মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামী রাজনীতির বিপত্তি

এডিটর’স নোট: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সংশ্লিষ্ট লেখকের, সিএসসিএস-এর নয়। নিবন্ধটির বক্তব্যের সার্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আমরা এটি প্রকাশ করছি। আশা করি, পাঠক এ বিষয়টি বিবেচনা করে নিবন্ধটি পাঠ করবেন।

***

সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘ইসলামী রাজনীতি’ অন্যতম আলোচিত ও সমালোচিত ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ‘সন্ত্রাসবাদে’র সাথে ‘ইসলামী রাজনীতি’র সংযোগের অভিযোগ থাকায় এই বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিতর্ক চলছে যে ধর্মের ভিত্তিতে বা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি কতটা যৌক্তিক? এটা সত্য যে রাজনীতিতে অনেক কিছু হয়। রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিশেষ ব্যক্তি, আদর্শ বা ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করা হয়। কোথাও কোথাও বাইবেল কিংবা কুরআনে হাত রেখে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানকে শপথ নিতেও দেখা যায়। তবে সেই রাজনৈতিক দলগুলোর মূল আদর্শ ধর্ম নয় কিংবা তারা ধর্মীয় আদর্শ বাস্তাবায়নের জন্যই রাজনীতি করে না। বরং, রাজনীতির প্রয়োজনেই ধর্মকে ব্যবহার করে। তাই এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি হয়— ধর্মের প্রয়োজনে রাজনীতির ব্যবহার হবে নাকি রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মের ব্যবহার হবে?

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে রাজনীতির প্রয়োজনে অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো ধর্মকেও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো দেশে পার্শ্ববর্তী দেশবিরোধী সেন্টিমেন্ট, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি রাজনীতির প্রভাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাকে দেখা যায় নির্বাচন আসলে হজ্জ্ব করে, টুপি মাথায় দেয়, হিজাব পরে, আবার কেউ কেউ বলে থাকে তাদেরকে ভোট দিলে ধর্ম বাঁচবে ইত্যাদি। কিন্তু এরা কেউই ধর্মীয় রাজনীতি বা ধর্মের জন্য রাজনীতি করে না। বরং, তাদের রাজনীতিটা টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে।

তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বরাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, ধর্মের নামেও বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলও গড়ে উঠে। ধর্মকে উদ্দেশ্য করে বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অথবা ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক দল কাজ করে। কোথাও সেটা ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, কিংবা খ্রিষ্টান ধর্মকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। অন্যান্য ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্মীয় আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতি শুরু করলেও সেসব রাজনৈতিক দল ধর্ম কিংবা ‘ধর্মীয় অনুশীলন’কে তাদের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করে না। ক্ষেত্রবিশেষে ঐ সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মীয় আদর্শ প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও নিজেদেরকে সার্বজনীন প্রমাণ করতে সংশ্লিষ্ট দলটি ধর্মীয় বিষয়গুলোকে রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে আলাদা করে ফেলে। কিন্তু ইসলামী রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শ ধারণ ও অনুশীলনকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। ব্যাপারটা এমন হয়ে যায় যে রাজনীতির উদ্দেশ্যই যেন ধর্ম চর্চা করা। যেমন: একটি দলকে এই বক্তব্য দিতে দেখা যায়: ‌‘We call you to the rules of Islam, to the guidance of Islam, to the teachings of Islam; if this means politics to you, then this is our politics.’

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বিভিন্ন দেশে অন্যান্য ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোর যে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব হয়, সেটাকে কোনো পক্ষই ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করে না। কেবল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হিসেবেই বিবেচনা করে। পক্ষান্তরে, ইসলামকে কেন্দ্র গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলের সাথে অন্যান্য দলের (যার সদস্যরাও মুসলমান) রাজনৈতিক সংঘাতকে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে কমপক্ষে একটি পক্ষ দাবি করে থাকে। ফলে এটা কারো কাছে রাজনৈতিক সংঘাত, আবার কারো কাছে ধর্মের খাতিরে জিহাদ হিসেবে বিবেচিত। এই জায়গা থেকেই প্রশ্নটি তৈরি হয়— যে রাষ্ট্রে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে ধর্মীয় আদর্শকে রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করে ধর্মীয় রাজনীতি বা ইসলামী রাজনীতির দরকার আছে কি? এই রাজনীতি একই ধর্মের মানুষের মধ্যে সংঘাত তৈরির পথ তৈরি করে কি? সেই সংঘাত কি ‘জিহাদ’ নাকি কেবল রাজনৈতিক সংঘাত? সর্বোপরি ‘রাজনীতি’ ‘ইসলামী’ হওয়া কতটা জরুরী? এ সকল প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই এই প্রবন্ধে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামী রাজনীতির বিপত্তিটা কোথায় সেটা অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হবে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাম, ডান ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল রয়েছে। বাম রাজনৈতিক দলগুলো সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চায়। মধ্যপন্থী দলগুলোর কাছে ক্ষমতাই মুখ্য। আর ডানপন্থী দলগুলো ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন করতে চায়।

বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। জরিপ করলে দেখা যাবে, অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষে থাকবে, কিন্তু ইসলামী রাজনীতিটাকে তারা সবাই সমর্থন করে না। আগেই বলেছি ইসলামী রাজনীতির সাথে অন্যান্য ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দলগুলোর একটি মৌলিক পার্থক্য হলো, তারা ধর্মীয় আদর্শকে সংঘাতের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলে না। কিন্তু ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকেই সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলে।

বাংলাদেশে অনেকগুলো ইসলামী দল রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস ইত্যাদি বড় দল হিসেবে বিবেচিত। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব লক্ষ ও উদ্দেশ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি আছে। এ সকল দলের কোনো কোনো ব্যক্তি সমাজে আলেম হিসেবে পরিচিত। ফলে ব্যক্তি আলেমের কারণে দলের কিছু সমর্থক তৈরি হয়। কিন্তু দলে যোগদান ও কর্মী হতে গেলে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হয়। এভাবে দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য তৈরি হওয়ার পর তারা রাজনীতির মাঠে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ইসলামী রাজনীতি করা এই দলগুলোর একটি বদ্ধমূল বিশ্বাস— ইক্বামতে দ্বীন বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠাই হলো ইসলামের চূড়ান্ত বিষয়। খাঁটি বাংলায় বলতে গেলে গদি দখলের মাধ্যমে সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। ফলে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা কিংবা নিজেদের জানান দেয়ার মতো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মীবাহিনী তৈরি হলে তারা নির্বাচনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবতীর্ণ হয়।

বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির প্রকৃতি ও কার্যক্রম বিশ্লেষণে দেখা যায়, তারা যখন কাউকে দলীয় সদস্য করে তখন ঐ ব্যক্তিকে নতুন করে ইসলাম শেখায়। এর ফলে নতুন ইসলাম শেখা লোকটি বা লোকগুলোর মাঝে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে ‘কেবল তারা নিজেরাই সঠিক’। ফলে সমাজের অন্যান্য মুসলিমকে তারা মূলত ‘ডিনাই’ করে। তাছাড়া নামে বা বংশানুক্রমিকভাবে মুসলিম কিন্তু ইসলামী গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত নয়, অথচ রাজনীতি সচেতন ও ‘ধর্মীয় রিচ্যুয়াল’ মেনে চলে— এমন মুসলমানদেরও ‘নতুন করে ইসলাম শেখা’ ইসলামী রাজনীতির লোকজন খারিজ করে দেয় কিংবা প্রকৃত ইসলাম বুঝে না বলে মনে করে। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে ইসলাম না মানা কিংবা ইসলাম অস্বীকার করা লোকজনের কাছাকাছি মনে করে। কাউকে কাউকে মুনাফেকও মনে করা হয়।

