বিজ্ঞান, দর্শন ও ইসলাম: আলেমদের করণীয়
ইসলাম ও বিজ্ঞানের তুলনামূলক আলোচনা নিয়ে সম্প্রতি আমি একটি মাস্টার্স লেভেলের কোর্সে অ্যাটেন্ড করেছি, ঢাকার একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে যিনি কোর্সটি করালেন তিনি একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী (ইসলামিক কোনো একটা বিষয়ে, তবে আমি ধরে নিচ্ছি উনার পিএইচডিতে সায়েন্স নিয়ে কোনো গবেষণা ছিলো না)।
আমি মোটামুটি হা করে উনার কথা শুনেছি পুরোটা কোর্সে। আমাদের দেশে আলেম বা স্কলার নাম নিয়ে যারা চলেন তাদের অনেকের ইসলামিক জ্ঞানের গভীরতা কম। কখনো কোনো নির্দিষ্ট দলের সমর্থন নিয়ে, কখনোবা নির্দলীয় অবস্থানের সুবিধা নিয়ে এরা আপামর জনসাধারণের জ্ঞানহীন পছন্দ-অপছন্দের জোরে আলেম খেতাব পেয়ে থাকেন।
যেখানে এ ধরনের ব্যক্তিদের ইসলামের সম্পর্কিত জ্ঞানই কম থাকে, যা নিয়ে কিনা তারা সারাজীবন একটি সিস্টেমের ভেতর দিয়ে চর্চা করে থাকেন; সেখানে একটা ডিসিপ্লিন হিসেবে বিজ্ঞান – যার ব্যাপারে কিনা তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা নেই – সে ব্যাপারে তাদের ধারণা কতটা দুর্বল, সেটা নিয়ে মনে হয় তারা নিজেরাও সচেতন থাকেন না। কিন্তু সেই গোষ্ঠিগত একটা অবস্থান থেকে এমন এক ধরনের প্রত্যয় তাদের থাকে যেন বিজ্ঞান খুব একটা না বুঝলেও চলে। এটাকে আপনি ইসলামিক জাফর ইকবালীয় সিন্ড্রোম বলতে পারেন। জাফর ইকবাল যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সবকিছুকে সহজে বুঝতে শিখেছেন, তেমন করে আল্লাহওয়ালা মানুষরাও মনে করেন যে আল্লাহ প্রদত্ত বারাকার কারণে যা তাদের বুঝার কথা নয়, তাও তারা বুঝে যান।
ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে যদি আপনি আলোচনা করতেই চান সেটা হতে হবে মাল্টিডিসিপ্লিনারি। এ দুটি ডোমেইনের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি ও জ্ঞানচর্চার মেথডলজি ডিসকাস করে এমন দুটি ফিল্ডেই আপনাকে যেতে হবে। ইসলামের ক্ষেত্রে সেটি হয় উসূলের আলোচনার মাধ্যমে। যদিও একটি ফিল্ডে উসূলের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ করা কষ্টকর, তবুও যে ফিল্ডটি এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেটি হোলো উসূল আদ-দীন বা দীনের উসূল (এখানে মূলত আমরা কীসের ভিত্তিতে ও কোন পদ্ধতিতে দীনের মূল বিশ্বাস ও ধারণাগুলোতে পৌঁছাই তা নিয়ে আলোচনা করা হয়)।
আবার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেই আলোচনাটা হলো বিজ্ঞানের দর্শন এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতত্ত্ব। যে ব্যাপারটা এখানে বুঝা দরকার তাহলো আমাদের স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষা কিন্তু এই বিষয়ে ধারণা দেয় না। ফলে স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষাই যাদের বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায়, তারা কিন্তু বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকে না। তারা কেবল বিজ্ঞানের কিছু ফলাফলের ধারণা রাখে মাত্র। যেমন করে একজন সাধারণ মুসলিম জানে নামাজ পড়ার সময় কী করতে হয়। যেমন করে একজন সাধারণ বিজ্ঞানের ছাত্র কেবল জানে যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি জিনিসটা কী। যারা জ্ঞান প্রক্রিয়াকে বোঝার অংশ হিসেবে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানগুলোর ভিত্তি সম্পর্কে পড়াশোনা করে, তারা সায়েন্সের ফিলোসফি বা সায়েন্টিফিক মেথডলজি সম্বন্ধে জানতে পারে। যে কোনো ডিসিপ্লিনের ক্ষেত্রে এটা সত্য। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথেমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করে আসা ৯৯% স্কুল-কলেজের ছাত্রকে যদি বিজ্ঞানের দর্শন ও পদ্ধতিতত্ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে দেখবেন যে এই ব্যাপারে সে কোনো ধারণাই রাখে না (অবশ্য প্রশ্নকর্তার নিজের যদি সঠিক ধারণা থাকে, তবেই বুঝবেন)।
ইসলাম ও বিজ্ঞানের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে আপনি যে বর্তমান বিজ্ঞানের থিওরির সাথে কুরআনের আয়াতের মিল দেখিয়ে আলোচনা শেষ করছেন, এতে না হচ্ছে বিজ্ঞান, না ধর্ম। এটা যদি আপনি না বুঝেন, তাহলে এই না বুঝার পেছনে উসূল আর মেথডলজির ব্যাপারে আপনার জ্ঞানের অভাবই দায়ী।
সমস্যা হচ্ছে একজন কওমি মাদ্রাসা পাশ মুফতি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি তার ওয়াজে যেমন বিজ্ঞানের ব্যাপারে হাস্যকর অশুদ্ধ সব কথাবার্তা খুবই কনফিডেন্স নিয়ে বলে যাচ্ছে, ঠিক একই লেভেলের কথা একজন আলিয়া মাদ্রাসা পাশ পিএইচডি করা বিশ্ববিদ্যালয় লেকচারার বা প্রফেসরও বলছেন। উসূল আদ-দীন, সায়েন্টিফিক মেথডলজি ও ফিলোসফি নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা তো দূর কি বাত, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে এমনসব কথাবার্তা এ ভদ্রলোক বলছেন যে মাথায় হাত দেয়া বাকি।
একটা উদাহরণ দেই। আমি একদিন একটু দেরি করে ক্লাসে ঢুকলাম। সিটে বসে যে কথাগুলো শুনলাম, মনে হলো সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যাই। তিনি আলোচনা করছেন– নক্ষত্রের যে নিজস্ব আলো থাকে এটা নাকি ইবনে সীনা আবিষ্কার করেছেন। এই কথাটা অলরেডি একটা অবৈজ্ঞানিক কথা হয়ে গেছে ‘আবিষ্কার’ শব্দটা ব্যবহার করার কারণে। যাক। এরপর তিনি বললেন যে এর আগে অ্যারিস্টটল নক্ষত্রের আলোর ব্যাপারে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেন ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা বলতে গিয়ে যে বাক্যটা উনি উচ্চারণ করলেন সেটা অবিশ্বাস্য।
তার মতে, এর কারণ হলো, অ্যারিস্টটল পুঁজিবাদী ছিলেন!
