ইসলামে ধর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতা
[এডিটর’স নোট: মানুষের নিরংকুশ স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইসলামের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়ে হিদায়াহ নামের একজন নারী onislam.net-এ একটি প্রশ্ন করেছিলেন। শায়খ ইউসুফ আল কারযাভী আরবীতে প্রশ্নটির বিস্তারিত জবাব দেন, যা ২০০৫ সালের ৩ আগস্ট ওয়েবসাইটটিতে প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধটি সেই প্রশ্নোত্তরের পরিমার্জিত অনুবাদ। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্যে অনুবাদ করেছেন কাজী শিহান মির্জা।]
***
ইসলাম স্বাধীনতার মূলনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) বিখ্যাত উক্তিটি হলো— “তোমরা কবে থেকে তাদেরকে ক্রীতদাস বানিয়েছ? তাদের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন হিসেবেই জন্ম দিয়েছে!” আলী ইবনে তালিব (রা.) অসীয়ত করে গিয়েছেন, “অন্যের জীবনকে যাপন করো না, আল্লাহ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।” প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর সৃষ্টির নিয়ম ও জন্মের প্রকৃতি অনুযায়ী মানুষ স্বাধীন। তাই স্বাধীনতা মানুষের অধিকার, মানুষ কারো দাস নয়।
ইসলাম এসেই স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছে। অথচ সে যুগে চিন্তা, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম এবং অর্থনীতির দিক থেকে মানুষ পরাধীন ছিল। ইসলাম মানুষকে বিশ্বাস, চিন্তা, মতপ্রকাশ ও সমালোচনা করার অধিকার দিয়েছে। মোটকথা, মানুষ যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা বা অধিকার চায়, তার সবগুলোই ইসলাম তাকে দিয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা
ইসলাম এমন একটি দ্বীন যা ধর্মীয় তথা বিশ্বাসের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম কখনোই মানুষকে জোর করে ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দেয় না। আল্লাহর কালাম এ সম্পর্কে ঘোষণা করেছে,
“(হে নবী,) তোমার মালিক চাইলে এ জমিনে যত মানুষ আছে তারা সবাই ঈমান আনতো; তুমি কি মানুষদের জোর-জবরদস্তি করবে যেন তারা সবাই মুমিন হয়ে যায়!”
[সূরা ইউনুস: ৯৯]
এটা তো মক্কী যুগের কথা। মাদানী যুগে নাযিল হওয়া সূরা বাকারায় বলা হয়েছে,
“দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, সত্য মিথ্যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে।”
[সূরা বাকারা: ২৫৬]
এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি, ধর্মীয় স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করতে, এর তাৎপর্যকে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে এবং এর মূলনীতিকে নিশ্চিত করতে ইসলাম কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে। জাহেলী যুগে আউস ও খাযরাজ গোত্রের নারীরা গর্ভধারণে অপারগ হলে মানত করতো যে ছেলে সন্তান হলে তাকে ইহুদী হিসেবে গড়ে তুলবে। এভাবে এই আরব গোত্র দুটির কিছু সন্তান ইহুদী হিসেবে বেড়ে উঠে। তারপর ইসলামের আগমন ঘটলে আল্লাহ এসব পিতামাতাকে এ দ্বীন কবুলের মর্যাদায় ভূষিত করে তাঁর নেয়ামত দ্বারা পরিপূর্ণ করলেন। তখন কোনো কোনো পিতামাতা তাদের ইহুদী সন্তানদেরকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। তখন ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধ চলমান থাকা সত্ত্বেও ইসলাম জোর করে কাউকে এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে — এমনকি তা ইসলামে হলেও — ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দেয়নি। “ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই”— এই ঘোষণা ইসলাম এমন এক সময়ে দিয়েছে যখন বাইজেন্টাইনের অন্যতম নীতি ছিলো— হয় খ্রিস্টান হও, নয়তো শির পেতে দাও। তৎকালীন অপর পরাশক্তি পারস্যের ধর্মীয় সংস্কারকদের ব্যাপারেও অনুরূপ জঘন্য অভিযোগ রয়েছে।
সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতা বা কোনো বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে স্বাধীনতার এই মূলনীতি আসেনি। মানবসভ্যতার অগ্রগতির এক পর্যায়ে তা এসেছে, এমনও নয়। আসলে এটা সমাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্বাধীনতার এই মূলনীতি এসেছে আসমান থেকে, যার উপর দাঁড়িয়ে মানবজাতি উন্নত হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মানবতাকে সমুন্নত করতেই ইসলামের আগমন ঘটেছে।
অবশ্য ইসলামে স্বাধীনতার এই মূলনীতিকে শর্তযুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে এই দ্বীন মানুষের হাতের খেলনায় পরিণত না হয়। ইহুদীরা সকালে ইসলামের প্রতি ঈমান এনে বিকেলে তা প্রত্যাখ্যান করে বলতো, আমরা মুহাম্মদের দ্বীনে এমন এমন বিষয় পেয়েছি, তাই ঈমান ত্যাগ করলাম। এমনকি তারা আজ ঈমান এনে পরদিন বা সপ্তাহখানেক পরেই তা বর্জন করতো। এভাবে তারা এই দ্বীনের সাথে নোংরামি করতো। এদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন,
“আহলে কিতাবদের (মধ্য থেকে) একদল তাদের নিজ লোকদের বলে, মুসলমানদের উপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা সকাল বেলায় তার উপর ঈমান আনো এবং বিকেল বেলায় তা অস্বীকার করো, (এর ফলে) তারা সম্ভবত (ঈমান থেকে) ফিরে আসবে।”
[সূরা আলে ইমরান: ৭২]
এসব কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা চেয়েছেন এই দ্বীন যেন খেলার পাত্রে পরিণত না হয়। তাই কেউ ইসলামে প্রবেশ করার সময় যেন নিশ্চিত হয়ে অন্তর্দৃষ্টির সাথে সচেতনভাবে ইসলামকে পুরোপুরি ধারণ করে। নয়তো পরবর্তীতে কেউ ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেলে স্বধর্মত্যাগের শাস্তির জন্য তার প্রস্তুত থাকা উচিত।
অতএব, স্বাধীনতার অগ্রাধিকার বিবেচনা করলে প্রথমেই ধর্মপালন ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ আসে।
চিন্তার স্বাধীনতা
দ্বিতীয় প্রকার স্বাধীনতা হচ্ছে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা। ইসলাম মানুষকে বিশ্বজগৎ নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করার আহবান জানিয়েছে।
“(হে নবী,) তুমি বলো, আমি তোমাদেরকে শুধু একটি কথারই উপদেশ দিচ্ছি, তা হলো— তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্যই (সত্যের উপর) দাঁড়িয়ে যাও, দুই দুইজন করে, (দুইজন না হলে) একা একা; অতঃপর ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করো।”
[সূরা সাবা: ৪৬]
“(হে নবী,) তুমি বলো, তোমরা দেখো যে আসমানসমূহ ও জমিনে কী কী জিনিস রয়েছে।”
[সূরা ইউনুস: ১০১]
“তারা কি জমিনে ভ্রমণ করেনি? করলে তাদের অন্তরগুলো এমন হতো, যা দিয়ে তারা বুঝতে পারতো; অথবা কানগুলো এমন হতো যা দিয়ে তারা শুনতে পেতো। বস্তুত, চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত অন্তর।”
[সূরা হজ্ব: ৪৬]
তবে যারা নিজের আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার অনুসরণ করে, ইসলাম তাদেরকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছে। আল্লাহ বলেছেন,
“আর সত্যের মোকাবেলায় (আন্দাজ) অনুমান তো কোনো কাজেই আসে না।”
[সূরা নাজম: ২৮]
আবার যারা নিজের প্রবৃত্তি, পূর্বপুরুষ, সমাজের প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয়দের অনুসরণ করে তাদের বিরুদ্ধেও ইসলাম কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারাই কেয়ামতের দিন বলবে,
“হে আমাদের মালিক, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথাই মেনে চলেছি, তারাই আমাদেরকে তোমার পথ থেকে গোমরাহ করেছে।”
[সূরা আহযাব: ৬৭]
“আমরা আমাদের বাপ দাদাদের এ মতাদর্শের অনুসারী (হিসেবে) পেয়েছি এবং আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী মাত্র।”
[সূরা যুখরুফ: ২২]
ইসলাম এ ধরনের লোকদেরকে পশু কিংবা তারচেয়েও নিকৃষ্ট হিসেবে তুলনা করেছে। অন্ধ অনুসারী ও নিষ্ক্রিয় মনমানসিকতার লোকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। বিবেক-বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কাজ করতে আহ্বান করেছে। মানুষের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়ে ইসলাম বলেছে,
“যদি তোমরা সত্যবাদী হও (তাহলে) তোমাদের দলীল প্রমাণ নিয়ে এসো!”
[সূরা বাকারা: ১১১]
আকীদা প্রমাণের জন্য ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তিক দলীলের উপর নির্ভর করেছে। এজন্যই আলেমগণ বলেছেন, “নিশ্চয়ই উদার বুদ্ধিবৃত্তি সঠিক আসমানী প্রত্যাদেশের ভিত্তি।” অর্থাৎ যুক্তি হলো ওহীর ভিত্তি। আল্লাহর অস্তিত্ব ও মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তের বিষয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে বুদ্ধিসম্মত যুক্তির উপর। বিবেক বুদ্ধিই বলে উঠে— তিনি আল্লাহর রাসূল, সত্যতা এবং মুজিজা হচ্ছে তাঁর নবুয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণ। অন্যদিকে বিবেকের যুক্তি বলে, অমুক তো মিথ্যাবাদী, দাজ্জাল। তার কাছে সত্যও নেই, মুজিজাও নেই। এভাবেই ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তিকে মর্যাদা দান করেছে।
জ্ঞানের জগতে স্বাধীনতা
চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি উপরের আলোচনায় আলোকপাত করা হয়েছে। এরপর আসে জ্ঞানের জগতে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। আমরা দেখতে পাই, আমাদের আলেমগণ পরস্পরের সাথে নানা বিষয়ে মতানৈক্য করেছেন। তাঁরা একে অপরের ভুল ধরেছেন এবং জবাব দিয়েছেন। এসবকে কেউই সমস্যা মনে করেননি। আমরা দেখতে পাই, ইমাম জামাখশারী রচিত ‘তাফসীরে কাশশাফ’ গ্রন্থটিকে সুন্নী ও মুতাজিলা উভয় দলই সমাদর করেছে। ইমাম জামাখশারী মুতাজিলাপন্থী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই তাফসীর থেকে সুন্নীরা উপকৃত হয়েছে। এটিকে কেউ কোনো সমস্যা মনে করেনি।
আলেমরা এগিয়ে আসায় এমনটা সম্ভব হয়েছে। ইবনে মুনীরের মতো প্রখ্যাত সুন্নী আলেম তাফসীরে কাশশাফের উপর ‘আল ইনতিসাফ মিনাল কাশশাফ’ নামে একটি হাশিয়া তথা টীকা গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ বিষয়ে হাফিয ইবনে হাযরের মতো ইমামও এগিয়ে এসেছেন। তিনি এই তাফসীরে ব্যবহৃত হাদীসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে ‘আল-কাফী আল-শাফী ফি তাখরিজি আহাদীসিল কাশশাফ’ নামে একটি পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এভাবেই আলেমগণ একজন আরেকজনের গবেষণাকর্ম থেকে উপকৃত হয়েছেন। আমরা দেখেছি, পারস্পরিক মতপার্থক্য করার ক্ষেত্রেও ফকীহগণের অন্তরের প্রশস্ততা ছিল। এসব উদাহরণ থেকে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে চিন্তা ও জ্ঞানের স্বাধীনতার প্রমাণ দেখা যায়।
সমালোচনা ও বাকস্বাধীনতা
ইসলাম বাকস্বাধীনতা এবং সমালোচনার স্বাধীনতাও দিয়েছে। এক্ষেত্রে বরং অনেক বেশি স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কারণ, উম্মাহর কল্যাণ, চরিত্র ও নৈতিকতা সংশোধনের স্বার্থে মতপ্রকাশ ও সমালোচনা করা কখনো কখনো ওয়াজিব হয়ে যায়। সবসময় হক কথা বলতে হবে, আল্লাহর পথে কাজ করতে গিয়ে কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করা চলবে না। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে হবে। কল্যাণের দিকে মানুষকে ডাকতে হবে। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়ে মানুষকে বলতে হবে, আপনি উত্তম কাজ করেছেন। আর কেউ মন্দ কাজ করলে বলতে হবে, আপনি খারাপ কাজ করেছেন।
এসব হক কথা বলার জন্য যখন নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিংবা আপনার নিরবতাই যখন উম্মাহর ক্ষতি ও মানুষের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তখন এসব সংশোধনমূলক কাজ অপরিহার্য কর্তব্যে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় সত্য বলা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। এতে কোনো বিপদের পরোয়া করা যাবে না।
“সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করো। এতে বিপদ আসলে সবর করো। নিশ্চয়ই তা এক মহান ব্যাপার।”— এই হলো ইসলামের অন্যতম মৌলিক অনুশাসন। ইসলামে এমন কোনো সুযোগ নেই যাতে করে মানুষের টুটি চেপে ধরে লাগাম পরিয়ে রাখা হবে, যেন অনুমতি ছাড়া মানুষ কথা বলতে না পারে বা ঈমান আনতে না পারে। এটি ফেরাউনের বৈশিষ্ট্য। ফেরাউন তার যাদুকরদের বলেছিল, “তোমরা কি আমার অনুমতি ছাড়াই তাঁর উপর ঈমান এনে ফেললে?” সে চেয়েছিল মানুষ যেন অনুমতি ছাড়া ঈমান না আনে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কথা না বলে।
স্বাধীনতা সুরক্ষা
ইসলাম মানুষকে শুধু চিন্তার স্বাধীনতাই দেয়নি, চিন্তা করার নির্দেশও দিয়েছে। মানুষ যা সত্য মনে করবে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে। শুধু তাই নয়, এর অনুসরণ করাকে ইসলাম কর্তব্য হিসেবে ধার্য করে দিয়েছে। প্রয়োজনে অস্ত্রবলে নিজের এই আকীদাকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। মুসলিমদের আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন প্রয়োজনে স্বশস্ত্রপন্থায় নিজেদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে, যতক্ষণ পর্যন্ত ফিতনা দূর না হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীন পুরোপুরি কায়েম না হয়। সবাই জুলুম থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত জালিমকে প্রতিহত করতে হবে।
কিতাল ও জিহাদের বিধান সংক্রান্ত প্রথম যে আয়াতটি নাযিল হয়, তাতে আল্লাহ বলেন,
“তাদেরও (এখন যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া গেলো, কেননা তাদের উপর সত্যিই জুলুম করা হচ্ছিলো।”
[সূরা হজ্ব: ৩৯]
এর পরের আয়াতেই আল্লাহ আবার বলছেন,
“যদি আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির একদলকে আরেক দল দিয়ে শায়েস্তা না করতেন তাহলে দুনিয়ার বুক থেকে (খ্রিস্টান সন্যাসীদের) উপসনালয় ও গির্জাসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেতো, (ধ্বংস হয়ে যেতো ইহুদীদের) ইবাদতের স্থান ও (মুসলমানদের) মসজিদসমূহও, যেখানে বেশি বেশি পরিমাণে আল্লাহ তায়ালার নাম নেয়া হয়।”
[সূরা হজ্ব: ৪০]
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা যদি মুসলিম ও মুমিনদেরকে স্বশস্ত্রপন্থায় হলেও স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার না দিতেন, তাহলে কারো পক্ষেই আল্লাহর ইবাদত করা সম্ভব হতো না।
