সুখী হওয়ার চেয়েও জীবনটা আরো বেশি কিছু

এডিটর’স নোট: ২০১৭ সালের  সেপ্টেম্বরে ‘The Power of Meaning: Finding Fulfillment in a World Obsessed with Happiness’ শিরোনামে একটি বই বেরিয়েছে। লিখেছেন এমিলি ইসফাহানী স্মিথ। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, জীবনের অর্থপূর্ণতা থাকা সুখের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বইটি নিয়ে টেড টকে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে তিনি কথা বলেছেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য সেই বক্তব্যটি অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।

*****

আগে আমি মনে করতাম, জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সুখের পেছনে অন্তহীন ছুটে চলা। সবাই আমাকে বলতো, সুখী হওয়াটাই হলো সফলতা। তাই আমি একটা পছন্দের চাকুরী, একজন ভালো বয়ফ্রেন্ড, একটি সুন্দর এপার্টমেন্ট – এইসব পাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি কখনোই এসবের মধ্যে পরিপূর্ণতা খুঁজে পাইনি। বরং দুশ্চিন্তা ও অসহায়ত্ব আমাকে সবসময় গ্রাস করে রাখতো। আমার নিজের ক্ষেত্রেই শুধু এমনটি ঘটেনি; আমার বন্ধুরাও একই ধরনের সমস্যার মধ্যে রয়েছে। মানুষের সত্যিকার সুখ কীসের মধ্যে, তা জানার জন্য আমি এমনকি ‘পজিটিভ সাইকোলজিতে’ স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেই। সেখানে আমার সামনে উন্মোচিত সত্য আমার জীবনবোধকেই পাল্টে দিয়েছে।

বিদ্যমান তথ্য অনুযায়ী, সুখের পেছনে ছুটে বেড়ানো মানুষকে অসুখী করে তুলতে পারে। আমি খুব অবাক হয়েছি এটা জেনে যে, দুনিয়া জুড়ে আত্মহত্যার হার বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় আত্মহত্যার হার বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ যে কোনো মানদণ্ডে মানুষের জীবনমান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে, তবু আরো বেশিসংখ্যক মানুষ এখন হতাশা, দুশ্চিন্তা ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। এক অদ্ভুত শূন্যতা মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝার জন্য আপনার নিজেরই হতাশাগ্রস্ততার অভিজ্ঞতা থাকার দরকার নেই। একটু চিন্তা করলেই যে কেউ সমস্যাটির গভীরতা বুঝতে পারবে। আমি মনে করি, আজ হোক, কাল হোক, আমাদের সবারই নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার: ব্যাপারটা কি এমনই হওয়ার কথা ছিলো?

এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল হলো, নিছক সুখের অভাব মানুষের হতাশার প্রধান কারণ নয়। বরং ‘অন্য কোনোকিছুর’ অভাবেই তৈরি হচ্ছে হতাশা। সেটি কী? আমার মতে, তাহলো জীবনে অর্থপূর্ণতার অভাব। তবে এই জবাব আমার মনে আরো কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে– সুখী হওয়ার চেয়েও বড় কিছু কি জীবনে আছে? জীবনের বিশেষ কোনো অর্থ থাকা আর সুখী হওয়ার মধ্যে পার্থক্য কী?

সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানী স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামে থাকা, সুখকর অনুভূতি থাকার কথা বলেছেন। কিন্তু জীবনের অর্থপূর্ণতার বিষয়টি আরো গভীর ব্যাপার। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী মার্টিন সেলিগম্যানের মতে, জীবনের অর্থপূর্ণতা আসে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক (belonging), ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কোনোকিছু বিলিয়ে দেয়া এবং নিজের ভেতরে লালন করা সদ্গুণ থেকে।

আমাদের সংস্কৃতি সুখের মোহে আচ্ছন্ন। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, এরচেয়ে বরং জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করা আরো বেশি সুখদানকারী ব্যাপার। এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল থেকেও জানা যায়, যাদের জীবনে অর্থপূর্ণতা রয়েছে, তারা তুলনামূলকভাবে দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে তারা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকে। এমনকি তারা বাঁচেও বেশিদিন। এ পর্যায়ে আমার মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে– আমরা প্রত্যেকে কীভাবে আরো বেশি অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারি?