কীসের সাথে কী! এবং আমি ভদ্রলোকের চেহারা দেখে বুঝতে পারছি যে উনি একটা কথার কথা হিসেবে এটি বলে দিয়েছেন। সমস্যাটা এখানেই। কোনো এক কারণে ইসলামকে জেতাতে চাওয়া ব্যক্তিদের একটা ধারণা হয়ে গেছে যে মঞ্চে কোনো একভাবে বিতর্ক করে কিছু চালু কথা বলে ইসলামকে জিতিয়ে দিলেই হলো। কথাটা সঠিক না বেঠিক, সেটি এখানে ইম্পর্টেন্ট নয়। ইসলাম জিতলো কিনা, বা যারা শুনছে তারা ইসলামকে বিজয়ী মনে করলো কিনা– সেটাই বড় কথা। ফলে তারা তাদের ওয়াজের মঞ্চে, বই-পুস্তকে, বা ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে এক অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের যুক্তিকে নিজেদের মনগড়াভাবে তুলে ধরে ঐটাকেই আবার নিজেরা ভাঙেন। তারপর জিতে যান। এই পুরো প্রসেসটায় তারা মৌলিক জ্ঞানের প্রশ্নে ইনসাফ করছেন কিনা, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। একটি মূর্খ জাতিকে কোনোরকমে এই বুঝ দেয়া যে ইসলাম থেকে আস্থা হারানোর কোনো কারণ নেই। এটাই হলো তাদের কাছে জ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য।
মুসলিমরা কেন এখন বিজ্ঞান থেকে সরে গেল এবং ‘খ্রিস্টান’রা (উদ্ধৃতি চিহ্ন খেয়াল করবেন) কেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেল– তার উত্তরে এই ব্যক্তি বললেন: আসলে মুসলিমরা অনেক সেল্ফিশ হয়ে গিয়েছে (মনে রাখবেন, এই ভাষা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার লেভেল ক্লাসে ব্যবহার করছেন)। আর ওদিকে খ্রিস্টানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগুনোর জন্য কুরআন থেকেই ‘বিজ্ঞানের’ নির্যাস নিয়ে কাজ করেছে। যদিও পিএইচডি করা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এসব কথার কোনো আগামাথা নাই। কিন্তু ঐ যে বললাম, ইসলাম নিয়ে যারাই কাজ করছেন তাদের সকলের পদ্ধতি হচ্ছে জ্ঞানের এই লড়াইয়ে তারা যেন একটা জিহাদে নামছেন। তারা মনে করেন– এই জিহাদে জিততে হলে কথার জোর, প্রেজেন্টেশন, সুন্দর সাহিত্য, বা গাজোয়ারি হুঙ্কার ইত্যাদি ব্যবহার করে মানুষকে বুঝাতে হবে যে পশ্চিমারা যতই উন্নতি করুক না কেন, ইসলামে সেইসব ইলহামপ্রাপ্ত মর্দে মুজাহিদ ও জ্ঞানকে পোষ মানানো শার্দুলরা জীবিত আছে যাদের কথার গরমে আপনি বুঝে যাবেন– ইসলামই সঠিক। এখন ধরেন, আপামর মুসলিম জনসাধারণ তো এটা মনে করেই যে ইসলাম সঠিক। আপনি যাই বোঝাবেন, দিনশেষে তারা যদি দেখে ইসলামে জিতছে তাহলেই তারা খুশি।
আমাদের ‘আলেম’-‘ওলামাদের’ যেটা বুঝা দরকার (কীভাবে তারা বুঝবেন এবং কে তাদের বুঝাবে এটা আল্লাহই ভালো জানেন) যে তারা বিজ্ঞান দূরে থাক, ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রগুলোও আসলে মৌলিকভাবে জ্ঞানকাঠামোর একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি অনুযায়ী শিখেন নাই। সেটা করতে হলে তালেবুল ইলম হতে হয়, জ্ঞান অন্বেষণকারী হতে হয়। জ্ঞান অন্বেষণকারী হওয়া মানে ছোটবেলা থেকে অনুসরণ করে আসা একটা সিস্টেমের