অমুসলিম নারী-পুরুষ কি মসজিদে প্রবেশ ও ইবাদত করতে পারবে?

দক্ষিণ আফ্রিকার একজন ধর্মান্তরিত মুসলমানের কাছ থেকে একবার আমি একটি তিক্ত ঘটনা শুনেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ইসলাম গ্রহণের আগে দীর্ঘদিন তিনি ইসলামের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন নিকটবর্তী একটি মসজিদে যেতে চাইলেন, তখন তাকে বলা হলো— যেহেতু তিনি অমুসলিম, তাই তার মসজিদে ঢোকার অনুমোদন নেই! তার কয়েকজন মুসলিম বন্ধু তার মসজিদ পরিদর্শনের অনুমতির ব্যাপারে বছরখানেক চেষ্টা করেন। অবশেষে মসজিদের ইমামকে রাজি করাতে সক্ষম হন। মসজিদের পরিবেশ তার বেশ পছন্দ হয়। তিনি কোরআন পড়তে পারবেন কিনা জানতে চান। তখন তাকে বলা হয়, অমুসলিম হওয়ায় তিনি কোরআন স্পর্শ করার মতো যথেষ্ট পবিত্র নন! আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ এবং তার কয়েকজন বিচক্ষণ মুসলিম বন্ধুর সাহায্যে অবশেষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আত্মীয়-স্বজন, বিশেষত নারী আত্মীয়দেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার প্রসঙ্গ আসলে তিনি এখনো একগুঁয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দের উপর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কারণ, অমুসলিমরা তো দূরের কথা, মুসলিম নারীদেরকেই এসব নেতৃবৃন্দ মসজিদে প্রবেশাধিকার দেয় না।

এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মসজিদের প্রকৃত ভূমিকা, নারীদের মর্যাদা এবং কোরআনের মিশন সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা এখনো আমাদের মসজিদগুলোতে প্রচলিত রয়েছে। এবং সমাজের অজ্ঞ ও অযোগ্য কিন্তু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কারণে এই অন্যায়গুলো চলে আসছে। মসজিদ এমন কোনো স্থান নয়, যা শুধু মুসলমানদের জন্য। কোরআন এমন কোনো গ্রন্থ নয়, যার শিক্ষা কেবল মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য। নারীরা পুরুষদের মতোই মসজিদে যাওয়ার সমান অধিকার প্রাপ্ত।

প্রকৃত সত্য হলো, অমুসলিম নারী-পুরুষকে মসজিদে আসা এবং কুরআন পড়ে দেখার জন্য বিশেষভাবে আহবান জানানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে কুরআন পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে আছে ‘সকল মানুষ’, ‘আহলে কিতাব’ এবং ‘কাফের’। এর উদ্দেশ্য হলো, যেন তারা কুরআনকে বুঝতে পারে। বলা হয়েছে, কোনো প্রশ্ন থাকলে তা যেন মোহাম্মদের (সা) কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে। আল্লাহ তায়ালা অমুসলিমদেরকে তাঁর বাণী পড়তে তিনি নিষেধ করেননি, এটি নিঃসন্দেহ। বরং শুরুতে তাদের উদ্দেশ্যেই কোরআন নাযিল করা হয়েছিলো।

ইবনে ইসহাক তাঁর সীরাত গ্রন্থে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইয়েমেনের নাজরান প্রদেশ থেকে খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলের (সা) সাথে মসজিদে নববীতে দেখা করেছিলো। প্রতিনিধি দলটি রাসূল (সা) এবং মদীনার ইহুদীদের সাথে পৃথকভাবে মসজিদের ভেতর জনসমক্ষে বিতর্ক করেছিলো। এরই মাঝে তাদের প্রার্থনার সময় হয়ে গেলে রাসূলের (সা) অনুমতি নিয়ে তারা মসজিদের ভেতরেই খ্রিষ্টীয় নিয়মে প্রার্থনা সম্পন্ন করে। এই ঘটনা সম্পর্কিত বিবরণীর একটি উদ্ধৃতি নিচে দেওয়া হলো। উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনুল কায়্যিম।[1] বিষয়টি আমাদের ভালো করে বুঝা প্রয়োজন।

‍“নাজরান থেকে খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকটে আসলো। মূল্যবান পোশাক ও জমকালো চাদর পরিধান করে তারা মসজিদে প্রবেশ করলো। রাসূল (সা) তখন সবেমাত্র আসর নামায আদায় করেছেন। বনী হারিস ইবনে কাবের নেতৃত্বে একটি পরিপূর্ণ উটের কাফেলা নিয়ে তারা এসেছিলো। সাহাবীদের মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এর আগে বা পরে এ রকম প্রতিনিধিদল তারা আর কখনো দেখেননি। তাদের প্রার্থনার সময় হলে তারা মসজিদে নববীর ভেতরেই প্রার্থনা করার জন্য ওঠে দাঁড়ালো। মহানবী (সা) সাহাবীদেরকে বললেন, ‘তাদেরকে প্রার্থনা করতে দাও।’ তারা পূর্বদিকে ফিরে তাদের প্রার্থনা করলো।

… তারপর, রাসূলের (সা) উপস্থিতিতে মসজিদে নববীর ভেতর নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলের সাথে মদীনার ইহুদীদের বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ইহুদী রাব্বিদের দাবি হলো ইব্রাহীম (আ) ইহুদী ছিলেন; আর খ্রিষ্টানদের দাবি হলো তিনি খ্রিষ্টান ছিলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আয়াত নাযিল করলেন:

يٰٓأَهْلَ الْكِتٰبِ لِمَ تُحَآجُّونَ فِىٓ إِبْرٰهِيمَ وَمَآ أُنزِلَتِ التَّوْرٰىةُ وَالْإِنجِيلُ إِلَّا مِنۢ بَعْدِهِۦٓ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ — هٰٓأَنتُمْ هٰٓؤُلَآءِ حٰجَجْتُمْ فِيمَا لَكُم بِهِۦ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَآجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُم بِهِۦ عِلْمٌ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ — مَا كَانَ إِبْرٰهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ — إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرٰهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهٰذَا النَّبِىُّ وَالَّذِينَ ءَامَنُوا ۗ وَاللَّهُ وَلِىُّ الْمُؤْمِنِينَ

‍‌‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা কেন ইব্রাহীম সম্পর্কে তর্ক করছো? তাওরাত এবং ইঞ্জিল তো তার পরবর্তীকালেই অবতীর্ণ হয়েছে। তোমরা কি তাও বুঝ না?

যেসব বিষয়ে তোমরা জ্ঞান রাখো, সেসব বিষয়ে তো যথেষ্ট বিতর্ক করেছোই। কিন্তু যেসব বিষয়ে তোমাদের কোনো জ্ঞান নাই, সেসব বিষয়ে কেন আবার বিতর্কে লিপ্ত হতে চাচ্ছো? আল্লাহই জানেন, তোমরা জানো না।

ইব্রাহীম না ছিলো ইহুদী, আর না ছিলো খ্রিষ্টান; বরং সে ছিলো আত্মসমর্পণকারী একনিষ্ঠ মুসলিম। সে কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না।

ইব্রাহীমের সাথে সম্পর্ক রাখার সবচেয়ে বেশি হকদার হলো তারা, যারা তার অনুসরণ করেছে। আর এখন এ সম্পর্ক রাখার বেশি হকদার হলো এই নবী এবং তার অনুসারী ঈমানদার লোকেরা। আল্লাহ ঈমানদারদের রক্ষাকর্তা।’

(সূরা আলে ইমরান ৩:৬৫-৬৮)

… তখন একজন রাব্বি জিজ্ঞেস করলো: ‘খ্রিষ্টানরা যেমন মরিয়ম পুত্র ঈসার উপাসনা করছে, তুমি মুহাম্মদও কি চাও যে আমরা তোমার উপাসনা করি?’ এবং নাজরানের একজন খ্রিষ্টান জিজ্ঞাসা করলো: ‘মুহাম্মদ, তুমি কি আমাদেরকে এই জন্যই ডেকেছো?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন: ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোনো কিছুর উপাসনা করা থেকে এবং কাউকে অন্য যে কোনো কিছুর উপাসনা করার আদেশ দেওয়া থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তোমরা যা বলছো, তা বলার জন্য আল্লাহ আমাকে পাঠাননি বা আদেশ করেননি। এই কুরআন পঠিত হবার জন্য আল্লাহ নাযিল করেছেন:

مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتٰبَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِّى مِن دُونِ اللَّهِ وَلٰكِن كُونُوا رَبّٰنِيِّۦنَ بِمَا كُنتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتٰبَ وَبِمَا كُنتُمْ تَدْرُسُونَ

‌‘আল্লাহ কাউকে কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুয়ত দান করবেন আর সে লোকদের বলে বেড়াবে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হয়ে যাও, এটা তার জন্য সম্ভব নয়৷ সে তো বরং এ কথাই বলবে, তোমরা আল্লাহর খাঁটি বান্দা হয়ে যাও, যেমনটা এই কিতাবের দাবি, যা তোমরা পড়ো এবং অন্যদের পড়াও৷’”

(সূরা আলে ইমরান ৩:৭৯)

নাজরানের খ্রিষ্টানদের ঘটনার বাকি অংশটুকু সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতের[2] ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর উল্লেখ করেছেন। সেটুকু হলো:

‍“তারা সত্যকে অস্বীকার করলো। অতঃপর তাদেরকে নতুন নাযিলকৃত আয়াতগুলো জানানোর পর ভোর শুরু হলে রাসূল (সা) হাসান ও হোসাইনকে তাঁর চাদরে জড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে আসলেন এবং তাঁর পিছু পিছু হেঁটে আসলেন ফাতেমা (রা)।”[3]

উপরোক্ত বর্ণনাগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, মসজিদে নববী ছিলো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও নারী-পুরুষের সাথে খোলামেলা, আন্তরিক ও নির্বিঘ্ন আলাপ-আলোচনার জায়গা। রাসূলের (সা) যুগের এই আদর্শ এখনকার মসজিদগুলোতেও অনুসরণ করা উচিত।

[মূল: জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]

অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

রেফারেন্স ও নোট:

[1] ইবনে কায়্যিম, যাদুল মা’আদ, পৃ. ৫৫০-৫৫২।

[2] খ্রিষ্টানরা রাসূলের (সা) যুক্তি অস্বীকার করার পর আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াত নাযিল করেন। সেখানে তিনি বলেন: “তোমার কাছে (পূর্ণ) জ্ঞান আসার পরে কেউ তার (ঈসার) ব্যাপারে তোমার সাথে বিতর্ক করলে বলবে, “এসো আমরা আমাদের ও তোমাদের পুত্রদেরকে, নারীদেরকে ও নিজেদেরকে ডাকি (অর্থাৎ নিজেদের স্ত্রীপুত্রদেরকে ডেকে নিয়ে আমরা উভয়পক্ষ বসি); তারপর (সবাই একত্রে) প্রার্থনা করে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত দেই।” সে মোতাবেক ভোরবেলা রাসূল (সা) তাঁর ঘরের লোকদেরকে নিয়ে বের হন। কিন্তু খ্রিষ্টানরা আসেনি। এটি মুবাহালার ঘটনা হিসেবে পরিচিত। — সম্পাদক

[3] তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৫৪/২।

এ ধরনের আরো লেখা