ইসলামী চিন্তার সংস্কার: বিচ্যুতি, প্রগতি, নাকি সময়ের দাবি?
এডিটর’স নোট: ইসলামী চিন্তার সংস্কারের প্রসঙ্গ আসলে প্রায়শই একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয় – সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বিবেচনাযোগ্য, আর কোনগুলো অপরিবর্তনীয়? এক্ষেত্রে অতি উদার কেউ কেউ শরীয়াহর খোলনলচে পাল্টে ফেলতে চান, আবার অতি রক্ষণশীল কেউ কেউ মনে করেন ইসলামে সংস্কারের কোনো ধরনের সুযোগ নেই। এই দুই প্রান্তিক অবস্থানের বাইরে সঠিক পথ কী হতে পারে?
২০১৪ সালের নভেম্বরে লন্ডনে প্রদত্ত দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার এক বক্তৃতায় ড. ইয়াসির ক্বাদী এ ব্যাপারে গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি ইসলামী চিন্তার প্যারাডাইমগুলোকে প্রধান পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। প্রতিটি প্যারাডাইমের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার পর সেগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। তারপর ইসলামী চিন্তার সংস্কারের ব্যাপারে তাঁর মতামতগুলো তুলে ধরেছেন। একটি গল্পের আশ্রয় নিয়ে পুরো বিষয়টিকে তিনি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আলোচনা শেষে আরো প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কথা বলেন। দীর্ঘ আলোচনার পরেও শ্রোতাদের কাছে যেসব বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছিল, প্রশ্নোত্তর পর্বে সেগুলো দূর হয়েছে বলা যায়।
ইসলাম নিয়ে যারা সত্যিকার অর্থে ভাবেন, সময়ের সংকটগুলোর পথ খুঁজেন, তারা এই বক্তব্য থেকে উপকৃত হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
*****
ভূমিকা
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته، الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله ، وعلى آله وصحبه ومن والاه ، أما بعد
আজকের আলোচ্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেকেরই ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি। পাশ্চাত্যে মুসলমানরা যেসব ইস্যু মোকাবেলা করছে, সেসব মূলত একটা বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। সেটা হলো, আধুনিক লাইফস্টাইল ও আধুনিকতার প্রেক্ষাপটে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হবে। আমি মনে করি, এটা কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়। বরং এটাই এখন আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা, অন্ততপক্ষে অন্যতম বড় সমস্যা।
আরেকটু সহজ করে বলতে গেলে, চৌদ্দশ বছরের পুরানো একটা ধর্মের শিক্ষা মোতাবেক আমরা কীভাবে আমাদের জীবন পরিচালনা করব, যেখানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর মানবতাবাদী ও লিবারেল মূল্যবোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি। পাশ্চাত্যের এই সমাজ যে কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিদ্যমান প্রভাবশালী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কী কী এবং কতটুকু গ্রহণ করব, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
এই গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক সচেতন মুসলমানেরই চিন্তাভাবনা করা উচিত। একটা উদাহরণ দেই। অবশ্য এটা একটা বিতর্কিত বিষয়। তাই আশা করব, আপনারা একে ফিকাহর দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে নিছক উদাহরণ হিসেবেই দেখবেন। সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া ‘হ্যাপি মুসলিম ভিডিও’ বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভিডিওটি হালাল নাকি হারাম আমি সে বিতর্কে যাচ্ছি না। এটি যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, আমি আপনাদেরকে শুধু সেদিকে দৃষ্টি দিতে বলব। অনেক মুসলমান ভিডিওটির ব্যাপারে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকেই এতে কোনো সমস্যা খুঁজে পাননি।
ভিডিওটির ফিকহী বা আইনী ব্যাখ্যা আমাদের মনোযোগের বিষয় নয়। এটা একটা বড় সমস্যার প্রতীকী উদাহরণ মাত্র। অর্থাৎ, আমরা কতটুকু পর্যন্ত গ্রহণ বা বর্জন করব, সেটা হলো মূল ব্যাপার। ভিডিওটিতে যা পারফর্ম করা হয়েছে, আমরা সবাই মিলে যদি তা করি – তাহলেই কি তা হালাল কিংবা হারাম বলে গণ্য হবে? এটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন।
ইউনাইটেড কিংডম অব ভেগানোপোলিসের গল্প
একটি দীর্ঘ উপকথা দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি। উপকথাটির দৃশ্যপট সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এটি নিছক একটি উপকথা হলেও আসলে ততটা অবাস্তব নয়। আমি যে চিত্রকল্প ও বাস্তবতা তুলে ধরবো, কয়েক দশক পর তা বাস্তবে ঘটতেও পারে। যাইহোক, গল্পটি শুরু করছি।
ইউনাইটেড কিংডম অব ভেগানোপোলিস (ইউকেভি) নামে একটি ভবিষ্যত দেশের কথা কল্পনা করি। দেশটির সবাই ভেজিটেরিয়ান। প্রাণীর মাংস এবং এ থেকে উৎপাদিত যে কোনো প্রকার খাদ্য গ্রহণকে তারা বর্বরতা বলে মনে করে। তাদের মতে, প্রাণী হত্যা একটি নিষ্ঠুর কাজ। এটা এক ধরনের রক্তচোষা প্রবণতা। স্রেফ মাংস, চামড়া, চোখ ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্যে পশু লালন-পালন এবং ‘হত্যা’ করাকে তারা অন্যায় মনে করে।
আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে –আক্ষরিক অর্থেই তারা নিজেদেরকে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বোৎকৃষ্ট সমাজ বলে দাবি করে। এ ব্যাপারে ইউকেভির অধিবাসীদের যুক্তি হচ্ছে – আমরা এমন একটি জাতি যারা মাংস খাওয়ার মতো আদিম প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
এই যুক্তিটি তাদের মাঝে এক ধরনের দাম্ভিকতা তৈরি করে। ফলে তারা আশেপাশের মাংসভোজী সমাজ ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা ও ঘৃণার চোখে দেখে থাকে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে – ‘তোমরা কীভাবে প্রাণী হত্যার মতো এত নিষ্ঠুর, পশ্চাৎপদ ও অসভ্য কাজ করতে পার? তোমরা কি দেখো না, কীভাবে জবাই করা প্রাণীর রক্তের স্রোত বয়ে যায়! তারপরও কীভাবে তোমরা সেই প্রাণীর মাংস খাও? এ থেকেই বুঝা যায়, তোমরা খুবই পশ্চাৎপদ ও অসভ্য একটা জাতি।’
ইউকেভির বৈদেশিক নীতি
নিজেদের এই ‘মূল্যবোধ’ অন্যান্য দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়াই ইউকেভির মুখ্য বৈদেশিক নীতি। এই মূল্যবোধ তাদেরকে এত বেশি আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, তাদের বন্ধুভাবাপন্ন অন্যান্য ভেজিটেরিয়ান দেশগুলোর উপরও তারা কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। ফলে তারা অন্যান্য দেশের উপর অবরোধ আরোপ করে, এমনকি আগ্রাসনও চালায়। এর পক্ষে তাদের যুক্তি হলো – আমরা এই ‘পিছিয়ে পড়া’ জনগোষ্ঠীর মাঝে ভেগানিজমকে ছড়িয়ে দিতে চাই। এসব দেশের জনগণ এখনো মাংস খাওয়া ছাড়তে পারেনি। অন্যদিকে, আমরা এমন একটি সুসভ্য জাতি যারা নিরামিষভোজী হিসেবে নিজেদেরকে উন্নীত করেছি। অন্যান্য দেশ নিশ্চয় একে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে। ভেগানিজমের প্রচার-প্রসারকে সেসব দেশের বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও শুভবোধসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ নিশ্চয় স্বাগত জানাবে।
এককথায়, তাদের সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যান্য দেশের লোকদেরকে জোরপূর্বক ভেগানিজমের আদর্শ গ্রহণে বাধ্য করা।
কাহিনীটি যদিও কাল্পনিক তবুও এর প্রেক্ষাপট খুব বেশি অবাস্তব নয়। কারণ, এখনই অনেকে প্রাণী অধিকার রক্ষায় সচেতন হয়ে উঠছেন। ভেগান মুভমেন্টও একইভাবে প্রসার লাভ করেছে।
প্রথম প্রজন্মের মুসলিম অভিবাসী
এবার ইউকেভির মুসলমানদের কথা ভাবা যাক। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিশর এবং টিম্বাকটুসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা ইউকেভিতে এসেছে। তারা সবাই শুরুতে জীবিকার তাগিদে শ্রমিক হিসেবে অভিবাসী হয়েছে। কিন্তু তাদের সন্তান ও নাতিপুতিরা বেশ আরামেই এখানে বসবাস করছে। তারা এখানকার অধিবাসীদের ভাষায় কথা বলে, একই প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে এবং ইউকেভির সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও দর্শনকে পুরোপুরি গ্রহণ করে নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন জাগে, মুসলিম সংস্কৃতি তো নিরামিষভোজী হওয়ার কথা বলে না। যে কারণে প্রথম প্রজন্মের মুসলিম অভিবাসীরা ভেগানিজম সম্পর্কে সচেতন ছিল। তারা মাংস খেতো। যার ফলে তারা সমাজের প্রভাবশালী সংস্কৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়নি। তো, ইউকেভির মুসলমানদের ব্যাপারে আপনার ভাবনা কী? ভেগানিজম প্রভাবিত সমাজের প্রভাবশালী সংস্কৃতির ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল বলে আপনি মনে করেন?
মুসলমানদের প্রতিক্রিয়ার পাঁচটি ধারা
কোনো মুসলিম দেশে ভেগানিজমের উৎপত্তি হয়নি। ইউকেভিতেই এর উৎপত্তি এবং সেখানে এটি খুব জনপ্রিয়। ফলে অভিবাসী মুসলমানদের জন্যে এই অভিজ্ঞতা নতুন। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? আমরা খুব সহজেই ধারণা করতে পারি – এ ব্যাপারে সব মুসলমানের প্রতিক্রিয়া একই রকম নয়, বরং মিশ্র। তাই না?
গল্পের সুবিধার্থে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়াগুলোকে আমি পাঁচটি ভাগে বিশ্লেষণ করতে চাই। অর্থাৎ ভেগানিজম ইস্যুটি নিয়ে ইউকেভিতে বসবাসকারী মুসলমানদের তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রজন্মগুলো মোটামুটিভাবে পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ দলের সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে, তবে আমি শুধু পাঁচটি প্রধান ধারাকে আলোচনায় রাখছি।
ধর্মত্যাগী ধারা
অবশ্যম্ভাবীভাবে কিছু মুসলমান ভেগানিজমের আদর্শ দ্বারা পুরোপুরি কনভিন্সড হয়ে পড়ে। তারা মনে করে, ভেগানিজমই হচ্ছে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একমাত্র লাইফস্টাইল। তারপর যখন তারা খেয়াল করে, ইসলামী ট্র্যাডিশনে প্রাণীর মাংস খাওয়ার সুস্পষ্ট বৈধতা রয়েছে, তখন পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি ও ধর্ম পুরোপুরি ত্যাগ করা ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প তারা দেখে না। কারণ, ততদিনে তারা ইউকেভির প্রভাবশালী সংস্কৃতির মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে।
প্রচলিত ব্যবস্থা
মুসলমানদের এই গ্রুপটি প্রচলিত ব্যবস্থাকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করে নিয়েছে। তারা ইউকেভি সমাজের মূল্যবোধ, আদর্শ ও সংস্কৃতিকে সঠিক মনে করে। তারা এটাও বুঝে, তাদের ধর্ম এই সমাজের মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই তারা বলে – ‘আমি আর মুসলমান থাকতে পারছি না। আমি নিজেকে এই প্রভাবশালী সংস্কৃতির একজন হিসেবেই মনে করি।’
পপুলিজম
তাদের অনেকে চুপিচুপি ইসলাম থেকে সরে গেছে। তারা ইসলামের শিক্ষাগুলো এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে এবং মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি হয়তো লোকমুখে তাদের ব্যাপারে শুনে থাকবেন, অমুক এখন আর ইসলামের বিধিবিধান পালন করছে না। তারা এখন প্রচলিত সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তাদের কেউ কেউ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে বেশ পরিচিত।
ইসলামের সমালোচনা
তারা মিডিয়াতে পূর্বপুরুষের সংস্কৃতির সমালোচনা করে থাকে। এভাবে তারা ইসলামের সমালোচকে পরিণত হয়। তারা বলে থাকে, ‘আমি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু আমার পরিবারের লোকজন মাংস খায়। তাই আমি এখন আর তাদের সাথে নেই।’
চলুন দেখা যাক, এই ধরনের ব্যক্তি আরো কী কী করতে পারে। এই ধরনের ব্যক্তি বিখ্যাত ও ধনী হয়ে ওঠবে, বই বেরুবে, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক পড়বে। কারণ, তিনি প্রচলিত সংস্কৃতিকে সঠিক হিসেবে তুলে ধরেন। এরই সাথে তিনি বলে বেড়ান – ‘আমি আমার বাপ-দাদার ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ত্যাগ করেছি।’ তাই এ ধরনের লোকেরা সাধারণত মিডিয়ার কাছে পোস্টার-চাইল্ড ও ডার্লিং-বয় হিসেবে খাতির পায়। মিডিয়া এইসব লোকদের খুব পছন্দ করে।
বিচ্ছিন্ন রেফারেন্স ব্যবহার
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, এই ধরনের ব্যক্তি তার সাবেক মুসলিম পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সমালোচনা করার মাধ্যমে প্রাচুর্য ও খ্যাতি অর্জন করেছে। তো এই ব্যক্তির সম্ভাব্য আরো কী বক্তব্য থাকতে পারে? তিনি এ রকমও বলতে পারেন, ‘আমি কোরআন ও সুন্নাহ নিয়ে পড়াশোনা করে দেখেছি কোরআন স্পষ্টভাবেই গোশত খাওয়াকে অনুমোদন করেছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।’ তারপর প্রমাণ হিসেবে কোরআনের আয়াত হয়তো পড়ে শোনাবেন, যেখানে আল্লাহ বলেছেন,
أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ ٱلْأَنْعَـٰمِ
তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে। (সূরা মায়েদা: ১)
তিনি কোরআন থেকে হয়তো আরো উদ্ধৃতি দিবেন। তারপর এসব আয়াতের উপর নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিবেন। একটি সরল ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়াতকে তিনি তার পক্ষপাতদুষ্ট পূর্বানুমানের সাথে প্রতীকী অর্থে পাঠ করবেন, যা সংশ্লিষ্ট আয়াতে আদতেই নেই। এভাবে তিনি একেকটি আয়াতকে ক্রমাগত নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে থাকেন। যেমন, তিনি বলতে পারেন– ‘প্রাণীদেরকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে জবাই করার ব্যাপারে কোরআন উৎসাহিত করেছে।’ অথচ কোরআনের আয়াতটি প্রকৃতপক্ষে এ রকম:
فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّـهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ
জবাই করার সময় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। তারপর তারা যখন ঢলে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্ত ও সাহায্যপ্রাথী অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও। (সূরা হাজ্জ্ব: আয়াত ৩৬)
কিন্তু তিনি এই আয়াতের অপব্যখ্যা করে বলতে পারেন– ‘প্রাণীদেরকে একের পর এক সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে সবগুলোকে একসাথে জবাই করার ব্যাপারে কোরআন স্পষ্টভাবেই উৎসাহিত করেছে।’
পরিভাষাগতভাবে দেখলে তিনি হয়তো সঠিক। কিন্তু আয়াতটি পাঠ করলে তার উপস্থাপিত নাটকীয় বর্ণনা ও প্রতীকী অর্থ আমাদের চিন্তায় মোটেও আসে না। অথচ প্রচলিত সংস্কৃতি তার ব্যাখ্যাটাই গ্রহণ করে। তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, প্রাণীদেরকে লাইনে দাঁড় করানো এবং একসাথে জবাই করা অত্যন্ত ‘বর্বর’ কাজ। আসলে তারা এভাবে ভাবতেই অভ্যস্ত।
এইসব ইসলামত্যাগীদের কেউ হয়ত আরো বলবেন– “আমি ‘তাদের’ নবীর জীবনী পড়েছি। ফলে আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে, তিনি নরমাংস খেতেন। তাদের অন্যতম একটি ধর্মগ্রন্থ সহীহ বুখারী থেকে আমরা জেনেছি, মোহাম্মদের প্রিয় খাবার ছিল ভেড়ার পায়ের নলি।”
তারপর তিনি হয়ত বলবেন– ‘মাংস কীভাবে ঈশ্বর প্রেরিত একজন সত্য নবীর প্রিয় খাবার হতে পারে? এটা কীভাবে সম্ভব! তারমানে এই নবী ঈশ্বর মনোনীত ছিল না।’
সবশেষে তিনি উপসংহার টানবেন– ‘ইসলাম প্রাণী হত্যাকে উৎসাহিত করে। তাদের ধর্মীয় উৎসব (যেমন– ঈদুল আজহা) মূলত প্রাণী হত্যার উৎসব। তাদের অনুষ্ঠানগুলো হাজার হাজার ভেড়া-বকরি জবাই করার উপলক্ষ্য ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এটা নাকি তাদের উৎসব! আকিকা ও ওয়ালিমাসহ যে কোনো আনন্দঘন ঘটনায় তাদের ধর্ম তাদেরকে কী করতে বলে? – যাও, গরু-ছাগল-ভেড়া জবাই করো, এদের হত্যা করো।
মনগড়া ব্যাখ্যা
সাদামাটা ব্যাপারগুলোকে এ ধরনের ব্যক্তি যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, সেভাবে আগে কেউ কখনো ভাবেনি। এর কারণ হচ্ছে সমাজের প্রভাবশালী ন্যারেটিভ বা প্রচলিত সংস্কৃতি ভেগানিজমকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তাই এই ব্যক্তিটির নিকট ইসলামের এই সবকিছুই ‘খারাপ’ ও ‘বর্বরতা’ বলে মনে হয়।
ব্যক্তিটি যদিও কোরআন ও হাদীসের সঠিক উদ্ধৃতি দিচ্ছে; কিন্তু সেই সাথে এসব উদ্ধৃতির প্রতীকী অর্থ আবিষ্কার করে এগুলোকে এমন অশুভ ও ভয়ংকর হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে যা কোনোভাবেই আমাদের কল্পনায়ও আসেনি। এমনকি ইউনাইটেড কিংডম অব ভেগানোপোলিশে জন্মগ্রহণকারী ছাড়া অন্য কারো চিন্তায়ও এসব আসার কথা নয়।
উদ্ভট ফিকহী মতামতের উদ্ধৃতি
তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অভিজ্ঞ লোকেরা এমনসব ফিকহী মতামতের উদ্বৃতি দেয় যেগুলো অধিকাংশ মুসলমানেরই অজানা। এইসব মতামত মুসলমানরা কখনো শোনেনি। তারা এই উদ্ভট মতামতগুলোই ফিকাহর গ্রন্থগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে। তারা সেগুলোকে হয়তো সঠিকভাবেই উদ্ধৃত করে, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন মতামত এখনকার ইসলামী সমাজে প্রচলিত নেই। হয়তো হাজার বছর আগে কিছু মানুষ সেগুলো অনুসরণ করতো।
তারা এভাবে বলে– ‘আরে, মুসলমানরা তো খুবই অসভ্য! তুমি জানো না, তাদের হাম্বলী মাজহাব তো বন্য কুকুর এবং শিয়াল খাওয়া জায়েজ করেছে! গরু-ভেড়া না হয় বাদ দিলাম, তাই বলে বন্য কুকুর আর শিয়াল! আর তুমি কি এটা জানো, তাদের মুহাদ্দিসরা মরুভূমির টিকটিকি খাওয়াকেও জায়েজ মনে করে! আর মালিকী মাজহাব কি বলেছে, তাও শুনে রাখো। তারা বলেছে, তুমি চাইলে কুকুর-বেড়ালও খেতে পারো। এগুলো হারাম নয়। আর কিছু আলেম তো শুকর ছাড়া সবকিছু খাওয়া জায়েজ মনে করে। অর্থাৎ তুমি চাইলে ইদুর, সাপ, টিকটিকি, বিচ্ছু– এইসবও খেতে পারো।’
মাজহাবগুলোর কোনো কোনো আলেম এগুলোকে জায়েজ মনে করেছেন– এটা সত্য। কিন্তু কয়জন এইসব মতামত জীবনে একবার হলেও শুনেছে? আর কয়জন এই মতামত অনুযায়ী জীবনযাপন করে? কেউ-ই নয়। অথচ তারা এ ধরনের মতামতগুলোই খুঁজে খুঁজে বের করে মিডিয়াতে প্রচার করে। তারপর এই কয়েকটা মতামতের উপর ভিত্তি করে পুরো ধর্মবিশ্বাসকে হেয় প্রতিপন্ন করে।
এই ব্যক্তির চূড়ান্ত বক্তব্য হচ্ছে এ রকম– ‘তাদের ধর্মগ্রন্থ, নবীর জীবনী এবং ফিকাহর বইগুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় ইসলাম একটা বর্বর, অসভ্য এবং পশ্চাৎপদ ধর্ম। কারণ এই ধর্ম প্রাণীহত্যার মতো ন্যক্কারজনক কাজকর্মের প্রচার করে। তাই আমার বিশ্বাস, কোনো সুস্থ মস্তিস্কসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান মানুষ এই ধর্মকে সত্য এবং সঠিক বলে মনে করবে না’।
আপসকামী ধারা
এই ধারার ব্যক্তিরা তাদের ইসলামী আইডেন্টিটি টিকিয়ে রাখার জন্যে সদাসর্বদা সচেষ্ট। অথচ প্রথম দলটি তাদের ইসলামী আইডেন্টিটি ইতোমধ্যেই ত্যাগ করেছে। দ্বিতীয় দলটি আপসকামী। তারা মনে করে, সমাজের ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ অর্থাৎ ভেগানিজম হচ্ছে একমাত্র নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোড অব ল। আবার একইসাথে তারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা প্রকাশ্যেই বলে, ‘আমরা পবিত্র কোরআন ও নবী মোহাম্মদের (সা) উপর বিশ্বাস রাখি।’
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? কোরআন স্পষ্টভাবেই মাংস খাওয়াকে অনুমোদন করেছে। অথচ আপসকামীরা মনে করে, এটা একটা জঘন্য, পশ্চাৎপদ এবং অসভ্য কাজ। তাহলে তারা কীভাবে কোরআন ও নবীর (সা) উপর বিশ্বাস রাখে? কীভাবে তারা মুসলিম থাকে?
হাদীস অস্বীকার
এই দলটি বিশেষ কোনো জনপ্রিয় ভাষ্য বা স্থানিক প্রথা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে অজান্তেই নিজেদের মূল্যবোধ পরিবর্তন করে ফেলে। এই বিকৃত আদর্শ ও নৈতিকতাকে তারা কোরআন ও ইসলামী ঐতিহ্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এরা সাধারণত হাদীস প্রত্যাখ্যান করে। ‘হাদীসকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। তাই শুধু কোরআন নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে’– এটি তাদের বক্তব্য।
মাংস নিষিদ্ধ করাই শরীয়াহর উদ্দেশ্য
মাংস খাওয়ার অনুমোদন সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হলো– ‘এটা সত্য যে অতীতের কিছু আলেম এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, কোরআন মাংস খাওয়াকে উৎসাহিত করে। কিন্তু আপনি যদি ইসলামের স্পিরিট বা শরীয়াহর উদ্দেশ্যের দিকে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন, মাংস খাওয়াকে পুরোপুরি বর্জন করাই ছিল শরীয়াহর উদ্দেশ্য। কিন্তু মানুষ মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে শরীয়াহ তা নিষিদ্ধ করতে পারেনি। তবে শরীয়াহ আমাদেরকে কিছু উপায় বাতলে দিয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে মাংস খাওয়াটা এক ধরনের পশ্চাৎপদতা। বর্তমানে আমরা ভেগানোপোলিস রাষ্ট্রে বসবাস করছি। তাই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বলা যায়, আমাদেরকে ভেগানিজম গ্রহণ করা উচিত। এটা ইসলামী আইনেরও দাবি! এ আইন মাংস খাওয়াকে হারাম গণ্য করে!’