তাবেদারী করা নয়, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন এটা প্রায় সর্বজনবিদিত যে এই সিস্টেমে সমস্যা আছে। আপনি হাটহাজারিতেই পড়েন কিংবা মদীনা বা আজহারে– আপনাকে বুঝতে হবে যে এগুলো শুধু জ্ঞান চর্চাকে শুরু করার একটা ট্র্যাক মাত্র। কেউ তো শূন্য থেকে শুরু করতে পারে না, তাই একটা ট্র্যাক লাগে। কিন্তু ট্র্যাকটা নিজেই যদি কারো মঞ্জিলে মাকসুদ হয়ে যায়, তাহলে তিনি সত্যিকারের তালেবুল ইলম হতে পারবেন না। তালেবুল ইলম হতে হলে সবকিছুকে প্রশ্ন করার এবং মৌলিক জ্ঞানকাঠামোকে আয়ত্ত্বে আনার আকুতি আপনার থাকতে হবে।
তার মানে কি আপনাকে এখন মাদ্রাসার পড়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান গবেষণা চালাতে হবে? যদি আপনি বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে চান, বেশ! কই? বিজ্ঞানের ছাত্ররা তো মাওলানা ডিগ্রি নেয় না, তাহলে আপনাকে কেন বিজ্ঞানের ডিগ্রি নিতে হবে? নিয়েন না। এমতাবস্থায় সেই জিনিস নিয়ে কথা বইলেন না, যা আপনি জানেন না। আর যদি আপনি চানই যে দীনের ঐ খেদমত করবেন, অর্থাৎ মানুষকে আপনি বিজ্ঞান আর ধর্মের পারস্পরিক সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের আলোকে ধর্মের পক্ষে সমর্থন দান করবেন, তাহলে আপনাকে এই জন্য জ্ঞান সাধনা আপনাকে করতে হবে। মানুষকে দুনিয়া কাঁপানো ওয়াজ না শুনিয়ে; নির্মোহভাবে ধর্ম, বিজ্ঞান ও দর্শন– এই তিনটির সম্পর্ক বোঝাতে হবে। এটি না করে মূর্খ অডিয়েন্সের কাছে হুঙ্কার দিয়ে আর গাঁজাখুরি গল্প দিয়ে কী অর্জিত হচ্ছে? এতে করে ইসলামের যে ক্ষতি হচ্ছে তা যিনি বুঝেন না, তিনি বিজ্ঞান তো দূরের কথা, বছরের পর বছর দরস করেও উসূল আদ-দীনই ঠিক মতো বুঝতে পারেননি– এ কথা বলা যায়।
মানুষকে একটা হিং টিং ছট বুঝ দেয়ার যে সুন্নত আপনারা শুরু করেছেন সেটা থেকে আল্লাহর ওয়াস্তে বের হোন। আর কিছু না হোক, নিজের দীনটার সত্যিকারের তালেব হন। উসূল নিয়ে নিরবচ্ছন্ন জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত থাকেন। এ দেশে তেমন একটা না থাকলেও বাইরে কিন্তু এমন অনেক আলেম আছেন, যারা এগুলো বোঝেন। তাদেরকে খুঁজে নেন এবং তাদের সম্বন্ধে পড়াশোনা করেন। মানুষের কাছে যতই আলেম, আল্লামা, শায়েখের তকমা পান না কেন নিজেরা একটু নিজেদের প্রশ্ন করেন– উসূলের বুঝ আপনাদের কতখানি? কুরআন, হাদীস, ফিক্হের উসূল বুঝতে আপনি কয়টা বই পড়েছেন? এ নিয়ে আপনার স্বতন্ত্র্য চিন্তা কতটা দাঁড় করাতে পারছেন? আপনি শরিঅত-তরিকত যাই অনুসরণ করেন, হানাফী হন বা আহলে হাদীস– ফাতাওয়ার বই থেকে মনপসন্দ ফাতওয়া বের করে মানুষকে শোনানো তো কঠিন কাজ নয়। ঐটা করেই যদি আল্লামা, শায়েখ ইত্যাদি তকমা পাওয়া যায় (আর আপনারাও যদি তাই বিশ্বাস করা শুরু করেন, মুখে যত বিনয়ের কালামই থাকুক না কেন), তাহলে সামনে ঘোর দুর্বিপাক আসতে পারে। আপনারাই এটি টেনে আনবেন। এর লক্ষণ আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি।