সময়েও অনেক মুসলিম নারী হিজাব তথা পর্দা করা পছন্দ করেন। এমন নয় যে বাবা, ভাই বা স্বামী নারীর ওপর পর্দা চাপিয়ে দিয়েছে। বরং পর্দার মাধ্যমে মুসলিম নারীর বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে। এই বিধান পালনের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে সচ্চরিত্রবান নারী হিসেবে তুলে ধরতে চায়। কোনো কোনো দেশে এটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হলেও অনেক জায়গায় এটি নারীদের চয়েসের ব্যাপার।

খিমার

খিমারের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমরা জানি না, খিমার দ্বারা ঠিক কোন পোশাককে বুঝানো হয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও আমারা কিছু দিকনির্দেশনা পাই। কোরআনের সূরা নূরের ৩০-৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّـهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ – وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ ۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوا إِلَى اللَّـهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

“৩০) হে নবী! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে৷ এটি তাদের জন্য অধিক পবিত্র পদ্ধতি৷ যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন৷

৩১) আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে আর তাদের সাজসজ্জা না দেখায়, যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া৷ আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল (খিমার) দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে৷ তারা যেন তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, তবে নিম্নোক্তদের সামনে ছাড়া— স্বামী, বাপ, স্বামীর বাপ, নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, নিজের মেলামেশার মেয়েদের, নিজের মালিকানাধীনদের, অধীনস্থ পুরুষদের যাদের অন্য কোনো রকম উদ্দেশ্য নেই এবং এমন শিশুদের সামনে যারা মেয়েদের গোপন বিষয় সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ৷ তারা যেন নিজেদের যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশ করে দেবার উদ্দেশ্য সজোরে পদক্ষেপ না করে৷ হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে৷”

এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট জানার জন্য তেমন কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। আয়াতটা খুব ইন্টারেস্টিং। এখানে শুধু মুসলিম নারীদেরকেই দৃষ্টি সংযত করতে ও লজ্জাস্থান হেফাযত করতে বলা হচ্ছে না, বরং আগে পুরুষদেরকে বলা হচ্ছে। যদিও পুরুষদের ব্যাপারটা তেমন আলোচিত হয় না। এখানে পুরুষদের বলা হয় নাই, তোমরা নারীদের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। বরং দায় যার যার। এই আয়াত থেকে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণায় পৌঁছতে পারি— বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে দুইজন নারী-পুরুষ প্রয়োজনে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে। এটি এখানে নিষেধ করা হয়নি। বরং দৃষ্টি সংযত রাখা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করতে বলা হচ্ছে, যাতে তারা একে অপরের প্রতি আকর্ষিত না হয়ে নিজেদের কাজের প্রতি ফোকাসড থাকে। আমরা বলতে পারি, কোরআন সামাজিক জনপরিসরে লিঙ্গভিত্তিক পৃথকীকরণের কথা আমাদেরকে বলে না। একইসাথে পাবলিক স্পেসে নারীর উপস্থিতির কারণে যেন যৌন উত্তেজনার (provocation) সুযোগ সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে।

যা হোক, এখানে ‌‘খিমার’ দ্বারা চাদরের মতো এমন এক কাপড়কে বুঝানো হচ্ছে, যা দিয়ে নারীদের গলা ও বুক ঢেকে নেয়া যায়। এখানে মাথা বা মুখ ঢাকার কথা বলা হচ্ছে না। মুখ ঢাকার কথা বুঝানো হলে নারী-পুরুষ উভয়কে দৃষ্টি অবনত করতে বলাটা অর্থহীন। আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, খিমার শব্দটি এক্সক্লুসিভলি শুধু নারীদের জন্য ব্যবহৃত হয় না। পুরুষের পাগড়ি বুঝাতেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

পর্দার উদ্দেশ্য

সর্বোপরি ইসলামে পর্দার উদ্দেশ্য কী সে প্রশ্নে আমরা মূলত তিনটি বিষয় পাই—

১। ব্যক্তিজীবন ও জনপরিসরের মধ্যে পার্থক্য করা
২। মুসলিম নারীর আত্মমর্যাদাবোধকে সুরক্ষা দেয়া
৩। নারী-পুরুষ উভয়ের শালীনতা (modesty) রক্ষা করা

পর্দা কি নিপীড়ন নাকি ধার্মিকতা?

মুসলিম নারীর জন্য পর্দা নিপীড়নমূলক কিনা সে ব্যাপারে আলোচনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং। মুসলিম নারীরাও পাশ্চাত্যের স্বল্পবসনা নারীদের ক্ষেত্রে একই কথা বলতে পারে। তারা বলতে পারে, ‌‘তাদেরকে কিছুই পরতে দেয়া হচ্ছে না, এ কেমন নির্যাতন!’ ফ্রান্সে একজন নারীর জন্য পাবলিক প্লেসে মুখ ঢাকা (নিকাব) আইনত দণ্ডনীয়। এই ‌‘অপরাধে’ সর্বোচ্চ বিশ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এর বিপরীতে আপনি বিকিনি পরিহিত একজন নারীর জন্য কোনো প্রকার শাস্তির বিধান দেখবেন না। এখন আপনিই বলুন, কোনটি নিপীড়ন?

সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে নারীর জন্য পর্দা কি বাধা? মোটেও নয়। আমি এমন অনেক পর্দানশীন নারীর কথা জানি, যারা উচ্চশিক্ষিত এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ শান্তিতে নোবেল জয়ী ইয়েমেনী নারী তাওয়াক্কুল কারমান ও সৌদি ক্যান্সার গবেষক ড. খাওলা আল খুরাইয়ার কথা আপনাদের বলতে পারি। ড. খাওলা সৌদি শূরা কাউন্সিলের প্রথম নারী প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য ছিলেন।

পর্দা কি মুসলিম নারীর জন্য নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা, নাকি ধার্মিকতার বহিঃপ্রকাশ— এটি কে ঠিক করবে? অন্যরা, নাকি বিশ্বাসী নারীরা? মুসলিম নারীদের কি আদতে ‌‘মুক্ত’ করার ব্যাপার আছে? আমরা তাদেরকে কী থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছি? এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, কী জন্য মুক্ত করতে চাই? তাদের কি নিজস্ব এজেন্সি নাই? আমাদের মতো করেই মুক্ত হওয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন কি তাদের আছে? নাকি আমাদের দিক থেকে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন, সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান ও পারস্পরিক ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করাটা জরুরি?

এ ধরনের আরো লেখা