ধরুন, একজন মানুষ তার শেখা জ্ঞান অনুযায়ী ইসলামকে কেবল ধর্ম হিসেবে চিনে। তো তিনি ধর্মীয় অনুশাসন হিসেবে নামাজ পড়েন, যাকাত দেন, রোযা রাখেন, হজ্জ্ব করেন; কিন্ত তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেন কিংবা মধ্যপন্থী পলিটিক্সে বিশ্বাস করেন অথবা ভোট দেয়ার সময় ইসলামী রাজনীতি করা লোকদের ভোট না দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। ইসলামী রাজনীতি করা লোকজন এই ধরনের লোকদের ইসলামের পক্ষের লোক হিসেবে মানতে চায় না। বরং, কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকে ইসলামের শত্রু তথা বাতিলের সাহায্যকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনকি ভাবতে থাকে, এই লোকগুলো আসলে প্রকৃত মুসলমান নয়। ফলে সাধারণ জনগণের একটি বিরাট অংশকে — যারা জন্মগতভাবে কিংবা উত্তারাধিকার সূত্রে অথবা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের অনুসারী হিসেবে মুসলমান — প্রকৃত মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

ইসলামী রাজনীতির আরেকটা বিপত্তি হলো, এর ফলে রাজনীতির ময়দানে একদল রাজনীতিক কর্মী তৈরি হয় যারা নিজেদেরকে যতটা না রাজনৈতিক কর্মী মনে করে তার চাইতে বেশি ইসলামের সৈনিক বা মুজাহিদ মনে করে। কিন্তু বাহ্যত তারা আসলে রাজনীতিই করে। বাইরের অন্য সবাই তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদেরকে ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে মনে করে। তাদের ফিলিংসটা এমন যে রাসূলের (সা) যুগে ইসলাম কায়েমের জন্য সাহাবীরা যে কাজ করেছেন তারাও সেই কাজই করছে। ফলে তারা নিজেদেরকে অন্যদের চাইতে সুপিরিয়র ভাবে। রাসূলের (সা) সময় সাহাবীগণ ইসলাম কায়েমের জন্য যেভাবে জানবাজি রাখতেন, সবকিছু ত্যাগ করতেন; তারাও সেই ফিলিংস নিয়ে তা করে। অথচ তারা স্রেফ রাজনৈতিক কর্মী। এর বেশি কিছু নয়।

যারা ইসলামী রাজনীতি করে তারা নিজেদের কাজকে ইসলামী আন্দোলন মনে করে। তারা দলের প্রত্যেকটা কাজকেই (মিছিল, মিটিং, ভোট দেয়া, মারামারি করা, ক্যাম্পাস দখল ইত্যাদি) ইসলামের কাজ এবং জেহাদের অংশ মনে করে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এসব দলের ইসলাম সম্পর্কিত কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয় অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে, নিজেদের মধ্যে। কেবল দলের সদস্যরাই এ সম্পর্কে জানে বা অংশ নেয়। বাইরের লোকজন যতক্ষণ না সেই দলে যোগ দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই কাজগুলো সম্পর্কে জানবে না। বাইরের লোকজন কেবল মিছিল, মিটিং, ভোট দেয়া, মারামারি করা, ক্যাম্পাস দখল ইত্যাদি কাজগুলোকেই দেখে। এবং অন্যদের কাছে তাদের এই কর্মকাণ্ড স্রেফ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই বিবেচিত হয়। অথচ তারা ভাবছে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তারা এসব করছে। বেহেশতের জন্য করছে। কিন্তু বাইরের লোকজন অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ, পুঁজিবাদী কিংবা বামপন্থী দলের সাথে তাদের খুব একটা পার্থক্য করতে পারে না। কেবল এতটুকু পার্থক্য যে এই লোকগুলো ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করছে। লোকগুলো তুলনামূলক ভালো। নামাজ পড়ে, দাড়ি রাখে বা ইসলামের মৌলিক হুকুমগুলো মানার চেষ্টা করে। এর বেশি কিছু নয়। ফলে দেখা যায়, ইসলামী রাজনীতি করা লোকজন যে ভাবনা বা ফিলিংস থেকে রাজনীতিটা করছে; অন্য লোকেরা তা কল্পনাও করতে পারছে না। ইসলামী রাজনীতি করা লোকদের কাছে যা ইসলামী আন্দোলন, অন্যদের কাছে তা স্রেফ রাজনীতি।

রাজনীতি হলো ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত বিষয়। আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হলো মাঠের ব্যাপারে। সেখানে পক্ষ-বিপক্ষ থাকাটা স্বাভাবিক। এখানে মিছিল-মিটিং হয়, সভা-সমাবেশ হয়। ভোট হয়। সেই ভোটে সরকারি ও বিরোধী দল হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো ‘ইসলামী রাজনীতি’ করা দলগুলোকেও এই প্রক্রিয়ায় আসতে হয়। তারাও পাবলিক মিটিং করে, সভা-সমাবেশ করে, ভোটে অংশ নেয়, ভোটের প্রচারণা চালায়। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেমন মানুষের উন্নয়নের জন্য ভালো কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেয়; ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো ভোটে গেলে একই ধরনের কথা বলে। কিন্তু রাজনীতির মাঠে তো কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। ফলে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি হতে হয়। কোনো দলই চায় না অন্য দল তার চাইতে বেশি জনসমর্থন অর্জন করুক, অন্য দলে তার চাইতে বেশি কর্মী থাকুক, ভোটে জিতে আসুক। এই প্রবণতার কারণে একটি দল অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করার মতোই ‘ইসলামী রাজনীতি’ করা দলেরও বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় নিজেদের ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সাধারণত ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহের কর্মকাণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ, বাধা বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাম দল, কিংবা মধ্যপন্থী অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটা করে থাকে।

এখানে একটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করা দরকার। কর্মকাণ্ডের দিক থেকে ইসলামী দলগুলো অন্যান্য দলগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন। যেমনটা ভিন্ন বাম দলগুলোও। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ইসলামী দলগুলো স্বীয় দলের নেতা-কর্মীদেরকে ইসলাম বুঝানো, মানানো এবং নতুন কর্মী সংগ্রহ করার জন্য আলাদা কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন কোরআন-হাদীস পড়া, ব্যাখ্যা করা, স্টাডি সার্কেল, যৌথভাবে ইবাদত করা ইত্যাদি। এই কাজগুলোকে ইসলামী দলের লোকজন স্বাভাবিকভাবেই কেবল ধর্মীয় কাজ হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংকেও ইসলামী দলের কর্মীরা স্রেফ ইসলামী কর্মকাণ্ড কিংবা ইবাদতের মতো মনে করে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে বড় হতে দিতে চায় না, ফলে ইসলামী দলের ঘরোয়া কাজগুলোতেও (কোরআন-হাদীস পাঠ করা, ব্যাখ্যা করা, যৌথভাবে ইবাদত করা) অন্য দলগুলো ক্ষেত্রবিশেষে বাধা দিয়ে থাকে। তাদের অনেকেই হয়তো স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার উদ্দেশ্যেই বাধা দিচ্ছে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘আদর্শিক প্রতিপক্ষ’ মনে করে বামপন্থী বা মধ্যপন্থী দলগুলো বা তাদের অনুসারী ব্যক্তিরা ইসলামী দলগুলোর এই কাজগুলোকে বাধা দেয়। যাহোক, তারা যখন বাধা দিচ্ছে তাদের মধ্যে এই ফিলিংসটা কাজ করে না যে তারা ইসলামী কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে। বরং এই ভেবে বাধা দেয়, ইসলামী দলগুলোকে কাজ করতে দিলে এরা আমাদের চেয়ে বড় হয়ে যাবে। বেশি জনসমর্থন অর্জন করবে। ভবিষ্যতে এমপি নির্বাচনে আমাদেরকে হারিয়ে দিতে পারে। কিংবা ক্ষমতাও দখল করতে পারে। এটা স্রেফ রাজনৈতিক ভাবনা।