পিক অ্যান্ড চ্যুজ ফ্যালাসি
তারা আরো বলে– ‘নবীজীর (সা) সীরাত থেকে এটা পরিস্কার যে, তিনি কদাচিৎ মাংস খেতেন।’
এটা ঠিক, মহানবী (সা) কদাচিৎ মাংস খেতেন। কিন্তু এই দলটি সাধারণত হাদীস অস্বীকার করে থাকে। তারপরেও নিজেদের সুবিধামতো দুয়েকটা হাদীস তারা ঠিকই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। একে বলা হয় পিক অ্যান্ড চ্যুজ ফ্যালাসি বা একপেশে নীতি। তারপর এই রেফারেন্সকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে, যার সাথে মূল বিষয়ের অর্থগত সম্পর্ক নেই। যেমন তারা বলে, ‘মহানবীর (সা) স্ত্রী আয়েশা (রা) বলেছেন, তাদের চুলায় তিন মাস পর্যন্ত আগুন জ্বলেনি। তারমানে, কোনো মাংসও রান্না হয়নি!’
মহানবী (সা) ভেগান ছিলেন!
এরপর তারা হয়তো বলবে, ‘এখন কেউ বলতেই পারে, এই ঘটনার মানে হলো মহানবী (সা) ভেগান ছিলেন। আসলে ভেগান হওয়াই ছিল ইসলামের স্পিরিট। এটা ঠিক, তিনি কদাচিৎ মাংস খেতেন। তবে এর পেছনে তখনকার রীতিনীতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তাই আদর্শ হিসেবে বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমাদের ভেগান হওয়াই উচিত।’
উটের অভিযোগ
তারা হয়তো এমনটাও বলতে পারে, ‘তখনকার সমাজে নানা ধরনের প্রথা বা রীতিনীতি থাকতেই পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাঁকে রহমাতাল্লিল আলামীন তথা বিশ্বজগতের জন্যে রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন’।
এখানে তারা আরেকটি কৌশল অবলম্বন করেছে। নির্দিষ্ট কোনো বিষয়কে নিজেদের অনুকুলে নেওয়ার জন্য সেটির ব্যাপক অর্থের পরিবর্তে তারা বিশেষ কোনো অর্থকে গ্রহণ করে।
আমরা জানি, কোরআনে মহানবীকে (সা) বিশ্বজগতের জন্যে রহমত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, হাদীসের সূত্রে একটি উট কর্তৃক তার মালিকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগের ঘটনা আমরা জানি। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় রয়েছে – ‘একবার একটি উট মহানবীর (সা) কাছে এসে অভিযোগ করলো, আমার মালিক আমাকে সাধ্যের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করায়, কিন্তু অনেক কম খাবার দেয়।’ আরেকটি হাদীসে এসেছে, উটটির অভিযোগ ছিল – ‘আমার মালিক আমাকে প্রহার করে’। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে মহানবী (সা) উটটির মালিককে তিরস্কার করেন।
এখন আপসকামী দলটি এই উদাহরণ দেখিয়ে বলবে, ‘যিনি বিশ্বজগতের জন্যে রহমত, যিনি উটকে প্রহার না করতে তার মালিককে নির্দেশ দিয়েছেন, অতিরিক্ত কাজ করাতে নিষেধ করেছেন; সেই দয়ালু নবী স্বীয় অনুসারীদেরকে ঈদের দিন রক্তপিপাসু হতে বলবেন, অধীনস্ত পশুদেরকে হত্যা করার কথা বলবেন – এমনটা আপনি কীভাবে ভাবতে পারেন! এটাই কি সেই ইসলাম, যা মহানবী (সা) নিয়ে এসেছিলেন! স্পষ্টতই এটা ভুল চিন্তা। কারণ তিনি তো রহমাতাল্লিল আলামীন! তাই ঈদের দিন পশু জবাই করাটা একটা অসঙ্গত কাজ। এ ধরনের কিছু ইসলামে নেই। আমরা মুসলমানরা হচ্ছি ভেগান। ইসলাম আমাদেরকে ভেগানই হতে বলে।’
এই দলের কৌশল হচ্ছে কোরআন-হাদীস থেকে শুধু সেই দলীলগুলোই গ্রহণ করা যেগুলো তাদের মানদণ্ডের সাথে খাপ খায়। স্পষ্টতই তাদের নিজস্ব মানদণ্ডের আলোকে তারা কোরআন ও সুন্নাহ পাঠ করে। কোনো বিষয়ে কোরআন প্রকৃতপক্ষে কী বলেছে, সেটা নিয়ে তাদের চিন্তা নেই। বরং তাদের মতামতই তারা কোরআনের উপর চাপিয়ে দেয়।
রক্ষণশীল ধারা
আমাদের মসজিদগুলোর মুসুল্লীদের অধিকাংশই রক্ষণশীল ধারার। দেশের প্র্যাকটিসিং মুসলমানদের বেশিরভাগই এই ধারার অনুসারী। এই দলটি পূর্বপুরুষের মাংস খাওয়ার ঐতিহ্যকে রক্ষা করে চলে এবং একে রীতিমতো আইনসিদ্ধ করার চেষ্টা করে। প্রচলিত বিরুদ্ধ সংস্কৃতি মাংস খাওয়াকে নিষিদ্ধ গণ্য করায় এই দলের কেউ কেউ একে মুসলমান হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত বানিয়ে নিয়েছে।
ধর্মবাদিতা
তারা মনে করে, ‘একজন ভালো মুসলমান হতে হলে আপনাকে অবশ্যই মাংস খেতে হবে।’ এমনকি কোনো মুসলমান ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে মাংস না খেলে তারা তাকে খুবই অবজ্ঞার চোখে দেখে– ‘হায়, তোমার আত্মা তো মরে গেছে! তুমি তো এখন প্রচলিত ভেগান সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছো! কারণ তুমি মাংস খাও না। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষরা মাংস খেতেন!’
ধর্মীয় প্রথা হিসেবে মাংস খাওয়া
এই ধরনের রক্ষণশীল ধারার মুসলমানদের নিকট মাংস খাওয়া ধর্মীয় প্রথার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও এর এত গুরুত্ব নেই। মাংস খাওয়াকে তারা ভালো মুসলমানের পরিচায়ক বলে মনে করে। কারণ, আপনি হলেন অমুসলিম সংস্কৃতি তথা প্রচলিত সংস্কৃতির বিরোধী লোক।
সেই কারণে আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, এই রক্ষণশীল ধারার মুসলমানরা যে কোনো অনুষ্ঠানে তাদের মাংস খাওয়ার অভ্যাসকে প্রতীকে পরিণত করে।
বিভিন্ন উপধারা
এই ধারার মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা কোন অঞ্চল থেকে এসেছিল, তার উপর ভিত্তি করে এদের মধ্যে বিভিন্ন উপধারা তৈরি হয়। এক দল বিরিয়ানীকে প্রাধান্য দেয়, তো আরেক দলের পছন্দ শর্মা। অন্যদিকে, আরেক দল এসে বলে, ‘অবশ্যই সেদ্ধ চাল এবং বাদাম ও কিশমিশ দিয়ে ভেড়ার মাংস রান্না হতে হবে।’ এরইমধ্যে আরো এক দলের দাবি হচ্ছে, ‘অবশ্যই মুরগী দিয়ে কুচ কুচ রান্না করতে হবে।
উল্লেখ্য, ভেগানরা নিরামিষভোজী হওয়া সত্বেও ইউকেভিতে মাছ খেতে কোনো বাধা নেই। এ কারণে ফিশ অ্যান্ড চিপস খাওয়াকে এই উপদলগুলোর কোনোটিই বরদাশত করে না। তাদের বক্তব্য হলো– ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা ফিশ অ্যান্ড চিপস খেতো না। এর বদলে আমাদেরকে বিরিয়ানী খেতে হবে।’ আরেক গ্রুপ ‘রুজদে জাজ’র কথা বলবে। তখন অন্য আরেক গ্রুপ এসে হয়তো বলবে, ‘না, শর্মাই খেতে হবে।’ কিন্তু কোনো গ্রুপই ফিশ অ্যান্ড চিপস খাওয়ার কথা বলবে না। কারণ, এর মানে হচ্ছে আপনি বিপথে চলে গেলেন!
এই বিশেষ বিশেষ খাবারগুলো স্ব স্ব উপধারার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে তারা পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়। আমরা একে তুচ্ছ মনে করলেও ব্যাপারটাকে তারা অনেক বড় বানিয়ে ফেলেছে।
আপনি যদি শর্মার চেয়ে বিরিয়ানীকে প্রাধান্য দেন, তাহলে তারা আপনার সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হবে, আপনাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। এমনকি এর ফলে তারা নামাজ পড়তে আলাদা মসজিদে পর্যন্ত চলে যেতে পারে। কারণ, তাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে ইসলাম পালন করেছে, তার সাথে আপনারটা মিলে না। এভাবে রক্ষণশীল ধারার প্রতিটি উপধারাই তাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতিকে আপন মনে করে আঁকড়ে ধরে। এটাকেই তারা ইসলাম অনুসরণের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে।
মাংস খাওয়া ভালো মুসলমানের পরিচয়
মাংস খাওয়াকে তারা এমনই তাৎপর্যপূর্ণ একটা ব্যাপারে পরিণত করেছে যে, এর উপর ভিত্তি করেই আপনি কতটকু ইসলাম পালন করেন, তা মূল্যায়ন করা হয়। এটা স্পষ্ট যে, এই ধারাটি প্রচলিত জনপ্রিয় সংস্কৃতির একটা পাল্টা প্রতিক্রিয়া মাত্র। এটাও বাস্তবতা যে, প্রচলিত সংস্কৃতির ব্যাপারে তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব থাকে। যদিও তাদের সন্তানেরা এখানেই জন্মগ্রহণ করেছে। হতে পারে তারা নিজেরাও এখানে জন্মগ্রহণ করেছে। তারপরেও তাদের অনেকে নিজেদেরকে ইউনাইটেড কিংডম অব ভেগানোপোলিসের সত্যিকারের নাগরিক পর্যন্ত মনে করে না।
বুদ্বুদের ভেতর বসবাস
এই মানুষগুলো দুইটি ভিন্ন জগতে বসবাস করে। তারা যখন দৈনন্দিন কাজকর্ম, চাকরি বা শপিংয়ের জন্যে কোথাও যায়; তখন তারা নিজেদের জগতের বাইরে ভ্ন্নি আরেকটা জগতে প্রবেশ করে। এর বিপরীতে, তাদের সামাজিক মেলামেশা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পূর্ণ আলাদা। আক্ষরিক অর্থেই তারা যেন একটা বুদ্বুদের ভেতর বাস করছে।
জেনারেশন গ্যাপের ভয়
আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে, তাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের অধিকাংশই এই বুদ্বুদের ভেতর আর বসবাস করতে চায় না। এটা নিয়ে তারা বেশ চিন্তিত। এ কারণে তাদের মতবিনিময় সভা কিংবা মসজিদগুলোতে বৃদ্ধ মানুষই বেশি অংশগ্রহণ করে। মোটকথা, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই রক্ষণশীল ধারাকে আর মেনে নিচ্ছে না। ফলে তারা বুঝতে পারছে, এটা একটা সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার কোনো সমাধান তাদের কাছে নেই।
কট্টরপন্থী ধারা
চতুর্থ দলকে আমরা কট্টরপন্থী ধারা বলতে পারি। এই দলটি ক্ষুদ্রতর হলেও মনমানসিকতায় উগ্রপন্থী। কারণ, বৃহত্তর সমাজ সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর উপর চড়াও হতে রাষ্ট্রকে অনুমোদন দিয়েছে। ফলে ইউকেভি একচোখা বৈদেশিক নীতি ও অন্যায় যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারছে এবং ভেগানিজম ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন মুসলিম দেশে আক্রমণ চালাচ্ছে।
এসবের ফলে তারা এত বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে যে, একপর্যায়ে তারা ভেগানবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে। প্রচলিত সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে তারা সবজির ফার্ম ধ্বংস করে ও প্রকাশ্যে শাকসবজিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দলটি সর্বক্ষণ ‘আমরা বনাম তারা’ – এই মানসিকতা দ্বারা তাড়িত হয়।
এই লোকদের এসব কাজকর্ম প্রচার করতে মিডিয়া খুবই ভালোবাসে। না হলে আমরা হয়তো এই মানুষগুলোর কথা কখনোই জানতাম না। সংবাদমাধ্যমগুলো এই ক্ষুদ্র কট্টরপন্থী দলটির কাজকর্ম প্রচার করে উচ্ছ্বাসের সাথেই বলে, ‘এই হচ্ছে সব মুসলমানের বৈশিষ্ট্য’।
সংস্কারপন্থী ধারা
নয়া প্যারাডাইম
পঞ্চম অর্থাৎ শেষ ধারাটি হচ্ছে আধুনিকতাবাদী ধারা। ‘আধুনিকতাবাদী’ পরিভাষাটির ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকায়, এটি ব্যবহার করার কিছু বিপদ আছে। তবুও আমি এটি ব্যবহার করতে চাই। কারণ এরচেয়ে ভালো কোনো পরিভাষা আমার জানা নেই। আর হ্যা, এই ধারাটির ব্যাপারেই আমার সবচেয়ে বেশি দরদ রয়েছে।
এই ধারাটিকে সংস্কারপন্থী হিসেবে অভিহিত করা যায়। পূর্বে উল্লেখিত চারটি ধারা থেকেই এটি আলাদা। ইউকেভির প্রভাবশালী ভেগান সংস্কৃতি এবং রক্ষণশীল ধারার মুসলমান কর্তৃক ইসলামী আইনের বিশেষ ধরনের ব্যাখ্যা– এই দুটি বিষয়কেই সংস্কারপন্থীরা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার হিসেবে দেখে।
দুটি প্রশ্ন
সংস্কারপন্থীরা মূলত দুটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে:
এক) কেন এবং কীভাবে ভেগানিজম এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছে? ভেগানিজমের সবকিছুই কি খারাপ কিংবা সবকিছুই কি ভালো? এখানে ভালো কী আছে, যা আমরা গ্রহণ করতে পারি? কিংবা, মন্দ কী আছে, যা আমাদের বর্জন করা দরকার?
দুই) ভেগানিজম সম্পর্কে ইসলামের সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য আছে কি? নাকি, এটা আধুনিক যুগের একটা ব্যাপার, যার উত্তর আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে?
এই ধারার অনুসারীরা বুঝতে পেরেছে, প্রাক-আধুনিক যুগে ভেগানিজম বলতে কিছু ছিল না। সেই কারণে ইসলামের চিরায়ত ঐতিহ্যে এ ব্যাপারে কিছু বলা নেই। কারণ অতীতের আলেমগণ কোনো ভেগান দেশে বাস করেননি। ফলে ইউকেভির মতো দেশের গতি-প্রকৃতি ও নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি মনোভাব
সংস্কারপন্থীরা আপসকামীদের মতো ইসলামী ঐতিহ্যকে খারিজ করে না। আপসকামীরা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করলেও ‘চৌদ্দশ বছরের পুরনো’ হওয়ার অজুহাতে ইসলামী আইনকে অগ্রাহ্য করে। এর বিপরীতে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সংস্কারপন্থীরা মনে করে, ‘স্বভাবতই চিরায়ত ঐতিহ্যের পক্ষে আধুনিক ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পারার কথা নয়। আধুনিক যুগের সমস্যাগুলোর যে ধরনের সমাধান দরকার, এটি তা পারে না। সে কারণে আমাদেরকে নতুন সমাধান বের করতে হবে। ঐতিহ্যকে বাতিল করে দিলে তো সমাধান হবে না। বরং চিরায়ত ঐতিহ্য ও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আধুনিক যুগের আলেমগণ ভেগানিজম সম্পর্কে মুসলিমদের অবস্থান নির্ণয় করবেন।’
উদার মানসিকতা
সংস্কারপন্থীরা ভেগানিজমকে যাচাই করে দেখতে আগ্রহী। ভেগান হওয়ার মাঝে ভালো কোনো দিক থাকতে পারে কিনা, সেই সম্ভাবনাও তারা যাচাই করেন। ‘ভেগান হওয়া কি অনৈসলামিক? একইসাথে একজন ভেগান ও ভালো মুসলমান হওয়া কি সম্ভব? কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে আসার পরিবর্তে ইউকেভিতে ভেগানিজমের উদ্ভব হওয়ার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কি একে মন্দ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে? এর মধ্যে কি কোনো ইতিবাচক দিক আছে, যা আমরা গ্রহণ করতে পারি?’
এই দলটি এ প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে আগ্রহী, যে কারণে তারা অন্যান্য গ্রুপ থেকে আলাদা। ধর্মত্যাগী ও আপসকামী ধারা দুটি আধুনিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, যাকে কোনো প্রকার প্রশ্ন করা যাবে না। অন্যদিকে, রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থী – উভয় ধারাই প্রতিক্রিয়াশীল। তারা মনে করে, আধুনিক মূল্যবোধগুলো আদতেই খারাপ। তাই এগুলো বৈধ নাকি অবৈধ, তা যাচাই করাটাও অবান্তর। নিছক এগুলোর বৈধতা যাচাই করতে গেলেও তাদের দৃষ্টিতে আপনি মন্দলোক হিসেবে বিবেচিত হবেন।
উভয় পক্ষকেই প্রশ্ন করা
উল্লেখিত চারটি ধারার বিপরীতে সংস্কারপন্থীরা বলবে – “না, উভয় পক্ষকেই প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্নটা কী? আমরা প্রতিটি প্রভাবশালী ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করি। এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ন্যারেটিভ হচ্ছে ভেগানিজম। আমরা কোরআন ও সুন্নাহকে প্রশ্ন করি না, আপসকামীরা যেমনটা করে থাকে। আমরা বরং ইসলামের গতানুগতিক বুঝজ্ঞানকেই (classical understanding) প্রশ্ন করি। বিশেষ করে রক্ষণশীল আলেমদের ‘বিধিবদ্ধ ইসলাম’কে (codified Islam) আমরা প্রশ্ন করি।”
টেক্সটুয়ালিটি এবং টেকনিক্যালিটি
‘হ্যা, নিশ্চিতভাবেই এটা সত্য – ইসলাম মোটাদাগে মাংস খাওয়ার পক্ষে। এটাও সত্য – মুসলিম সমাজের অনেকে বিরিয়ানী পছন্দ করে, আবার অনেকে শর্মা পছন্দ করে। কিন্তু ইসলাম কি সরাসরি আমাদেরকে বিরিয়ানী বা শর্মা খেতে বলেছে? এ ব্যাপারে কোরআন-হাদীস আমাদেরকে কী বলে?’ এভাবেই সংস্কারপন্থীরা প্রশ্ন করতে শুরু করে। অবশ্য অন্যদের জন্যে এটা বেশ অস্বস্তিকর ব্যাপার।
মূলকথা হচ্ছে, সংস্কারপন্থীরা কোনো ধরনের কমপ্লেক্সে ভোগেন না। ফলে ‘ভেগানিজম সর্বদা ভালো’ – এ ধরনের দাবি করার মানসিকতাও তাদের নেই। তারা প্রতিক্রিয়াশীলও নয়, আবেগপ্রবণও নয়। বরং তারা মনে করে, একজন ব্যক্তি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও টেকনিক্যালি ভেগান হতে পারে। এটি তার খোদাভীতির ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
সকল ইসলামী স্কলার এই ব্যাপারে একমত যে, কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মাংস না খেলে কিংবা মাংস খেতে অপছন্দ করলে, ইসলামের দৃষ্টিতে তা অন্যায় কিছু নয়। এর ফলে তাকে কেউ এ রকম বলতে পারে না যে, ‘এই ব্যক্তি হীনমন্য কিংবা ভালো মুসলমান নয়।’ তাই না?
কোনো সীমারেখা আছে কি?
কোনো ব্যক্তি যদি বলে, ‘মাংস খাওয়াটা পশ্চাৎপদ একটা ব্যাপার হওয়া সত্বেও আল্লাহ কীভাবে এটা হালাল করলেন!’ এটা কি কোনো ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা? না, আপনি তা বলতে পারেন না। মনে করুন, কোনো একজন মুসলমান মাংস খেতে পছন্দ করে না; কিংবা ইউকেভির কথাই ধরুন, যেখানে মাংস খাওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ ইসলাম মাংস খাওয়াকে অনুমোদন করলেও সমাজ তা করে না – এমন পরিস্থিতিতে কেউ ভেগান হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তিনি পুরোপুরি ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যেই থাকেন। তিনি কোনোভাবেই ইসলামকে ছোট করেন না। একদিকে, আধুনিক সংস্কৃতি তাকে মাংস খাওয়ার অনুমোদন দেয় না। অপরদিকে, একজন ভালো মুসলমান হওয়ার জন্যে মাংস খেতেই হবে, এমন নয়।
সমন্বয়মূলক অবস্থান
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কারপন্থীরা রক্ষণশীলদের সাথে একমত পোষণ করে। যেমন – ইসলামের সাধারণ নীতি হচ্ছে মাংস খাওয়া হালাল। অন্যদিকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা প্রগতিবাদীদের সাথেও একমত হন। যেমন – ভেগানিজমের কিছু ভালো দিকও থাকতে পারে। এমনকি সংস্কারপন্থীরা এমনটাও বলতে পারে – ‘কসাইখানায় পশুদের সাথে এমনকিছু আচরণ করা হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিতেও অন্যায়। কোনো প্রাণীকে অন্য প্রাণীর সামনে জবাই করা উচিত নয়, প্রাণীদের সাথে খারাপ আচরণ করা উচিত নয়, তাদেরকে আজেবাজে খাবার খাওয়ানো ঠিক নয়। প্রাণীদের ব্যাপারে এইসব সুস্পষ্ট বিধান ইসলাম আমাদেরকে পালন করতে বলেছে।’
এসব বিধানের কথা কেউ বললে প্রচলিত সংস্কৃতি তাকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে – এই আশংকাটাও ঠিক নয়। আবার, মাংস খাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য তুলে ধরার পর কেউ যুক্তি দিতে পারে, আসলে মাংস কম খাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। আমাদের সময়ের প্রচলিত সংস্কৃতিতে এমনটাই বলা হয়ে থাকে। তাই না? এমতাবস্থায় সংস্কারপন্থীরা বলতে পারে – ‘আপনি কি জানেন, ইসলাম অনুযায়ী আপনি নিজের ব্যাপারে যত্ম নিতে বাধ্য? তাই আমাদের মাংস কম খাওয়া উচিত। আর ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক পশু-প্রাণীদের সাথে আমাদের আরো ভালো ব্যবহার করা উচিত। এগুলোকে আপনি সংস্কারপন্থীদের বক্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন।’
এই ধরনের নৈতিক অবস্থান প্রথম চারটি দলেরই বিপক্ষে যায়। তাতে স্পষ্টতই কিছুসংখ্যক মানুষ একটা ভিন্নতর প্যারাডাইম তৈরি করছে। রক্ষণশীলদের মতো জনপ্রিয় না হলেও সংস্কারপন্থীরা এই পাঁচটি ধারার অন্যতম হিসেবে ইতোমধ্যেই আবির্ভূত হয়েছে।
গল্পের সমাপ্তি
গল্পটি এখানেই শেষ। এবার চলুন পেছনে ফেলে আসা মূল বিষয়ের প্রতি আমরা মনোযোগী হই। মাংস খাওয়া নিয়ে আলোচনা করা আমাদের মূল প্রসঙ্গ নয়। আমরা জানি, শরীয়াহ আমাদের জন্যে মাংস খাওয়া হালাল করেছে, আলহামদুলিল্লাহ। সত্যি কথা বলতে কি, রাতের খাবারে মাংস না থাকলে আমার মনে হয় যেন খাবারই পরিবেশন করা হয়নি!
যাইহোক, গল্পটি মূলত মাংস নিয়ে নয়। তাই একে উড়িয়ে দেবেন না। কারণ, দুনিয়া যেভাবে চলছে, তাতে করে ইউরোপের কোথাও এমন একটা সমাজের কথা কল্পনা করা অসম্ভব নয়, যারা ভেগানিজমকে গ্রহণ করে নেবে। তখন কিন্তু এই ইস্যুগুলো তৈরি হতে পারে।
বাস্তব ইস্যু
ভবিষ্যতে যাইহোক না কেন, সত্যি কথা হচ্ছে বর্তমানে ভেগানিজম কোনো ইস্যু নয়; আমরা যা নিয়ে এতক্ষণ কথা বলছিলাম। এখনকার ইস্যুগুলো হচ্ছে – নারী-পুরুষের সম্পর্ক, যৌনতা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং আধুনিক পাশ্চাত্য যুগে ইসলামী আইনের প্রয়োগযোগত্যা ইত্যাদি।
সাদাকালো নয়, রঙিন
এই পাঁচটি ধারার কোনোটিই পুরোপুরি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ধারা নয়। এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে এবং এ সবগুলো ধারার সমন্বয়ে এক ধরনের বর্ণচ্ছটা (spectrum) তৈরি হয়েছে। এ কারণে আপনি হয়তো একইসাথে একাধিক ধারায় একই ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে থাকবেন। এটি হলো নানা রংয়ের সমাহার। তাই না? আর তাই আমি এই ধারাগুলোর কিছু স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্টের কথা আপনাদেরকে এখন বলবো।
মুসলমানদের মধ্যে নানা মত ও পথের ধারাবাহিকতার কারণে কারো কারো মাঝে একইসাথে প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, আবার কারো কারো মাঝে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার কিছু প্রভাবও থাকতে পারে। একজন মুসলমানের উপর এই সকল পরস্পরবিরোধী ধারার প্রভাব থাকাটাও এই স্পেকট্রামের একটা অংশ। তাছাড়া, কঠোরভাবে যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে এই ধারাগুলো নির্ধারণ করা হয়নি। যাইহোক, আমি আসলে এই গল্পটির শিক্ষনীয় দিকের উপরই জোর দিতে চাচ্ছি।
ধারাগুলোর বিশ্লেষণ
ধর্মত্যাগী ধারার বৈশিষ্ট্য
প্রথম ধারাটির অনুসারীরা ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করেছে। এদেরকে মুরতাদ বলা হয়। মুরতাদরা বলে– ‘দেখো, কোরআন কত সেকেলে একটি বই! আধুনিক যুগের জন্য এটি উপযুক্ত নয়। কোরআনে দৈহিক শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোরআনের আইন অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীকে পুরুষের অর্ধেক দেয়া হয়েছে… ইত্যাদি ইত্যাদি।’
ভেগানিজমের সমতুল্য আধুনিক বিষয়গুলোর তালিকা করলে দেখা যাবে এসব বিষয়ে মুরতাদদের কোনো আপত্তি নাই। এটাই হলো মুরতাদদের সমস্যা। ভেগানিজম নিজেই যে একেবারেই সাময়িক একটি মানবীয় ব্যাপার হতে পারে, এটা যে কালোত্তীর্ণ কোনো ব্যাপার নয়– সেই দিকটা তারা কখনোই বিবেচনা করে না। তারা কখনোই এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করে না।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা
আমাদের সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হিসেবে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়েই কথাই বলা যাক। নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে– আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে গত ত্রিশ বছরে– যত বেশি আলোচনা হয়েছে, মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসেও তা হয়নি। সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা একইরকম হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য থাকা উচিত নয়– এই ধারণাটি খুবই সাম্প্রতিককালের। স্পষ্টতই, ইসলাম এই ধারণাকে সমর্থন করে না। তাই নয় কি?
দণ্ডবিধি
একজন অপরাধীর শাস্তি কী হওয়া উচিত– এটা বর্তমান সময়ের খুব আলোচিত একটি প্রশ্ন। আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা এটি নিয়ে বিতর্ক করে যাচ্ছেন। কথা হচ্ছে, আপনাদের রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ডকে পশ্চাৎপদ প্রথা মনে করে। তাহলে এবার আমার দেশ আমেরিকার কথাই ধরুন। মাদকসহ যেসব ছোটখাটো অপরাধে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, শরীয়াহ আইনেও সেগুলোর ক্ষেত্রে এত কঠোর শাস্তির বিধান নেই।
আপনারা জানেন, শরীয়াহ আইনে খুব সুনির্দিষ্ট কিছু অপরাধের জন্যেই কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাছাড়া, মৃত্যুদণ্ড একটা পশ্চাৎপদ প্রথা হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বের সকল বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ব্যাপারটা তাও নয়।
কিন্তু মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগীদের সমস্যা হলো তাদের কখনোই মনে হয় না যে, প্রভাবশালী ন্যারেটিভও ভুল হতে পারে। হীনমন্যতাবোধ (যা আজকাল খুবই সাধারণ ব্যাপার) কিংবা বিদ্যমান প্রভাবশালী সংস্কৃতির প্রভাবে তারা ধরেই নেয় – যা কিছু প্রভাবশালী, সেটাই সঠিক। লোকপ্রিয় ও চটকদার কথাবার্তা দ্বারা তারা এতোটাই আচ্ছন্ন যে, প্রভাবশালী ন্যারেটিভের যথার্থতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। তাই এ ধরনের লোকেরা ধর্মত্যাগ করে এবং এর পক্ষে যুক্তি দেয়, ‘দেখো, ইসলাম মৃত্যুদণ্ডের কথা বলে। তাই আমার পক্ষে মুসলমান থাকার কোনো উপায় নেই। ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে ফিকাহগত পার্থক্যের কথা বলে।’
সমান বণ্টন নয়, বরং ন্যায়সঙ্গত বণ্টন
হ্যা, ইসলামে এমনটা আছে। উত্তরাধিকার আইন, বিবাহ আইনসহ কিছু বিষয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমরা তা অস্বীকার করি না। আপনি যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা উচিত নয়; তাহলে ইসলাম আপনার এই আধুনিক বুঝজ্ঞানকে খণ্ডন করতে যাবে না।
এই শ্রেণীর লোকেরা প্রথম গ্রুপের অনুসারী। আমাদের সমাজে এই শ্রেণীর প্রচুর মানুষ আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিখ্যাত হয়ে গেছে। তারা বই লেখে, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপসকামী ধারার বৈশিষ্ট্য
এই ধারাকে আমরা আপসকামী হিসেবে অভিহিত করেছি। তারা প্রথম গ্রুপের মতো ইসলামী ঐতিহ্যকে খারিজ না করলেও তারা ইসলামকে যেভাবে চর্চা করে সেটাকে ‘আধুনিক বা প্রগতিবাদী ইসলাম’ বলা যায়। মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রথম দলটির মতো তাদেরও একই ধরনের সমস্যা রয়েছে। অর্থাৎ তারাও প্রভাবশালী ন্যারেটিভকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে মেনে নেয়, যাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে যৌনতা কিংবা একটু আগে বলা নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে তাদের সম্ভাব্য বক্তব্য হচ্ছে, ‘চিরায়ত ঐতিহ্য ভুলে যান। নারী-পুরুষের সম্মিলিত জুমার নামাজে নারীরা ইমামতি করতে পারবে না– এটা কোরআনের কোথায় বলা আছে? বরং এ ধরনের নামাজে নারীদেরকে ইমামতি করতে আমাদের উৎসাহ প্রদান করা উচিত।’
এটা খুবই প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। তাই না? কিংবা তারা এমনটাও বলতে পারে– ‘নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমকামী সম্পর্ক অনুমোদনযোগ্য। এ ধরনের সম্পর্ককে মসজিদগুলোর অনুমোদন দেয়া উচিত।’
সমাজের প্রভাবশালী ন্যারেটিভ যেহেতু এ জাতীয় সম্পর্ককে ইচ্ছার স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচনা করছে, তাই এইসব আপসকামী মুসলমানরা মনে করে, ইসলামেরও উচিত এগুলোকে অনুমোদন করা। ফলে তারা বলছে, ‘এ জাতীয় সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোরআনে কিছুই বলা হয়নি।’ অথচ কোরআনে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। তারা মিথ্যা দাবি করছে।
নিজেদের মূল্যবোধ কোরআনের উপর চাপিয়ে দেয়া
এক্ষেত্রেও তারা নিজেদের মূল্যবোধকে কোরআনের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। নিজেদের বিকৃত ব্যাখ্যাকে তারা নানা কৌশলে ও গায়ের জোরে কোরআনের উপর এমনভাবে চাপিয়ে দেয়, যেন তাদের কথাটা কোরআনেরই কথা। এ ধরনের লোকেরা হাদীসকে সাধারণত পুরোপুরি অস্বীকার করে থাকে। তবে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্যে ব্যবহৃত বিশেষ কোনো পরিভাষাকে সাধারণীকরণ করে ফেলতে তারা ঠিকই হাদীসের অপব্যবহার করে। যেসব হাদীস উদ্ধৃত করলে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়, তারা শুধু সেগুলোই ব্যবহার করে।
এই গ্রুপটির জন্য আমার তেমন সহানুভূতি নেই। এরা আসলেই হীনমন্যতায় ভুগছে। এই ধারার অনুসারীরা ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষার প্রতি বিশ্বস্ত নয়। তারপরও তারা কেন নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করে – তা সত্যিই বিস্ময়কর!
সত্যি বলতে কি, মুরতাদরা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যানকারী হওয়া সত্বেও প্রগতিবাদীদের চেয়ে বেশি যুক্তিবোধ ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখুন। আমি বলছি না যে, মুরতাদরা তুলনামূলকভাবে ভালো। বরং আমি বলেছি, তারা তুলনামূলকভাবে যুক্তিবোধসম্পন্ন। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যেমন, মুরতাদ ব্যক্তি বলে থাকে, “ইসলাম ‘ক’-বিষয়কে মেনে চলতে বলে। আমি এটা পছন্দ করি না, তাই আমি মুসলমান নই।”
এক্ষেত্রে আপনি খুব সাধারণ একটা লজিক অনুসরণ করতে পারেন।
‘ক’ প্রসঙ্গে সারাবিশ্বের মুসলিম স্কলারগণ একমত অর্থাৎ তারাও এটা মেনে চলতে বলেন। দীর্ঘদিনের পরিক্রমায় এটা যখন প্রতিষ্ঠিত একটা ব্যাপার হয়ে গেছে, তখন এই প্রগতিবাদীদের কেউ বলবে, ‘এ ব্যাপারে আমার কাছে একটি ইউনিক ব্যাখ্যা আছে। আমি কোরআনের অন্তর্গত রহস্যের চাবিকাঠি পেয়ে গেছি। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নতুন ফিকাহ ও নতুন ব্যাখ্যা রয়েছে।’
এ ধরনের কোনো ব্যক্তির কাজ-কারবার দেখলে মনে হয় যেন তিনি নতুন একজন নবী, যিনি নতুন বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন! তাই নয় কি? আসলে এসব ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে প্রগতিবাদীরা এমনসব বিষয়ে জড়িয়ে পড়ছে, যেগুলোকে তারা আসলে অস্বীকার করে। তারা ফিকাহ ও হাদীসকে পরোয়া করে না। কোরআন যেন ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভকে মেনে নেয় – এই হলো তাদের চাওয়া।
সত্যি কথা হলো, উপরের দুটি গ্রুপের কোনোটির প্রতি আমার কোনো প্রকার শ্রদ্ধাবোধ নাই।
রক্ষণশীল ধারার বৈশিষ্ট্য
এবার তৃতীয় অর্থাৎ রক্ষণশীল ধারা নিয়ে আলোচনা করা যাক। ভেগানিজমের গল্পে এই গ্রুপটি মাংস খাওয়াকে ইসলামের ‘বিধিবদ্ধ’ ব্যাপার ও ধর্মীয় রীতি বানিয়ে ফেলেছিল, যা আদতে ইসলাম বলেনি। এই গ্রুপে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে।
সোজা কথায়, এই ধারার মুসলমানরা ইসলামী আন্দোলন এবং দেশের মসজিদ লাইব্রেরির বইগুলো অনুসরণ করে থাকে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এ কথা বলছি, তাদেরকে কোনোভাবে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
ভবিষ্যৎ নিয়ে রক্ষণশীলদের ভীতি
রক্ষণশীল ধারা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে এটাই হচ্ছে সত্য যে, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্ম ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি কাজ করে। হ্যা, নীতিগতভাবে সবারই এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। যাইহোক, এই ভীতির ফলে তারা কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে? ইসলাম সম্পর্কে তাদের যদ্দুর ধারণা আছে, ততটুকুকেই তারা আইনসিদ্ধ মনে করছে। ইসলামের যে ব্যাখ্যা তাদের স্ব স্ব অঞ্চলে প্রচলিত এবং যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তারা বেড়ে ওঠেছে, তাকেই তারা একমাত্র সঠিক ইসলাম মনে করে। এই ধারাটি বেশ জনপ্রিয়। কারণ ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভে তাদেরই প্রথম আগমন ঘটেছে।
স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিধান
বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিরিয়ানী খুব জনপ্রিয় খাবার। একইভাবে শর্মাও জনপ্রিয়। উভয় খাবারেই মাংস থাকায় ওইসব অঞ্চলের মুসলমানরা মাংস খেয়ে অভ্যস্ত। অতএব, তারা যখন এ দুটি খাবার এই দেশে প্রচলন করে তখন তারা ভাবে, এটা বুঝি ইসলামেরই একটা প্রতীক। এভাবে তারা কোনো মুসলিম অঞ্চলের একটা বিশেষ সাংস্কৃতিক উপাদানকে নিয়ে আসে এবং একে ইসলামের অন্যতম মূল ব্যাপার হিসেবে অনুসরণ করে।
কেউ বিরিয়ানী বা শর্মা খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় যেন ইসলামকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, তারা পূর্বপুরুষদের থেকে যা পেয়েছে তাকেই সত্যিকার অর্থে ইসলামের অংশ মনে করে। হ্যা, এর কিছু ভালো দিক রয়েছে বটে। কারণ, বিশ্বের প্রচুর মানুষ এ ধরনের খাবার খায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও সাধারণত এসব খাবার প্রচলিত। তাই যখনই আপনি এ ধরনের রক্ষণশীল কোনো ধারায় যোগ দিবেন, তখন আপনার মনে হবে যেন বিশ্বের একটা বৃহৎ অংশে এ ধরনের ইসলামই রয়েছে।
কিন্তু এই রক্ষণশীল ধারাটির প্রতিক্রিয়াশীলতা ও নিছক ভীতি থেকে উদ্ভূত কার্যকলাপের ফলে কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকে ইসলাম পালন করাকে অনেক কঠিন মনে করছে। বিশেষত, কোরআন ও সুন্নাহ কোনো বিশেষ ধরনের খাদ্যের কথা বলেনি। অথচ এখানে ইসলামের নামে বাধ্যতামূলকভাবে এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস প্রচলিত থাকায় তরুণ প্রজন্মের জন্য তা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এটা এমন ইসলাম, যা কোরআন-হাদীস থেকে উৎসারিত নয়। বরং ইউনাইটেড কিংডম অব ভেগানোপোলিসে বসবাসরত মুসলমানদের আচরিত সংস্কৃতি থেকে এর উদ্ভব হয়েছে।
বিরিয়ানী খাওয়া কোনো নির্দিষ্ট সময়, স্থান ও সংস্কৃতিতে জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এর মধ্যে ইসলামের কিছুই নেই। কিন্তু রক্ষণশীল মুসলমানরা এই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেনি। আর তাই, ইউকেভির কোনো মুসলমান ফিশ অ্যান্ড চিপস খেলে কাফের হয়ে যাবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। যদিও এটি ইউকেভি সংস্কৃতিতে জনপ্রিয় খাবার। বিরিয়ানী ও ফিশ অ্যান্ড চিপস – এ দুটির কোনোটিরই একটির উপর আরেকটির বিশেষ কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নেই।
ড্রেস কোড
বিরিয়ানী কিংবা ফিশ অ্যান্ড চিপস আমাদের ইস্যু নয়। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে তা হতেও পারে, তবে বাস্তবে এটা কোনো প্রধান ইস্যু নয়। সরল মনের কারো চিন্তায় আসতে পারে – কীভাবে পোশাক পরিধান করতে হবে? একজন আলেম তার নিজের জন্য কী ধরনের পোশাক পছন্দ করেন? রক্ষণশীল ধারার আলেমগণ কীভাবে পোশাক পরিধান করেন? এটা একটা ইস্যু বটে।
এক্ষেত্রে সরল সত্যটা হলো – তারা সবাই কোনো বিশেষ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, শতাব্দী বা যুগে প্রচলিত ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী পোশাক পরিধান করেছেন। এটি ছিল তাদের ধর্মবোধের পরিচায়ক। আপনারা কি বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাচ্ছি?
সুতরাং, আপনি যদি রক্ষণশীল ধারার কোনো সমাজে যান, তাহলে আপনার সাদা শাল-কোর্তা পরিধান করা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তা না করলে আপনি তাদের মসজিদে খোতবা দিতে পারবেন না। একইভাবে, রক্ষণশীল ধারার অন্য কোনো এলাকায় গেলে আপনাকে ‘সাওব’ পরিধান করতে হবে। আবার, অন্য কেউ আপনাকে ‘জালাবিয়্যাহ’ পরতে বলবে। এভাবে চলতেই থাকবে। কারণ তারা স্ব স্ব ন্যারেটিভের সাথে পুরোপুরি অভ্যস্ত। তাই ভিন্ন পোশাকে তাদের নিকট কেউ যাওয়া মাত্রই অবশ্যম্ভাবীভাবে তিনি প্রত্যাখ্যাত হবেন। শুরুতেই তারা ধরে নিবে, বিদ্বান সমাজের একজন হওয়া এই ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তাদের বিদ্বান সমাজে এ ধরনের কোনো ব্যক্তিকে তারা দেখেনি।
স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়াই সুন্নতের আদর্শ
পোশাকের সুন্নত নিয়ে বাস্তবসম্মত কথা হলো, শরীয়াহর আওতার মধ্যে থেকে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে যতটুক সম্ভব মানিয়ে নিয়ে পোশাক পরিধান করা উচিত। এটা শুধু আমার মতামত নয়। ইমাম ইবনে কাইয়ুমসহ অনেক আলেম এই মত দিয়েছেন।
ফ্যাশন বিপ্লব করার জন্যে মোহাম্মদ (সা) আসেননি। আবু জাহেল, উতবা, উমাইয়া ইবনে খালফসহ মক্কার মুশরিকরা যে ধরনের পোশাক পরত, আল্লাহর রাসূল (সা) ঠিক সে ধরনের পোশাকই পরতেন। কারণ, তাঁর সময়ে সে ধরনের পোশাক পরিধান করাই ছিল প্রচলিত সংস্কৃতি।
অতএব, পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে কেউ একটি বিশেষ সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে পারে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এমন অনেক ধরনের কাপড় রয়েছে, যেগুলো মহানবী (সা) কখনোই দেখেননি। এরমধ্যে ‘সাওব’ও রয়েছে। অথচ একে আমরা সুন্নতের খুব কাছাকাছি মনে করি। সত্যিই এটা খুব চমৎকার পোশাক। এতে জাঁকজমকপূর্ণ বিভিন্ন উপাদান ও সুন্দর বোতাম লাগানো থাকে এবং পোশাকের মাপ থাকে পুরোপুরি নিখুঁত!
তবে আপনি যদি সত্যিই সুন্নত অনুসরণ করতে চান, তাহলে খুবই খসখসে ভেড়ার চামড়া জোগাড় করে পোশাক বানান। এই পোশাক কোনোভাবেই নিখুঁত হয় না। এটা হচ্ছে সুন্নত। তবে এটা সেই সুন্নত নয়, যা আমাদের অনুসরণ করা রাসূলের (সা) কাম্য ছিল। আমাদের মহানবী (সা) কখনোই বলেননি – ‘এই ধরনের পোশাক পরিধান করো।’
ব্রিটিশ হিজাব
আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে মুসলিম বোনদের হিজাব। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার নারীরা যুগ যুগ ধরে যেভাবে হিজাব পরিধান করে আসছেন, নাইজেরীয় বোনদের পদ্ধতি থেকে তা বেশ আলাদা। আবার নাইজেরীয় নারীদের হিজাব মরোক্কান ও সৌদি বোনদের হিজাব থেকে আলাদা। আবার আফগান বোনদের হিজাব ভিন্নরকম।
তাই আমরা যদি সৌদি আরবের হিজাবকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য মনে করি, তাহলে তা ভুল হবে। অপেক্ষা করুন, ‘বৃটিশ হিজাবে’র যে ধারা গড়ে ওঠছে, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই – নাইজেরীয় বোনদের জন্য নাইজেরীয় হিজাব, একইভাবে ইন্দোনেশীয়, মরোক্কান, পাকিস্তানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের বোনদের জন্য যদি স্ব স্ব সংস্কৃতির হিজাব পরিধান হালাল হয়; তাহলে অন্য আরেকটি সাংস্কৃতিক ভূখণ্ডের মুসলমানরা ইসলামের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতরে থেকে যদি একই কাজ করে, সেটা হারাম হবে কেন?
এখানেই সংস্কারপন্থী এবং রক্ষণশীল ধারার মধ্যে পার্থক্য। হ্যা, রক্ষণশীল মুসলমানদের মধ্যেও অনেক ভালো কিছু রয়েছে। ইসলামের নিদর্শন বলে মনে করা হয় এমন দৃশ্যমান প্রতীক, যেমন – কোর্তা, সাওব ইত্যাদি তারা পরিধান করে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এটি তাদের মুসলিম পরিচিতি তুলে ধরে। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যদিও এটি কোনো অপরিহার্য বিষয় নয়। এটা ধর্মের এমন কোনো বিষয় নয়, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) সবাইকে অনুসরণ করতে বলেছেন।
সংস্কারপন্থী ধারার বিশ্লেষণ
এবার আসুন সংস্কারপন্থী ধারা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। সংস্কারপন্থীরা ঐতিহ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। বিদ্যমান প্রভাবশালী সংস্কৃতি নিয়ে তাদের কোনো ধরনের হীনমন্যতা নেই। তারা ভালো করেই জানে, ভেগানিজম নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার। বছর বিশেক আগে ভেগানিজম যেভাবে চালু হয়েছিল, এখন থেকে পনের বছর পর হয়তো এর আকর্ষণ ফুরিয়ে যাবে। আবার তারা ভেগানিজমকে পুরোপুরি বাতিলও করে না। ইউকেভি রাষ্ট্র ভেগান হওয়ার কারণেই ভেগানিজম এবং এর সকল উপাদান বাতিল বলে তারা মনে করে না। ভেগানিজমের মাঝেও ভালো কিছু থাকতে পারে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভেগান ছিলেন না বলেই ভেগানিজম ভুল – ব্যাপারটা তা নয়। চলুন বিষয়টির দিকে আরেকটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।
ভেগানিজম ও ইসলামের মাঝে সমন্বয়
সংস্কারপন্থীরা মতে, আমাদের খাদ্যাভ্যাসে বেশি পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি থাকা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মাংস কম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। প্রাণীদেরকে যথাযথভাবে প্রতিপালন ও যত্ম করা আমাদের কর্তব্য। আর জবেহ করার সময়ে মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে আমাদের ধর্ম নির্দেশ দেয়।
সত্যি কথা হলো, সংস্কারপন্থীরা ভেগানিজমের কিছু কিছু উপাদান গ্রহণ করে। যদিও সেগুলো তাদের পূর্বপুরুষরা বিবেচনা করেনি এবং গতানুগতিক ঐতিহ্যেও সেসব অনুপস্থিত। এসব ব্যাপারে তাদের মত হচ্ছে, ‘ভেগানিজমের ইতিবাচক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ করতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’
সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা
হিজাব ইস্যুটি এখানে আবারো প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সংস্কারপন্থীরা ব্যক্তির প্রতিটি কাজকর্ম, রক্ষণশীলদের পালিত প্রতিটি রীতিনীতিকে সেগুলোর প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিবেচনা করে। কোর্তা পরিধান করা আপনার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় কেন? কারণ, এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত বিদ্রোহে সেখানকার মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তৎকালীন সময়ে কোনো ব্যক্তির পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদের স্টাইল থেকেই বুঝা যেত তিনি ব্রিটিশ বিরোধী নাকি তাদের সমর্থক। একইভাবে, ‘সাওব’ কেন আপনার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পোশাক? এর পেছনের কারণটা সংস্কারপন্থীরা তুলে ধরে।
এভাবে সংস্কারপন্থীরা প্রতিটি কাজকর্ম ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরে। বলাবাহুল্য, সংস্কারপন্থীরা সবচেয়ে কম জনপ্রিয়। কেননা, অপরাপর সকল পক্ষই তাদের ব্যাপারে সমালোচনামুখর।
সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
রক্ষণশীলরা সংস্কারপন্থাকে সমস্যা মনে করে। কারণ ঐতিহ্যের ব্যাপারে রক্ষণশীলদের যে বুঝজ্ঞান, সেই অর্থে সংস্কারপন্থীরা ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত নয়। ব্যাপারটা পরিষ্কার। তাই না? আপনি বিরিয়ানীর সমালোচনা করলে, তারা একে সুন্নতের সমালোচনা হিসেবে বিবেচনা করবে। আপনারা কি পয়েন্টটা ধরতে পারছেন? একই কথা সাওব কিংবা কোর্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমি মতে, এটা সুন্নাহ বিরোধী। কেউ লন্ডনের মতো শহরে সালোয়ার-কামিজ পরিধান করাকে অধিক ইসলামী রীতি মনে করলে তা হবে সুন্নতের খেলাফ।
নিছক নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এ ধরনের পোশাক পরিধান করা নিশ্চয়ই অনুমোদনযোগ্য। তবে একে ইসলামী ব্যাপার মনে করাটা ঠিক নয়। সাওব বা কোর্তার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলোতে ইসলাম খুঁজতে যাওয়া একগুঁয়েমি ছাড়া কিছুই নয়।
মহানবীর (সা) রীতি
আমাদের মহানবী (সা) যতটা সম্ভব স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতেন। যেমন, ভিন্ন অঞ্চলের কোনো মেহমান মহানবীর (সা) সাথে দেখা করতে আসলে, হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘তিনি ইয়েমেনী শাল পরিধান করতেন’। কে তাকে বলেছিল বিশেষ উপলক্ষ্যে ইয়েমেনী শাল পরিধান করাই হলো সপ্তম শতাব্দীর আরবীয় রীতি? এটা কি তিনিই উদ্ভাবন করেছিলেন? নাকি কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ পোশাক পরিধান করতে হলে ইয়েমেনী শাল পরিধান করাই তাঁর সময়ের প্রচলিত রীতি ছিল? হ্যা, এটাই ছিল তখনকার রীতি। তখন ভালো পোশাকে সজ্জিত হওয়ার মানে ছিল চমৎকার ইয়েমেনী শাল পরিধান করা।
স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে চলা
আমাদের সময়ে ইয়েমেনী শাল নয়, বরং স্যুট পরিধান করাই হচ্ছে প্রচলিত রীতি। মহানবী (সা) যখন বিভিন্ন প্রতিনিধি দলকে দাওয়াত দিতেন, তখন তাঁর সময়ের প্রচলিত উৎকৃষ্ট পোশাকই পরিধান করতেন। তাহলে আমাদের দাওয়াতী কাজের অবস্থা কী? আমরা এসব ক্ষেত্রে কী করি?… এটাই হলো ব্যাপার।
আপনি যখন সমাজের লোকদের চেয়ে ভিন্ন পোশাক পরিধান করবেন এবং ভিন্নতর ধর্মীয় বক্তব্য নিয়ে তাদের কাছে হাজির হবেন, তখন আপনার প্রত্যাখ্যাত হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ আপনি তো তাদের সাথে একই ভাষায় কথা বলেন! আল্লাহ তায়ালা কেন প্রত্যেক নবীকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় বাণী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন? আপনি যখন একই রকম পোশাক পরিধান করবেন, তখনই কেবল আপনি ওই সমাজের একজন হিসেবে বিবেচিত হবেন।
قَالَ يَا قَوْمِ أَرَأَيْتُمْ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّي وَآتَانِي رَحْمَةً مِّنْ عِندِهِ فَعُمِّيَتْ عَلَيْكُمْ أَنُلْزِمُكُمُوهَا وَأَنتُمْ لَهَا كَارِهُونَ
সে বললো, হে আমার জাতি! তোমরা কি ভেবে দেখেছো, আমি যদি আমার মালিকের পাঠানো একটি সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকি, তারপর তিনি যদি আমাকে তাঁর বিশেষ রহমত দান করে থাকেন, তারপরেও যদি তা তোমাদের চোখে না পড়ে, তাহলে তোমরা অপছন্দ করা সত্বেও আমি কি তা তোমার উপর চাপিয়ে দিতে পারি? (সূরা হুদ: ২৮)
কেউ যদি সমাজের লোকদের পরিচিত হয়, তারা যদি তাকে নিজেদের ঘনিষ্ট মনে করে, এরপর সে ব্যক্তি যদি ভিন্ন একটা ধর্মীয় বক্তব্য তাদের সামনে উপস্থাপন করে, তখন তারা তার ব্যাপারে ততটা বিরোপ মনোভাব পোষণ করবে না। আমার মতে, এটিই হলো ইসলামের লক্ষ্য। তাই আমি যদি বলি, ‘অমুসলিম শ্রোতাদের সামনে বক্তব্য রাখার সময় আলেমদের উচিত আমাদের যুগের প্রচলিত মানদণ্ড অনুযায়ী পোশাক পরিধান করা।’ তখন অনেকেই সমালোচনা করে বলবে, ‘এই লোকটাকে দেখো, সে এখনো প্যান্ট-শার্ট পরে আছে। এই ব্যক্তি কোন ধরনের আলেম!’ তাই না?
টুপি পরিধান
আপনারা জানেন, আমি সাধারণত টুপি পরি না। যদিও হজ্বের পর থেকে আমার মাথা কামানো। এ ব্যাপারে আমার বিনম্র মত হচ্ছে, মাথা ঢেকে রাখা পুরোপুরিই সাংস্কৃতিক একটি ব্যাপার। হ্যা, আমাদের মহানবী (সা) মাথা ঢাকতেন; কিন্তু তিনি কখনোই কাউকে এটা করার জন্য নির্দেশ দেননি। তিনি এটা করতে বলেছেন বলে বিশুদ্ধ কোনো হাদীস নেই। এটা ছিল তখনকার একটি সামাজিক প্রথা। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই তখন মাথা ঢাকতো। শতাধিক বছর আগে ইংল্যান্ড-আমেরিকার লোকজনও তো তাদের মাথা ঢাকতো। তাই না? লোকজনের এই অভ্যাসটা একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার। আপনি চাইলে মাথা ঢাকতেই পারেন। কিন্তু একে ইসলামী রীতি মনে করলে এই দেশে তা অহেতুক জটিলতা তৈরি করবে বলে আমার মনে হয়। নিজের দেশ (অর্থাৎ যেখানে এটি প্রচলিত) হলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
সমকামী বিবাহ
রক্ষণশীলরা সংস্কারপন্থার ব্যাপারে রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত। তাদের দৃষ্টিতে, সংস্কারপন্থীরাই আধুনিকতাপন্থী ও প্রগতিবাদীদের উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ‘আপনি যদি স্যুট-টাই পরাকে অনুমোদন দেন, তাহলে এরপর কী অনুমোদন দিবেন? সমকামী বিবাহ?’ রক্ষণশীলরা এভাবে স্যুট-টাই থেকে একলাফে সমকামী বিবাহ ইস্যুতে চলে যায়। এটা রক্ষণশীলদের এক ধরনের ভীতি। আপনারা হাসছেন? আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমাকে এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
নিতান্তই সাংস্কৃতিক কিছু রীতিকে রক্ষণশীলরা হারাম বলে থাকে। আপনি যদি যুক্তি সহকারে এগুলোকে হালাল বলেন, তাহলে তাদের গড়ে তোলা ইসলাম ভেঙে পড়ে। ফলে স্বভাবতই এটা তাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ও আল্লাহ, এরপর আর কী দেখার বাকি আছে! কোত্থেকে আপনি এইসব বলছেন?’ তারা সবসময় এক অজানা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে।
নতুন প্যারাডাইমের প্রয়োজন কেন?
রক্ষণশীলদের একটি শক্তিশালী প্যারাডাইম রয়েছে। সেটা হচ্ছে ইসলামের মূলনীতির দিকে ফিরে যাওয়া। একইভাবে প্রগতিশীলদেরও নিজস্ব শক্তিশালী প্যারাডাইম আছে। যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ডমিন্যান্ট পশ্চিমা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা। এর বিপরীতে, সংস্কারপন্থীরা একটা নতুন প্যারাডাইম গড়ে তুলছে, যেটা অন্যদের কাছে আশংকার ব্যাপার। সংস্কারপন্থীদের হারানোর কিছু নেই। তারা নতুন স্থান, কাল ও প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় রেখে একটি নতুন মডেল গড়ে তুলছে।
এর ফলে স্বভাবতই রক্ষণশীলরা সংস্কারপন্থীদের প্রচুর সমালোচনা করছে। প্রগতিবাদীরাও তাদের বিরোধিতা করে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে সংস্কারপন্থীরা যথেষ্ট প্রগতিশীল নয়, বরং তারা শেষ পর্যন্ত কোরআন-সুন্নাহর উপরই অটল থাকে।
ওমর সিরিজ নিয়ে বিতর্ক
পোশাক থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে এতক্ষণ আমি উদাহরণ দিয়েছি। ইস্যুগুলো নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে হয়তো আমরা আরো বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাবো। এখন আমি একটি সহজ উদাহরণ দেবো। রক্ষণশীলদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তারা এই ব্যাপারটি নিয়ে ভুল বুঝেছেন বলে আমার ধারণা। আমাদের সার্কেলে গত বছর এটা বোধহয় সবচেয়ে বেশি কৌতুহলের বিষয় ছিল।
বিষয়টি হলো, ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা) জীবনীর উপর মিডলইস্ট ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (এমবিসি) একটি সিরিজ নির্মাণ করেছে। বিশ্বের একদল প্রাজ্ঞ আলেমের নির্দেশনা অনুসারেই ত্রিশ পর্বের এই সিরিজটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমার জানা মতে, মধ্যপ্রাচ্যের সর্ববৃহৎ স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠান এমবিসি এই প্রথম কোনো বিষয়ে খ্যাতিসম্পন্ন আলেমদের সাথে যোগাযোগ করেছে। এদের মধ্যে শায়খ সালমান আল আওদা, আলী সালাবীসহ আরো বিখ্যাত আলেম ও ইতিহাসবিদগণ রয়েছেন। সীরাত ও ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এই ব্যক্তিগণ সিরিজটির প্রতিটি সংলাপ ও ঘটনার সত্যতা যাচাই করে দেখেছেন। ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা) জীবনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে তারা কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।
তারপর সিরিজটি যখন সবার জন্য উন্মুক্ত করা হলো তখন পৃথিবীর প্রতিটি রক্ষণশীল ক্যাম্পের আলেমগণ এর বিরোধিতা করেছেন। সালাফী থেকে শুরু করে দেওবন্দী, এমনকি সুফীরা পর্যন্ত এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। কোনো বিষয়ে আল আজহার এবং সৌদি আলেমদের একমত হওয়া বিরল ঘটনা। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা সবাই একমত। তাদের কথা হলো, ‘না, আপনি এর চিত্রায়ণ করতে পারেন না। এটা হারাম।’
তারা হারাম বিষয়গুলোর একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন। কিন্তু সে তালিকার অধিকাংশ বিষয়গুলোই আসলে হালাল। তবে আমি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা অনায়াসেই এই সমালোচনা করেছেন। তাদের কথা হচ্ছে, ‘কেউ কখনো যা করেনি, আপনি কীভাবে তা করতে পারেন? আপনি তো সাহাবীদের অনুকরণ করেছেন! তাই নয় কি?’
গঠনমূলক চলচ্চিত্র ঈমানকে মজবুত করে
এখানে উপস্থিত সবাইকে আমি চ্যালেন্জ করে বলতে পারি, ওমর সিরিজের কয়েকটা পর্ব দেখে আপনি না কেঁদে পারবেন না। এতে অবশ্যই আপনার ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আমি একজন সীরাত বিশেষজ্ঞ, তাই আমি সিরিজটির সংলাপগুলো হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করেছি। সিরিজটি দেখার সময় পেছনের সংলাপগুলো বার বার উদ্ধৃত করায় আমার স্ত্রী বিরক্ত হচ্ছিল। আমার কোট করা সংলাপ শোনার চেয়ে সিরিজটি দেখে যাওয়াকেই সে পছন্দ করছিল। এটি না দেখা পর্যন্ত আপনি এ সম্পর্কিত আবেগকে ঠিক বুঝতে পারবেন না। আপনারা কি জানেন, আমিও কেঁদেছি! আমার ঈমান অনেক মজবুত হয়েছে। আপনারা কি ভাবতে পারেন, সাধারণ মুসলমানরা এই সিরিজের প্রতিটি পর্ব দেখছে! একেকটি পর্ব বেরুচ্ছে আর লোকজন সিনেমা হলের দিকে ছুটছে!
এখানে এমন কে আছেন, যিনি ‘ব্যাটমান’, ‘রিটার্ন অব দ্য ডার্ক এজেস’ কিংবা ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ দেখেন নাই? আমার পয়েন্ট হচ্ছে সেটাই। এগুলো এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, উম্মাহর ৯৯ শতাংশ মানুষ পর্দায় আপত্তিকর কিছু না কিছু দেখছে। অথচ তারা ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা) জীবনী পড়ছে না। এই যখন অবস্থা, তখন সংস্কারপন্থীরা এগিয়ে এসে বলে, ‘ভাইয়েরা, এই মানুষগুলোর কল্যাণের জন্যই ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা) জীবনীর উপর একটি ধারাবাহিক মুভি তৈরি করা প্রয়োজন।’
চিত্রায়ণের মাত্রা
সংস্কারপন্থীদেরকে অবশ্যই একটি সীমারেখা মেনে কাজ করতে হবে। আমার মতে, এই সীমারেখা হলো মহানবীকে (সা) প্রত্যক্ষভাবে কোথাও চিত্রায়িত না করা। এই সীমারেখা আমরা কোনোভাবেই লঙ্ঘন করতে পারি না। এ ব্যাপারে সহীহ হাদীসে মোহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘শয়তান আমার চেহারা অনুকরণ করতে পারবে না।’ এই হাদিসের মর্মার্থ হলো – যে কারো জন্যই মহানবীর (সা) চেহারা অনুকরণ করা হারাম। তাই কোনো অভিনেতাই আমাদের মহানবীর (সা) চরিত্রে অভিনয় করে না। আমার মতে, এটাই হলো সীমারেখা। এই সিরিজ মুভিতে যেহেতু মাত্রা অতিক্রম করা হচ্ছে না, তাই গড়পরতায় এটা অনুমোদনযোগ্য। এটা একটা ভালো মুভি।
সময়ের প্রয়োজন
ওমর সিরিজের সবকিছুই অকাট্য, আমি তা বলছি না। আমার কথা হচ্ছে, এটা মন্দের ভালো। কারো বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকলে সে বিষয়টি বুঝতে পারবে। তারমানে লোকজনকে তাহাজ্জুদের নামাজের পরিবর্তে ওমর সিরিজ বেছে নিতে বলা হচ্ছে না। বরং এখানে দর্শকরা সমাজপতি ‘সিটিজেন কেইন’[1] ও হজরত ওমরের (রা) মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেবেন। আপনি কোনটা দেখবেন? কোনটা দেখা আপনার জন্য উপকারী? এখানে সেই অপশনটা দেয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সংস্কারপন্থীদের কথা হলো, ‘দেখুন, আমাদেরকে বর্তমান যুগের কথা বিবেচনা করতে হবে। মহানবী (সা) হাসান বিন সাবিতের (রা) কবিতার প্রশংসা করেছেন। তাঁর সময়টা ছিল কাব্যের। অন্যদিকে, আমাদের সময়টা হচ্ছে মিডিয়া ও সিনেমার।’
কাব্যচর্চা প্রসঙ্গে
এক অর্থে, ইসলাম কাব্যচর্চাকে উৎসাহিত করে না। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে,
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ
বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে। (আশ শোয়ারা: ২২৪)
সর্বদা কাব্যচর্চা ভালো কিছু নয়। কিন্তু সমাজে এর প্রচলন থাকায় গঠনমূলক কাব্যচর্চা এবং তা প্রচার করা যেতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللَّـهَ كَثِيرًا
তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। (আশ শোয়ারা: ২২৭)
ইসলামের সাংস্কৃতিক বোধ
ইসলামকে পরিবর্তন করা সংস্কারপন্হীদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সংস্কৃতি সম্পর্কে ইসলামের বোধকে তারা গুরুত্ব দেয়। আমরা কখনোই সাহাবীদেরকে নাট্যমঞ্চ কিংবা মুভিতে চিত্রায়িত করিনি। এমন কোনো নাটক-সিনেমা করা হয়নি যেখানে আবু বকর (রা) কিংবা ওমরকে (রা) সরাসরি চিত্রায়িত করা হয়েছে। হয়েছে কি? না, হয়নি। কিন্তু কোরআন-হাদীসে কি এ ব্যাপারে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আছে? না, নেই।
ইতিবাচক ফলাফলের জন্যে পরিবর্তনকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সংস্কারপন্হীরা বেশ উদার মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। এভাবে প্রচুর উদাহরণ দেয়া যাবে, যার মধ্যে কিছু মামুলি উদাহরণও রয়েছে। আমার পরিষ্কার কথা হলো, ছোটবেলা থেকেই আমরা কিছু ব্যাপারে শুনে আসছি যে, এগুলো হচ্ছে – হারাম, হারাম, হারাম। অথচ এগুলোর কোনোটাই হারাম নয়!
বার্ষিকী পালন
এ সংক্রান্ত খুব সহজ একটা উদাহরণ হলো জন্মদিন কিংবা বিভিন্ন বার্ষিকী উদযাপন। এসবের কোনোটাই ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বরং ইসলাম বিভিন্ন বার্ষিকী পালনকে উৎসাহিত করে। কারণ, কাজ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়, এমন সবকিছুকেই ইসলাম উৎসাহ দেয়। কথা হচ্ছে, আমাদের বাপ-দাদারা বিবাহ বার্ষিকী ও জন্মদিন পালন করেনি বলেই আমাদের জন্যে তা অনৈসলামী হয়ে যাবে না। প্রকৃতিগতভাবেও এগুলোতে অনৈসলামী কোনো উপাদান নেই।
এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ফিকহী আলোচনা করতে আমি আগ্রহী। কারো কারো মতে, এগুলো পালন করার মাধ্যমে লোকজন বিধর্মীদের রীতি অনুকরণ করছে। এগুলো এক ধরনের ডমিন্যান্ট কালচারাল ন্যারেটিভ। তবে এটা ফিকাহর অনেকগুলো ব্যাখ্যার একটা ব্যাখ্যা মাত্র। তবে অন্যপক্ষের মতে, এই ধরনের অনুষ্ঠান উদযাপনকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেনি। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত বলবো
হ্যাঁ, বড়দিন বা দেওয়ালি– এগুলো অন্যদের ধর্মীয় উৎসব। আমরা এসবের অনুসরণ করতে পারি না। কারণ, অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবগুলো আমাদের জন্যে হারাম। আমাদের নিজস্ব উৎসব রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত বা ঘরোয়া– এমন যে কোনো উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে শরীয়াহ সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেনি। এসব ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের কার্যকলাপ হালাল হলে অনুষ্ঠানটিও হালাল হিসেবে গণ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে কেউ পার্টির আয়োজন করলে শরীয়াহর দৃষ্টিতে তা কি হারাম? না। এমনকি আপনি চাইলে কোনো বাৎসরিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেন অথবা যে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেন। এ ধরনের কোনো উদযাপন সম্পর্কে শরীয়াহ সরাসরি হ্যাঁ-না কিছু বলে না।
একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের পুনর্মূল্যায়ন
আরেকটি ইস্যু নিয়ে আমরা এখন কথা বলবো। এটি বেশ বিতর্কিত একটি বিষয়। তবে এই আলোচনা আমাদের মধ্যে ভাবনার খোরাক জোগাবে। আপনারা আমার সাথে একমত বা দ্বিমত যাই পোষণ করুন না কেন, চলুন আগে আলোচনাটা শুরু করা যাক। সমকামী সম্পর্কের ব্যাপারে মুসলমানদের বক্তব্য কী হওয়া উচিত? এ ব্যাপারে এখন খুব বিতর্ক চলছে।
এ প্রসঙ্গে প্রগতিবাদীদের বক্তব্য হলো – ‘কোনো সমস্যা নেই, এগিয়ে যাও। আমাদের উচিত একে অনুমোদন দেয়া।’ রক্ষণশীলরাও তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা কথাই বলতে থাকে।
এটি করতে গিয়ে রক্ষণশীলরা নিজেরাই ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়ে। এর ফলে তাদের বক্তাগণ এ দেশে নিষেধাজ্ঞারও সম্মুখীন হন। তাই না? কারণ তারা স্বভাবতই পর্যাপ্ত সহযোগিতা পায় না।
আমি মনে করি, সমকামীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ইসলামসম্মত নয়। তারমানে, আমরা কি তাহলে সমকামী সম্পর্ককে অনুমোদন করছি? অবশ্যই নয়। তা যদি না করি, তাহলে কি দেশের সমকামীদের সাথে অপ্রীতিকর, জঘন্য ও নিষ্ঠুর আচরণ করতে হবে? না। এটা তাদের দেশ। তারা চাইলে এটা করতে পারে। আমরা নৈতিকতার জায়গা থেকে তাদেরকে অনুমোদন না দিলেও রাজনৈতিক ও আইনগত দিক থেকে এটি ভিন্ন ব্যাপার।
বিচ্যুত মুসলমানের সাথে ব্যবহারের আদব
সমকামিতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে এমন কোনো মুসলমানের সাথে দেখা হলে অধিকাংশ রক্ষণশীল মুসলমান খুবই নির্দয় ও কঠোর আচরণ করে। এমনও বলে, ‘আমাদের মসজিদ থেকে বেরিয়ে যান, আপনাকে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।’
আমি বলতে চাই, এই ব্যক্তি একজন মুসলিম। তিনি এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন, একজন ভালো মুসলমান হতে চাচ্ছেন। অথচ তিনি তো প্রগতিবাদীদের মতো নিজেকে সঠিক দাবি করছেন না। তিনি তো আর বলছেন না – ‘সমকামিতা তো হালাল। আপনি কেন আমাকে এটা হারাম বলছেন? আমি একে মসজিদে প্রকাশ্যে উদযাপনের আয়োজন করবো।’ তিনি যদি এটা না বলে থাকেন, বরং তার কথা যদি হয় এমন – ‘দেখুন, আমি এটা সহজে ছাড়তে পারছি না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ এভাবে তিনি যাই বলুন না কেন, তিনি যদি তার ভুল স্বীকার করে বলেন – ‘আমি জানি এটা একটা সমস্যা। আমি এই অভ্যাস থেকে বেরুতে চেষ্টা করছি।’
একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির – যিনি তা ছেড়ে দেওয়ার জন্যে চেষ্টা করছেন – সাথে আমরা যে রকম আচরণ করি, উপরোল্লিখিত ধরনের সমকামী মুসলিমের সাথে আমরা কেন এরচেয়ে ভিন্ন আচরণ করি? মসজিদে আগত মুসল্লীদের জনে জনে গিয়ে আপনি কি জিজ্ঞাসা করেন – ‘এই যে ভাই, আপনি কি কখনো মদপান করেছেন? আপনি কি কখনো ড্রাগস নিয়েছেন?’ অথবা, আপনি জানেন এক ব্যক্তি মদপান করে। আপনি তাকে পানশালায়ও দেখেছেন। সেই লোকটি জুমার নামাজ পড়তে এলো। আপনি কি তখন বলা শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা, এই লোকটি স্থানীয় পানশালায় মদপান করে।’ আপনি কি এভাবে সিন ক্রিয়েট করেন? নিশ্চয় না। বরং আপনার বা আমার বলা উচিত ‘আলহামদুলিল্লাহ, লোকটি অবশেষে জুমার নামাজ আদায় করতে এসেছে।’ তাই না? সুতরাং, যে ব্যক্তি একটা সমস্যা থেকে নিজেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, আমরা কেন তাকে বুঝতে পারি না এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারি না?
গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিই কি আপসকামী মনোভাব?
আমি কি এখানে ইসলামী আইনের পরিবর্তন করেছি? না। আমি মোটেও সমকামিতাকে অনুমোদন করার কথা বলছি না। আমি বলছি না, ‘আমরা একে আইনসম্মত করে নিচ্ছি। আমরা একে উদযাপন করবো। তাই গরু-ভেড়া জবাই করে ভোজের আয়োজন করো।’ এভাবে ভেগান ইস্যুতে ফিরে যাওয়ার কথা আমি বলছি না। তবে আমি বলতে চেয়েছি, এসব লোকদের সাথে আমরা যে ধরনের আচরণ করি, তা পুনর্বিবেচনা করতে ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ আমাদেরকে বাধ্য করেছে। অবশ্যই বাধ্য করেছে।
ভালো আচরণ করতে অসুবিধা কি? আমার চেয়ে একটু ভিন্নতর সমস্যায় নিমজ্জিত একজন মুসলিম ভাইয়ের প্রতি আমরা কি একটু সহানুভূতিশীল হতে পারি না? এই সমস্যায় হয়তো আমি নাও পড়তে পারি, তাই বলে তার আপ্রাণ চেষ্টার প্রতি কি আমি সহানুভূতি প্রকাশ করবো না? তার সাথে কি আমার জঘন্য ও অপ্রীতিকর আচরণ করতে হবে? তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে? তাকে যাচ্ছেতাই বলতে হবে? কখোনোই না। অন্য আর দশটা গোনাহগার মুসলিমের মতো তাকে আমি বড়জোর বলতে পারি, ‘ভাই, আল্লাহ সকল পাপই ক্ষমা করে দেন। মসজিদে চলুন। বেশি বেশি কোরআন পাঠ করুন। আপনি যদি এখনো এই অভ্যাস থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে তা আমাদেরকে বলার দরকার নেই। এটা আল্লাহ এবং আপনার মধ্যে গোপন রাখুন। কাউকে বলার দরকার নেই। আল্লাহর কাছে অনুশোচনা করুন এবং একজন ভালো মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করুন।’
সহযোগিতামূলক হওয়া মানে আপসকামিতা নয়
উপরোক্ত পরামর্শগুলোই আমাদের দেওয়া উচিত। আমি কী বলতে চাইছি, আপনারা নিশ্চয় তা বুঝতে পারছেন। আমরা ইসলামী আইনকে পরিবর্তন করার কথা বলছি না। আসলে আমার বলা উচিত, ইসলামের কোনো আইনকে আমরা পরিবর্তন করছি না। বরং ইসলামী আইনের প্রচলিত ব্যাখ্যার পুনর্মূল্যায়ন করতে আমরা আগ্রহী।
মুসলমানদের এই পাঁচটি প্যারাডাইম সম্পর্কে আমি যা বলতে চেয়েছি, এতক্ষণে বোধহয় তা আপনাদের সামনে পরিষ্কার করতে পেরেছি।
সংস্কারের দিকনির্দেশনা
বক্তব্য শেষ করার আগে সংস্কারের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা তথা ইসলামে সংস্কারের পদ্ধতি, মাত্রা ও পরিধি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমার মতে, ইসলামী সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদেরকে পাঁচটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
১। খেলা একই শুধু মাঠ আলাদা
আমাদেরকে বুঝতে হবে, এই পাঁচটি ধারা সবসময়ই ছিল। এগুলোর কোনোটাই নতুন কিছু নয়। কোনো কোনো ইস্যু হয়তো নতুন হতে পারে। ভেগানিজম নয়, আমাদের ইস্যু হচ্ছে সমকামিতা, নারী-পুরুষের ভূমিকা ইত্যাদি। একইভাবে, সহস্র বছর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল আল্লাহর সত্ত্বা ও তাঁর গুণাবলির সম্পর্ক।
এই যুগেও আপনি কি গ্রিক সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবেন বা গ্রিক সভ্যতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবেন? কিংবা কোরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করবেন? এটা বোধহয় ঠিক হবে না। কারণ, ইতোমধ্যে ইস্যুর পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনে মানুষ কীভাবে সাড়া দেয়? মানুষের চিন্তাভাবনার পরিসর বেশ সীমিতই বলতে হবে। আসল কথা হচ্ছে, খেলা আগেরটাই আছে, কিন্তু মাঠের পরিবর্তন হয়েছে। খেলার নিয়মনীতিও আগের মতোই আছে, শুধু স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তন ঘটেছে।
সুতরাং, যে পাঁচটি ধারার কথা বলেছি এর কোনোটাই নতুন নয়। মহানবীর (সা) যুগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই ধারাগুলো ছিল এবং আছে। তবে এর মানে এই নয় যে, পাঁচটি ধারাই সঠিক। আমি অকপটে বলতে চাই, মুরতাদ ও প্রগতিবাদী ধারার প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। প্রগতিবাদীদেরকে আমি হিসেবের মধ্যে ধরি না। তারা যতটা স্মার্ট হিসেবে নিজেদের দেখায়, আসলে ততটা নয়। তারা নিজেদেরকে উঁচুমানের বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মনে করে, যদিও তারা তা নয়।
রক্ষণশীলদের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। এক দশক আগে আমি নিজেও এই ধারার সাথে যুক্ত ছিলাম। আমি মনে করি এটা ইসলামের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ধারা। আমি এখনো মসজিদে তাদের সাথে সময় কাটাই। তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা রয়েছে। অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা নিয়েই আমি তাদেরকে বলতে চাই, আপনাদের পালিত ইসলাম আপনাদের উত্তরসুরীদের পক্ষে পালন করা হয়তো সম্ভব হবে না। প্রভাবশালী সংস্কৃতিরই অংশ অথচ গঠনমূলক – এমন কোনো উপাদানকে গ্রহণ করা অন্যায় কিছু নয়। এতে বরং আপনার পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে ইসলাম পালন করা সহজতর হবে।
এই হচ্ছে আমার প্রথম কথা। আমি আবারো বলছি, এই পাঁচটি ধারার বাইরেও আরো অনেক ধারা থাকতে পারে। আমি সেসব সম্ভাব্য প্যারাডাইমের কথা আলোচনা করছি না। বরং আমি সেগুলো নিয়ে কথা বলছি যেগুলো সুবিদিত।
২। আলেমদের দায়িত্ব
প্রতিটি ইস্যুকে কোরআন-হাদীস এবং আধুনিক ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনা করা আলেমদের দায়িত্ব। এটা সাধারণ মুসলমানদের কাজ নয়। আমি সবসময় বক্তব্যকে যথাসম্ভব স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করি। তারপরও শ্রদ্ধেয় অনেক আলেম এই বলে সমালোচনা করেন, ‘ইয়াসির, তুমি সাধারণ মুসলমানদেরকে মুজতাহিদ হতে বলছ!’
এই অভিযোগটি মোটেও সত্য নয়। ইংরেজি ভাষায় যতটা পারা যায়, আমি ততটা পরিষ্কারভাবে তাদেরকে প্রশ্ন করতে চাই – পোশাক, জন্মদিন, ভোটাধিকার প্রয়োগসহ যে কোনো ইস্যুর পর্যালোচনা করা কাদের দায়িত্ব? সুন্নাহ নিয়ে যাদের গভীর অধ্যয়ন রয়েছে এমন অভিজ্ঞ আলেমদেরই এটা দায়িত্ব।
আমি ঠিক এই কাজটাই করছি। কোনো একটা বিষয়ে বিভিন্ন মাজহাবে যা বলা হয়েছে, আমি সেগুলো তুলে ধরি। যেন আপনারা সংশ্লিষ্ট বিষয় ভালোভাবে বুঝতে পারেন। পাশাপাশি এটাও যেন বুঝতে পারেন – মতামতের এতো বৈচিত্র্য (spectrum of opinion) কেন। এটা কোনো সাধারণ মুসলমানের দায়িত্ব নয়। দুয়েকটা লেকচার, একটা সাপ্তাহিক সেমিনার, এমনকি অনেকগুলো সাপ্তাহিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করলেই একজন আলেম হওয়া যায় না।
সেমিনার ও লেকচারগুলো নিছক সাধারণ শিক্ষার জন্যে হলেও এগুলোর মাধ্যমে কোনো একটি বিষয় আরো ভালোভাবে হৃদয়াঙ্গম করা যায়। আমি আশা করি, আপনারা কেউ যদি আজকের এই একটা লেকচারই শুনে থাকেন তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি ওয়াকিবহাল হয়ে থাকবেন।
৩। মতামতের বৈচিত্র্য
বিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বদা মতপার্থক্য হয়। সবাই মিলে একটি একক মতামত (uniformity of opinion) গ্রহণ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এর ভালো একটা উদাহরণ হচ্ছে ‘ওমর সিরিজ’। ছয়জন স্কলার এই সিরিজ নিয়ে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন এবং পর্বের শেষে প্রদর্শিত নামের তালিকায় তাঁদের নাম দেয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছিলেন। তাঁদের দুই তিনজনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। আমি সত্যিই তাদেরকে শ্রদ্ধা করি।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্যান্য স্কলারগণ তাদের সমালোচনা করেছেন, ‘আপনাদের সাহস তো কম নয়!’ এই ধরনের সমালোচনার প্রবল চাপে তাঁদের কেউ কেউ ‘ভুল’ স্বীকার করেন এবং ‘আমরা আসলে বুঝতে পারিনি’ – এ জাতীয় বিবৃতি দিয়ে নিজেদেরকে বিতর্ক থেকে সরিয়ে নেন।
অতএব, স্কলারদের মাঝে, বিশেষ করে রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্হী স্কলারদের মাঝে মতানৈক্য হতেই পারে। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই – প্রতিটি অগ্রগামী চিন্তা বা উদার মতামতই যে সঠিক, তা নয়। একইভাবে প্রতিটি রক্ষণশীল মতামতই যে পশ্চাৎপদ, তাও নয়। মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রমও হতে পারে। কখনো কখনো রক্ষণশীল মতামত তুলনামূলক ভালো হয়। এমনকি সংস্কারপন্থীদের জন্যেও তা ভালো। আবার কখনো কখনো অগ্রগামী চিন্তাই তুলনামূলক ভালো হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
সুতরাং, প্রতিটি পরিবর্তনই ইতিবাচক, তা নয়। সংস্কারপন্হীরাও তেমনটা দাবি করছেন না। আমিও তা বলছি না। প্রতিটি বিষয়েই আলেমগণ বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এটা করতে গিয়ে তাদের মাঝে কিছু বিষয়ে মতের ভিন্নতা তৈরি হওয়াটই স্বাভাবিক। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, আলেমরা কখনোই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না।
আরেকটি বিষয় বলা দরকার। সেটি হলো, স্কলারগণ যেসব বিষয়ে সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন, সে সব সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা এই ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন। কোনো বিষয়ে যদি স্কলারদের সর্বসম্মত মতামত থাকে, তাহলে তাতে সত্যিই আপনার আস্থা রাখা উচিত। আর যদি মতামতের ভিন্নতা থাকে, ভিন্নমত পোষণকারী স্কলারগণ সংখ্যায় কম হলেও আপনি যে কোনো একটা মতামত বেছে নিতে পারেন। ওমর সিরিজের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। ছয়জন স্কলার একে অনুমোদন দিয়েছেন। আর মূলধারার সুন্নী ফতোয়া কমিটিগুলো এর বিপরীত মতামত দিয়েছেন। তারপরেও এ সম্পর্কিত ইখতিলাফ তথা মতানৈক্যের বৈধতা রয়ে গিয়েছে। এর ফলেই চতুর্থ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪। প্রকৃত আলেমের অনুসরণ করা
অন্তত ১৫-২০ বছর অধ্যয়ন করতে না চাইলে আলেম হওয়া আপনার কাজ নয়। তাহলে আপনার কাজ কী হবে? আপনার কাজ হবে এমন একজন আলেমকে বেছে নেওয়া, যার মধ্যে নিম্নোক্ত দুইটি গুণ রয়েছে –
ক. তিনি হবেন পূর্ণ ঐকান্তিক ও তাকওয়াসম্পন্ন। কে এ ধরনের ব্যক্তি – তা হয়তো আপনি নিশ্চিতভাবে জানতে পারবেন না, তবে উপলব্ধি করতে পারবেন। এ ধরনের ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলেন, টাকার বিনিময়ে ফতোয়া দেন না এবং যথেষ্ট বিবেকবান হয়ে থাকেন।
খ. এ ধরনের ব্যক্তি ইসলামী বিষয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন। এর অর্থ হচ্ছে তিনি আলেমদের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ইসলামের পর্যাপ্ত জ্ঞানসম্পন্ন।
যোগ্য আলেম চেনার উপায়: আপনার চিকিৎসার জন্য কীভাবে ডাক্তার ঠিক করেন? শুধু যোগ্যতা থাকলেই তার কাছে আপনি চিকিৎসা নিতে যান না। বরং যে ডাক্তার আপনার কথা আগ্রহ নিয়ে শোনে, তার কাছেই আপনি যান। শরীয়াহর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি প্রযোজ্য। নিজে ডাক্তার না হওয়া সত্বেও আমরা কীভাবে একজন ডাক্তারকে বেছে নেই? সুবিধার কথা চিন্তা করে? নাকি কম খরচের কথা চিন্তা করে? এটা জীবন মরণের প্রশ্ন। কোন ডাক্তার কার চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে, আমরা কি তা বিবেচনা করি? অবশ্যই না।
কারণ, ‘শায়খ গুগল’ থেকে ডাক্তারি শেখা কোনো ডাক্তার টাকা কম নিলেও যেমন আপনি তার কাছে যান না, তেমনিভাবে শুধু নিজের সুবিধাজনক ফতোয়ার জন্য আপনি কোনো আলেমের কাছে যেতে পারেন না। যিনি যোগ্যতাসম্পন্ন এবং আপনার সমস্যার ব্যাপারে যিনি আন্তরিক বলে আপনি মনে করেন, তেমন ডাক্তারের কাছেই তো আপনি যান। তাই নয় কি? তাহলে শরীয়াহর ক্ষেত্রে একই ব্যাপার মানতে পারবেন না কেন? এ ক্ষেত্রে তো বরং এই নীতি আরো বেশি করে মানা উচিত। সুতরাং এমন আলেমের কাছে আপনার যাওয়া উচিত, যিনি যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং খোদাভীরু বলে আপনি মনে করেন।
সাধারণ মুসলমানদের অযুহাত: আপনার এবং আমাদের সকলের কর্তব্য হচ্ছে এমন একজন মুজতাহিদ আলেম খুঁজে বের করা যিনি যথেষ্ট জানেন। একজন সাধারণ মুসলমানদের জন্য এটাই চূড়ান্ত ইজতিহাদ। এর ফলে কেয়ামতের দিন আমরা আল্লাহর কাছে এই বলে কৈফিয়ত দিতে পারবো, ‘হে আল্লাহ! আমি কোনো ফিকাহবিদ নই। তবে আমি অমুক আলেমকে অনুসরণ করেছিলাম, যিনি একে হালাল বলেছিলেন।’ আপনি যদি আন্তরিক হন এবং এমন একজন আলেমকে অনুসরণ করেন যাকে সত্যিকার অর্থেই আপনার কাছে আলেম বলে মনে হয়, তাহলে অবশ্যই আপনি মুক্তি লাভ করবেন। কারণ, তখন আপনি বলতে পারবেন, “হে আল্লাহ! আমি কোনো আলেম নই। আমি অমুক আলেমকে বিশ্বাস করেছিলাম, যিনি বলেছিলেন, ‘এইগুলো হালাল আর ওইগুলো হারাম’। আমি তার কথা অনুযায়ী আমল করেছিলাম।”
তাহলে আপনার দায়িত্ব কী? আপনার কাজ হচ্ছে ধর্মীয় বিষয়ে এমন কাউকে বেছে নেওয়া যাকে আপনি সবচেয়ে বিশ্বস্ত বলে মনে করেন। আর যদি আপনি রক্ষণশীল কিংবা সংস্কারপন্হীদের সাথে থাকেন, তাহলেও সমস্যা নেই।
প্রখ্যাত আলেমদের অবস্থান: এটি নিশ্চিত যে, মুরতাদদের মধ্যে কোনো আলেম নেই। প্রগতিবাদীদের মাঝেও কোনো আলেম নেই। আর সত্যি বলতে কি, উগ্রপন্থী বা জিহাদী দল হিসেবে পরিচিত গ্রুপগুলোর মাঝে অল্প কয়েকজন আলেম থাকলেও তারা এসব ক্যাম্পে যোগ দেয়ার পরেই বিখ্যাত হয়েছেন। সেখানে এমন একজন আলেমও নেই, যিনি এসব গ্রুপে যোগ দেয়ার আগে থেকেই বিখ্যাত ছিলেন। তারা কেউই প্রকৃত আলেম নন, তাদের পাণ্ডিত্য সর্বজন স্বীকৃত নেই। রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্থী ধারার আলেমরাই কেবলমাত্র সর্বজন স্বীকৃত।
৫। যথাসম্ভব কম সমালোচনা করা
আপনাদের কাছে আমার শেষ পরামর্শ হলো – অন্যদের যুক্তিখণ্ডন ও সমালোচনা যথাসম্ভব সর্বনিম্ন মাত্রায় রাখার চেষ্টা করবেন। এই অভ্যাস পুরোপুরি দূর করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। অন্য মুসলমানরা যদি এমন কিছু করে, তাদের আলেমগণ যার বৈধতা দিয়েছেন; তাহলে এটা আল্লাহ তায়ালা ও তাদের মধ্যকার ব্যাপার। আপনি বড়জোর নতুন ধারার চিন্তাভাবনা কিংবা অন্য কোনো আলেমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদেরকে এ ব্যাপারে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে পারেন। ব্যস, এটুকুই আপনার দায়িত্ব। একজন সাধারণ মুসলমান হিসেবে কারো সাথে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়া আপনার উচিত হবে না। যে কোনো বিষয়েই মতামতের বৈচিত্র্য থাকতে পারে।
ফেরকার চেয়ে নিয়তই বেশি গুরুত্বপূর্ণ: কেউ যদি ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট ধারা অনুসরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাহলে তা খারাপ কিছু নয়। একান্ত আন্তরিকতার সাথে কিছুটা রক্ষণশীল কিংবা কিছুটা উদার ধারা কেউ অনুসরণ করলে এ জন্য শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন না।
আন্তরিক নিয়তের সাথে কেউ যদি কোনো কিছুকে হালাল মনে করে তা মেনে চলে, তাহলে তা নিয়ে শংকার কিছু নেই। যে কোনো ফেরকা, দল বা জামায়াতের চেয়ে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমাশীলতার পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও রাসূলের (সা) অনুসরণ করাই যদি আপনার নিয়ত হয়ে থাকে, তাহলে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে গেলেও দুনিয়া উল্টে যাবে না।
প্রকৃত ধার্মিকতা: আপনার ইবাদত, নামাজ, যাকাত– এগুলোর বিনিময়েই ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন। আশাবাদী মনোভাব থাকতে হবে। কোনো ছোটখাটো বিষয়ে আপনার সাথে কোনো মুসলমানের মতপার্থক্য হলেই সে জাহান্নামী হয়ে যাবে, ব্যাপারটা তা নয়। এটা বিরিয়ানীর পরিবর্তে শর্মা খাওয়ার মতোই নগণ্য ব্যাপার। সত্যিকারের তাকওয়ার সাথে আল্লাহর ইবাদত করা এবং রাসূলকে (সা) সম্মান করাই প্রকৃত ধার্মিকতা।
এর মানে অবশ্য সবাই যে সমপরিমাণে সঠিক তা নয়। বরং এর মানে হচ্ছে, কারো সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া আপনার কাজ নয়। যারা কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাদের উচিত কোনো আলেমের শরণাপন্ন হওয়া। তখন আলেমগণ নিজেদের মাঝে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করবেন।
উপসংহার
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! শেষ করার আগে কিছু কথা বলতে চাই। নিরামিষ ভোজন তথা ভেগানিজম কিংবা মাংস খাওয়া আমাদের ইস্যু নয়। আপনার প্রাসঙ্গিক ইস্যু হচ্ছে কীভাবে একজন বৃটিশ মুসলিম হওয়া যায়। অন্যদিকে কীভাবে একজন পশ্চিমা আমেরিকান মুসলিম হওয়া যায়, তা আমার জন্যে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এটা বেশ কঠিন ব্যাপার।
কচ্ছপের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখা
কচ্ছপ ভয় পেলে কী করে? খোলসের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমরা মনে করি এটা ভালো এবং কার্যকর। আমার বিনীত মতামত হলো, বেশিরভাগ রক্ষণশীল আন্দোলনই এ রকম। নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার এই প্রবণতা এক ধরনের ভীতি থেকেই সৃষ্ট। কিন্তু গুটিয়ে নেয়ার এই প্রচেষ্টা প্রকৃতপক্ষে কোনো রকমে টিকে থাকার সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়। পরিণতিতে, আপনি সামনে এগিয়ে যেতে পারছেন না। কিন্তু এটা তো আপনার কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে নিরাপদ নয়, মুক্তির পথও নয়।
আপনারা জানেন, আপনাদের সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে, আপনার ভাষা কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা কয়জনইবা আমাদের পূর্বপুরুষের ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারি!
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
কোনো কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেখতে কোনো সমস্যা নেই। ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ থেকে কিছু কিছু উপাদান গ্রহণ করাও এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আওতাভুক্ত। যেমন, আমরা তাদের ভাষা গ্রহণ করেছি। আমি উর্দু বা আরবির চেয়ে ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমরা সবাই জানি, এটা অন্যায় কিছু নয়।
সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সমঝোতা
ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভের ভাষা গ্রহণ করতে সমস্যা না থাকলে অন্যান্য উপাদান গ্রহণ করা কেন অন্যায় হবে, যেসব ব্যাপারে ইসলামে হ্যাঁ কিংবা না বলা নেই? এসব ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সাহস দেখানো প্রয়োজন।
আগেও বলেছি, রক্ষণশীলদের প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে। জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় তাদের সাথে কাটাতেই আমি সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। কিন্তু যখন থেকে আমি তরুণদের সাথে মিশতে শুরু করলাম এবং ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রচার ও শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হলাম, তখন থেকে মুক্তভাবে চিন্তা করা শুরু করেছি।
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসুন
পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থেই আমাদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। এখনই এর উপযুক্ত সময়। আমরা হয়তো মাঝপথে হারিয়েও যেতে পারি। কারণ, আমাদের কাছে কোনো প্রতিষ্ঠিত প্যারাডাইম নেই। যখন আমার ডানে মোড় নেয়া উচিত, তখন হয়তো বামে মোড় নিয়ে ফেলবো। কিন্তু লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে যদি আমি কোনো ভুল করেও ফেলি, তাহলে পেছনের লোকেরা নিশ্চয় তা দেখে থাকবে। ফলে তারা এই বিপদ হতে নিরাপদ থেকে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।
ব্রিটিশ ইসলাম
অনেকের মতে, আমরা ভুল পথে যাচ্ছি এবং রক্ষণশীল ধারাই সঠিক। তাদের বক্তব্য – ‘আপনারা জানেন না আপনারা কোন পথে যাচ্ছেন।’ তাদের কথার যৌক্তিকতা আছে বটে। কারণ, আমরা এখনো চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছতে পারিনি।
তবে ‘ব্রিটিশ ইসলাম’ পরিভাষাটি কোনোভাবেই ভুল নয়। আপনারা সবাই ব্রিটিশ এবং একইসাথে মুসলমান। একইসাথে ব্রিটিশ ও মুসলিম পরিচয়কে ধারণ করা অসম্ভব নয়। এতদুভয়ের মধ্যে সুসমন্বয় সম্ভব। তবে এটি কীভাবে এবং কতটুকু মাত্রায় সম্পন্ন হবে, আমরা এখন সেটি নির্ধারণ করার মূলনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। এই সংলাপ অর্থবহ করার জন্যে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক।
উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যই শেষ কথা নয়
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! সর্বশেষ কথা হচ্ছে, আমরা পূর্বপুরুষদের চেয়ে ভিন্ন যুগ ও অঞ্চলে বাস করছি। আমরা ঐতিহ্যকে সম্মান করি। আমরা উপলব্ধি করি, আমরা যে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী, তা সমৃদ্ধ ও সুন্দর। তারমানে সেই উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে, তা নয়। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
আমরা তা-ই গ্রহণ করবো, যা আমাদের প্রয়োজন। আমরা সেটাই পরিবর্তন করবো, যার অনুমোদন আমাদের রয়েছে। আর আমরা তা পরিত্যাগ করবো, যা পরিত্যাজ্য। এগুলো আসলে ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার এবং এ ধরনের আলোচনা কখনোই পুরোপুরি শেষ হয় না। বরং আলেমগণ সদাসর্বদাই এসব বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবেন।
বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে আপনারা ইউটিউবে প্রচুর কথাবার্তা ও ভিডিও পাবেন। এসব ক্ষেত্রে আপনার কাজ হচ্ছে, যে আলেমের উপর আপনার আস্থা রয়েছে, আপনি তার কথার ওপর অটল থাকবেন। আপনি যদি আন্তরিক হয়ে থাকেন, আল্লাহকেই কেবল সন্তুষ্ট করতে চান এবং এর জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যান; তাহলে জেনে রাখুন, মহান আল্লাহর দয়া আমাদের সবাইকে ঘিরে রয়েছে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথের রোল মডেল হিসেবে গড়ে ওঠার তওফিক দান করুন। তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দিন। তিনি আমাদেরকে জান্নাতিদের পথে চলার তওফিক দিন। আমরা যেন মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন ও মুমিন হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে পারি এবং মহানবী (সা) ও শহীদদের সাথে কেয়ামতের ময়দানে হাজির হতে পারি, তিনি আমাদেরকে সে তওফিক দান করুন। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
প্রশ্নোত্তর পর্ব
বক্তৃতা শেষে শায়খ ইয়াসির ক্বাদী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষদের লিখিত প্রশ্নের জবাব দেন। সেগুলো এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন-১: আপনি পাঁচটি ধারার কথা বলেছেন। এরমধ্যে প্রগতিবাদীরা একটা ধারা। আমার জানার বিষয় হচ্ছে, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যারা এই ধারায় আছে, তাদের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর: আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রগতিবাদীরা কখনোই বেশি এগুতে পারবে না। তারা সবসময়ই একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসেবেই থাকবে। কারণ, আল্লাহ এই ধর্মকে রক্ষা করার ওয়াদা করেছেন। মহানবী (সা) তাঁর উম্মতের ব্যাপারে বলে গেছেন,
إن أمتي أمة مرحومة
আমার উম্মতের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে।
যে কোনো প্রগতিবাদী ধারার প্রতি লক্ষ্য করলে আপনি দেখবেন, তাদের অবস্থা এমন যেন ‘খালি কলস বাজে বেশি’। অর্থাৎ যদিও তাদেরকে সংখ্যায় অনেক মনে হয় কিন্তু আসলে মোটেও তা নয়।
পাশ্চাত্যের কয়টি মসজিদ সমকামী বিয়ের অনুমোদন দিচ্ছে? কিংবা এর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে? হাতেগোনা দুয়েকটা বাদে এরকম মসজিদ নেই বললেই চলে। তাদেরকে বাধা দেয়ার মতো কোনো আইন এখানে নেই। তাদের জীবনের উপর কোনো ধরনের হুমকিও বাস্তবে নেই। আজকে তারা যদি রাস্তার পাশে একটি মসজিদ খুলে বসে তাহলে সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার। আমি মনে করি, তাদের উপর শারীরিক আক্রমণ চালানো আমাদের জন্য হারাম। এই দেশে তারা কী করবে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতকিছুর পরেও তাদের অবস্থান কোথায়? আপনি তাদেরকে তেমন একটা খুঁজে পাবেন না। তাই, আমি বিশ্বাস করি, প্রগতিবাদীরা সবসময় একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসেবেই থাকবে।
সাধারণ মুসলমানরা মনে করে, মুসলমান থাকতে চাইলে মদ খাওয়া যাবে না, আর খেলে নিজেকে ভালো মুসলমান দাবি করা যাবে না। আপনি মাদক গ্রহণ করবেন আবার বলবেন, ‘ইসলামই আমাকে এটা করতে বলেছে’, সেটা হতে পারে না। আর মাদক গ্রহণ করার পর যদি স্বীকার করেন, ‘হ্যা, আমি খারাপ মুসলমান’, তাহলে আপনি কিছুটা হলেও ইসলামের গণ্ডির মধ্যে থাকেন। দুনিয়াতে কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আপনি কোনোক্রমেই অকাট্য হারাম বিষয়কে হালাল দাবি করতে পারেন না। প্রগতিবাদীরা ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছে। আল্লাহর শুকরিয়া যে, তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
এখন প্রশ্ন হলো তাদের সাথে আপনি কেমন আচরণ করবেন? আমি সত্যি মনে করি, তাদের মানসিক সমস্যা রয়েছে। তারা হীনমন্যতায় ভোগে। ফলে তারা নির্দ্বিধায় ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভের উপর আস্থা রাখে। এ ক্ষেত্রে আমার যে বক্তব্য রয়েছে তা ভুলও হতে পারে। তবে তারা মূলত যা বিশ্বাস করে তা খারিজ করার চেয়ে ডমিন্যান্ট প্যারাডাইমের বিচার-বিশ্লেষণ করাই (deconstruction) আমার মূল উদ্দেশ্য। যাইহোক, আমার বক্তব্যটি হলো– মানবতাবাদ নিয়ে পড়তে গেলে আপনি দেখবেন সেখানে এনলাইটেনমেন্ট, পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা নিয়ে কথাবার্তা রয়েছে। উত্তরাধুনিকতার মূল কথা হচ্ছে, মানুষের বিবেচনাবোধকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে কোনো নৈতিক মানদণ্ড নেই। অথচ আমাদের কাছে নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে কোরআন ও হাদীস রয়েছে। আমরা যদি এগুলোকে অনুসরণ না করি তাহলে সত্যিকার অর্থে আর কোনো নৈতিক মানদণ্ড অবশিষ্ট থাকে না।
তাই আমরা দেখি, পঞ্চাশ বছর আগে যে বিষয়গুলোকে মন্দ বলে বিবেচনা করা হতো, এই যুগে এসে সেগুলোকে বৈধ মনে করা হচ্ছে। আমাদের জীবদ্দশায়ই আমরা এসব দেখছি। অথচ আশির দশকে আমরা যখন কিশোর ছিলাম, তখন এ ধরনের কিছু কিছু বিষয়কে নিষিদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। আর এখন আপনি এই বিষয়গুলোর বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলেও আপনাকে পশ্চাৎপদ মনে করা হবে।
অতএব, নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই যে কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। আমরা যদি সাহসিকতার সাথে এমন কিছুর উপর অটল থাকি, যা অপরিবর্তনীয়; তাহলে আমাদের সামনে আর কোনো বাধা থাকবে না। আমাদের জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যাবে। আর এই অপরিবর্তনীয় বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহর বাণী। তাই আমি মনে করি, এসব ভাইবোনদের সাথে কথা বলার সময় নিছক যুক্তিখণ্ডন কিংবা ‘আল্লাহ এই বলেছেন, সেই বলেছেন’ এগুলো না বলাই উত্তম। কারণ, তাদের অন্তরে যথেষ্ট ঈমান নেই।
তাদেরকে দুইভাবে মোকাবেলা করা যায়। প্রথম উপায়টি হলো – আধুনিক চিন্তা এবং দর্শনের বিশ্লেষণ করা। অবশ্য এই কাজটা ইতোমধ্যেই এক প্রকারে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আধুনিক জ্ঞানজগতের অসংখ্য চিন্তাবিদ উত্তরাধুনিকতাবাদ কিংবা উত্তর-কাঠামোবাদ নিয়ে কাজ করেছেন। উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে জানতে গুগল সার্চ করতে পারেন, অন্তত এ সংক্রান্ত উইকিপিডিয়ার পাতাটি পড়ুন। এভাবে কিছু ঘাটাঘাটি করলে আপনি এ ব্যাপারে খানিকটা ধারণা পাবেন। আপনি যদি সত্যিই এগুলো বুঝতে পারেন, তাহলে তাদেরকে মোকাবেলা করার একটা পথ পেয়ে যাবেন। দ্বিতীয় উপায়টি হলো – কোরআনের বাণী, আধ্যাত্মিকতা ও এ ধরনের আন্তরিকতাপূর্ণ নানা উপায়ে তাদের অন্তরে ঈমানের আলো প্রজ্জ্বলনে সহায়তা করা।
মোটকথা হলো, এটা একধরনের দ্বৈত প্রক্রিয়া। এর একদিকে ডমিন্যান্ট ন্যারাটিভগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। তারপর অন্যদিকে, তারা যেন সত্যিকার অর্থে আল্লাহর প্রতি অনুগত হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে, সে ব্যাপারে সহায়তা করা।
দেখুন, ইসলাম হচ্ছে একটা সামগ্রিক ব্যাপার। আপনি যদি আল্লাহ ও কোরআনের উপর বিশ্বাস রাখেন, তাহলে আল্লাহর নাজিলকৃত গ্রন্থের আইন অনুযায়ী জীবনযাপন করাটাই হবে আপনার জন্যে সবচেয়ে যৌক্তিক কাজ। এমনকি আপনি যদি প্রতিটি আইন নাও বুঝে থাকেন। যেহেতু আপনি বিশ্বাস করেন, এই আইন আল্লাহরই আইন তাই আপনাকে এর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে।
এ বিষয়টি নিয়ে আমি আগেও কথা বলেছি। আপনারা চাইলে কয়েক বছর আগে অনুষ্ঠিত আমার ‘দোহা ডিবেট’ দেখতে পারেন। সেখানে একজন নারী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘দুইজন নারীর পরস্পরকে বিয়ে করার বিধান ইসলামে থাকা উচিত। এখানে সমস্যাটা কোথায়? এটাকে অন্যায় বলার আপনি কে?’ তারপর আমরা সেই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করেছি। এখান থেকে আপনারা বর্তমানকালের প্রগতিবাদী মুসলমানদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। যাইহোক, এ বিষয়ে আমার বেশ কিছু আলোচনা এবং আর্টিকেল রয়েছে।
শেষ কথা হলো, প্রগতিবাদীদেরকে আমি বড় কোনো হুমকি মনে করি না। আমি সবসময় বলার চেষ্টা করেছি, এদের দলে হাজার হাজার মুসলিম তরুণ কখনোই যোগ দেবে না। দিলেও বড়জোর এক শতাংশ। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
প্রশ্ন-২: আমাদের কমিউনিটির রাজনৈতিক ও আইনী স্বার্থ রক্ষার জন্য রক্ষণশীল আলেমদের দেয়া যুক্তিসম্মত মতামতগুলোকে সেলফ-সেন্সরশীপের মাধ্যমে আমরা কি নিজেদেরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি?
উত্তর: আমরা সেলফ-সেন্সরশীপ করছি বলে আমি মনে করি না। বরং এর উল্টোটাই হচ্ছে বাস্তবতা। আমি মনে করি, অধিকাংশ মানুষই অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে থাকে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা প্রায়শ কোনো ন্যারাটিভের মূলকথাই ধরতে পারি না। আমরা কোনো সমস্যার গভীরে না গিয়েই তা থেকে উত্তরণ পেতে চাই।
এই মুহূর্তে এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে সমকামী সম্পর্ক নিয়ে আমাদের মনোভাব। আমার বিনীত অভিমত হলো, এ ব্যাপারে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে না পারায় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। এ কথা থেকে আবার সমকামিতা নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করবেন না যেন। তবে আমি আমার মতামতকে ভদ্রোচিত ভাষায় ব্যক্ত করতে চাই। কোনোভাবেই অগ্রহণযোগ্য ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়। কোন বিষয়টি নৈতিকতার আওতাভুক্ত আর কোনটি আওতাবহির্ভূত, এককথায় নৈতিকতা প্রসঙ্গে আমাদের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আমাদের মসজিদে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যত্যয় ঘটাবো না। আমাদের বিয়েতেও আমরা সমকামিতাকে অনুমোদন করবো না। কিন্তু একইসাথে আমরা মসজিদের বাইরে এসব ইস্যুতে জড়িত হবো না।
ধরুন, দুইজন ব্যক্তি নিয়মিত পানশালায় যায়। আমরা কি পানশালায় যাওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনের কথা তাদেরকে শোনাই? না। একইভাবে তারা যদি অন্য এমন কিছু করে, যা অনৈতিক বলে আমরা মনে করি; সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষতি করা বা দুর্ব্যবহার করা উচিত হবে না। তারা যা করছে, তা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই আর কি।
আমি একে সেলফ-সেন্সরশীপ হিসেবে দেখি না। বরং বিচক্ষণতা হিসেবেই দেখি। আপনি যা বিশ্বাস করেন, তা কীভাবে উপস্থাপন করবেন? অবশ্যই শালীনভাবে। তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। মূর্তিপূজা নিয়ে কোরআনে আল্লাহ কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ‘তারা যে মূর্তির পূজা করে, সেগুলোকে গালমন্দ করো না।’ তারমানে কি আমরা সেগুলোকে সম্মান করি? আমরা সেগুলোর ওপর বিশ্বাস রাখি? না। কিন্তু আল্লাহ কী বলেছেন? তিনি বলেছেন,
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ
তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাসনা করে। (সূরা আনআম: ১০৮)
কেন? আপনি তাদের কাছ থেকে কী অর্জন করতে চাচ্ছেন? আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা যেন আপনার কথাগুলো বিবেচনা করে এবং তাদের কাজকর্মে এর প্রতিফলন ঘটায়। দেখুন, মুসাকে (আ) আল্লাহ তায়ালা উপদেশ দিয়েছিলেন এভাবে,
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ
অতঃপর, তোমরা দুজনে তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে। সম্ভবত সে উপদেশ গ্রহণ করবে। (সূরা ত্বহা: ৪৪)
অর্থাৎ, এই বিনম্র কথাগুলো হয়তো তাকে নাড়া দিয়ে যাবে, যা তাকে ভালো চিন্তা করতে সহায়তা করবে।
যাইহোক, বর্তমানে মূর্তিপূজা কোনো ইস্যু নয়। আমি মূর্তিপূজা নিয়ে কথা বললেও আপনাদের বৃটিশ সরকার এতে গা করবে না। কিন্তু আমি যদি সমকামিতা নিয়ে কঠোর ভাষায় কিছু বলি, তাহলে এই দেশে এটাই আমার শেষ সফর হতে পারে। এটা একেবারেই ভিন্ন একটা ব্যাপার। তাই আমি যদি এ বিষয়টা একটু ভিন্নভাবে বলি, তাহলে তারা আশ্বস্ত থাকে। তাই না?
গার্ডিয়ান পত্রিকাসহ অনেকেই আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা আমার কাছে জানতে চায়, ‘অমুক ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?’ আমি বলেছি, ‘দেখুন, ইসলামে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক অনুমোদিত নয়।’ এ কথার সাথে তারাও একমত। ‘যেহেতু বিবাহ-বহির্ভূত যে কোনো সম্পর্ক অনৈতিক, তাই বিবাহ-পূর্ব সম্পর্ক বা সমকামী সম্পর্কও আমাদের জন্য অনৈতিক। কিন্তু কেউ যদি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাহলে আমরা তার কোনো ক্ষতি করি না। আমরা কোনো কিছুই চাপিয়ে দেই না। কোনো সমকামী মুসলমান আমাদের কমিউনিটিতে এলে আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা তার ওপর হামলা করি না। মূলধারার অনেক খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের অবস্থানও এ রকম। তাদের ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?’ আমি বলতে চেয়েছি, মুসলমানরা তাদের ব্যাপারে কোনো বিদ্বেষ পোষণ করে না। মুসলমানদের সরল বক্তব্য হচ্ছে, ‘মদ্যপানকে আমরা যে কারণে সমর্থন করি না, একই কারণে সমকামিতাকেও সমর্থন করি না।’
আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আইনগত ও জ্ঞানগত উভয় ব্যাপারেই আমাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আরো বেশি প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহ আমাদের জন্য যে সুন্দর ধর্ম মনোনীত করেছেন, তার দাবি হচ্ছে মানানসই ভাষায় কথা বলা। মহানবীর (সা) সীরাত অধ্যয়ন করে আমি দেখেছি, এটাই ছিল তাঁর সুন্নাহ। তিনি তাঁর বিশ্বাসে অটল ছিলেন এবং এ ব্যাপারে আপস করেননি। কিন্তু এসব ব্যাপারে তিনি সুন্দর ভাষা ও পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে অপমান বা হেয় করা উচিত নয়।
তাই সেলফ-সেন্সরশীপ নয়, বরং এর উল্টোটাই সত্য বলে আমি মনে করি। এ ধরনের বিষয়ে এখুনি আমাদের উন্মুক্ত আলাপ-আলোচনা শুরু করা উচিত। যাতে করে আমাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সুন্নাহর ভাষায় কথা বলার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
প্রশ্ন-৩: এই প্রশ্নটা নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে। এ ব্যাপারে রক্ষণশীলদের পরামর্শ যথেষ্ট সতর্কতামূলক। এক দৃষ্টিতে তা অবাস্তবও বটে। শরীয়াহর দিক থেকে এ ব্যাপারে আমাদের অবকাশ ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা দরকার। আপনি কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে কীভাবে দেখেন? যেমন, নারীদের সাথে হ্যান্ডশেক করা ও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা একটা পেশাগত সৌজন্যতা। কিন্তু শরীয়াহর দিক থেকে এর বিপরীত ধারণাই আমরা পাই। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে আপনি কীভাবে সমন্বয় করবেন?
উত্তর: বর্তমানে এই বিষয়টি যে কর্মক্ষেত্রের অন্যতম একটি সমস্যা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কর্মজগতে গিয়ে ঠিক কী ধরনের আচরণ করতে হবে – আমরা যারা এখনো কর্মক্ষেত্রে পা ফেলিনি তারা তা ভাবতেও পারি না। কোনো বিষয়ে কট্টর হওয়া খুব সহজ। কিন্তু যখন আপনি কর্পোরেট জগতে পা ফেলবেন, পেশাগত নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন, এর ডাইনামিকস বুঝবেন; তখন কিছুটা হলেও আপনার মনোভাব পরিবর্তিত হবে।
বাস্তবতা হলো, এই সমস্যাটির মতো আরো জটিল বিষয় আমাদের সামনে রয়েছে। এর ফলে ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে আমাদের অনেকে ইসলামকে এমন কঠোর বানিয়ে ফেলে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) করেননি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে যে কোনো ধরনের যোগাযোগই যেন হারাম!
যদিও ক্লাসরুম বা কোনো সভায় বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। এখানেই আপনারা নিজেদের প্রতি খেয়াল করে দেখুন, আপনারা একেকজন বিপরীত লিঙ্গের কত কাছাকাছি বসে আছেন! তাই না? … আপনারা এখানে আক্ষরিক অর্থেই সার্ডিন মাছের মতো জটলা বেঁধে আছেন। তবে আপনার পাশে – নারী বা পুরুষ – কে বসবেন, তা আপনি ঠিক করেননি। তাই না? কোনো বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকলে একজন ভাই ও বোন পাশাপাশি বসতে পারেন। তবে ওই রকম কোনো সম্পর্ক থাকলে, সেটা একটা সমস্যা বটে।
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে একটি সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছাতে পারি? এটা একটা চলমান বিতর্ক, যার সমাধান আমার কাছে নেই। তবে আমরা দেখি, এ ব্যাপারটা নিয়ে দুটি প্রান্তিক অবস্থান তৈরি হয়েছে। একদিকে, আমাদের অনেক ইসলামিক সেন্টার এবং মসজিদ নারী-পুরুষের পৃথকীকরণের ব্যাপারে এতোই কঠোর, যা সাহাবী ও প্রথম যুগের মুসলমানরা কল্পনাও করতে পারতেন না। এই কঠোরতা স্বয়ং মহানবী (সা) ও সাহাবীদের চেয়েও বেশি। আশ্চয! শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসহ সম্ভাব্য সকল উপায়ে এই কঠোরতা আরোপ করা হয়। আমি এ ধরনের কঠোরতার বিরোধী। এই বিচ্ছিন্নতা একেবারেই অবাস্তব। এটি শুধু ইসলামী শিক্ষা সমাবেশেই বজায় থাকে। এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া মাত্রই এর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। তাহলে এই কৃত্রিম বুদ্বুদ তৈরি করার মানে কী?
আমি আবারো পরিষ্কারভাবে কিছু কথা বলতে চাই। নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রসঙ্গটাই আমাদের জন্য একটা বিব্রতকর বড় সমস্যা। কারণ, পাপাচারের আশংকায় আমরা ইসলামী সার্কেলে সম্পূর্ণভাবে পৃথক থাকি। ফলে আমরা বিপরীত লিঙ্গের মুসলিম কারো সাথে ভদ্রতা ও শ্রদ্ধার সাথে কথা বলতে শিখি না।
অথচ বিপরীত লিঙ্গের অমুসলিম কারো সাথে কীভাবে কাজ করতে হয়, তা আমরা ঠিকই জানি। বিপরীত লিঙ্গের অমুসলিম কেউ এসে আপনাকে যখন বলে, ‘হ্যালো, শুভ বিকাল। দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’ তখন আপনার কী বলা উচিত তা আপনি ঠিকই জানেন। কোনো ধরনের চটুলতা ছাড়াই ভদ্রোচিত ও সম্মানজনকভাবে জবাবও দেন। ঠিক কিনা? অথচ কোনো ইসলামী সম্মেলন বা অন্য কোথাও একজন হিজাবী বোন কোনো দাড়িওয়ালা মুসলিম ভাইকে সালাম দিলেও তিনি সাথে সাথে ভাবতে শুরু করেন, ‘সে কি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে? সে কি বিবাহিত?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এটা অবশ্যই একটা সমস্যা। যৌনতার চিন্তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে আপনি অন্যের সাথে উঠাবসা করতে পারছেন না। কেন? কারণ, আমরাই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছি। পুরুষ ও মহিলা সাহাবীগণ এ রকম ছিলেন বলে কি সত্যিই আপনার মনে হয়? তাঁদের জীবনী পড়লে আপনার কাছে ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাঁরা সম্মানের সাথে একে অপরকে সালাম দিতেন। তারা তাদের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অথচ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আমরা এগুলো শেখাই না। আমার মতে, যুগ যুগ ধরে চলমান ইসলামের অতি রক্ষণশীল চর্চা এক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। শরীয়াহ যতটুকু চায়, আমরা তারচেয়েও বেশি কঠোর। এর ফলাফল স্বভাবতই নেতিবাচক হয়েছে।
আমরা যথাযথ আচরণ করতে জানি না। আমাদের ভাইয়েরা বোনদের সাথে সম্মানজনকভাবে আচরণ করতে জানে না। অথচ এটা তাদের প্রাপ্য। পাশাপাশি হাঁটতে থাকলেও তারা বোনদেরকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলে, যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। আপনার কোনো অমুসলিম সহকর্মী বা শিক্ষিকাকে যদি আপনি ‘শুভ সকাল’, ‘শুভ বিকেল’ বলে সম্ভাষণ জানাতে পারেন, কিংবা কোনো ক্যাশিয়ার বা বাস ড্রাইভারকে যদি আপনি ‘হ্যালো’ বলতে পারেন; তাহলে আপনার মুসলিম বোন কি এরচেয়েও বেশি সম্মানের উপযুক্ত নন? আপনি কি কোনো প্রকার কুচিন্তা ছাড়া তাকে সালামও দিতে পারেন না? যদিও তিনি আপনার পরিচিত। কোনো প্রয়োজন বা বিপদে কিংবা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে তিনি আপনাকে কাছে পেয়ে সাহায্য চাইতে পারেন। কিন্তু না…! তাকে এমনভাবে উপেক্ষা করার জন্য আমাদেরকে শেখানো হয়, যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। নারী-পুরুষ উভয় তরফ থেকেই এটা ঘটছে। সত্যিই এটা একটা সমস্যা।
আমরা যেভাবে নারী-পুরুষকে সম্পূর্ণ দুই গোলকের বাসিন্দা বানিয়ে রেখেছি, সীরাত অধ্যয়ন করলে এ ধরনের গোঁড়ামির কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। এটা মাদানী যুগের কথা। এবার ইংল্যান্ডের কথা চিন্তা করুন, যেখানে নারী-পুরুষের কোনো বিভাজন নেই। এখানে আমরা যদি একটা কৃত্রিম বিভাজন তৈরি করি, তাহলে কী ঘটবে?