স্বাধীনতার সীমারেখা
ইসলাম অধিকারের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু ধর্মহীনতা ও পাপাচারের স্বাধীনতা দেয়নি। আজকাল যাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা হিসেবে দাবি করা হয়, ইসলামের স্বাধীনতার স্বরূপ তেমনটা নয়। ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ পরিভাষা ব্যবহারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ইচ্ছেমতো ব্যাভিচার, মদপান ও সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করার সুযোগ তৈরি করা। তবে কল্যাণ ও সংশোধনের সাথে জড়িত ব্যাপারগুলোর কোনো স্বাধীনতা সেখানে নাও থাকতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, সমালোচনা করা যাবে না, যা বিশ্বাস করা হয় তা বলা যাবে না, উত্তম কাউকে বলা যাবে না যে ‘তুমি ভালো কাজ করেছ’, খোঁড়াকে খোঁড়া বলা যাবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে শুধু নিজেকে নষ্ট করার মধ্যে, চরিত্র বরবাদ করার মধ্যে, চেতনাকে বিকৃত করার মধ্যে, ইবাদতকে নষ্ট করার মধ্যে, পরিবারকে ধ্বংস করার মধ্যে।
এই যদি হয় স্বাধীনতার অর্থ, তাহলে ইসলাম এমন স্বাধীনতাকে অনুমোদন করে না। কারণ, এটা পাপাচারের স্বাধীনতা; অধিকারের স্বাধীনতা নয়। চিন্তাভাবনা, জ্ঞানচর্চা, মতামত গঠন, মতপ্রকাশ, সমালোচনা, বিশ্বাস ও ধর্মের স্বাধীনতাকে ইসলাম অনুমোদন করে। এই স্বাধীনতাগুলোর উপরই মানবজীবন দাঁড়িয়ে আছে। অন্যের ক্ষতিসাধন করবে না— এই আইনী শর্ত ও নীতির ভিত্তিতে ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দেয়। ইসলামের সাধারণ মূলনীতি হলো, “ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করাও নয়।” আদতে এমন কোনো স্বাধীনতা কি আছে, যা নিজের বা অন্যের ক্ষতিসাধনের অনুমোদন দেয়? যদি থাকে তাহলে এমন স্বাধীনতাকে মোকাবেলা করা উচিত, শর্তাধীন করা উচিত। কারণ, এ ধরনের ব্যবস্থায় যেখান থেকে অন্যের স্বাধীনতার শুরু হয়, আপনার স্বাধীনতা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তাই এমন স্বাধীনতার কথা কেউই সমর্থন করে না, যেখানে স্বাধীনতার নামে অপরকে দমনপীড়ন বা নিষ্পেষণের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
রাস্তায় সবার চলাফেরার স্বাধীনতা থাকলেও রাস্তার আদব-কায়দাও তো মেনে চলতে হবে। আপনি অপরের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে পারেন না। যানবাহনের পথ রোধ করতে পারেন না। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করতে পারেন না। লাল বাতি জ্বললে আপনাকে থেমে যেতে হবে, কিংবা নির্ধারিত পথেই আপনাকে হাঁটতে হবে। এগুলোই হচ্ছে আপনার স্বাধীনতার শর্ত বা সীমারেখা। সবার কল্যাণের স্বার্থেই এই বিধিনিষেধ ঠিক করা হয়েছে।
প্রত্যেক মতাদর্শ ও ব্যবহারিক ব্যবস্থার মধ্যেই স্বাধীনতার এরূপ সীমারেখা নির্ধারিত রয়েছে। ইসলামও তাই করেছে। কেননা মানবতার জন্য এটাই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা।