ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মত্যাগ কি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ?
এডিটর’স নোট:
ইসলামে মুরতাদের শাস্তি নিয়ে জনপরিসর তো বটেই, এমনকি সচেতন মুসলমানদের মধ্যেও বেশ বিভ্রান্তি রয়েছে। মুরতাদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড– এমন একটা ভুল ধারণা সমাজে বদ্ধমূল হয়ে আছে। ইতোপূর্বে আমরা তারিক রমাদানের একটি লেকচার থেকে এ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরের অনুবাদ পাবলিশ করেছিলাম। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য এবার অনুবাদ করা হলো জামাল বাদাবী রচিত Is Apostasy a Capital Crime in Islam? শিরোনামের এই আর্টিকেলটি। অনুবাদ করেছেন মাসউদুল আলম।
***
১. ভূমিকা:
রিদ্দা একটি আরবী পরিভাষা, যার শাব্দিক অর্থ দল বা ধর্ম ত্যাগ করা, অথবা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া।[1] কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম যদি ইসলামের প্রতি বিশ্বাস থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়, তাহলে সেটি বুঝাতে ইসলামী আইনশাস্ত্রে এই পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়। রিদ্দার শাস্তির ব্যাপারে গত প্রায় চৌদ্দশত বছর ধরে ফকীহদের মধ্যে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা গেছে। অধিকাংশ ফিকাহবিদের মতে, মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের সংহতি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হওয়ার কারণে রিদ্দা একটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোরআন ও হাদীসের আলোকে উক্ত অভিমতসমূহের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা। প্রবন্ধটির শুরুতে গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু কথা বলা হয়েছে। তারপর ইসলামী শরীয়াহর প্রাথমিক উৎসদ্বয় তথা কোরআন ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের সংশ্লিষ্ট দলীল-প্রমাণসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। মহানবীর (সা) ইন্তেকালের পর তাঁর সাহাবীগণ এ বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোও সংক্ষেপে বলা হয়েছে। পরিশেষে এ কথা বলে উপসংহার টানা হয়েছে যে, নিছক ইসলাম পরিত্যাগই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ– এমন দাবির পক্ষে চূড়ান্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২. গবেষণার পদ্ধতি:
ধর্মত্যাগ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত অন্য যে কোনো বিষয় বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সুস্পষ্ট ও কার্যকর একটি মেথডলজি ঠিক করা বেশ জটিল কাজ। উল্লেখ্য, ধর্মত্যাগ বা রিদ্দার বিষয়ে মতবিরোধের পরিধি বেশ বিস্তৃত। আইনী যুক্তিসমূহ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে ইসলামী আইনশাস্ত্র কয়েক শত বছরের চর্চার মাধ্যমে নিজস্ব মেথডলজি গড়ে তুলেছে। অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই শাস্ত্রটি ‘উসূলে ফিকহ’[2] বা ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি হিসেবে পরিচিত। গভীর আলোচনায় না গিয়ে উসূলে ফিকাহর শুধু উল্লেখযোগ্য ও মৌলিক কিছু সাধারণ নিয়ম তুলে ধরা হলো:
১। মুসলমানদের কোনো তৎপরতাই প্রকৃত ইসলামের সমমান সম্পন্ন নয়। এমনকি তা ইসলামের নামে বা আল্লাহর নামেও যদি করা হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃত ইসলামকে শুদ্ধতা নিরূপণের মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
২। প্রকৃত ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষার এক নম্বর ভিত্তি হলো ইসলামের সর্বপ্রধান উৎস আল-কোরআন। কোরআনের পরেই দ্বিতীয় উৎস হিসেবে রয়েছে হাদীস, কোনো কোনো সময় যাকে ‘সুন্নাহ’[3] পরিভাষা দিয়েও বুঝানো হয়। ইসলামী শিক্ষার মর্ম অনুধাবন ও বাস্তবায়নের দিক থেকে মহানবীর (সা) কথা, কাজ ও অনুমোদনকে হাদীস বলা হয়।[4] হাদীসকে রেফারেন্স হিসেবে নেয়ার ক্ষেত্রে এর বিশুদ্ধতাকে যথাযথ সতকর্তার সাথে বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক।
ইসলামী শিক্ষার উৎসগুলোর এই ক্রমসোপান বিবেচনায় রেখে আমরা আমাদের প্রথম ক্রিটিক্যাল প্রশ্নটির জবাব খোঁজা শুরু করতে পারি। প্রশ্নটি হলো– ধর্মত্যাগীর সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে কোরআনে কোনো দলীল আছে কি?
৩. কোরআনের দলীল-প্রমাণ যাচাই:
স্পষ্টতই, ধর্মত্যাগীকে দুনিয়াবী কোনো শাস্তি প্রদানের কথা সংবলিত একটি আয়াতও কোরআনে নেই। ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে কোরআনে বর্ণিত আয়াতগুলোতে কেবল পরকালে আল্লাহ কর্তৃক শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিচের আয়াত দুটি দেখুন:
وَمَن يَرْتَدِدْ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَـٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۖ وَأُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”[5] (সূরা বাকারা: ২:২১৭)
إِنَّ الَّذِينَ ءَامَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ءَامَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَّمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًۢا
“যারা একবার মুসলমান হয়ে পরে কাফের হয়ে গেছে, তারপর পুনরায় মুসলমান হয়েছে এবং আবারো কাফের হয়ে গেছে এবং দিন দিন কুফুরীর পরিমাণ বাড়িয়েই চলেছে, আল্লাহ তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না, সঠিক পথও দেখাবেন না।” (সূরা নিসা: ৪:১৩৭)
উপরের আয়াত থেকে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, কোরআন যদি ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদানের নির্দেশনা দিতো, তাহলে প্রথমবার ধর্মত্যাগের পরেই ধর্মত্যাগীকে হত্যা করা হতো। ফলে “তারপর পুনরায় মুসলমান হয়েছে এবং আবারো কাফের হয়ে গেছে এবং দিন দিন কুফুরীর পরিমাণ বাড়িয়েই চলেছে” – এ ধরনের কোনো সুযোগই কেউ পেতো না। আরো উল্লেখ্য, উপরে বর্ণিত আয়াতে বার বার ধর্মত্যাগের যে উদাহরণ দেয়া হয়েছে, এমনটি কেউ করলেও মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য নৈতিক বা আইনগতভাবে বৈধ কোনো নিদের্শনা বা নির্দেশ দেয়া হয়নি।[6]
ধর্মত্যাগের জন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ব্যাপারে কোরআনের এই নীরবতা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে– বিবেক, বিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতার পক্ষে কোরআনে অসংখ্য দলীল রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি আয়াত তুলে ধরা হলো:
وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ ۖ فَمَن شَآءَ فَلْيُؤْمِن وَمَن شَآءَ
“আর বলে দাও, ‘সত্য এসেছে তোমাদের রবের নিকট হতে, কাজেই যার ইচ্ছে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করুক।’” (সূরা কাহাফ: ১৮:২৯)
لَآ إِكْرَاهَ فِى الدِّينِ
“দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই।” (সূরা বাকারা: ২:২৫৬)
فَذَكِّرْ إِنَّمَآ أَنتَ مُذَكِّرٌ – لَّسْتَ عَلَيْهِم بِمُصَيْطِرٍ
“কাজেই তুমি তাদেরকে উপদেশ দাও, তুমি একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের ওপর জবরদস্তিকারী নও।” (সূরা গাশিয়াহ: ৮৮:২১-২২)
فَإِنْ حَآجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِىَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ ۗ وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتٰبَ وَالْأُمِّيِّۦنَ ءَأَسْلَمْتُمْ ۚ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا ۖ وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلٰغُ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌۢ بِالْعِبَادِ
“যদি এরা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে তুমি বলো– আমি এবং আমার অনুসরণকারীগণ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিয়েছি; অতঃপর যারা কিতাবপ্রাপ্ত এবং যারা (কিতাব না পেয়ে) মূর্খ (থেকে গেছে), তাদের জিজ্ঞেস করো– তোমরা কি সবাই আত্মসমর্পণ করছো? তখন তারা যদি আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেয় তাহলে তো তারা সঠিক পথ পেয়েই গেলো; আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে কেবল (আমার কথা) পৌঁছে দেয়া। আল্লাহ (নিজেই) তাঁর বান্দাদের (কর্মকাণ্ড) পর্যবেক্ষণ করছেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩:২০)
এগুলোসহ কোরআনের আরো অনেকে আয়াত মানুষের স্বাধীন সত্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যক্তি নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের কারণে আইন ভঙ্গ বা অপরাধ না করে। এই আয়াতগুলো ‘ইসলাম’ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ, স্বাধীন ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত থেকে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমে এবং তাঁর রহমত ও পথনির্দেশ লাভের মাধ্যমে শান্তি অর্জন করা, অন্তরের প্রশান্তি লাভ করা এবং আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিকূল তথা মানুষ, প্রাণীজগৎ, উদ্ভিদজগৎ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপন করা।
যদি কাউকে জোর করে মুসলিম বানানো হয়, কিংবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলমান হিসাবে থাকতে বাধ্য করা করা হয়, তাহলে এই শান্তি লাভ করা রীতিমতো অসম্ভব।
“হ্যাঁ, কাউকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়নি, তবে কেউ স্বেচ্ছায় একবার ইসলাম গ্রহণ করে ফেললে তা পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ”– এ প্রসঙ্গে এমন কথা বলাটাও অসঙ্গত। বিশ্বাসের স্বাধীনতা সংক্রান্ত কোরআনের অসংখ্য আয়াতের সাথে এ ধরনের যুক্তি কোনো অবস্থায়ই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ, বিশ্বাস হলো হৃদয়ের গভীর থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করা বা কোনো কিছুর ওপর আস্থা স্থাপন করার স্বতস্ফূর্ত এক অনুভব। যদি নিছক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদানের কথা বলা হয়, তাহলে এটি ধর্মের হবে ‘বলপূর্বক’ নিয়মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক নিয়ম। এটি বিবেকের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত লঙ্ঘন, যা কোরআনে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাছাড়া, এ ধরনের শাস্তির ভয় অনেককে মুনাফিকীর দিকে নিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, এর ফলে এ ধরনের লোকেরা নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যই শুধু অনেকে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেবে। চূড়ান্ত বিচারে– ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই– সমাজের জন্য ধর্মদ্রোহিতার চেয়ে মুনাফিকী আরো বেশি বিপজ্জনক সমস্যা। মুসলিম হিসাবে পরিচয়দানকারী মুনাফিকদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের অনেক বেশি ক্ষতি করা সম্ভব।
আরেকটি অদ্ভূত যুক্তি দেয়া হয় যে “দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই” (সূরা বাকারা: ২:২৫৬) শীর্ষক আয়াতটি নাকি রহিত করা হয়েছিলো। অথচ আমরা জানি, অন্য আরো অনেক আয়াতের মতো এই আয়াতটিও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকার মূলনীতিকে নিশ্চিত করে। তাই কট্টরপন্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এই আয়াতটির ‘রহিতকরণের’ মাধ্যমে এ ধরনের অন্য সকল আয়াতও রহিত হয়ে গেছে।
কিন্তু এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো, যে কোনো ধরনের নাসখের (নাসখ অর্থ বাতিল, আরো সঠিকভাবে বললে স্থলাভিষিক্তকরণ) দাবিকে অতি অবশ্যই সতর্কতার সাথে খতিয়ে দেখা উচিত। সম্পূর্ণ কোরআন নিশ্চিতভাবেই অথেন্টিক এবং অবিকৃতভাবে সুসংরক্ষিত (ক্বাতঈ ছুবুত)। তাই যে কোনো নাসখের দাবিকে অতি অবশ্যই সুনিশ্চিত হতে হবে। নিছক মতামত বা আন্দাজ-অনুমাননির্ভর হলে হবে না। ইবনে হাজার আসকালানীর একটি কথা ইমাম সুয়ূতী উদ্ধৃত করেছেন,
