'রিক্লেইমিং দ্যা মস্ক' বইয়ের ধারাবাহিক অনুবাদ: পর্ব-১৭

মসজিদের সামাজিক কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণে কোনো বিধিনিষেধ আছে কি?

জবাব হলো— না। রাসূলের (সা) যুগে নারীরা বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নিচে কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো, যার মধ্যে কয়েকটি ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে:

রুবায়ই বিনতে মুয়াব্বিয ইবনে আফরা (রা) বলেন, আশুরার দিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সা) এক ব্যক্তিকে দিয়ে মদীনার পার্শ্ববর্তী আনসার গ্রামগুলোতে এই নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন:

“রোযা অবস্থায় যার সকাল হয়েছে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। আর যে ইতোমধ্যে নাস্তা করে ফেলেছে, সেও যেন দিনের বাকি অংশটুকুতে রোযা রাখে।” তারপর থেকে আমরা ওই দিন রোযা রাখতাম এবং আল্লাহ চাহে তো আমাদের বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখাতাম। আমরা সাধারণত মসজিদে যেতাম এবং বাচ্চাদের জন্য পশমের খেলনা বানাতাম। ক্ষুধা লাগার পর বাচ্চারা যখন খাবারের জন্য কান্নাকাটি করতো, তখন তাদেরকে ভুলিয়ে রাখার জন্য খেলনাগুলো দিতাম। এভাবে ইফতারের সময় হয়ে যেতো।[1]

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন:

“সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) খন্দকের যুদ্ধে আহত হলেন। … তারপর, রাসূল (সা) সাদের (রা) জন্য মসজিদের ভেতর একটি তাঁবু স্থাপন করলেন, যেন তাকে নিয়মিত দেখতে যেতে পারেন।[2] এই বর্ণনাটির ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, “রাসূল (সা) আসলে তাঁর মসজিদের পাশে স্থাপিত রুফাইদার (রা) তাবুতে সাদকে (রা) রাখতে বলেছিলেন। আহতদের চিকিৎসায় দক্ষতার কারণে রুফাইদা (রা) বেশ পরিচিত ছিলেন। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘সাদকে তার [অর্থাৎ, রুফাইদা (রা)] তাবুতে রাখো, যেন আমি কাছে থেকে তাকে দেখতে পারি।’”[3]

নিচের ঘটনাটি জাবের (রা) বর্ণনা করেছেন:

“খুতবা দেওয়ার সময় রাসূল (সা) সাধারণত একটা গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়াতেন। একদিন এক আনসার মহিলা রাসূলকে (সা) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার একজন দাস কাঠমিস্ত্রি। আমি কি তাকে দিয়ে আপনার জন্য একটি মিম্বর তৈরি করে দেবো?’ রাসূল (সা) বললেন, ‘হ্যাঁ’। মহিলা তাই করলেন। তারপর রাসূল (সা) সেটি ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এক জুমাবারে রাসূল (সা) যখন নতুন বানানো মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন, তখন আমরা ওই গাছের গুঁড়ি থেকে কাতর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। রাসূল (সা) বললেন, ‘গাছের গুঁড়িটি কাঁদছে। কারণ, আমি যে তার উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করতাম, গুঁড়িটি তা মিস করছে।”[4]

আয়েশার (রা) সূত্রে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,

“কোনো এক ঈদের দিন রাসূল (সা) আমাকে হাবশিদের খেলা দেখার জন্য ডাকলেন। মসজিদের ভেতর তারা বর্শা চালনায় নিজেদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করছিলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি খেলা দেখতে চাও?’ আমি বললাম: ‘হ্যাঁ।’ তারপর আমি তাঁর পেছনে দাঁড়ালাম। তিনি তাঁর কাঁধ নিচু করলেন যেন সেখানে আমার থুতনি রাখতে পারি। আমি তাই করলাম এবং তাঁর গালের সাথে আমার মুখ ঠেস দিয়ে খেলা দেখতে থাকলাম। এমনকি রাসূল (সা) কয়েকবার অনুরোধ করলেন যেন আমি ছেড়ে দেই। প্রত্যেকবারই আমি বলেছি, ‘আরেকটু অপেক্ষা করেন।’ সত্যি বলতে কি, খেলা দেখার প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। সেদিন বরং আমি চেয়েছিলাম, বিশেষ করে, নারীরা জানুক— তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক কেমন। তাই, তোমরা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রতি তরুণীদের আগ্রহকে সুদৃষ্টিতে দেখো।”[5]

বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) বলেন,

“আমি রাসূলের (সা) সাথে ঈদের নামাযে অংশগ্রহণ করলাম। তিনি আযান ও ইকামত ছাড়া এবং খুতবা দেওয়ার পূর্বেই নামায শুরু করলেন। নামায শেষে তিনি দাঁড়ালেন এবং বেলালের দিকে দৃষ্টিপাত করেই তিনি লোকদেরকে আল্লাহকে ভয় করা এবং তাঁর আদেশ মেনে চলার উপদেশ দিতে থাকলেন। প্রথমে তিনি পুরুষদেরকে উপদেশ দিলেন। তারপর নারীদের দিকে হেঁটে গেলেন এবং তাদেরকে উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন— ‘তোমরা দান করো।’ … নারীরা তাদের অলঙ্কার সামগ্রী দান করা শুরু করলো। তারা নিজেদের কানের দুল ও হাতের আংটি খুলে বেলালের (মেলে ধরা) কাপড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগলো।”[6]

দান প্রসঙ্গে একটি বিষয় না বললেই নয়, নারীরা আজকাল মসজিদ ও মসজিদ কেন্দ্রিক বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যাপক হারে দান করছে। কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদান করবে, অথচ সেটি হতে ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ও সেবা পাবে না— এটি অন্যায়। ইসলাম এটি সমর্থন করে না।

আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন,

একজন কালো মহিলা মসজিদ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন। একদিন তিনি মারা গেলেন। রাসূল (সা) যখন তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলেন, তখন সাহাবীরা বললেন, তিনি তো মারা গেছেন। রাসূল (সা) বললেন, “মহিলাটি যখন মারা গেলো, তখন তোমরা কেন আমাকে খবর দাওনি? এখন আমাকে তার কবরটা দেখিয়ে দাও।” তারপর রাসূল (সা) মহিলাটির কবরের কাছে এসে তার জন্য জানাযার নামায আদায় করলেন।”[7]

আনাস (রা) বর্ণনা করেছেন,

মসজিদের একটি দেওয়ালে থুথু দেখে রাসূল (সা) খুব রাগান্বিত হলেন। (তা দেখে) একজন আনসার নারী থামলেন এবং দেওয়ালের নিকট গিয়ে থুথু মুছে দিলেন। তারপর সেখানে কিছু সুগন্ধি লাগিয়ে দিলেন। তখন রাসূল (সা) বললেন, “এটি কতই না চমৎকার কাজ!”[8]

উপরোক্ত উদাহরণগুলো থেকে বুঝা যায়, মসজিদে নববীর সামাজিক ভূমিকার ক্ষেত্রে নারীদের অবদান ছিলো অমূল্য। সমাজে পুনরায় নারীদের সেই ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেওয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।

রাসূলের (সা) যুগে রমযান বা অন্য কোনো মাসে ইতিকাফের জন্য নারীদের মসজিদে অবস্থানের অনেক দলীল আছে। আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন,

“ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত রাসূল (সা) রমযান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। রাসূলের (সা) পর তাঁর স্ত্রীগণও এই অভ্যাস অব্যাহত রাখেন।”[9]

আয়েশা (রা) আরো বর্ণনা করেছেন,

রাসূল (সা) সাধারণত রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন এবং তিনি রাসূলের (সা) জন্য তাঁবু টাঙাতেন। ফজরের পর তিনি ওই তাঁবুতে প্রবেশ করতেন। হাফসা (রা) নিজের জন্য একটি তাঁবু টানাতে আয়েশার (রা) অনুমতি চাইলেন। আয়েশা (রা) তাঁকে অনুমতি দিলেন। ফলে হাফসা (রা) তাঁর তাঁবু টাঙালেন। এটি দেখে জয়নব বিনতে জাহশও (রা) আরেকটা তাঁবু টাঙালেন। সকালবেলা রাসূল (সা) তাঁবুগুলো খেয়াল করলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, “তুমি কি মনে করো, তারা পরহেজগারিতা থেকে এই কাজ করেছে?”[10] ফলে সেই মাসে তিনি ইতিকাফ পরিত্যাগ করেন এবং পরবর্তীতে শাওয়াল মাসের দশদিন ইতিকাফ করেন।[11]

রাসূলের (সা) স্ত্রী সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রা) বর্ণনা করেছেন,

রাসূল (সা) যখন রমযানের শেষ দশ রাত ইতিকাফ পালনের জন্য মসজিদে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি রাসূলের (সা) সাথে দেখা করেন। তিনি কিছুক্ষণ রাসূলের (সা) সাথে কথা বলেন এবং তারপর ঘরে ফিরে আসেন। রাসূলও (সা) তাঁকে এগিয়ে দিতে যান। তাঁরা যখন মসজিদের দরজার কাছে পৌঁছলেন, তখন দুজন আনসার সাহাবী তাঁদেরকে পাশ কাটালেন। তারা রাসূলকে (সা) সালাম দিয়ে দ্রুত সামনে চলে যান। রাসূল (সা) তাদের বললেন, “তাড়াহুড়া করার কিছু নেই, সে সাফিয়া বিনতে হুয়াই।” তারা স্বমস্বরে বলে উঠলো, “সুবহানাল্লাহ।”[12]

[মূল: জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]

অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

রেফারেন্স ও নোট:

[1] সহীহ বুখারী ৩/৩৭; সহীহ মুসলিম ২/৭৯৮। এখানে মুসলিমের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করা হয়েছে।

[2] সহীহ বুখারী, অভিযান অধ্যায়, ৪১৬/৮; সহীহ মুসলিম, জিহাদ অধ্যায়, ১৬০/৫।

[3] ফাতহুল বারী, ৪১৫/৮।

[4] মুসান্নাফে আবু শায়বা, ৩১৯/৬।

[5] সহীহ বুখারী, ৪৪৫; সহীহ মুসলিম, ৮৯২।

[6] সহীহ বুখারী, ১৪৬২।

[7] সহীহ বুখারী, অভিযান অধ্যায়, ৪১৬/৮; এবং সহীহ মুসলিম, জিহাদ অধ্যায়, ১৬০/৫।

[8] সহীহ ইবনে খুজায়মা, ১২২৯; এবং সুনানে ইবনে মাজাহ, ৭৬২; সুনানে নাসায়ী, ৭৯৭।

[9] সহীহ বুখারী, রোযা অধ্যায়, ৫/১৭৭।

[10] মূল সংস্করণের সম্পাদকের নোট: আলেমদের মতে, এই প্রশ্নের মানে হলো, “এই তাবুগুলো খাটানোর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ইবাদত ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, নাকি স্ত্রীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও টক্কর দেওয়া?”

[11] সহীহ বুখারী, নারীদের ইতিকাফ অধ্যায়, ৩/৪৮-৪৯।

[12] সহীহ বুখারী (৩/৪৯), মহানবীর স্ত্রীগণের গৃহসমূহ অধ্যায়, সহীহ মুসলিম (৪/১৭১২); সুনানে বায়হাকী (৪/৫২৯); ইতিকাফ অবস্থায় স্বামীর সাথে নারীদের দেখা-সাক্ষাৎ অধ্যায়; সহীহ ইবনে খুজায়মা (৩/৩৪৯), ইতিকাফরত স্বামীর সাথে স্ত্রীর দেখা-সাক্ষাতের রুখসত অধ্যায়; সহীহ ইবনে হিব্বান, ইতিকাফরত স্বামীর সাথে রাতের বেলা স্ত্রীর দেখা-সাক্ষাতের অনুমতি অধ্যায়; এবং অন্যান্য গ্রন্থ।

জাসের আওদা
জাসের আওদাhttp://www.jasserauda.net
মাকাসিদে শরীয়াহর উপর একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। ‘মাকাসিদ ইনস্টিটিউট গ্লোবাল’ নামক একটি থিংকট্যাংকের প্রেসিডেন্ট। ফিকহ কাউন্সিল অব নর্থ আমেরিকা, দ্য ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতওয়া এবং ফিকহ একাডেমি অব ইন্ডিয়ার সদস্য। পড়াশোনা করেছেন আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলস এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু থেকে ইসলামী আইন ও সিস্টেম অ্যানালাইসিসের উপর দুটি পিএইচডি করেছেন। বিভিন্ন দেশের বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। আরবী ও ইংরেজিতে প্রায় ২৫টি বইয়ের লেখক।

সাম্প্রতিক

এ ধরনের আরো নিবন্ধ