এর উত্তর খুঁজে পেতে আমি টানা পাঁচ বছর শত শত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। মনোবিদ্যা, স্নায়ুতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রের হাজার হাজার পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করেছি। এক পর্যায়ে আমি জীবনের অর্থপূর্ণতা অর্জনের চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছি। যাকে আমি বলছি ‘অর্থপূর্ণ জীবনের চার স্তম্ভ’। আমরা যদি এসবের কিছু কিছু বা সবগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে প্রত্যেকেই জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারবো।

প্রথম স্তম্ভ: হৃদ্যতা (belonging)

হৃদ্যতা আসে এমন সম্পর্ক থেকে, যেখানে আপনি প্রকৃতপক্ষে যেমন, সেভাবেই আপনাকে মূল্যায়ন করা হয় এবং আপনিও অন্যদেরকে সমভাবে মূল্যায়ন করেন। কিন্তু অনেক সম্পর্কের মধ্যে এই হৃদ্যতার ব্যাপারটি তেমন মজবুত নয়। এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিসত্তার পরিবর্তে আপনি কী বিশ্বাস করেন বা অপছন্দ করেন, তার আলোকেই আপনাকে মূল্যায়ন করা হয়।

সত্যিকারের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় ভালোবাসা থেকে। ব্যক্তির মধ্যে প্রতিনিয়ত সেটি কাজ করে। অন্যদের সাথে আপনি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবেন কিনা, এটি নিতান্তই আপনার ইচ্ছার ব্যাপার। আমার বন্ধু জোনাথন নিউ ইয়র্কে এক হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন সকালে পত্রিকা কেনে। তাদের সম্পর্ক এখন আর নিছক পত্রিকা কেনাবেচার মধ্যেই সীমিত নেই। তারা একে অপরের সাথে টুকটাক কথা বলে, পরস্পরের সাথে আন্তরিক ব্যবহার করে। হঠাৎ একদিন পত্রিকা কেনার পর জোনাথন খেয়াল করলো, তার কাছে ভাংতি টাকা নেই। তখন পত্রিকা বিক্রেতা বললো, ‘কোনো অসুবিধা নেই, এটা নিয়ে তুমি ভেবো না।’ কিন্তু জোনাথন টাকাটা পরিশোধ করে দিতে চাচ্ছিলো। তাই সে একটা দোকানে গিয়ে ভাংতি করার জন্য একটা কিছু কিনলো, যা আসলে তার কেনা দরকার ছিলো না। তারপর হকারকে টাকাটা দিতে গেলে সে নিতে চাইলো না। বরং এই আচরণে সে খানিকটা অপমানবোধ করলো। কারণ, এতোদিন ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ফলে সে জোনাথনকে কিছুটা খাতির করতে চেয়েছিলো। জোনাথন তাকে এই সুযোগটা থেকে বঞ্চিত করায় সে মনে কষ্ট পেয়েছে।

আমার ধারণা, আমরা সবাই এভাবে নিজের অজান্তে কাছের মানুষকে কমবেশি প্রত্যাখ্যান করি। আমি অন্তত এই ভুলটা কখনো কখনো করেছি। কখনো এমন হয়, আমি পরিচিত কারো পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, কিন্তু তাকে দেখেও দেখলাম না। কিংবা, আমার সাথে যখন কেউ কথা বলছে, তখন আমি আমার ফোন নিয়ে ব্যস্ত  হয়ে পড়লাম। এ ধরনের আচরণের মাধ্যমে আসলে অন্যদেরকে খাটো করা হয়। এতে তারা নিজেদেরকে ছোট মনে করে, হীনমন্যতায় ভোগে। কিন্তু আপনি যখন ভালোবাসা নিয়ে কারো দিকে এগিয়ে যান, তখন আপনি এমন একটি বন্ধনের সূচনা করেন, যেখানে সেও আপনার দিকে ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসবে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার এ ধরনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হলো অনেকের কাছে অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দ্বিতীয় স্তম্ভ: উদ্দেশ্য (purpose)

অনেকের কাছে আবার জীবনকে অর্থবহ করার চাবিকাঠি হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য চেষ্টা করা। আমি একে অর্থপূর্ণ জীবনের দ্বিতীয় স্তম্ভ বলছি। যে চাকরিটা পেয়ে আপনি খুব সুখী, জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়াটা ঠিক সে রকম কিছু নয়। আপনার চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে বরং আপনি কী দিতে পারলেন, উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি হাসপাতালের একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী আমাকে বলেছে, তার জীবনের উদ্দেশ্য হলো রোগীদের সেবা করা। অনেক বাবা-মা আমাকে বলেছে, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তানদের লালনপালন করা।