“নাসখের ক্ষেত্রে কোরআনের কোনো ব্যাখ্যাকারের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি যারা বিশুদ্ধ বর্ণনা ও সুস্পষ্ট দলীল ছাড়া ইজতিহাদ করেছেন সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু, মহানবীর (সা) জীবদ্দশায় কোনো বিধান বাতিল করে এর পরিবর্তে অন্য আরেকটি বিধান চালু করার সাথে নাসখের বিষয়টি সম্পর্কিত। তাই, এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাদীস ও ইতিহাসই কেবল গ্রহণযোগ্য। এছাড়া কারো মতামত বা ইজতিহাদ গ্রহণযোগ্য নয়।”[7]
কোরআনের কয়েক ডজন আয়াত রহিত করা হয়েছিলো বলে কয়েকজন স্কলার দাবি করলেও অধিকাংশ স্কলার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। উসূলে কোরআনের বিখ্যাত স্কলার জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রহিত আয়াতের সংখ্যা ১৯-এ কমিয়ে এনেছেন। অন্যদিকে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী এবং সুবহি আল-সালেহের মতো স্কলারগণ রহিতকৃত আয়াতের সংখ্যা আরো কমিয়েছেন।[8] সুয়ূতী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, বা আল-সালেহ কর্তৃক উল্লেখিত এসব রহিত আয়াতের কোনোটিই ধর্মে জবরদস্তি না থাকার বিষয় সম্পর্কিত আয়াতটিকে বাতিল করে না।
ইসলামী আইনশাস্ত্রের একটি প্রাথমিক মূলনীতি হলো কোরআনের কোনো আয়াত বাতিল হতে পারে শুধু কোরআনেরই অন্য কোনো আয়াত দ্বারা, কিংবা রাসূলের (সা) শিক্ষার আলোকে সরাসরি, অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও সুস্পষ্ট কোনো সুন্নাহ অনুযায়ী।
এটা একদম সুস্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত দলীল নেই। নিছক ধর্মত্যাগ করার কারণেই কাউকে শাস্তি দেয়া উচিত– এমন দাবির পক্ষে অন্তত কোরআনে মোটেও কোনো দলীল নেই।[9] ধর্মত্যাগ যে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ নয়– কোরআনে দলীল না থাকার ব্যাপারটিই এই অনুমানকে বৈধতা দান করে।
পরবর্তী ক্রিটিক্যাল প্রশ্নটি হলো এ ব্যাপারে হাদীসে সুস্পষ্ট কোনো দলীল আছে কিনা। এই ইস্যুটি এখন আলোচনা করা হবে।
৪. হাদীসের দলীল-প্রমাণ যাচাই
মহানবীর (সা) কথা, কাজ ও অনুমোদনকে হাদীস বলা হয়। আগেই বলা হয়েছে, কোরআনের পরেই ইসলামের দ্বিতীয় প্রধান উৎস হলো বিশুদ্ধ হাদীস। তাই আলোচ্য বিষয়ে জরুরি প্রশ্নগুলো হলো:
ক. মহানবীর (সা) জীবদ্দশায় ধর্মত্যাগের কোনো বর্ণনা কি পাওয়া যায়?
খ. এ ধরনের কোনো বর্ণনা থেকে থাকলে, সেগুলোর বিশুদ্ধতার মাত্রা কতটুকু?
গ. যদি কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে মহানবী (সা) কি সেই সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন?
ঘ. মহানবী (সা) এ ধরনের ঘটনা কীভাবে সামলেছেন? এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য বা পদক্ষেপ কী ছিলো?
ঙ. মহানবী (সা) কর্তৃক গৃহীত সেইসব ব্যবস্থা গ্রহণকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে? এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত কিছু নিয়মকে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এরমধ্যে একটি নিয়ম হলো– কোনো হাদীস যদি সত্যিকার অর্থে কোরআনের সাথে কিংবা আরো বিশুদ্ধ কোনো হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা উচিত হবে না। এই প্রশ্নগুলোর এক ধরনের সমন্বিত জবাব নিচে দেয়া হলো।
তওবা করতে অস্বীকারকারী কয়েকজন ধর্মত্যাগীকে আল্লাহর রাসূল (সা) হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মর্মে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এই সবগুলো বর্ণনাকেই হাদীস বিশারদগণ দুর্বল (অবিশুদ্ধ) বলে মনে করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিখ্যাত হাদীস বিশারদ মুহাম্মদ আল-শাওকানী [মৃত্যু: ১২৫৫ হিজরী] এই হাদীসগুলোর ইসনাদের (হাদীসের বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিক পরম্পরা) সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ কারণে এই হাদীসগুলো, বিশেষত মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির মতো গুরুতর বিষয়ে নির্ভরযোগ্য নয়।[10] এই হাদীসগুলোর কোনোটিই পূর্ববর্তীদের কর্তৃক বর্ণিত হয়নি এবং বুখারী ও মুসলিমের মতো তুলনামূলকভাবে অধিক নির্ভরযোগ্য হাদীসের উৎসগুলো থেকে এ সমস্ত হাদীসের অবস্থান বেশ দূরে।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ বাস্তবতা হলো, ধর্মত্যাগের ঘটনা সংক্রান্ত একটি হাদীস সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীসের গ্রন্থ সহীহ বুখারীতে আরো এক ধাপ বেশি নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী ইসনাদ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। এটি ধর্মত্যাগ সংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদীস। ধর্মত্যাগীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পক্ষের লোকেরাও বরাবর এই হাদীসটির উদ্ধৃতি দেয়। নিচে এর অনুবাদ ও এ সংক্রান্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো।
প্রথম হাদীস:
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, এক বেদুইন ইসলামের জন্য আল্লাহর রাসূলের (সা) প্রতি অনুগত থাকার বাইয়াত গ্রহণ করলো (অর্থাৎ, ইসলাম গ্রহণ করলো)। তারপর সে জ্বরে আক্রান্ত হলে রাসূলকে (সা) বললো, “আমার বাইয়াত বাতিল করে দিন।” কিন্তু রাসূল (সা) সম্মত হলেন না। বেদুইনটি আবার তাঁর কাছে এসে বললো, “আমার বাইয়াত বাতিল করে দিন।” কিন্তু রাসূল (সা) সম্মত হলেন না। তারপর বেদুইনটি মদীনা ত্যাগ করলো। তখন আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “মদীনা হলো এক জোড়া হাপরের মতো। এটি তার দূষিত উপাদানগুলো বের করে দেয় এবং কল্যাণগুলোকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়।”[11]
কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন– মদীনা পরিত্যাগ নয়, বরং বাইয়াত থেকে মুক্ত হওয়াই সম্ভবত লোকটির ইচ্ছা ছিলো। এই যুক্তির পক্ষে কোনো টেক্সটচুয়্যাল সাপোর্ট বা অন্য কোনো দলীল নেই। এই হাদীসটির শব্দচয়ন থেকে স্পষ্টত বুঝা যায়, স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণটাই ছিলো তার বাইয়াত। সুতরাং, বাইয়াত থেকে মুক্ত করে দেওয়া সংক্রান্ত অনুরোধের মানে হলো, সে ধর্মত্যাগ করতে চায়। এই ঘটনা মদীনায় সংঘটিত হয়েছিলো। মুসলমানরা তখন মদীনায় একটি স্বাধীন ইসলামী ‘রাষ্ট্রে’ বসবাস করতো, যেখানে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিলো মহানবীর (সা) হাতে। যদি সত্যিই ধর্মত্যাগের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ‘নাযিল’ হতো, তাহলে মহানবীই (সা) সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তি হতেন। বাস্তবতা হলো, সেই বেদুইনের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ধরনের শাস্তির ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালের ফিকাহবিদরা একমত হয়েছেন– সেই ‘ধর্মত্যাগীকে’ গ্রেফতার করার জন্য তিনি কাউকে পাঠাননি, তাকে আটক করেননি, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার বা পুনর্বিবেচনা করার জন্য তাকে অনুরোধও করেননি।
অন্যদিকে, এই হাদীসটি বা এ ধরনের অন্য হাদীসগুলোর ‘রহিত’ হয়ে যাওয়ার দাবির ব্যাপারেও সত্যিকারের কোনো ভিত্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে, এই হাদীসগুলো হচ্ছে এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তিকে প্রত্যাখ্যান ও বিবেকের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ইসলামের অন্যতম মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যশীল। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতটি দেখা যেতে পারে।
উপরে বর্ণিত ঘটনাটি রাসূল (সা) কর্তৃক গৃহীত ‘হুদাইবিয়ার সন্ধির’ একটি শর্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শর্তটি ছিলো, যদি মদীনায় হিজরতকারী কোনো মুসলমান ধর্মত্যাগ করে পূর্বের পৌত্তলিকতায় ফিরে যেতে চায়, তাহলে তার মক্কায় ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মহানবী (সা) বাধা দিতে পারবেন না। এটা সত্য যে, মক্কা বিজয় ও বিজয়ী বেশে মহানবীর (সা) মক্কায় প্রবেশের আগে এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো। যা হোক, কেউ কেউ আশা করেছিলো, মহানবী (সা) এই শর্তটি প্রত্যাখ্যান করবেন, যাতে এ ধরনের সম্ভাব্য ধর্মত্যাগীকে শাস্তি প্রদান করা যায়।
একটি ইন্টারেস্টিং বিষয় মনে রাখা দরকার, মুরতাদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষের স্কলারদের কেউ কেউ নিজেদের মতামতের ন্যায্যতা তৈরি করতে মুসলিম সমাজের বাহ্যত জরুরি সুরক্ষার দোহাই দেন এবং মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক বিভেদ ও মুসলমানদের ঈমান পরিত্যাগ ঠেকানোর যুক্তি দেন। অথচ এ ধরনের জাস্টিফিকেশন রাসূলের (সা) যুগে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ছিলো। কিন্তু, তিনি স্বেচ্ছায় হুদায়বিয়ার সন্ধিতে সেই শর্তটি মেনে নিয়েছিলেন এমন এক সময়, যখন মুসলিমরা আরো বেশি অরক্ষিত ছিলো এবং এই চুক্তির পরও তুলনামূলকভাবে বেশি অনিরাপদ ছিলো।
উপর্যুক্ত হাদীসটি এবং এ ধরনের অন্য বর্ণনাটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশুদ্ধ, নির্ভরযোগ্য এবং অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে অন্যান্য সহীহ হাদীস বিবেচনা করার সময় এগুলোকেও সমভাবে বিবেচনা করতে হবে।
দ্বিতীয় হাদীস:
আব্দুল্লাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঘোষণা দিয়েছে– আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি তাঁর রাসূল, তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত তেমন মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত করা যাবে না: খুনের ঘটনায় কিসাস, বিবাহিত ব্যক্তির ব্যাভিচার এবং সেই ব্যক্তি, যে ইসলাম থেকে ফিরে গেছে (মুরতাদ) এবং মুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করেছে।”[12]
এই হাদীসটি প্রায়শ হাদীস ব্যাখ্যার নির্দিষ্ট পদ্ধতির বাইরে গিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। মহানবী (সা) এখানে তিনটি অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়ে কথা বলেছেন। এর মধ্যে তৃতীয়টি হলো মুরতাদ হয়ে যাওয়া এবং মুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করা সংক্রান্ত। যদি নিছক ধর্মত্যাগ ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কাজ না করে শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করা সত্ত্বেও কাউকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা বৈধ হতো, তাহলে মহানবী (সা) কেন উপরে উল্লেখিত প্রথম হাদীসে বর্ণিত ব্যক্তিটিকে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দিলেন? আসলে তখন মুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করা বলতে বুঝানো হতো, ধর্মত্যাগের সাথে সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত শত্রুদের সাথে যোগদান করা।
যেহেতু ইসলাম একই সাথে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সত্তা, তাই ধর্মত্যাগ মাত্রই বিশ্বাসঘাতকতা– এই যুক্তিটি কয়েকটি দিক থেকে প্রশ্নসাপেক্ষ।
প্রথমত, কোরআনের নির্দেশ হলো, অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের লোকজন মুসলমানদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করলে তাদের সাথে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত ও সদয় আচরণ করতে হবে (সূরা মুমতাহিনা: ৬০:৮)। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা বা চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। কেউ মুরতাদ হয়ে যেতে চাইলে মুসলমানদের দৃষ্টিতে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। তবে সেক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো– এ ধরনের ধর্মত্যাগ রাষ্ট্রবিরোধী অন্যান্য অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট কি না?
তারচেয়েও মৌলিক প্রশ্ন হলো, ব্যক্তিগতভাবে ধর্মত্যাগ মাত্রই শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ কি না (আরবীতে যাকে ‘জারীমাহ’ বলা হয়)?
(১) এটি যদি অপরাধ হয়েই থাকে, তাহলে তা একান্তই আল্লাহর বিরুদ্ধে কৃত একটি অপরাধ (আর আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত কোনো ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কেয়ামতের দিন জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে)।
(২) কিংবা, এটি এমন এক অপরাধ– যেটি এই দুনিয়াতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য হিসেবে বিবেচিত, যার জন্য বিশেষ কোনো পরিস্থিতি বা শর্ত পূরণের প্রয়োজন নেই।
ধর্মত্যাগ অন্যান্য শাস্তিযোগ্য অপরাধের মতো কিনা, তা বলা বেশ দুরূহ ব্যাপার। ধর্মত্যাগের কারণে মুসলিম সমাজ বা ইসলামী রাষ্ট্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকে গৌণ করে দেখা এই পর্যালোচনার উদ্দেশ্য নয়। ধর্মত্যাগের পরিণতিতে মুসলিম সমাজে সাধারণ মানুষের মনোবলের উপর সম্ভাব্য প্রভাবকে উপেক্ষা করাও এর উদ্দেশ্য নয়। ড. ইউসুফ আল-কারযাভী ইসলাম অনলাইনে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধে এই সমস্যা ও ক্ষতিগুলো সুন্দর ও বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন।[13] বিশেষ করে যখন দেখা যায় যে মুসলমানরা মনে করছে– ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমনকি ধর্মীয়ভাবে পশ্চিমা আক্রমণ চলছে, (তখন তাঁর এই বক্তব্য আরো বেশি প্রাসঙ্গিক)। কিন্তু এই একই মুসলিম সমাজের মধ্যে এমন কিছু মুসলমান রয়েছে, যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরও নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে দাবি করে। ড. কারযাভী এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক মুরতাদী কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।[14] অথচ, তুলনামূলকভাবে বেশি ভয়ংকর, ধ্বংসাত্মক ও প্রপাগান্ডামূলক এই ‘মুরতাদী কর্মকাণ্ড’ শাস্তির আওতার বাইরে থেকে যায়।
উপরে উদ্ধৃত দ্বিতীয় হাদীসটির অন্য একটি ভাষ্য অধিকতর সুস্পষ্ট। এটি সম্ভবত এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে আমাদেরকে সহায়তা করবে।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন, “কোনো মুসলমান যদি ঘোষণা দেয় যে আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপাসনা লাভের অধিকার নেই এবং আমি তাঁর রাসূল, তাহলে তার রক্ত ঝরানো যাবে না। তবে তিনটি ব্যতিক্রম বাদে: কোনো বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে তাকে পাথর মারতে হবে; কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাকে হয় হত্যা করতে হবে, বা শূলে চড়াতে হবে, আর নয়তো দেশ থেকে বহিষ্কার করতে হবে; এবং কোনো ব্যক্তির হত্যাকারীকে বদলা হিসেবে হত্যা করতে হবে।”[15]
এই হাদীসটির ব্যাপারে নিচে কিছু মন্তব্য তুলে ধরা হলো:
১। ব্যভিচার এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে পরিকল্পিত হত্যা– এই দুটি ক্যাটাগরিতে উপরে উল্লেখিত বুখারীর হাদীসটির সাথে এই হাদীসটির অনেক মিল রয়েছে। তবে, বুখারীর হাদীসে বর্ণিত তৃতীয় ক্যাটাগরির ব্যাপারে এই হাদীসে কোনো মুসলমান কর্তৃক ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা’র বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কোনো মুসলমানের পক্ষে ধর্মদ্রোহী হওয়া অকল্পনীয় একটি কাজ হলেও হাদীসে তেমনটিই বলা হয়েছে।
ধর্মত্যাগের সুস্পষ্ট আলামত। যদিও এটি এমন কারো সাথে সংশ্লিষ্ট যে কিনা সত্যিকারের একজন মুসলিম।
২। আয়েশা (রা) বর্ণিত এই হাদীসটির অভিব্যক্তি এবং কোরআনে বর্ণিত অভিব্যক্তি হুবহু এক। কোরআনে বলা হয়েছে:
إِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَسْعَوْنَ فِى الْأَرْضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوٓا أَوْ يُصَلَّبُوٓا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلٰفٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ۚ ذٰلِكَ لَهُمْ خِزْىٌ فِى الدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِى الْءَاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আর ভূপৃষ্ঠে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা এক দিকের হাত ও অপর দিকের পা কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে; এটা তো দুনিয়ায় তাদের জন্য ভীষণ অপমানজনক ব্যাপার, আর আখিরাতেও তাদের জন্য ভীষণ শাস্তি রয়েছে।” (সূরা মায়েদা: ৫:৩৩)
এই আয়াত এবং আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি নিছক ধর্মত্যাগের সাথে সম্পর্কিত নয়; বরং ‘হিরাবাহ’ তথা হত্যা ও সশস্ত্র ডাকাতির মতো সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং জনজীবনে ত্রাস সৃষ্টিকারী অপরাধের সাথে সম্পর্কিত। এ ধরনের অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করে অপরাধীকে কী ধরনের শাস্তি দেয়া হবে, তা নির্ভর করে আদালতের উপর। বুখারীতে বর্ণিত এই তৃতীয় ক্যাটাগরি তথা ধর্মত্যাগের বিষয়টি মূলত অন্যান্য অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট, যেগুলোর কোনো কোনো মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ– এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা অযৌক্তিক নয়। এ রকম যুক্তিসঙ্গত একটি সম্ভাবনার কথা ইবনে তাইমিয়া (রহ) বিবেচনা করেছিলেন।[16]
তৃতীয় হাদীস:
ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার ধর্ম ত্যাগ করে, তাকে হত্যা করো।”[17]
ধর্মত্যাগকে যারা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে, তারা এই হাদীসটি সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত করে। এই বিষয়ে যদি এই একটা হাদীসই থাকতো, তাহলে তাদের যুক্তিটি হয়তো অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য হতে পারতো। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এই হাদীসটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে:
১. কোরআনের বিভিন্ন স্থানে ধর্মত্যাগের প্রসঙ্গ থাকলেও কোথাও দুনিয়াবী শাস্তির কথা বলা নেই।