কিন্তু ইসলামী রাজনীতি করা লোকজন নিজেদের কাজটাকে যেহেতু রাজনীতির পরিবর্তে ইসলামী আন্দোলন মনে করে, সেহেতু তাদের এই কাজগুলোর বিরোধিতাকে তারা ইসলামের বিরোধিতা কিংবা ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা হিসেবে বিবেচনা করে। অতএব, ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা মানে তো মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া। মানে একজন মানুষ যখন ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করবে সে তো আদতে আর মুসলমান থাকে না। ফলে ইসলামী রাজনীতি করা লোকজন তাদের রাজনীতির বিরোধিতাকারীদের ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির কারণে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা সেই ব্যক্তিটিই হয়তো খাস দিলে নামাজ-রোযা করছে। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে অন্য একটি রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের (ইসলামিস্টরা যাকে ইসলামী আন্দোলন বলছে) বিরোধিতা করছে। তার কাছে কিন্তু এটা ইসলামের বিরোধিতা নয়, স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধিতা; যেখানে ক্ষমতা আছে, মোহ আছে, স্বার্থ আছে। এটাকে তারা ধর্মের সাথে মিশাচ্ছে না।

একটা ব্যাপার লক্ষ করা খুব জরুরী, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। অন্তত ৫০ শতাংশ ধর্মকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলামী রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা তারও কম। এখন ইসলামী রাজনীতির কারণে অন্তত ২০ শতাংশ মানুষকে (এর চেয়ে বেশিও হতে পারে) ইসলামের শত্রুতে পরিণত হতে হচ্ছে। ফলে ইসলামী রাজনীতি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে মুসলমানদেরকে ইসলামের পক্ষ শক্তি ও বিপক্ষ শক্তিতে পরিণত করছে। যা খুবই ভয়ঙ্কর। যে মানুষটা ইসলাম কম বুঝার কারণে হয়তো অন্য একটি রাজনীতি করছে, কেবল রাজনৈতিক কারণে তাকে ইসলামের শত্রুতে পরিণত করা হয়। যদিও সে গতানুগতিকভাবে প্র্যাকটিসিং মুসলমান। রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ইসলামকে রাজনীতির ময়দানে তুলে ধরার ফলে অন্যান্য মুসলমানরাই ইসলামের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। যাকে ইসলামের শত্রু বলা হচ্ছে, সুযোগ পেলে সেই হয়তো ইসলামের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতো। কিন্তু ইসলামী রাজনীতি তাকে তা করতে দিচ্ছে না।

আরেকটি ব্যাপার হলো, যে ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে ইসলাম মানে না, তাকে কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে ইসলাম মানানো সম্ভব? যদি সেটা না হয় তাহলে কেন ইসলামী রাজনীতির প্রয়োজন? কেন ইসলামের নামে একটি রাজনৈতিক দল করে সেই দলকে ক্ষমতায় যেতে হবে? একজন শাসককে হটিয়ে বা একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে অন্য দলের ক্ষমতা গ্রহণ তো রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকের পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেটা করে সমাজের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়তো করা যাবে, কিন্তু সকল মুসলমানকে ইসলাম মানানো যাবে না। আর যদি আইন প্রয়োগ করে মানাতে হয়, তাহলে সেটা তো ‘অটোক্রেসি’ হয়ে যায়। সেটা সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে— রাজনৈতিক দল বা সরকার কি ধর্ম প্রচারকারী কিংবা ধর্মীয় বিধান বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করবে? এরূপ কাজ করলে সাধারণ মানুষ কি সেই দল বা সরকারকে মেনে নিবে? উপরন্তু ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে সেটার দরকার আছে কি?