আমার এ কথা থেকে কেউ আবার এমনটা মনে করবেন না যে, আমি বুঝি বলতে চাচ্ছি – ‘মাশাআল্লাহ, তাবারাকাল্লাহ, চলুন নারী-পুরুষের সম্মিলিত একটা পার্টি হয়ে যাক!’ আমি মোটেও তেমন কিছু বুঝাচ্ছি না। কেউ যখন আমার মতো এ ধরনের কথাবার্তা বলতে শুরু করে, রক্ষণশীলরা তখন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা বলে ফেলে, ‘এসব কথাবার্তা বলে আপনি আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ এটা আরেকটা সমস্যা। আমি তাদের এই ভীতির কারণটা বুঝি। যুক্তিবিদ্যার ভাষায় একে ‘ফ্লাডগেট আর্গুমেন্ট’ বলা হয়। আমি যদি দরজাটা এক ইঞ্চি পরিমাণও খুলি, তাহলে ধরে নেয়া হয় অবশেষে আমি দরজাটা পুরোপুরিই খুলে দিতে যাচ্ছি – এটাই হলো ‘ফ্লাডগেট আর্গুমেন্ট’। কারো বক্তব্যকে খণ্ডন করার জন্যে এটা খুবই হালকা ও স্থূল পদ্ধতি।
আমি সীমাতিক্রম করতে বলছি না। তাহলে সীমারেখাটা কী? স্পষ্টতই হারাম সম্পর্ক হচ্ছে সেই সীমা। কিন্তু নারী-পুরুষ সম্পর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে কীভাবে একে অপরকে শ্রদ্ধা করতে হয়, তা যদি উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের না শেখাই; তাহলে আমরা কীভাবে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলবো?
আমাদেরকে একে অপরের নাম পর্যন্ত জানতে দেয়া হয় না। আমাদেরকে বলা হয়, ‘তার নাম বলা হারাম। সে শুধুই একজন অপরিচিত বোন।’ এভাবে কারো নাম পর্যন্ত নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত হয়। অথচ সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, জয়নব (রা) দরজায় কড়া নাড়ছিলেন। আয়েশা (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা), জয়নব দরজায় কড়া নাড়ছে।’ তিনি জয়নবের নাম উল্লেখ করেছিলেন। তিনি কিন্তু বলেননি, ‘একজন বোন এসেছে।’ নবী (সা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন জয়নব? আমি তো অনেক জয়নবকেই চিনি। তুমি কোন জয়নবের কথা বলছো?’ তখন আয়েশা (রা) বুঝিয়ে বললেন যে, তিনি কোন জয়নবের কথা বলছেন।
আমার কথা হলো, ইসলাম আমাদেরকে যতটা না কঠোর হতে বলে, আমরা তারচেয়েও বেশি কঠোর হয়ে যাচ্ছি। এর ফলে আমরা প্রতিক্রিয়াশীল (backlash) জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এটা সত্যিই আমাদের অন্যতম একটা বড় সমস্যা।
এই তো গেলো একদিকের কথা। আবার অন্যদিকে আরেকটি পক্ষ রয়েছে, যারা এসব বিষয়কে মোটেও পাত্তা দেয় না। আসলে, আপনি যদি সবসময় প্রতিটি ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখান, তাহলে কেউ না কেউ এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাবেই। আর এ কারণে ইসলামের প্রায়োগিক ও বাস্তবসম্মত বোঝাপড়াই হলো এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়। আমি এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
তাই, নারী-পুরুষের পারস্পরিক যোগাযোগ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কর্মক্ষেত্রে সবসময় অবনত মস্তকে তাকিয়ে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তো আল্লাহ কোরআনে কী বলেছেন?
اتَّقُوا اللَّـهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
আল্লাহকে ভয় করো, যতটুকু তোমাদের পক্ষে সম্ভব। (সূরা তাগাবুন: ১৬)
সুতরাং, কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনে নারীর দিকে তাকাতে পারেন। কিন্তু তার দেহকে সৌন্দর্যের বস্তু মনে করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকবেন না। তার সাথে সম্মানজনক আচরণ করুন। একজন অমুসলিম মহিলার সাথে কীভাবে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে হয়, তা আমরা সবাই জানি। তাদের সাথে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করুন। কেউ যদি খোলামেলা পোশাক পরে, যার ফলে আপনার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে, তাহলে তার দেহের সংশ্লিষ্ট দিকে তাকাবেন না। আপনার দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করুন। এটা খুবই কঠিন। দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে রাখলেও সে যেন উপলব্ধি করে, আপনি তাকে মানবিক মর্যাদার দৃষ্টিতেই দেখছেন।
আমি এক বয়োজ্যেষ্ঠ বোনকে জানি, যিনি ৩৫ বছর আগে মুসলিম হয়েছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণ করার পেছনে একটি ঘটনা রয়েছে। একবার এক মুসলিম দেশ থেকে আগত এক যুবকের সাথে তার দেখা হয়। বোনটির বাড়ি ইংল্যান্ডে নয়, অন্য কোনো দেশে। যাইহোক, তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন। তার পরনে ছিল খোলামেলা পোশাক। তারপরও যুবকটি তার সাথে সম্মানজনক আচরণ করছিল। কোনো প্রকার কুরুচিপূর্ণ ও চটুল কথাবার্তা বলছিল না। এতে মহিলা খুবই অবাক হয়ে ভাবছিলেন, ‘আমি কত সুন্দরী! সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, নানা ধরনের মন্তব্য করে। তাহলে এই যুবক আমার সাথে এ রকম সম্মানজনক আচরণ করছে কেন!’ এক পর্যায়ে তিনি যুবককে প্রশ্নটি করেই ফেললেন। যুবক জবাব দিলেন, ‘আমি মুসলমান। কোনো নারীর দিকে অপলক ও লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থাকতে আমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।’ জবাব শুনে তিনি খুবই অভিভূত হলেন। তারপর ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিলেন এবং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলেন। বর্তমানে তিনি খুবই সক্রিয়।
আমার কথা হলো, ‘নারীদের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থেকো না’ আল্লাহর এই বাণীর তাৎপর্য আপনাকে বুঝতে হবে। তাই আপনি কামনা ও প্রেমভাব নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। কিন্তু আমরা যে রকম করপোরেট পরিবেশে কাজ করছি সেখানে আপনি যদি কামনা ও প্রেমভাব না নিয়ে নারীদের দিকে তাকান, বিনা প্রয়োজনে না তাকান, শুধু প্রয়োজনীয় কথাবার্তাই বলেন এবং সম্মানজনক আচরণ করেন; তাহলে আমি কোনো সমস্যা দেখি না।
এ ব্যাপারে শরীয়াহতেও আমরা দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। আয়েশার (রা) ঘটনা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। একদা তিনি মসজিদে বর্শা খেলা দেখছিলেন। তিনি পুরুষদের দিকে তাকিয়ে থাকায় মহানবী (সা) কিছু মনে করেননি। কারণ, তিনি জানতেন আয়েশা (রা) সে ধরনের কোনো অনুভূতি নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন না।
অতএব, ‘আল্লাহকে ভয় করুন, যতটুকু সম্ভব।’ মূল ব্যাপার হচ্ছে, আপনি আদবকায়দা ও শিষ্টাচার মেনে চলছেন কি না।
আর বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে হ্যান্ডশেক করাকে আমি নিরুৎসাহিতই করবো। একে উৎসাহিত করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। হ্যান্ডশেক করাকে কমপক্ষে মাকরুহ বলা যায়। তাই একে নিরুৎসাহিত করা উচিত। এই রাস্তা খুলে দেয়া উচিত হবে না। আমি কিন্তু একে হালাল বলছি না। দয়া করে ভুল বুঝবেন না।
তবে শয়তানের প্ররোচনায় কখনো এই কাজটি করে ফেললে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু সদকা করে দিন। এ জন্য নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ লোক ভাবার দরকার নেই। এর ফলে আপনি একেবারে ধ্বংস হয়ে যাননি। এরচেয়ে অনেক বড় বড় পাপও আছে। আমরা সকলেই পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। একটি পাপ যেন অন্যান্য ভালো কাজ থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে না নেয়, সেই চেষ্টা করুন।
শেষ কথা হলো, এই দেশে আপনাকে হয়তো এমন অনেক কিছুই করতে হচ্ছে যা আপনার অপছন্দনীয়। আল্লাহ ঠিকই তা জানেন। অবশ্য, এই দেশে এমন কিছু ভালো কাজও আপনি করতে পারছেন, যা হয়তো অন্য কোনো দেশে করতে পারতেন না। তাই, এখানকার ভালো-মন্দ উভয় দিকই বিবেচনায় রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য কঠিন সমস্যাগুলো সহজ করে দিন।
প্রশ্ন-৪: আপনি বলেছেন, সংস্কারের জন্য যোগ্য আলেমের সন্ধান পাওয়া জরুরি। এই দেশে যোগ্য আলেমের অভাব থাকায় আমাদের মতো সাধারণ মুসলমানরা কী করতে পারি? এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা কি অন্য দেশ থেকে ভালো মানের আলেম নিয়ে আসবো?
দ্বিতীয়ত, সাধারণত আলেমগণ ও মাদ্রাসাসমূহ গতানুগতিক ধ্যানধারণা পোষণ করেন। বলাবাহুল্য, প্রচলিত ধ্যানধারণা যে কোনো পরিবর্তনের বিরোধী। এমতাবস্থায়, ইসলামিক রিফর্মের জন্য আমরা যোগ্য নেতৃত্ব কীভাবে পেতে পারি?
উত্তর: দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন, রক্ষণশীল ধারার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। আমার বক্তব্যে স্পষ্টভাবেই বলেছি, তারা যা করছেন সে সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তাই তাদেরকে অসম্মান করা কারোরই উচিত হবে না। ইসলামকে এ পর্যন্ত নিয়ে আসার পেছনে তাদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমাদেরকে আরো সামনে এগুতে হবে। ইসলামের যে কোনো প্রকার সংস্কার প্রচেষ্টা রক্ষণশীল ধারার ভেতর থেকেই উঠে আসা প্রয়োজন। কারণ, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেমন, আমি নিজেই এর একটা উদাহরণ। স্পষ্টতই আমি একসময় এই ধারার একজন ছিলাম। আমার পুরাতন ভিডিওগুলোতে দেখবেন, আমি একসময় ‘সাওব’ ও টুপি পরতাম। আর এখন অবশ্য সবকিছু বদলে গেছে।
যাইহোক, আমরা আশা করি কিছু রক্ষণশীল আলেম এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসবেন। তবে কেউ আসতে না চাইলেও সমস্যা নেই। তাদের জন্য সেটাই ভালো। তাদেরকে বলয়ের বাইরে টেনে আনার চেষ্টা করা উচিত হবে না।
এবার মূল কথায় আসা যাক। আমরা সাধারণত সমালোচনা করে থাকি, অনেক আলেমের চিন্তাভাবনা সেকেলে, বাস্তবতার সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। এসব সমালোচনার কিছুটা ভিত্তি আছে বৈকি। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই, আমাদের অধিকাংশ আলেমদের এই অবস্থার পেছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনার মনে হয়? এর কারণ হলো, আমাদের মেধাবী, শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের অধিকাংশই আলেম হতে আগ্রহী নয়। আমাদের যে সকল সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন, তাদের কয়জন দারুল উলুম, আল আজহার কিংবা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছেন? মাশাআল্লাহ, আমরা প্রায় সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, গণিত পড়তে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাচ্ছি।
অথচ একটা সময় ছিল, যখন আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সবচেয়ে সেরা ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা ইসলামী জ্ঞান অর্জন করতে যেতো। আর বর্তমানের বাস্তবতা হলো কিছু মুসলিম দেশের সরকার ঠিক করে দিচ্ছে কে কোন বিষয়ে পড়বে। পরীক্ষায় কেউ যদি ৯০ শতাংশ নম্বর পায় তাহলে সে মেডিকেল কলেজে পড়তে পারে। এভাবে ৮০ শতাংশ পেলে ইঞ্জিনিয়ারিং, আর ৭০ শতাংশ পেলে অ্যাকাউন্টিং পড়তে পারে। আর যদি ফেল করে তাহলে তার জন্য উপযুক্ত জায়গা হলো দ্বীনি শিক্ষা! এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। আমি বানিয়ে বলছি না। আমি সেই দেশগুলোর নাম জানি, কিন্তু বলতে চাচ্ছি না। যদিও অনেক মুসলিম দেশে আইন করে এটা করা হচ্ছে না, তবে সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা অনেকটা এ রকমই নির্ধারিত। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ – এসব দেশে মেধাবীরা নয়, বরং মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শীরাই আলেম হওয়ার জন্য পড়তে যায়। আমি কী বলছি, আপনারা কি তা বুঝতে পারছেন? নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষে মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য কোথায় যায়? আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া।
সুতরাং, যে মানুষগুলো আধুনিকতার সাথে সবচেয়ে কম পরিচিত তারাই আলেম হয়। ফলে তাদের চিন্তাভাবনা বাস্তবতা থেকে বেশ দূরেই থেকে যায়। আলেমদের এই পরিস্থিতিতে যারা অবাক হয়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ত্রুটিপূর্ণ। আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাই বলে ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়ে আলেম হওয়ার জন্য আপনাকে জোর করছি না। আমি বলছি, চলুন আমরা অন্তত আলোচনাটা শুরু করি।
আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তিন-চারটি সন্তান দান করে থাকলে তাদের মধ্য থেকে অন্তত একজনকে আলেম হওয়ার জন্য উৎসাহিত করুন। আমাদের নিজেদের সামাজিক অবস্থানের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে আলেমদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। এ জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মানুষজনের আলেম হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যদি মনে করেন, নির্দিষ্ট এক শ্রেণীর মানুষই কেবল আলেম হবে, তাহলে তাদের কাছ থেকে কীভাবে আপনি উচ্চমান প্রত্যাশা করেন?
এটা একটা জটিল সমস্যা। আমি এ ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন। কিন্ত তাদেরকে দোষারোপ বা নিন্দা করে এর সমাধান করা যাবে না। বরং আমাদের প্রত্যেকে এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারলেই এর সমাধান হবে। আমি সবসময় বলি, ‘আপনি আলেম হতে না পারলেও অন্তত অজ্ঞ থাকবেন না।’ কিছু না কিছু শিখতে থাকুন। বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করুন, লেকচার শুনুন। এতে করে আপনি হয়তো আলেম হয়ে যাবেন না, কিন্তু চলতি ইস্যুগুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবগত থাকতে পারবেন। ইতিহাসের কিছু বেসিক কোর্স করে ইতিহাসবিদ হতে না পারলেও দুনিয়ার চলমান ঘটনা সম্পর্কে মূল্যায়ন করা যায়। একইভাবে ইসলাম নিয়ে কিছু পড়াশোনা করলে আপনি হয়তো আলেম হতে পারবেন না, তবে সত্যিকারের আলেমদের চিনতে পারবেন, ইসলামের অন্যান্য ধারা চিনতে পারবেন।
আসলে এটি এমন একটি সমস্যা, যার সহজ কোনো সমাধান আমার জানা নেই। আমার এভাবে কথা বলার এটা একটা কারণ। আমার ব্যাপারে একটা সমালোচনা রয়েছে, ‘কোনো বিষয় নিয়ে এভাবে কথা বলে আপনি মানুষকে শুধু শুধু বিভ্রান্ত করেন।’ এর জবাবে আমি বলি, এভাবে কথা বলাই একমাত্র উপায়। আল্লাহ চাহে তো এর মাধ্যমেই আমাদের আলোচনা এগিয়ে যাবে। এ ধরনের আলোচনার মাধ্যমেই আপনার মধ্যে সন্তানকে আলেম বানানোর প্রকৃত আগ্রহ তৈরি হবে, যারা বাস্তবতাকে বুঝবে। এভাবে আপনি বিদ্যমান প্যারাডাইমের পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন।
সে তো বেশ দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। আপনি জানতে চাইতে পারেন, ‘এই মুহূর্তে আমার করণীয় কী?’
প্রথমত, আমার মনে হয়, আপনি ব্রিটিশ আলেমদের পাণ্ডিত্যকে স্বীকার করতে চাচ্ছেন না। ব্রিটেনে কোনো আলেম নেই – এ ধরনের কথার সাথে আমি একমত নই। তবে আমি কারো নাম বলতে চাই না। কারণ, কারো কারো নাম বাদ পড়ে গেলে লোকজনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হবে। ব্রিটেনে যেসব আলেম রয়েছেন, তারা অনেক যোগ্য বলে আমি মনে করি। তাঁরা আপনাদের সমাজেরই অংশ। তাঁরা ইতোমধ্যে তাঁদের পাণ্ডিত্য, যোগ্যতা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমি সবসময় বলি, জ্ঞানের জন্য আমাদের বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা জরুরি নয়। একটা ফতোয়ার জন্য টিম্বাকটু কিংবা কোনো দূরদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং এমন কারো কাছে যান যিনি আধুনিক চিন্তাচেতনার সাথে পরিচিত, যিনি আপনাদের মাঝেই বাস করেন। এ ধরনের আলেম বুঝতে পারবেন যে, কিছু কিছু ফতোয়া এ দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। আপনারা অনুসন্ধান করলে এ ধরনের আলেম এ দেশেই পাবেন।
তাই আমি আপনাদের এই অভিযোগের ব্যাপারে একমত নই যে, ‘আমাদের কোনো আলেম নেই। এ জন্য আমাদেরকে বাইরে যেতে হবে।’ ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে এই লন্ডনেই সবচেয়ে বেশি আলেম রয়েছেন। আপনারা কি সেটা জানেন? এমনকি মদীনা ও আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের আলেমদের কথা যদি বলেন, তাহলে লন্ডনেই সবচেয়ে বেশি আলেম পাবেন। কারণ, আপনারা সবাইকে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। তাই অনেকেই একে ‘লন্ডনিস্তান’ বলা শুরু করেছেন। আপনাদের এখানেই অনেক আলেম বসবাস করেন। কিন্তু তারা যে আলেম শ্রেণীর মানুষ, সেটা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন। আশপাশে জিজ্ঞেস করুন, তাহলে কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবেন। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে আপনি কী কী করতে পারেন? পালাবদলের ক্ষেত্র ও মাত্রা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করুন। ভাবুন, ‘আমাকে কিছুটা হলেও ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে।’ অজ্ঞ হয়ে থাকবেন না। ফিকাহ, ধর্মতত্ত্ব ও তাফসীর সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করুন। তাহলে আপনি বাস্তবতার সাথে মানিয়ে চলতে পারবেন এবং আপনার পরিবার ও আপনার এলাকার মসজিদে ইসলামের মর্মবাণী (ethos) তুলে ধরতে পারবেন। এভাবেই একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যারা আরো বেশি সচেতন হবে। আমাদের হাতে কোনো জাদুকরী সমাধান নেই। অতএব, ধীরে হলেও পরিবর্তন আসবে।
প্রশ্ন-৫: ইসলামে সেসব ক্ষেত্রে সংস্কার দরকার, তারমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের সংস্কার কি সর্বাধিক জরুরি? আলেমগণ যদি যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত এবং উপযুক্ত হন, তাহলে তারা বর্তমান সময়ের নানাবিধ সমস্যা ও বাধা মোকাবেলায় সক্ষম হবেন।
উত্তর: শিক্ষাক্ষেত্রকেই সংস্কারের একমাত্র জায়গা বলে আমি মনে করি না। অবশ্যই সংস্কারের আরো ক্ষেত্র রয়েছে। ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। একইভাবে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোরও ভালো-মন্দ রয়েছে। আমি দুই ধারার প্রতিষ্ঠানেই পড়াশোনা করেছি। পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠান থেকে আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর ডিগ্রি নিয়েছি, কলা ও মানববিদ্যায় পড়েছি। আবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বছর পড়াশোনা করেছি। সেখান থেকে পিএইচডি করেছি। সবমিলিয়ে আমি টানা ২২ বছর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। বিশ্বাস করুন, এর ফলে আমি নিছক দুইটা ব্যাচেলর, তিনটা মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রিই করেছি, তা নয়। বরং উভয় ব্যবস্থা থেকে আমি ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছি, সেটা এখন বুঝতে পারি। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে পশ্চিমা বিশ্বে একটি প্রশিক্ষণ কলেজ স্থাপন করার যে স্বপ্ন আমি দেখি, তার পেছনে এই উপলব্ধিও একটা কারণ। সেই কলেজে আমরা আলেমদেরকে প্রশিক্ষণ দেবো। যেন তাঁরা অপেক্ষাকৃত অগ্রগামী চিন্তা করতে পারেন। যেন তাঁরা রাজনীতি, মিডিয়া এবং সমাজে আরো গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারেন।
সংস্কার আমাদের জন্য জরুরি বটে। তবে সবার আগে এই দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে আপনাদের প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তাভাবনার সংস্কার হওয়া দরকার। আমি এখানে এক ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলাম। তাকে বললাম, আপনি আলেমদের অবস্থা নিয়ে ভাবছেন – এটা বেশ ভালো। কিন্তু আপনার নিজের খবর কী? ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আপনি নিজে কী করছেন? আপনার নিজের জীবনের ভিশন কী? আপনার মসজিদ, কমিউনিটি, প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কী? ব্যক্তি পর্যায়ে এগুলোই হচ্ছে আপনার জন্য সংস্কারের ক্ষেত্র।
আপনি নিজেও এই দেশ ও সংস্কৃতির অংশ – এই ব্যাপারটা আপনাদেরকে সহজে মেনে নিতে হবে। ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’ – এই মানসিকতা থাকা উচিত নয়। আপনার মনমতো এমন কোনো দেশ নেই, এই দেশ ছেড়ে গিয়ে যেখানে আপনি বসবাস করতে পারবেন। বিশেষ করে, যারা এখানে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, তারা অন্য কোথাও গিয়ে এখানকার মতো স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারবেন না। এই দেশে বসবাস করাটাই অন্যায় নয়। মনের মধ্যে এ ধরনের অপরাধবোধ থাকলে তা ঝেড়ে ফেলুন। এটা ঠিক, এ দেশের বেশিরভাগ বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ রয়েছে। তবে এই নীতিগুলোর পরিবর্তনের জন্য ভেতর থেকে আপনিই সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। জনমত, মিডিয়া বা এ জাতীয় অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বাইরের কারো পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
আর দাওয়াতী কাজ তথা মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার ক্ষেত্রেও এখানে আপনার স্বাধীনতা রয়েছে। তাই শুধু নেতিবাচক বিষয়গুলো দেখা উচিত নয়। এগুলো আমাদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা নয়। অবশ্য মুসলমানদের ব্যাপারে একটা বাস্তবসম্মত অভিযোগ হচ্ছে – তারা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ভালোবাসে এবং অন্যকে দোষারোপ করতে পছন্দ করে। এটা আসলেই একটা সমস্যা। এটা মহানবীর (সা) সুন্নত নয়।
মনে রাখতে হবে, ইলুমিনাতি’রা দুনিয়া চালায় না। পবিত্র কাবা শরীফ যেভাবে মুসলমানদের একত্রিত হওয়ার কেন্দ্র, তাদের সে রকম কোনো গুপ্ত কেন্দ্র নেই, যার অদৃশ্য সুতার টানে সবাই নিয়ন্ত্রিত হয়। আল্লাহই সৃষ্টিজগতের পরিচালক। অন্য কেউ নয়। হ্যা, তারা শক্তিশালী বটে। কিন্তু তারা ব্ল্যাক ম্যাজিক বা এ রকম কোনো কিছুর মাধ্যমে শক্তিশালী হয়নি; অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির মাধ্যমেই হয়েছে। সত্য সবসময়ই ক্ষমতার উপর জয় লাভ করে। মুসা (আ) থেকে শুরু করে ইসলামের সকল নবী-রাসূলের জীবনীর উপর আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাই, সত্য সর্বদা মিথ্যার উপর জয় লাভ করেছে।
তাই আপনি আপনার কাজে মনোযোগ দিন। কোনো অযুহাত দেখাবেন না। এখনো অনেক কিছুই করার বাকি রয়েছে। নিজের জীবনে পরিবর্তন আনার মাধ্যমেই আপনাদের প্রত্যেকের সংস্কার কাজ শুরু করা উচিত। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন – ‘নিজের, পরিবারের এবং কমিউনিটির ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য আমার ভিশন কী?’ এই ভিশনের যে বৈশ্বিক রূপ থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ‘ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে তুমি এককভাবে কী দায়িত্ব পালন করেছো?’ – আল্লাহ আপনাকে এই প্রশ্ন করবেন না। কিন্তু আপনি চাইলেই আপনার মসজিদের জন্য কিছু গঠনমূলক কাজ করতে পারেন। আপনি আপনার পরিবারের সদস্যদেরকে নামাজের জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। ইবাদতমুখী, কর্মনিষ্ঠ ও ইতিবাচক মানসিকতা তৈরির মাধ্যমে তাদেরকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারেন। ঘনিষ্ট বন্ধুমহলের মধ্যে পরিবর্তনের কাজ শুরু করতে পারেন। সবাই যদি তার অমুসলিম প্রতিবেশী ও সহকর্মীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখে, তাহলে কী ব্যাপার ঘটবে – আপনি কি তা ভাবতে পারছেন? নিশ্চয় খুব ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ইসলামের জন্য কাজ করার একমাত্র উপায় হলো আলেম হওয়া – এমনটা মনে করবেন না। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উপায়। কিন্তু সবাই আলেম হয়ে গেলে দুনিয়া চলবে কীভাবে? সাহাবীদের সবাই আলেম ছিলেন না। আবু হুরায়রা (রা) আলেম ছিলেন, কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) ছিলেন না। কোরআন-হাদীসের বিশেষায়িত জ্ঞান তাঁর ছিল না। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা), ওসমান ইবনে আফফানের (রা) ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। ওসমান (রা) আর্থিক সহায়তা করার দিক থেকে এগিয়ে ছিলেন। তখন আমাদের জন্য ওসমানের (রা) মতো সফল ব্যবসায়ীর প্রয়োজন ছিল। তাই আল্লাহ তায়ালা আর্থিকভাবে অনেক কিছু করার সামর্থ্য তাঁকে দিয়েছিলেন।
সুতরাং, আমি মনে করি, আপনাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। নিজের সামর্থ্যকে তুচ্ছ ভাববেন না। আপনার কাজে আপনার বিকল্প কেউ নেই। আপনার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীসহ যারা এখানে উপস্থিত নেই, তাদেরকে আপনিই প্রভাবিত করতে পারবেন। আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আপনার কাজটা অন্য কেউ করে দিবে না। তাই আল্লাহ আপনাকে যে মেধা, দক্ষতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং উদ্যম দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আপনার নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। আপনারা প্রত্যেকেই যদি যার যার দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হয়ে ওঠবে। পরিবার, সহকর্মী ও সর্বোপরি নিজের জন্য একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাওয়াই আপনার কাজ। তাহলেই ইনশাআল্লাহ, শেষ বিচারের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে যেসব নেয়ামত দিয়েছেন, আমি সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।’ এর ফলেই আপনি জান্নাতুল ফেরদাউস পেয়ে যেতে পারেন। এটাই আমাদের ধর্মের সৌন্দর্য।
প্রশ্ন-৬: আপনি বলেছেন, কেউ যত বেশি স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে, সে তত বেশি কোনঠাসা হয়ে পড়বে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটা খুবই সত্য। কিন্তু এমন একজন বোনের অবস্থা কেমন হবে যিনি শালীনতার দাবি পূরণ করতে গিয়ে হিজাব পরিধান করছেন, এমনকি নিকাবও পরছেন, যেটি তার দৃষ্টিতে ফরজ? আমাদের প্রবীণদের মতেও এটি এমন হওয়া উচিত। এমতাবস্থায় বৃটিশ সমাজে এটাকে কীভাবে মানিয়ে নেয়া যাবে?