২. কোরআনে বার বার নিয়মিতভাবে বিবেকের স্বাধীনতা এবং বিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতার কথা দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে।
৩. পূর্বে আলোচিত বুখারীর হাদীসটিতে দেখা গেছে, তৎকালীন মদীনায় এক ব্যক্তি যখন ধর্মত্যাগ করলো এবং এর ধারাবাহিকতায় মদীনা ত্যাগ করলো, তার ব্যাপারে স্বয়ং মহানবী (সা) কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
৪. মহানবী (সা) তাঁর জীবদ্দশায় ধর্মত্যাগের জন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন মর্মে কোনো সহীহ হাদীস নেই।
৫. এ ব্যাপারে ড. আল-আওয়া মতামত দিয়েছেন– “তাকে হত্যা করো” বক্তব্যটি অপরিহার্যভাবে বাধ্যতামূলক নির্দেশ বুঝায় না।[18] বাস্তবিক অর্থে, ইসলামী আইনশাস্ত্রের একটি মৌলিক নীতি হলো, অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়াটি বাধ্যতামূলক নির্দেশ অর্থে হতে পারে (যেমন– নামাজ, রোজা ও যাকাত)। আবার, এটি কোনো ঐচ্ছিক কাজকেও বুঝাতে পারে (যেমন– তাহাজ্জুত নামাজ)। আবার, এটি কোনো কাজের অনুমোদন অর্থেও বুঝানো হতে পারে। এভাবে অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়ার আরো অন্যান্য অর্থও হতে পারে। এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাপারে অধিকতর দলীল-প্রমাণের সমর্থন থাকা বা না থাকার উপর এর প্রাসঙ্গিক অর্থ নির্ভর করে। উপরে আলোচিত দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, এক্ষেত্রে রাসূলের (সা) নির্দেশ মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন অর্থে ছিলো বলে মনে হয়। তাও যখন ধর্মত্যাগের সাথে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অন্যান্য অপরাধ যুক্ত থাকে তখন। যেমন– মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা।
৬. ড. কারযাভী এই হাদীসটির সম্ভাব্য আরেকটি অর্থের কথা বলেছেন: “… আরেকটি সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে ‘যে ব্যক্তি তার ধর্ম ত্যাগ করে, তাকে হত্যা করো’ মহানবীর (সা) এ কথাটিকে ওমর (রা) যেভাবে বুঝেছেন। তা হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে এটি একটি নির্বাহী সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত ব্যাপার, যা ‘সিয়াসাহ আল-শারঈয়্যাহর আওতাভুক্ত। এটি কোনো ফতোয়া ছিলো না। কিংবা, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এমন কোনো সিদ্ধান্তও ছিলো না, যা স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে মুসলিম উম্মাহ মানতে বাধ্য থাকবে।”[19] এ থেকে বুঝা যায়, ধর্মত্যাগের জন্য যদি কোনো শাস্তি থেকেও থাকে (যেহেতু স্বয়ং মহানবী (সা) মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়া এক ধর্মত্যাগীকে কোনো শাস্তি প্রদান করেননি), তাহলে তা বাধ্যতামূলকভাবে নির্ধারিত শাস্তি তথা ‘হদ’ নয়। ড. আল-আওয়া এই মতামতের পক্ষে অন্যান্য প্রামাণিক তথ্য আরো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।[20]
চতুর্থ হাদীস:
ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে কেউ কেউ মহানবীর (সা) জীবদ্দশায় সংঘটিত একটি ঘটনার সাথে সম্পর্কিত একটি হাদীসের একাধিক ভাষ্যকে তুলে ধরেন। উকল ও উরাইনা গোত্র থেকে একদল লোক মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। কিছুদিন পর তারা ধর্মত্যাগ করে। তারপর একজন রাখালকে (অন্য বর্ণনা মতে কয়েকজন রাখালকে) নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে এবং তাদের দেহ বিকৃত করে ফেলে। মহানবীর (সা) নির্দেশে তাদেরকে গ্রেফতার ও হত্যা করা হয়।[21]
প্রশ্ন হলো, তাদেরকে কী ধর্মত্যাগের জন্য হত্যা করা হয়েছিলো, নাকি নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দায়ে? নিশ্চিতভাবেই জানা যায়, পরবর্তী কাজটির জন্যই তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো।
৫. সাহাবী ও তাবেয়ীদের কর্ম ও ব্যাখ্যা সংক্রান্ত দলীল-প্রমাণ যাচাই:
মহানবীর (সা) মুখ নিঃসৃত বাণীর সরাসরি বর্ণনা, কিংবা মহানবীর (সা) শিক্ষার আলোকে সাহাবীদের কর্মকাণ্ডের বর্ণনাগুলো হাদীস গ্রন্থসমূহের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। সাহাবীদের ঐক্যমত্যকে (ইজমা) ইসলামী শরীয়াহর উৎস হিসাবে গণ্য করা নিয়ে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আমরা এটিকে একটি বৈধ উৎস মনে করতে পারি। বিশেষ করে অন্যান্য দলীল-প্রমাণ যদি একে সমর্থন করে। সর্বোপরি, আমাদের মনে রাখতে হবে– ইসলামী শরীয়তে রাসূলের (সা) কথা ও কাজই হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কেননা, ঈমানের বিষয়গুলো কী হবে, তা আমরা জানতে পারি মহানবীর (সা) উপর নাজিলকৃত ওহীর মাধ্যমে।
আলী (রা), মুয়াজ (রা) ও আবু মুসা (রা) ধর্মত্যাগীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নির্ধারণ করেছিলেন বলে কয়েকটি হাদীস থেকে জানা যায়। যেমন একটি হাদীসে মুয়াজকে (রা) উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন– “এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিচার।”
যা হোক, এসব ঘটনার উদাহরণ থেকে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ,
১। বিশুদ্ধ হাদীসগুলো থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) নিজে এই শাস্তি নির্ধারণ করেননি। তিনি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
২। শাস্তি সংক্রান্ত অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদীসগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে, যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
৩। মুয়াজের (রা) মতো সাহাবী যখন বলেন, “এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিচার”, তখন তিনি এ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর যে ব্যাখ্যা উপরে দেয়া হয়েছে, সেভাবেও বুঝিয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করা সম্ভব।