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামী রাজনীতির কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা থেকে উত্তরণ দরকার। বিকল্প চিন্তা দরকার। ধর্মের নামে রাজনীতি হতে পারে। কিন্তু সেখানে বিরোধিতাকারীকে ইসলামের শত্রু বিবেচনা করা কতটা যৌক্তিক? কিংবা, যারা পক্ষের তাদেরই কেবল ইসলামী শক্তি হিসেবে বা ইসলামের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচয় দেয়া কতটা যৌক্তিক? এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বিশেষত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে — যেখানকার মানুষের মধ্যে প্রবল ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে — ইসলামী রাজনীতি (আধুনিককালে ইসলামী রাজনীতির যে ফরমেট তথা জামায়াত, ব্রাদারহুড ইত্যাদি) কতটা জরুরী? নাকি সেখানে বিকল্প কিছু ভাবা যেতে পারে? ভিন্ন কিছু হলে যারা ইসলাম কায়েম করতে চায় তারা কী করবে? (কোনো কিছু কায়েম করতে গেলেই তো অন্যকে ডমিনেট করতে হবে। সেটা অবশ্য ভিন্ন আলোচনা) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামকে সার্বজনীন অনুশীলনের বিষয়ে (কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল অর্থে নয়, সমাজে ইসলামের প্রসার ও চর্চা অর্থে) পরিণত করার বিকল্প কিছু আছে কি?

যদি বিকল্প চিন্তা করতেই হয়, তাহলে কী হতে পারে? এখানে একটা বিষয় বলতেই হয়, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। রাজনীতি সেই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার বাইরের কোনো বিষয় নয়। এই যুক্তিতে ইসলামী রাজনীতি তো করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সামগ্রিক জীবনে ইসলামকে বাস্তবায়নের যে চিন্তা থেকে ইসলামিস্টরা ইসলামী রাজনীতি করে, সেটা কি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগেই অন্য মুসলমানদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে করতে হবে, নাকি অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় করা উচিত? মানে, আমি সঠিক প্রক্রিয়ায় আছি, অন্যরা বাতিল শক্তি; সুতরাং, আমার মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেই কেবল ইসলাম বিজয় হবে— এমনটা ধরে নিয়ে রাজনীতি করতে হবে নাকি অন্য কোনোভাবে? সেক্ষেত্রে কি বিদ্যমান অন্য সকল শক্তিকে ইসলামবিরোধী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেই করতে হবে?

আসলে কী করতে হবে, তা স্পষ্ট হওয়া জরুরী। কারণ, নির্বাচনে গিয়ে কোনো দল যখন তার ইশতেহারে শরীয়ার কথা বলবে, কুরআনের আইনের কথা বলবে; তখন সেটার বিরোধিতা করাটা বিশ্বাসগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কুরআনে বিশ্বাস করে, ইসলামী হুকুম কমবেশি মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু সে ইসলামী দলের পরিবর্তে অন্য দল করে। এখন নির্বাচনী প্রচারণায় রাজনৈতিক কারণে তাকে সেই ইশতেহারের বিপক্ষে কথা বলতে হবে, যেই ইশতেহারে আল্লাহ, কুরআন কিংবা শরীয়ার কথা বলা আছে। এই পরিস্থিতি অন্য দলের রাজনীতি করা বিশ্বাসী মানুষকে অন্তত তাত্ত্বিক দিক থেকে ইসলামের শত্রুতে পরিণত করলো। আর বাস্তবে ইসলামী দলগুলো তো তাই মনে করে বা প্রমাণ করার চেষ্টা করে।

একটা বিষয় আছে, ইসলামিস্টরাও (‌ইসলামী দল নয়, বরং ইসলাম মানে এমন লোক) রাজনীতি করতে পারে। মানে যারা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী তারাও রাজনীতি করতে পারে। তাতে কোনো সমস্যা নাই। যখন সে রাজনীতি করবে তখন তারা মানুষের কাছে ইসলাম নিয়ে যাবে না, বরং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে যাবে। যেহেতু তারা রাষ্ট্র চালাবে, সুতরাং রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কিংবা জনগণের চাহিদা নিয়ে কিংবা জনগণকে তারা কী দিতে চায় সেটা নিয়েই যাবে। সেখানে অন্য অনেক কিছুর সাথে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি থাকতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলাম শেখানোর দায়িত্ব পালনকেই মুখ্য বিবেচনা করে জনগণের কাছে যাওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক হবে সেটা আলোচনার দাবি রাখে। ইসলাম শেখানো বা মানানোর কাজ যে কোনো ইসলামী সংগঠন বা দল (রাজনৈতিক দল নয়) করতেই পারে। কিন্তু তা রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। রাজনৈতিক দলের কাজ হলো ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা, ক্ষমতায় গিয়ে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা, জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা। ধর্ম শেখানো বা প্র্যাকটিস করানোর দায়িত্ব রাজনৈতিক দল গ্রহণ করলে তার পক্ষে রাষ্ট্র চালানো সম্ভব নয়। জনগণের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। আর আধুনিক কালে তো স্বয়ং সরকারের কাজই কমে যাচ্ছে। সরকার কেবল অন্যদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। বা অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। মানে অনেকটা ফেসিলিটেটরের ভূমিকা পালন করে। ফলে একটি রাজনৈতিক দল (ইসলামী দল নয়) ক্ষমতাসীন হয়ে বরং ইসলামী দল বা সংগঠনকে (রাজনৈতিক দল অর্থে নয়) কাজ করার সুযোগ তৈরি দিতে পারে, তার বেশি কিছু নয়।

উপরের আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্ন ও যুক্তি দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামী রাজনীতির বিভিন্ন বিপত্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। সংক্ষেপে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামী রাজনীতির বিপত্তিগুলো আবারও উল্লেখ করা হলো: (১) সাধারণ মুসলমানদেরকে বাতিলের সাহায্যকারী হিসেবে চিহ্নিত করা, (২) সাধারণ মুসলমানকে ইসলাম না বুঝা কমিউনিটি হিসেবে মনে করা, (৩) নিজেদেরকে ইসলাম শেখা/বুঝা একমাত্র কমিউনিটি মনে করা, (৪) ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েও নিজেকে মুজাহিদ মনে করা, (৫) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ইসলামী আন্দোলন বা জিহাদ মনে করা, (৬) নিজেরাই সঠিক ইসলাম পালনকারী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা, (৭) বিরোধী দলকে ইসলামের শত্রু বা বাতিল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা, (৮) রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতাকে ইসলামের কেন্দ্রীয় বিষয় বলে মনে করা।

এই আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট— এ সকল বিপত্তি তৈরি হওয়ার মূল কারণ হলো ক্ষমতা পরিবর্তনের নির্বাচনে তথা ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় ইসলামী দলগুলোর অবতীর্ণ হওয়া। এখানে সচেতনভাবেই ক্ষমতার পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কারণ, নির্বাচন বা নির্বাচনী প্রতিযোগিতা স্রেফ ক্ষমতার পরিবর্তন তথা শাসকের পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাহলে প্রশ্ন হলো এর সমাধান কী? তাহলে কি ইসলামী দল বা সংগঠন থাকবে না? কিংবা ইসলামী দল বা সংগঠন কি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিবে না? অথবা রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম কি ইসলামের বাইরে থেকে যাবে?

এই প্রেক্ষিতে এখানে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো:

  • একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অবশ্যই ইসলামী সংগঠন থাকবে। যেহেতু বিপত্তিটা তৈরি হয় ক্ষমতার প্রতিয়োগিতায় অংশগ্রহণ করায়, তাই ইসলামী সংগঠন বা দল নির্বাচনী প্রতিযোগিতা বা ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না।
  • ইসলামী দলগুলো হবে ভালো মানুষ তৈরির কারখানা। সেই ভালো মানুষগুলো রাজনৈতিক দলসহ সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে। যারা সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে ভালো কাজের উদাহরণ তৈরি করবে। একইসাথে সমৃদ্ধ ও উন্নত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে।
  • ইসলামী দল বা সংগঠনের কাজ হবে দ্বিমুখী। (১) মানুষদেরকে ইসলাম বুঝাবে, ইসলাম শেখাবে, সমাজের সর্বস্তরে ইসলাম অনুশীলনের প্রচেষ্টা চালাবে। অর্থাৎ দাওয়াহ। (২) তারা সমাজের অন্যতম বড় প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনদের ভালো কাজ করার জন্য চাপ তৈরি করবে। একইসাথে, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য এডভোকেসি, সভা, সেমিনার, পলিসি পেপার, জনসচেতনতা, সর্বোপরি প্রতিবাদ বা আন্দোলন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করবে।
  • ইসলামী দলগুলো হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে সরকার নির্ধারণের অন্যতম ক্রীড়ানক। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ না নিলেও ইসলামের দাওয়াহ কাজ করার কারণে তাদের প্রচুর সমর্থক থাকবে। যা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। দেশ, মানুষ ও ইসলামের জন্য যেসব রাজনৈতিক দলকে ভালো ও ইতিবাচক মনে করবে, এই বিপুলসংখ্যক সমর্থক তাদেরকে সমর্থন বা ভোট দিয়ে সরকার নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারবে।

এর বাইরে ইসলাম অনুশীলন করেন বা ইসলামী আদর্শ ধারণ করেন এমন ব্যক্তিরা মিলে রাজনৈতিক দল গড়তে পারেন। অথবা কোনো বড় ইসলামী সংগঠন আলাদা রাজনৈতিক শাখা তৈরি বা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোতে তাদের প্রভাব তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা হলো:

  • ক্ষমতার প্রতিযোগতায় অংশ নেয়া যে কোনো দলকে কেবল রাজনৈতিক দল হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভালো, খারাপ থাকতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই একে ইসলামী সংগঠন বা দল কিংবা ইসলামী আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তা সে পীর সাহেব, বড় কোনো মুফতির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল কিংবা ইসলামের আদর্শ ধারণকারী ব্যক্তির রাজনৈতিক দল হোক না কেনো।
  • ইসলামী দলগুলো চাইলে দেশে বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষেত্রবিশেষে সমর্থন দিতে পারে। তবে অবশ্যই সমর্থনের ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দলকে ইসলামের পক্ষের শক্তি এবং অন্যদেরকে ইসলামের বিপক্ষের শক্তি বানানো যাবে না।
  • কোনো ইসলামী দল চাইলে রাজনৈতিক শাখা তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে—
    • ঐ রাজনৈতিক শাখাকে বা দলকে দেশে বিদ্যমান অন্যান্য রাজনীতিক দলের মতোই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যেন বিবেচিত হয়, সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।
    • এ ধরনের রাজনৈতিক দলে যারা রাজনীতি করবে তারা দলটিকে রাজনৈতিক দলই মনে করবে। জনগণও তাদের কাজকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই জানবে।
    • ধর্মীয় সংগঠন বা ইসলামী সংগঠন বা ইসলামী আন্দোলনের সাথে এই দলের যেন কোনো দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি না হয়, সেটা স্পষ্ট রাখতে হবে।
    • ইসলামী দলের সদস্যদের দিয়ে তৈরি করলেও এটিকে ইসলামী দল থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
    • এই রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা যেন ইসলামের বিরোধিতা হিসেবে বিবেচিত না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে। যারা সেই দলের রাজনীতি করবে, তাদের কাজকে তারা যেন ইসলামী আন্দোলন মনে না করে। কেবল জনগণের সেবার জন্য রাজনীতি করছে, সেটা যেন মনে করে— তেমন ধরনের ম্যাকানিজম থাকতে হবে।
    • এই রাজনৈতিক দলের বিরোধী শক্তিকে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে হবে। ইসলামের শত্রু হিসেবে দেখা যাবে না।

এ ধরনের আরো লেখা