উত্তর: আমি স্পষ্টভাবেই বলেছি, শরীয়াহ যতটুকু অনুমোদন করে, প্রচলিত সংস্কৃতির ততটুকুই আমরা গ্রহণ করবো। এটাই করা উচিত। তাই বলে সমাজের ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ হওয়া সত্বেও আমরা নিশ্চয় পানশালায় যাবো না। শরীয়াহ এটা অনুমোদন করে না। অর্থাৎ এ জায়গায় এসে আমাদের সীমারেখা টানতে হবে। নারীদের মাথা ঢাকার প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। কোরআনে এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে। এটা মধ্যযুগের কয়েকজন আলেমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মাত্র নয়। কেউ যদি কোরআনের এই স্পষ্ট বক্তব্যকে অস্বীকার করে তাহলে বুঝতে হবে, তিনি আসলে সাধারণ আরবী ভাষাই বুঝেন না। কারণ, আরবীতে মাথা ঢাকার কাপড় বুঝাতে যে শব্দ রয়েছে, সেটাই আল্লাহ তায়ালা ব্যবহার করেছেন।
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ
তারা যেন তাদের বক্ষদেশের উপর মাথার উড়না ফেলে রাখে। (সূরা নূর: ৩১)
অর্থাৎ, শব্দটি হচ্ছে ‘খুমুর’ বা ‘খিমার’, যাকে আমরা হিজাব বলে থাকি। ‘খিমার’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে মাথা ঢেকে রাখার চাদর বা ওড়না (head scarf)। কোরআনে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, একজন নারীর ‘আওরা’, যার মধ্যে মাথাও অন্তর্ভুক্ত, ঢেকে রাখার ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে ঐক্যমত রয়েছে।
পক্ষান্তরে, এ ব্যাপারটাকেই আমরা আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বানিয়ে ফেলেছি। মাথা ঢেকে হিজাব পরিধান করা কিংবা দাড়ি রাখা মানেই কেউ ভালো মুসলমান – এমনটা মনে করা রক্ষণশীলদের অন্যতম একটা সমস্যা। দুঃখজনকভাবে, অনেকেই অবচেতনভাবে এই মানসিকতা দ্বারা আচ্ছন্ন। আমরা সত্যি সত্যিই তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে এ বিষয়গুলোর আলোকে বিচার করা শুরু করি। অথচ আমরা এগুলোকে যতটা অপরিহার্য মনে করি, এগুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারমানে, আমি এগুলোকে মোটেও অগুরুত্বপূর্ণ বলছি না। কিন্তু এগুলো নামাজ আদায়ের মতো অপরিহার্য নয়। এমন অনেক দাড়িওয়ালা ভাই আছেন, যারা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন না। আবার, এমন অনেক বোন আছেন, যারা হিজাব না পরলেও আখলাকের দিক থেকে ভালো, গীবত করেন না, ‘এটা-সেটা’ করে বেড়ান না। হিজাব না পরার চাইতেও গীবত করা বেশি গুনাহর কাজ। অথচ অনেক হিজাবী বোনই গীবত করে বেড়ান!
মূল কথা হচ্ছে, এমন কিছু বাহ্যিক বিষয়ের আলোকে অন্যদের ধার্মিকতা যাচাইয়ের সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে চালু হয়ে গেছে, যেগুলো আসলে অপেক্ষাকৃত নমনীয় ব্যাপার। বিরিয়ানী খাওয়া যদিও হালাল, কিন্তু এটা নিশ্চয় ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না ধরে নিয়েই বলছি – হিজাব পরিধান করা অবশ্যই ওয়াজিব। কিন্তু আপনারা কি জানেন, হিজাবের বিধান সংক্রান্ত আয়াত কখন নাজিল হয়েছিল? পঞ্চম হিজরীর শেষ দিকে। নামাজ, রোজা, জাকাত, উত্তরাধিকার, বিয়ে এবং তালাক সংক্রান্ত মৌলিক বিধানগুলো নাজিলের পরে নবুওয়তের শেষ দিকে যেসব বিধান নাজিল হয়, তারমধ্যে একটি হলো হিজাব। এমনকি হিজাব সংক্রান্ত সূরা আহযাবের আয়াতটি আল্লাহ তায়ালা শেষ করেছেন এভাবে, ‘আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’।
অতএব, আমরা যে ধরনের সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি, সেখানে যে বোনেরা হিজাব পরার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার হৃদয় নিংড়ানো সহানুভূতি রয়েছে। আল্লাহ চান নারীরা হিজাব পরিধান করুক। তাই আমি কখনোই এই বিধানকে পরিবর্তন করার কথা বলবো না। তবে তাদেরকে আমি বলতে চাই, শুধুমাত্র হেডস্কার্ফ পরতে না পারার কারণে নিষ্ঠাবান মুসলমান হতে পারছেন না– এমনটা ভাববেন না।
আমাদের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে দাড়ি নিয়ে ভাইদেরকে লজ্জা দেয়া। যেমন আমরা বলে থাকি, ‘ভাই, দাড়ি না থাকলে আমাদের ইসলামী কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত হতে আসবেন না।’ সুবহানাল্লাহ! এভাবে আপনি ভালো কাজের দরজাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছেন! ঠিক আছে, বড় কোনো গুনাহর কাজ করলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে ইসলামী কেন্দ্রের সভাপতি হওয়া উচিত নয় – তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সেই ব্যক্তি কি কোনো ইসলামী কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্তও থাকতে পারবে না! গুনাহর কাজ ও উত্তম আমলের তালিকা তৈরি করে, তার আলোকে লোকজনকে ইসলামী কেন্দ্রের সদস্য বানানো কি উপযুক্ত পন্থা? না। বরং প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের জন্যই ইসলামী কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার দরজা খোলা রাখা উচিত। সভাপতি ও মুখ্য দায়িত্বপালনকারী সদস্যদেরকে ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন হওয়া উচিত, এটা বোধগম্য ব্যাপার। কিন্তু সমাজসেবা, ফান্ড রাইজিং কিংবা ইসলামী সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে থাকতে চাইলেও কি এ রকম উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন হতে হবে? না। অবশ্যই প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য সমাজে ও ইসলামী কেন্দ্রগুলোতে একটা স্পেস থাকা জরুরি; কেউ হিজাব করুক বা না করুক, দাড়ি রাখুক বা না রাখুক।
হ্যাঁ, বোন, হিজাব পরিধানের কারণে বাস্তবিকই আপনি মনোযোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবেন, এটা ঠিক। এবং এ ব্যাপারে কোরআন-হাদীসের বর্ণনা সুস্পষ্ট, যা আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি। আমরা প্রগতিবাদী নই। এ ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল রয়েছে, যা আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। তবে হিজাবের ধরন, স্টাইল, কাপড়ের রং – এসব ব্যাপারে আমাদের সৃজনশীল ও শিল্পানুরাগী প্র্যাকটিসিং মুসলিম বোনেরা কাজ করতে পারেন। আপনারা হিজাবের এমন ডিজাইনের কথা ভাবুন, যা একইসাথে শালীন হবে এবং আমরা যেখানে বাস করছি, সেখানকার সংস্কৃতি ও ড্রেসকোডের প্রতিফলনও যাতে ঘটবে।
একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। পাকিস্তানী বোনেরা সাধারণত খুব ঢিলেঢালা সালোয়ার-কামিজ পরে থাকেন। সাথে বড় শাল গায়ে দেন। আবার, মালয়েশিয়ান বোনেরা বেশ উজ্জ্বল রংয়ের হিজাব পরিধান করেন, মাশাআল্লাহ। তাদের হিজাবে চমৎকার কারুকাজ করা থাকে। তারা এতেই অভ্যস্ত। তাই নয় কি? অন্যদিকে, নাইজেরিয়ান বোনদের হিজাবের নকশা বেশ জটিল। তাদের হিজাবও যথেষ্ট শালীন।
পোশাকটি শালীন কি না, তা খেয়াল রাখুন। আঁটোসাঁটো পোশাক পরা উচিত নয়। অবশ্য আমরা সবাই তা বুঝি। হিজাবের কাপড়, রং, স্টাইল ইত্যাদি ব্যাপার শরীয়াহ ঠিক করে দেয় না। এটা হতে পারে মার্জিত কোনো টু-পিস পোশাক, যেমন বিজনেস স্যুট। তবে সেটা অবশ্যই ঢিলা হতে হবে, আঁটোসাঁটো হওয়া যাবে না।
আর কেউ যদি জিলবাব পরতে চায়, তাহলে তো কথাই নেই। মূল পোশাকের উপরে বাড়তি যে পোশাক পরা হয়, আরবীতে তাকে জিলবাব বলে। কিন্তু আমার মতে, জিলবাব পরাটা বাধ্যতামূলক নয়। এটা পরতে শুধু উৎসাহিত করা হয়েছে, এর বেশি কিছু নয়। এটাকে উৎসাহিত করার কারণ হচ্ছে, জিলবাব শব্দটা কোরআনের পরিভাষা। ‘লিসানুল আরাবিয়্যাহ’সহ আরবী ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন বইয়ে জিলবাব শব্দটির ভাষাতাত্ত্বিক অর্থ খেয়াল করলে আপনি দেখতে পাবেন, ‘জিলবাব হচ্ছে কোনো বড় আচ্ছাদন, যা নারীরা পরিধান করে।’ কেউ যদি বড় হেডস্কার্ফ পরে, তাহলে সেটাও জিলবাব হিসেবে বিবেচিত হবে। জিলবাব অবশ্যই উত্তম। আমাদের যেসব বোন জিলবাব পরেন, তাদের জন্য সেটাই ভালো। যারা হিজাব করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আমরা তাদেরকে উৎসাহিত করি। আমরা তাদেরকে বলতে চাই, শুরু করে দিন। আপনার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু জিলবাব পরতে চেষ্টা করুন।
মনোযোগ দিয়ে শুনুন। দয়া করে পরবর্তীতে আমার কথাকে ভুলভাবে উদ্বৃত করবেন না। কোনো বোন হয়ত হেডস্কার্ফ পরেন; কিন্তু একইসাথে আঁটোসাঁটো শার্ট-জিন্স প্যান্ট পরিধান করেন। তিনি আসলে হিজাব থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। অন্যদিকে, কোনো বোন হয়তো মাথা ঢাকেন না; কিন্তু ঢিলেঢালা পোশাক পরেন। হিজাবের উদ্দেশ্যের দিক তিনি আগের জন থেকে কাছাকাছি রয়েছেন। আমরা অনেকেই আসলে বুঝি না হিজাব বলতে কী বুঝায়? হেডস্কার্ফ পরাকেই অনেকে হিজাব মনে করেন। এটা আমাদের একটা সমস্যা। আবারো বলছি, আমাকে ভুলভাবে উদ্বৃত করবেন না। মাথা খোলা রাখাকে আমি হালাল বলিনি। আমি আসলে বলতে চেয়েছি, যে বোনটি হেডস্কার্ফ পরলেও আঁটোসাঁটো জিন্স প্যান্ট ও শার্ট পরেন (দুঃখজনকভাবে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে এই প্রবণতা বেশি), তার তুলনায় যিনি মাথা না ঢাকলেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে রাখে এমন ঢিলেঢালা পোশাক করেন, তার পোশাক হিজাবের আদর্শ রূপের বেশি কাছাকাছি। আঁটোসাঁটো পোশাক পরে মাথা ঢেকে রেখে আর কী লাভ? তাই আমি বলেছি, শুধু মাথা ঢাকার চেয়ে ঢিলেঢালা পোশাক পরা হিজাবের অধিকতর নিকটবর্তী।
যাইহোক, যে বোনেরা হিজাবে পুরোপুরি অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন তাদেরকে বলবো, আপনারা এগিয়ে যান। হাত-পা ঢাকা ও ঢিলেঢালা পোশাক দিয়ে শুরু করুন। ইনশাআল্লাহ, ধীরে ধীরে মাথা ঢেকে চলার ব্যাপারেও হয়ত আপনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। তারপর আপনি যদি জিলবাব পরতে চান, তাহলে তো সেটা খুবই ভালো। যদিও তা পরা বাধ্যতামূলক নয়। আমরা বোনদের উৎসাহিত করতে চাই। আর এ ধরনের কথাবার্তা তাদেরকে নিরুৎসাহিত করার চেয়ে উৎসাহিত করবে বলেই আমি মনে করি।
আর ভাইদেরকে বলছি, আপনাদের ব্যাপারটা আরো সহজ। কারণ, দাড়ি থাকলেও আপনি সহজেই আর দশজনের মাঝে মিশে যেতে পারেন। কিন্তু আশি-নব্বইয়ের দশকে ব্যাপারটা এমন ছিল না। এখন তো কারো মুখে দাড়ি আর চোখে সানগ্লাস থাকলে তাকে বেশ স্মার্ট ও সুপুরুষ মনে হয়। তাই এখন আর কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু আমাদের বোনেরা সত্যিই অনেক ভোগান্তিতে পড়েন। আমি সত্যিই হিজাবী বোনদের তারিফ করতে চাই। আপনারাই আমাদের ঈমানী অ্যাম্বাসাডর, প্রতিনিধি। আমরা দাড়ি রেখেও সহজে লোকজনের সাথে চলতে পারি। কেউ হয়ত আমাদের মুসলিম হিসেবে চিনতে পারলেও তাদের সাথে আমাদের পোশাকের মিল দেখে হয়তবা কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। অবশ্য বোনদের বেলায় এমনটা সচরাচর ঘটে না।
তাই আমাদের বোনদেরকে সম্মান করা উচিত। এমনকি যারা হিজাব পরে না, তাদেরকেও সম্মান করা উচিত। হিজাব করার জন্য এখানে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। তাই তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত মন্তব্য করবেন না। আপনি তা করতে পারেন না। কোনো বোন যদি যথাযথভাবে পোশাক না পরেন, তাহলে অন্য কোনো বোনকেই এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতে দিন। তারাই ব্যাপারটার সমাধান করুক। তাদের ব্যাপারে মতামত দেয়া আপনার কাজ নয়। কিংবা ‘তিনি কেন এটা করছেন না’ ধরনের কোনো চিন্তা করাও আপনার কাজ নয়। বাস্তবতা হচ্ছে তিনি মসজিদে কিংবা কোনো ইসলামী কেন্দ্রে আসছেন। ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো দেশে বাস করে তিনি এসব জায়গায় আসার প্রয়োজনবোধ নাও করতে পারতেন। কিন্তু এই আধুনিক সমাজে বাস করেও তো তিনি আসছেন। তাই তিনি যেমন পোশাক পরেই আসুন না কেন, তাকে ফিরিয়ে দেবেন না।
আর যে বোনেরা ব্যাপারটা সামাল দেবেন, তারা খুবই ভদ্রভাবে তা করবেন। নতুন কোনো বোনকে আপনি যদি বলেন, ‘কেন তু্মি এ ধরনের পোশাক পরে এসেছ?’ তাহলে তা ভদ্র আচরণ হবে না। বরং আপনি হাসি মুখে সালাম দিয়ে তাকে বলতে পারেন, ‘বোন, আপনার নাম কি?’ ‘আমি ফাতেমা। আপনি?’ … এভাবে তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। এভাবে পাঁচ-দশ বার আপনাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে ঘনিষ্টতা তৈরি হওয়ার পর হিজাব নিয়ে কথা বলুন। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই যদি তার সাথে কঠোর ও বাজে আচরণ করেন, তাহলে কীভাবে তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করতে পারেন? আসলে সবকিছুই নির্ভর করে আমাদের মানসিকতার উপর।
টিকে থাকা নিয়ে আমরা এখন সত্যিই চিন্তিত। তাছাড়া কঠোর ও বাজে আচরণ করা কোনোক্রমেই ইসলামসম্মত নয়। বিশেষত আমরা যেখানে সংখ্যালঘু এবং আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেখানে ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করছে, সে পরিবেশে কঠোর ও আল্ট্রা-ইসলামিক হওয়া আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাহলে এই ইস্যুটার সমাধান আপনি কীভাবে করবেন? এ ব্যাপারে কথা বলতে আমি আগ্রহী।
আমার আগের কথা থেকে এটা পরিষ্কার যে, বোনদের মাথা ঢাকার ব্যাপারটি কোরআনেরই বিধান। আমরা তা পরিবর্তন করতে পারি না। তাহলে আমরা কী করতে পারি? আমি আগেই বলেছি, উগ্র এবং আঁটোসাঁটো না হওয়ার শর্তে আপনি পোশাকের স্টাইল, প্যাটার্ন ইত্যাদি পরিবর্তন করতে পারেন। বাজারে প্রচলিত হিজাবগুলো খুব জমকালো নয়। আপনারা সেগুলো পরতে পারেন।
বোনদেরকে আমি আরেকটা কথা বলতে চাই। হিজাবের ফ্যাশন বা এ জাতীয় ব্যাপারগুলো নিয়ে আপনাদেরকেই ভাবতে হবে। ফ্যাশন বলতে আমি পাশ্চাত্য মূল্যবোধকে বুঝাচ্ছি না। বরং শরীয়াহর উপাদানগুলো বজায় রেখে প্রচলিত সংস্কৃতি থেকে যথাসম্ভব গ্রহণ করার কথা বলছি। আলহামদুলিল্লাহ, আমার অভিজ্ঞতায় এ ধরনের বেশকিছু ভালো ডিজাইন রয়েছে।
বোনদেরকে সর্বশেষ বলতে চাই, পোশাকের ব্যাপারে পুরুষদের তুলনায় আপনাদের জন্য শর্ত বেশি থাকায় আপনারা পুরস্কারও বেশি পাবেন। কারণ, ভাইদের তুলনায় আপনারা বেশি কষ্ট করছেন। মহান আল্লাহ আপনাদেরকে তওফিক ও উত্তম পুরস্কার দান করুন। আপনারা নিশ্চয় তা প্রাপ্য। আমীন।
উপস্থাপক: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে আপনি আজকের আলোচনা শেষ করুন।
ইয়াসির ক্বাদী: বিশেষ কোনো সমাপনী বক্তব্য নেই। আমি শুধু এ কথাটি বলতে চাই, আমরা খুবই কঠিন ও সংকটময় সময়ে বাস করছি। এই সময়টাতে বিশ্বজুড়ে ও স্থানীয়ভাবে, এমনকি আপনার নিজস্ব কমিউনিটিতেও প্রতিনিয়ত অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। মুসলমানদের ব্যাপারে সরকারসমূহের কথাবার্তাগুলো যথেষ্ট আশংকাজনক হয়ে ওঠছে। তাই নিজেকে খোলসে লুকিয়ে রাখার সময় এখন নয়, বরং একজন গর্বিত মুসলমান হিসেবে গঠনমূলক চিন্তাভাবনা করার সময়। নিজের পরিবার, পরিচিত মহল, বন্ধুবান্ধব ও কমিউনিটির মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরা করা দরকার। ঠিক এ কারণেই আমি এই ইস্যুটি নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে এত বেশি আগ্রহী হয়েছি। এ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাকে আমি আরো এগিয়ে নিতে চাই। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকেই কেবল সফলতা আসে। তাই আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলুন। তাঁর সাথে সম্পর্ক না থাকলে কোনোকিছুই সফল হবে না। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
[মূল: ইয়াসির ক্বাদী, অনুবাদ: আইয়ুব আলী]
নোট:
[1] ১৯৪১ সালে নির্মিত জনপ্রিয় একটি আমেরিকান ড্রামা মুভি। যেখানে সিটিজেন কেইন একজন সমাজপতি।