৪। ড. আল-আওয়া এবং ড. কারযাভীর মত হলো, মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত এই বর্ণনাগুলো বাধ্যতামূলক আজ্ঞা অর্থে ছিলো না। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তখন ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাহী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। স্থান-কাল বিবেচনায় বর্তমানেও ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। ফতোয়া কোনো ‘ধর্মীয় সিদ্ধান্ত’ নয়, যা ‘যে কোনো স্থান ও পরিস্থিতিতে সদাসর্বদা উম্মাহ মানতে বাধ্য থাকবে’।[22]
উল্লেখ্য, এক ধর্মত্যাগীকে হত্যার খবর জানার পর ওমরের (রা) মতো নেতৃস্থানীয় সাহাবী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো, এমতাবস্থায় তিনি কী করতেন? তখন তাঁর প্রস্তাব ছিলো, ধর্মত্যাগীকে বন্দী করে রাখা উচিত এবং তাকে নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ দেয়া উচিত। উল্লেখ্য, তিনি কোনো সময়সীমার কথা উল্লেখ করেননি, যা বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের ধারণাকে বাতিল করে দেয়।
তাবেয়ীদের মধ্য থেকেও দুজনকে পাওয়া যায়, যারা একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তাঁরা হলেন– ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.) এবং সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.)।
কোনো কোনো স্কলার যুক্তি দিয়েছেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ধর্মত্যাগের কারণ ছিলো নিরাপত্তার অভাব ও যুদ্ধ পরিস্থিতি। যেমন জামাল আল-বান্নার অভিমত হলো: “রাসূলের (সা) যুগে ধর্মত্যাগের বিয়ষটি ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তাই, রাসূলের (সা) উপর ঈমান আনার মানে ছিলো তাঁকে সমর্থন করা এবং ধর্মত্যাগী হয়ে যাওয়ার মানে ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এবং পৌত্তলিকদের সাথে যোগ দেয়া।”[23] তারপর তিনি একটি উদাহরণ দেন। এটি হলো আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আস-সারহের ঘটনা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। পরে ইসলাম ত্যাগ করেন এবং মক্কায় গিয়ে কোরাইশদেরকে মহানবীর (সা) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচিত করেন। এ বিষয়ে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন শায়খ আব্দুল মাজিদ সুবহ।[24]
৬. উপসংহার:
এ বিষয়ে উপর্যুক্ত আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়–
১। কোরআন ও সুন্নাহর সংশ্লিষ্ট দলীলসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়– ধর্মত্যাগ মাত্রই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য শাস্তি, এ দাবির পক্ষে তেমন কোনো শক্ত ভিত্তি নেই।
২। রাসূলের (সা) নবুয়তী জিন্দেগীর প্রথম দিকে ধর্মত্যাগের জন্যে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের যেসব ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, সেগুলো নিছক ধর্মত্যাগের জন্য ছিলো না। বরং সংশ্লিষ্ট মুরতাদরা ধর্মত্যাগের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অন্যান্য অপরাধও করেছিলো।
৩। প্রাথমিক যুগে চতুর্মুখী আক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে উদীয়মান মুসলিম সমাজের জন্য ধর্মত্যাগ ছিলো একটি বড় ধরনের হুমকি। তাই এ ব্যাপারে তখন নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখালে মুসলিম সমাজের উত্থানই ঝুঁকিতে পড়ে যেতো। ধর্মত্যাগকে একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনার করার ব্যাপারে স্কলারদের মধ্যে ঐক্যমত্য হওয়ার পেছনে সম্ভবত এটি একটি কারণ। যদিও রিদ্দার উপযুক্ত শাস্তির ব্যাপারে নানা ধরনের মত রয়েছে।
৪। স্থান, কাল, পাত্র ও সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে ফতোয়ারও পরিবর্তন ঘটে। তাই ইসলামী আইনশাস্ত্রের প্রাথমিক সীমারেখার মধ্যে থেকে এই বিষয়টিকে পর্যালোচনা করা জরুরি। তবে নিছক অন্যদের চাপের কারণে এটি করা উচিত নয়। অন্যদেরকে খুশি করতে, কিংবা ‘মডারেট’ বা ‘ওপেন মাইন্ডেড’ উপাধি পাওয়ার জন্য শরীয়তের বিতর্কযোগ্য নয় এমন, অপরিবর্তনীয় এবং স্থায়ী বিষয়গুলো পরিবর্তন করার এখতিয়ার কারো নেই। অন্যদিকে, পরিবর্তনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে ইতোপূর্বে প্রদত্ত ফিকহী মতামত ও ব্যাখ্যাগুলোকে স্থায়ী হিসাবে বিবেচনা করারও অবকাশ নেই।
৫। এ ধরনের যে কোনো প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ইসলামী আইনশাস্ত্রের কিছু মূলনীতি সহায়ক হতে পারে। যেমন–
ক. “মা’আলাত আল-আফ’আল” তথা একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা গ্রহণ করার পরিণতিকে বিবেচনা করা। এমনকি অনুমোদিত বা পছন্দনীয় কোনো বিষয় পালন করতে গেলে যদি ইসলামের ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে, তাহলে তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইসলাম ও এর সুনাম রক্ষা করার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সা) অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। অথচ, তাঁকে যখন পরামর্শ দেয়া হলো– মদীনায় বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে থাকায় আব্দুল্লাহ ইবনে আবি সলুলকে হত্যা করা উচিত, মহানবী (সা) তখন জবাব দিলেন– তিনি আশংকা করছেন যে লোকেরা বলাবলি করবে, “মোহাম্মদ তার সাথীদেরকে হত্যা করছে।”
খ. প্রতিটি নির্দিষ্ট কাজের ভালো-মন্দ (আলাদাভাবে) বিচার করা। অবশ্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালে কোনো ভালো কাজও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
অতীতের তুলনায় আমাদের সমসাময়িক বিশ্বের পার্থক্য অনেক বেশি। তাই, বর্তমানে এই নীতিমালা প্রয়োগ করতে গেলে কিছু প্রশ্ন চলে আসে। যেমন–
ক. ইসলামী আইনশাস্ত্রে প্রচলিত একটি সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গিকে আঁকড়ে ধরলে কি মুসলমানদের এবং ইসলামের সুনাম বাড়বে? কিংবা, তাদের উপরে অন্যায়ভাবে আরোপিত অভিযোগসমূহ খণ্ডিত হবে?
খ. মহানবী (সা) ও প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ তাদের সময়কালে পরিবর্তনযোগ্য বিষয়গুলোকে (গাইরে সাবিত) যেভাবে বিবেচনা করেছেন, বর্তমানকালের স্কলারদেরও কি সেভাবে বিবেচনা করা উচিত নয়?