উদ্দেশ্যের মূলকথা হচ্ছে অপরের জন্য নিজের সামর্থ্যকে কাজে লাগানো। অবশ্য আমাদের অনেকেই নিজ কর্মের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য পূরণ করে থাকে। এভাবেই আমরা অন্যদের জন্য কাজ করি এবং আমাদের জীবনে তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারি। এ থেকে আরেকটা বিষয় বুঝা যায়। সেটি হলো– অলসতা, বেকারত্ব, শ্রমিকদের পরিশ্রম না করার মানসিকতা প্রভৃতি বিষয় নিছক অর্থনৈতিক সমস্যা, এমন নয়। বরং এর সাথে জড়িত রয়েছে আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকট। সত্যিকার অর্থে ভালো কিছু না করতে পারলে মানুষ শান্তি পায় না। কাজকর্মের উদ্দেশ্য আপনাকে খুঁজে বের করতেই হবে, তা নয়; কিন্তু উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে সংশ্লিষ্ট কাজটাকে আপনি আরো বেশি উপভোগ করতে পারবেন।

তৃতীয় স্তম্ভ: অতিবর্তিতা (transcendence)

অর্থপূর্ণ জীবনের তৃতীয় স্তম্ভটিও নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া সংক্রান্ত, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে। সেটি হলো ট্রানসেন্ডেন্স। ট্রানসেন্ডেন্স হলো সেই দুর্লভ মুহূর্ত, যখন আপনি নৈমিত্তিক ব্যস্ততার ঊর্ধ্বে ওঠতে পারেন, যখন আপনার ব্যক্তিস্বার্থ গৌণ হয়ে পড়ে এবং উচ্চতর বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন বলে অনুভব করেন।

একজনের সাথে আমার কথা হয়েছিলো, চিত্রকর্ম দেখার মাধ্যমে যার কাছে ট্রানসেন্ডেন্স ধরা দেয়। আরেক জনের কথা জানি, যিনি চার্চে গেলে এমন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। একজন লেখক হিসেবে আমার ক্ষেত্রে এটি ঘটে লেখালেখির মাধ্যমে। মাঝেমধ্যে আমি লেখালেখিতে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ি, স্থান-কাল ভুলে যাই।

ট্রানসেন্ডেন্সের এই অভিজ্ঞতা আপনাকে পাল্টে দিতে পারে। এক গবেষণার অংশ হিসেবে, কিছু শিক্ষার্থীকে প্রায় ২০০ ফুট লম্বা ইউক্যালিপ্টাস গাছের দিকে এক মিনিট তাকিয়ে থাকতে বলা হয়েছিলো। তারপর দেখা গেলো, তাদের মধ্যে স্বার্থপরতার মানসিকতা কমে গেছে। সে সময়ে তাদেরকে এমন পরিস্থিতির সুযোগ দেয়া হলো, যাতে  করে তারা চাইলে কাউকে সাহায্য করতে পারে। দেখা গেলো, তারা আগের চেয়ে বেশি মানবিক আচরণ করছে।

চতুর্থ স্তম্ভ: গল্প বলা

জীবনকে অর্থবহ করে তোলার জন্য চতুর্থ স্তম্ভটার কথা আমি যাকেই বলেছি, সেই খুব অবাক হয়েছে। আপনি নিজের সাথেই নিজের সম্পর্কে গল্প করুন। নিজের জীবন থেকে মনের মতো গল্প সাজালে দেখবেন, আপনার জীবনটা অনেক বেশি বাঙময় হয়ে ওঠেছে। আপনি কীভাবে আপনি হয়ে ওঠেছেন, সেটি বুঝতে এটি আপনাকে সহায়তা করবে।

কিন্তু আমরাই যে আমাদের জীবনের গল্পকার এবং আমরা চাইলে যে আমাদের গল্পটাকে পরিবর্তন করে নিতে পারি, সেটি আমরা সবসময় বুঝতে পারি না। আপনার জীবনটা নিছক কতগুলো ঘটনার সমষ্টি নয়। জীবনের বাস্তব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আপনি আপনার গল্পটিকে ঘষামাঝা করতে পারেন, ব্যাখ্যা করতে পারেন, তারপর নতুন করে গল্পটা উপস্থাপন করতে পারেন।

এমিকা নামের এক তরুণের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। ফুটবল খেলতে গিয়ে সে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলো। এ ঘটনার পর সে আফসোস করছিলো, ‘আমার ফুটবল খেলার জীবনটা কী দারুণ ছিলো। আর এখন…!’ জীবনটা কত সুন্দর ছিলো। অথচ এখন কী বাজে সময়ই না পার করছি– নিজের জীবনের গল্পটা যারা এভাবে বলতে শুরু করে, তারা সহজেই গভীর হতাশা ও বিষণ্নতার দিকেই এগিয়ে যায়। এমিকাও এমন একটি সময় পার করছিলো। তবে এক পর্যায়ে সে নিজের গল্পটাকে ভিন্নভাবে বুনতে শুরু করলো। তার ভাষায় নতুন গল্পটা ছিলো এ রকম: ইনজুরিতে পরার আগে আমার জীবন ছিলো উদ্দেশ্যহীন। পার্টিতে পড়ে থাকতাম। আমি ছিলাম বেশ স্বার্থপর একজন ব্যক্তি। কিন্তু এই আঘাতটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, আমি আরো ভালো মানুষ হতে পারতাম।’ গল্পের এই সামান্য হেরফেরই এমিকার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে। নিজের জীবনের গল্পটি নতুন করে সাজানোর পর থেকে সে বাচ্চাদের মেন্টরিং শুরু করলো। তখন সে আবিষ্কার করলো, অন্যদের জন্য কাজ করাই ছিলো তার জীবনের আসল উদ্দেশ্য।

এই গল্পে আমরা দেখি ব্যক্তির ভালো দিকটি তার মন্দ দিককে ছাড়িয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানী ড্যান ম্যাক এডামস একে নিজেকে সারিয়ে তোলার গল্প বলে অভিহিত করেছেন। তার অভিজ্ঞতায়, যারা অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করছে, তাদের জীবনের একেকটা গল্প নিজেকে সংশোধন, আত্মগঠন ও অপরকে ভালোবাসার গল্প।

এখন প্রশ্ন হলো, নিজের জীবনের গল্পকে কীভাবে পাল্টানো যায়? মনোচিকিৎসকদের সহায়তায় কারো কারো জীবনের পরিবর্তন ঘটে। তবে চাইলে কাজটি আপনি নিজেই করতে পারেন। আপনি কী পেলেন, কী হারালেন, অর্থাৎ জীবনের কোন অভিজ্ঞতাকে কীভাবে দেখবেন, তা একান্তই আপনার ব্যাপার। আপনাকে জাস্ট নিজের জীবন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এমিকা ঠিক এ কাজটিই করেছিলো। তবে জীবনকে আপনি রাতারাতি পাল্টে ফেলতে পারবেন না। নিজেকে পরিবর্তন করার এ কাজে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। হতে পারে, আপনাকে অনেক কষ্টও সইতে হবে। আমরা সবাই কমবেশি দুঃখকষ্ট সয়েছি এবং নানাভাবে জীবনসংগ্রামে নিয়োজিত। অতীতের সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে মেনে নেয়ার মাধ্যমেই জীবনে সম্ভাবনার নতুন দরজা খোলা সম্ভব। এর মাধ্যমে আপনি এমন এক স্বস্তি খুঁজে পাবেন, যা আপনাকে শক্তিশালী করবে।

এই হলো অর্থপূর্ণ জীবনের চারটি স্তম্ভ। সৌভাগ্যজনকভাবে ছোটবেলায় আমি এই সবগুলো ব্যাপারই পেয়েছিলাম। তখন মনট্রিলের বাড়িতে আমার বাবা-মা এক ধরনের সুফি মজলিশের আয়োজন করতেন। উল্লেখ্য, সুফিবাদ হলো কবি রুমির ধ্যানধারণা এবং সুফি দরবেশদের ঘূর্ণিনাচ, এসব নিয়ে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতার চর্চা। আমাদের বাড়িতে সুফিরা আসতেন সপ্তাহে দুবার। তারা ধ্যান করতেন, ইরানী চা পান করতেন, নানা ধরনের গল্প শোনাতেন। এছাড়াও তারা ছোটখাটো এমন কিছু কাজ করতেন, যা ছিলো প্রত্যেক সৃষ্টজীবের  প্রতি তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কেউ অন্যায় করলেও তার সাথে সদয় আচরণ করা ছিলো তাদের নীতি। এর মাধ্যমে তারা নিজের আত্মম্ভরিতার আগুনে পানি ঢালতেন।

কলেজে পড়াশোনার জন্য একসময় আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। সেখানকার পরিবেশে সুফিবাদ চর্চার সুযোগ না থাকায় আমি অস্থিরতায় ভুগতাম। ফলে এমন কিছু খুঁজছিলাম, যা আমার জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলবে। সেই থেকে আমার এই পথচলা শুরু। পেছনে ফিরে তাকালে এখন বুঝি, তখনকার সুফি মজলিশ ছিলো আমার জীবনে অর্থপূর্ণতার উৎস। এসব বিষয় আমাকে জীবনের গভীরতর তাৎপর্য অনুধাবনে সহায়তা করেছে। সংঘবদ্ধ দল, গুপ্ত সংগঠন, ভালো কিংবা খারাপ, যাই হোক না কেন; যে কোনো কমিউনিটি থেকেই আমরা এই ধরনের মৌলিক বিষয়গুলো পেতে পারি।

এই সবকিছুই হলো অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের নানা রকম উপায়। অর্থপূর্ণতা লাভের এসব উপায় মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার সাহস যোগায়। ঠিক এ কারণেই সমাজের সদস্য হিসেবে আমাদেরকে অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো বিকল্পকে বেছে নিতে হবে। লোকদেরকে যথাসম্ভব ভালো হিসেবে গড়ে ওঠায় সহায়তা করা আমাদের দায়িত্ব। এ জন্য নিজেদের পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের এই মৌলিক বিষয়গুলোকে কার্যকর করা জরুরি।

অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য নিরন্তরভাবে কাজ করে যেতে হবে। এটি একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া। প্রতিদিনই আমরা আমাদের জীবনে নতুন নতুন ঘটনা যোগ করে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে আমরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়তে পারি। আমার  ক্ষেত্রে যখনই এমন কিছু ঘটে, তখন আমি আমার বাবার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা স্মরণ করি।

আমি যখন কলেজ থেকে পাশ করি, তার কয়েক মাস পরের ঘটনা। আমার বাবার বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়। আমরা আশংকা করছিলাম, তিনি বাঁচবেন না। কিন্তু তিনি বেঁচে যান। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর মনে কী ধরনের চিন্তাভাবনা কাজ করছিলো। তিনি বলেছিলেন, আমার ভাই ও আমাকে দেখাশোনা করার জন্যই তিনি তখন বাঁচতে চেয়েছিলেন। এই আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। জরুরি অপারেশনের জন্য তাঁকে যখন এনেসথেসিয়া দেয়া হয়, তখন দশ থেকে উল্টোদিকে গোনা শুরু করার পরিবর্তে তিনি বরং আমাদের নামগুলো মন্ত্রের মতো জপছিলেন। যদি তিনি মারাও যান, তাহলে আমাদের নামগুলোই যেন পৃথিবীতে তাঁর উচ্চারিত সর্বশেষ কথা হয়, এটাই ছিলো তাঁর চাওয়া।

আমার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি এবং সুফি। তাঁর জীবনটা খুব অনাড়ম্বর, কিন্তু সুখী। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কেন তাঁর বেঁচে থাকা প্রয়োজন। ভালোবাসা, পরিবারের সাথে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, বাবা হিসেবে তাঁর কর্তব্য, তাঁর ট্রানসেন্ডেন্ট বিবেচনাবোধ থেকে বার বার আমাদের নাম আওড়ানো– এসব বিষয়ই ছিলো তাঁর বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার পেছনের কারণ। নিজের সাথে তিনি এই গল্পটাই করেন। এটাই হলো তাঁর জীবনের অর্থপূর্ণতার উৎস।

জীবনে সুখ আসবে-যাবে; কিন্তু জীবনের অর্থ যদি আপনার জানা থাকে, তাহলে তা আপনাকে সর্বদাই শক্তি যোগাবে, হোক সেটা সুসময় কিংবা দুঃসময়।

সবাইকে ধন্যবাদ।

এ ধরনের আরো লেখা