গ. ড. কারযাভী ও অন্যদের মতামত যাই হোক না কেন, ধর্মত্যাগের বিষয়ে উত্থাপিত কোনো অভিযোগকে সমাধা করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ, ধর্মত্যাগের আইনগত পরিণতির সাথে অনেক দিক থেকে ইসলামের পারিবারিক আইনের সম্পর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে অবশ্যই বেনিফিট অব ডাউট দিতে হবে। এবং শুধুমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞগণই এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। কেননা আমরা জানি, কোনো অবস্থায়ই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অনুমতি কাউকে দেয়া হয়নি।
এই নিবন্ধে যদি সঠিক কিছু থেকে থাকে, তাহলে তা একান্তই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এবং আমাদের স্কলারগণের নিকট থেকে কিছু শিখতে পারার ফল। তাঁদের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, যদিও আমি তাঁদের একজন নই। আর ভুল কিছু থেকে থাকলে এর দায় একান্তই আমার এবং এ জন্য আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। এই নিবন্ধে বলা এ বিষয়ে আমার প্রাথমিক চিন্তাভাবনাগুলোর সাথে কেউ দ্বিমত করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আলোচনায় কোনো অসুবিধা দেখি না। একইসাথে আল্লাহ তায়ালার নিকট বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে সম্পূর্ণ সত্য উপলব্ধি এবং এর উপর আমল করার তৌফিক দান করেন।
রেফারেন্স ও নোট:
[1] বায়ালবাকী, রুহী, আল-মাওরিদ: অ্যা মডার্ন অ্যারাবিক-ইংলিশ ডিকশনারি, দারুল ইলম লিল-মালায়ীন, বৈরুত, পঞ্চদশ সংস্করণ, ২০০১, পৃ. ৫৮২।
[2] এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন– কামালী, মোহাম্মদ হাশিম, প্রিন্সিপালস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স, ইসলামিক টেক্সটস সোসাইটি, ক্যামব্রিজ, ১৯৯১।
[3] হাদীস ও সুন্নাহর মাঝে বেশ পার্থক্য রয়েছে বলে কোনো কোনো স্কলারের অভিমত থাকলেও অধিকাংশ স্কলারই এ দুটি পরিভাষাকে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন– আল-সালেহ, সুবহি, উলুমুল হাদীস ওয়া মুসতালাহুহ (আরবী), দারুল ইলম লিল-মালায়ীন, বৈরুত, ত্রয়োদশ সংস্করণ, ১৯৮১, পৃ. ৩, ১১।
[4] আইন বিষয়ক সুন্নাহ (আস-সুন্নাহ আত-তাশরিয়্যাহ) ও আইন নিরপেক্ষ সুন্নাহর পার্থক্য জানতে দেখুন– কামালী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০-৫৭। আরো দেখুন– আল-সালেহ, সুবহি, মাবাহিত ফি উলুমুল কোরআন, দারুল ইলম লিল-মালায়ীন, বৈরুত, চতুর্দশ সংস্করণ, ১৯৮২, পৃ. ৩৪-৩৫।
[5] মূল লেখক কোরআনের ইংরেজি অনুবাদ নিয়েছেন মূলত মুহাম্মদ আসাদের ‘দ্যা ম্যাসেজ অব দ্যা কোরআন’, দারুল আন্দালুস, জিব্রাল্টার, ১৯৮৪ সংস্করণ থেকে। বোধগম্যতার স্বার্থে তিনি সামান্য কিছু পরিমার্জনও করেছেন। আমরা এই নিবন্ধে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা মুজিবুর রহমান ও হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ কৃত বাংলা অনুবাদ গ্রহণ করেছি। মূল লেখকের মতো আমরাও অনুবাদের ভাব ঠিক রেখে বোধগম্যতার স্বার্থে ভাষাগত কিছু পরিমার্জন করেছি। – অনুবাদক
[6] ধর্মত্যাগ সংক্রান্ত অন্যান্য আয়াতের জন্য দেখুন– সূরা ইমরান: ৩:৬২, ৮৬, ৯০; সূরা মায়েদা: ৫: ৫৪; সূরা তওবা: ৯: ৭৩-৭৪; সূরা নাহল: ১৬:১০৬ এবং সূরা মুহাম্মদ: ৪৭:২৫।
[7] আল-সুয়ূতী, জালাল উদ্দীন, আল-ইতক্বান ফিল উলুমুল কোরআন, আল-হালাবী, কায়রো, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৭৮, খণ্ড-২, পৃ, ৩২।
[8] দেখুন– আল-সালেহ, সুবহি, মাবাহিছু ফি উলুমিল কোরআন, দারুল ইলমি লিল-মালায়ীন, বৈরুত, চতুর্দশ সংস্করণ, ১৯৮২, পৃ. ২৭২-২৭৪।
[9] কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে, এই দুনিয়াতে এবং পরকালে আল্লাহ কর্তৃক শাস্তি প্রদানের কথা কোরআনে (সূরা তওবা: ৯:৭৪) বলা হয়েছে। তবে, কোরআন-হাদীসের পাঠ এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত– উভয় দিক থেকেই আয়াতটির উদ্দেশ্য মুনাফিকরা, ধর্মত্যাগীরা নয়। ঈমানের ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মুনাফিকরা নিজেদেরকে ঈমানদার বলে দাবি করে যেতো। তাই তাদেরকে ‘ধর্মত্যাগী’ বলা হতো না। এক্ষেত্রে বেসিক রুল হলো, মুনাফিকদের ঈমান গ্রহণের দাবি মেনে নেয়া এবং ইহজগত ও পরজগতে তাদের শাস্তির বিষয়টি একান্তভাবে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া।
[10] আল-শাওকানী, মুহাম্মদ বিন আলী, নাইলুল আওতার, দারুল জীল, বৈরুত, ১৯৭৩, খণ্ড-৮, পৃ. ২-৩।
[11] সহীহ বুখারী (মুহাম্মদ মুহসীন খান অনূদিত), মাকতাবাতুল রিয়াদ আল-হাদীসাহ, রিয়াদ, ১৯৮২, খণ্ড-৯, হাদীস নং– ৩১৬, পৃ. ২৪১। একই ধরনের আরো হাদীস অন্যান্য বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যেমন: হাদীস নং– ৩১৮, পৃ. ২৪২; হাদীস নং– ৩২৩, পৃ. ২৪৬।
[12] আল-আসকালানী, ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী বি শরহান সহীহুল বুখারী (আরবী), এম. আব্দুল বাকী এবং এম. আল-খতীব কর্তৃক সম্পাদিত, দারুল রাইয়্যান লিততুরাস, কায়রো, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৮৭, খণ্ড-১২, বাবে দিয়াত, হাদীস নং– ৬৮৭৮, পৃ. ২০৯, এই লেখক কর্তৃক অনূদিত।
[13] http://islamonline.net/English/contemporary/2006/04/article01c.shtml – ১৪ এপ্রিল, ২০০৬ তারিখে আপডেটকৃত।
[14] প্রাগুক্ত
[15] আল-আজদী, আবু দাউদ সুলাইমান (মৃত্যু: ২৭৫ হিজরী), সুনান আবু দাউদ (আরবী সংস্করণ), সম্পাদনা: এম. এম. আব্দুল হামীদ, মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, বৈরুত, তারিখ নেই, খণ্ড-৪, হাদীস নং– ৪৩৫৩, পৃ. ১২৬, এই লেখক কর্তৃক অনুদিত।
[16] ইসলাম অনলাইন, পূর্বোক্ত।
[17] সহীহ বুখারী, পূর্বোক্ত, খণ্ড-৯, হাদীস নং– ৫৭, পৃ. ৪৫।
[18] ইসলাম অনলাইন, পূর্বোক্ত।
[19] ইসলাম অনলাইন/আরবী পেজ। এই লেখক কর্তৃক অনূদিত।
[20] প্রাগুক্ত
[21] সহীহ বুখারী, পূর্বোক্ত, খণ্ড-৮, হাদীস নং– ৭৯৪, ৯৭৫, ৭৯৬, ৭৯৭, পৃ. ৫১৯-৫২২।
[22] ইসলাম অনলাইন, পূর্বোক্ত।
[23] ইসলাম অনলাইন/আরবী পেজ। জামাল আল-বান্না কর্তৃক লিখিত একটি নিবন্ধ, এই লেখক কর্তৃক অনূদিত।
[24] ইসলাম অনলাইন, পূর্বোক্ত।