“রিডিং ইন দ্য সামার”
ইংরেজিতে “সামার রিডিং লিস্ট” বলে একটা প্রথা চালু আছে। অর্থাৎ অবসরে আপনি যা যা পড়বেন তার একটি ফর্দ। তবে আমি এ তালিকাকে পছন্দ করি না। কারণ এতে পড়াশুনা যে গুরুত্ব ও মূল্য আছে তা নষ্ট হয়ে যায়। পড়াশুনাকে এভাবে হালকাভাবে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে লেখক-পাঠক উভয়কে অপমান করা হয়। শখের বশে বই পড়ে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে বইকে এমনভাবে নিতে হবে যাতে বিভিন্ন ‘আইডিয়া, চিন্তা, অনূভুতি, স্বপ্নে’র সাথে নিজকে সাজিয়ে নিতে আমন্ত্রণ পেয়েছি। সে আমন্ত্রণে প্রকৃত লেখক পাঠকের সামনে ‘স্বপ্ন, অনূভুতি, চিন্তা বা আইডিয়া’ নানাবিধ উপায়ে নিজেকে উপস্থাপন করে।
পড়াটা হলো একটা সিরিয়াস কারবার। পাঠক ‘রান্নার বই অথবা প্লেটো’র বই যাই পড়ুক না কেন, লেখকের বইয়ের মধ্যে দিয়ে পাঠক তার মনের জগতে ঢুকার পথ তৈরি করে দেয়। পাঠক নিজেকে জড়িয়ে নেয় লেখকের আইডিয়া ও ধারণার সাথে। আবার কখনো লেখকের লিখা অপছন্দ হলে লেখকের মতের সাথে মিল হয়না। পাঠক লেখকের লিখার সাথে অমিল হলে সমালোচনার ক্ষেত্রেও ছাড় দেয় না। ফলাফল যা হোক না কেন, পাঠক ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ ভ্রমণ করতে লেখকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। বই পড়ার সাথে পাঠকের ‘মন ও আত্মা’র সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থা নির্ভর করে কতটুকু লেখকের সাথে পাঠকের ভ্রমণের সময়টা সমৃদ্ধিশালী অথবা বিষন্ন হবে।
মানুষ মন দিয়ে চিন্তা করে আর হৃদয় হলো ‘আবেগ ও চিন্তা’র উৎসস্থল। পড়া মনের চিন্তা ও হৃদয়ের আবেগ, দুইটাকে কাজে লাগায়।। মনকে চিন্তার কাজে লাগিয়ে বই পড়া হয় তবে সাথে সাথে বইটি পাঠকের হৃদয়ের ‘আবেগ-অনুভূতি’র দিকগুলোর সাথেও জড়িয়ে যায়। উপন্যাস বা সৃষ্টিতত্ত্ব যাই পড়া হোক, পাঠক নিজস্ব ‘বুদ্ধিবৃত্তি ও অভিজ্ঞতালব্ধ আবেগ’ দিয়ে বইয়ের প্রধান আইডিয়া ও প্রস্তাবের প্রতি সাড়া দেয়। বই নিজের কাজ করে যায় পাঠকের চিন্তাকে ছাঁচ বা আকার দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। আবার পাঠকেরও বইয়ের প্রতি দায় থেকে যায় বইয়ের জ্ঞান আলোচনা- সমালোচনা গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে দিয়ে।
ভালো বই পড়ে আনন্দ ও ভালো লাগা কাজ করে। অনেকেই বই পড়াকে অবসর সময়ের ভালো বিনিয়োগ হিসেবে দেখে। মনকে ফুরফুরে ও আত্মাকে উন্নত করতে বই পড়াতে খারাপের কিছু নেই। শুধু অবসর সময়ে বই পড়া উচিত- এ বিশ্বাসটাই সত্যিকারের ভ্রান্ত চিন্তা। তবে কেউ বই পড়াকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে চিত্ত বিনোদনের চেয়েও ভালো কিছু হাসিল করতে পারে।
পড়াটা যখন সঠিকভাবে চিন্তার যোগে হয়, তখন তা ‘মন ও আত্মা’ উভয়কে পুষ্টি দেয়। এ জন্য কি পড়তে হবে ও কিভাবে পড়তে হবে- এ উভয়দিক জানা জুরুরি। সব বই হলো লেখক-পাঠকের মিলিত ভ্রমণস্থল। পাঠককে এ ভ্রমণ গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত যদি সে পাঠ শেষে ভালো কিছু অর্জন করতে চায়। বই পাঠককে ‘হাসাতে,কাঁদতে কিংবা চিন্তা’ করাতে শেখায়। এ দুনিয়ায় যাপিত জীবনের এ বিশাল ভ্রমণে হাসি-কান্না-চিন্তা এসব খুবই সিরিয়াস বিষয়।
পড়তে হবে মনোযোগের সাথে সুশৃঙ্খল উপায়ে। এর অর্থ এ নয় যে, সারাক্ষণ শুধু পড়াশুনার জন্য বড় বিশাল গবেষণার লাইব্রেরিতে যাওয়া উচিত অথবা নিজেকে সব কিছু থেকে একা করে ফেলবে। তবে লাইব্রেরিতে সময় কাটানো হলো অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা’। শুধু বইয়ের শিরোনামের দিকে তাকিয়েও পাঠকের মনে অসংখ্য সম্ভাবনা জাগতে পারে। পাঠক প্রতিদিন নিজেকে বইয়ের মাঝে ডুবাতে নিজস্ব একটা ছন্দ তৈরি করা উচিত। যেকোনো অবস্থায় যেকোনো পরিবেশে পড়াশুনার অভ্যাস করতে হবে।এতে প্রয়োজন শুধু মানসিক শৃঙ্খলা ও মনযোগ।
স্বীকার করতে হবে যে, এ যুগে পড়াশোনায় মনযোগ ধরে রাখা এখন এত সহজ কাজ নয়। কারণ এ যুগে লক্ষ লক্ষ মনোযোগ হরনকারী আগ্রাসী শব্দ ও টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজের শিরোনাম আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এর চেয়েও আরো অধিকতর খারাপ হলো, আধুনিক বিশ্বের “ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষিপ্ত, মানহানিকর, ভাসাভাসা, আক্রমণাত্মক তাৎক্ষণিক বার্তা”সমূহে আমাদের সাড়া দিতে অভ্যস্ত করানো হচ্ছে। প্রত্যেক নিউজ এমনভাবে ভেসে আসে যাতে দর্শকদের তাৎক্ষণিকভাবে অন্য আরেকটি নিউজের দিকে চোখ সরানো যায়। এসব নিউজ তাৎক্ষণিকভাবে আসে আবার ভাসাভাসাভাবে চলে যায় কোনো গভীর আবেদন বা শিক্ষার কিছু রাখা ছাড়াই।
তাই পড়াশুনার কাজটা আগের তুলনায় এখন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। সময় নষ্ট না করে এমনভাবে পড়তে হবে যাতে জ্ঞান ও উপলব্ধির পরিসীমা বাড়ানো যায়। সুতরাং কিভাবে পড়ব আর কি পড়ব দুইটাই গুরুত্বপূর্ণ।
পড়াশুনা এখন কিন্তু শুধু বই পড়াতে আর সীমাবদ্ধ নেই। দৃশ্যমান যত কিছু আমাদের চোখের সামনে আছে যেমন “গান, শৈল্পিক কারুকর্ম, প্রকৃতি” সবকিছু ঘিরেই এখন পড়াশুনার ব্যাপ্তি। বই যেভাবে অনেক কিছু জানায় সেই সাথে আশপাশের প্রকৃতিও কথার মধ্যে দিয়ে মানুষকে কিছু জানাতে চায়। তবে প্রকৃতির কথা বুঝতে আমাদের কান ও চোখকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে কান-চোখ প্রকৃতির গভীর “সৌন্দর্য চেতনা, ভারসাম্য, ঐকতান” বুঝতে পারি। ‘আর্ট বা শিল্প’ আমাদের মধ্যে ‘বৃহৎ মহত্তর অনুভূতি’ জাগাতে এমনভাবে কাজ করায় যাতে করে শিল্পটির বাহ্যিক গঠনের উর্ধ্বে উঠে গিয়ে অর্থবহ অবস্থানে পৌছতে পারি। আশ্চর্য অনূভুত উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে কারুকলা বা শিল্প শিখায়। যারা শব্দের উর্ধ্বে গিয়ে অর্থ বা ভাবকে বুঝতে চায় গান তাদের জন্য ভাব উদয়ের পথ হিসেবে কাজ করে। মানব জাতি নিজকে আবিষ্কার বা শিক্ষিত করতে “গান-শিল্প-প্রকৃতি” হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার রুপ বা উপকরণ।
পড়াশুনা হচ্ছে এমন কর্ম যা সত্যের উপরে যে কুয়াশা বা আবরণ আছে তা দূর করার উপায়, আর সত্যের যে বিভিন্ন রুপ আছে তার অর্থ উদ্ধারের অন্যতম মাধ্যম। “বই, প্রাকৃতিক আর্ট,পরিবেশ” আমাদের জন্য সত্য ও তার অর্থ উপলব্ধির পথ খুলে দেয়, পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় এ জগত-যার সম্পর্কে আমরা অসচেতন, তা আবিষ্কারের আমন্ত্রণ জানায়। তবে সচেতনতা আবিষ্কার প্রক্রিয়াটা হলো নিজকে আবিষ্কারের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় আমরা আমাদের ভেতর আর বাহির দুই অবস্থাকে বুঝতে সক্ষমতা অর্জন করি। অস্তিত্বের প্রত্যেক বস্তুকে বুঝার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের বুঝতে চেষ্টা চলে।
আর ইসলামি ঐতিহ্যে সত্যকে বুঝতে পড়াশুনার অবস্থান মসজিদের পবিত্রতার মতই। অর্থাৎ মসজিদ, কোরানকে ইসলাম যে পবিত্রতার চোখে দেখে সেভাবে সত্য আবিষ্কারে পড়াশুনাকেও ঠিক একইভাবে চোখে দেখে। নবী মুহাম্মদ সাঃ এর উপর প্রথম ওহীকৃত “ইকরা”র অর্থ পড়া ও তেলওয়াত দুইটাই। ইকরা শব্দ দিয়ে কুরআনকে পবিত্র বই হিসেবে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে পাশাপাশি কুরআনের দৃষ্টি দিয়ে যেন অস্ত্বিত্বের সব বিষয়ের প্রতি সুক্ষদৃষ্টিতে অনুসন্ধান চালিয়ে গভীরতম সত্ত্বাকে বুঝতে আহবান জানাচ্ছে। কুরআন মানুষের নিজের আত্মার ভিতর ও বাহিরের বিশ্বের যে নিদর্শন আছে তা পড়তে প্রেরণা দিচ্ছে। এ প্রেরণা উদ্দেশ্য হলো, যাতে মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তা ও যথার্থ গুণাবলির ব্যবহার করে আরো ভালো মানুষ হতে পারে। যারা এসব নিদর্শন পড়তে ব্যর্থ হয়, তারা নিদর্শন পড়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার যে সত্যিকার ক্ষমতা, সে কার্যকর পথ বাদ দিয়ে নিম্নতর জীবন-যাপনকে গ্রহণ করে।
জ্ঞানকে বাড়াতে, মনের দিগন্ত ও জগতকে আরো প্রশস্ত করতে আমাদের পড়াশুনার পরিধি বাড়ানো উচিত। সুতরাং এমন কিছু পড়তে হবে যা স্থায়ী ও প্রয়োজনীয়। হাল আমলে কত ঠুনকো ভুংভাং তথ্য আসা যাওয়া করবে, এসবে আমলে নেওয়া ও সময় নষ্ট করা যাবে না। ঐসব লেখকদের বই পড়তে হবে যা আমাদের চিন্তাকে বিভিন্ন রুপ দিয়ে কাঠামোবদ্ধ করে দিবে, গড়পড়তা কল্পনাশক্তিকে অসিম মাত্রায় নিয়ে যাবে, আরো ভালো ও আরো বুদ্ধিমান মানুষ হতে প্রেরণা দিবে। মানুষদের কথায় কান দিবেন না যারা বলে- ‘প্লেটো,আরিষ্টেটল’ পড়তে কষ্ট হয়,কারণ এটা ভারী ও কঠিন। তবুও প্লেটো, আরিষ্টেটল পড়ুন। ‘কিং মার্কাস আরিলিয়াস’কে পড়ুন, তাকে স্টাডি করতে গিয়ে শিখবেন- কিভাবে একজন রাজা আদর্শ ও বাস্তবতা, নীতি-সত্যের পারষ্পরিক মুখামুখী চিন্তার দ্বন্দ্বকে মোকাবেলা করে। ‘মার্কাসের আরিলিয়াসে’র মত আমরাও দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন লেভেলে “আদর্শ-বাস্তবতা,নীতি-সত্যের” প্রশ্নে আগে কোনটা অগ্রাধিকার দিব সে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। বিশ্বাস ও যুক্তি এ উভয় ইস্যু কিভাবে তুখোড় চিন্তা দ্বারা মোকাবিলা করে,তা বুঝতে ‘সেন্ট অগাস্টিন’কে পড়তে হবে।
আধুনিক সংকটাপন্ন অবস্থা বুঝতে আমাদের কবি ও লেখক “টিএস এলিয়ট এবং সিএস লুইস”কে পড়তে হবে। আধুনিক পৃথিবীকে বুঝতে কেউ হয়ত ‘যুক্তি ও স্বাধীনতা’কে বাছাই করে নিয়েছে নতুবা আবার কেউ শুধু স্রষ্টার উপর নির্ভরশীল হয়ে বুদ্ধি-যুক্তিকে পকেটে রেখে দিয়েছে অর্থাৎ কাজে লাগাচ্ছে না। এ অর্থপূর্ণ বিশ্বকে বুঝতে আল্লাহ অথবা মানুষে যুক্তির স্বাধীনতা কোনটিকে বাদ না দিয়ে কিভাবে জীবন চালনা করা যায়, তার জন্য “আল-ফারাবী,ইবনে সীনা, মোল্লা সদরা, অন্যান্য মুসলিম চিন্তক”দের পড়তে হবে, যারা বিশ্বাসী হয়েও যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখে পৃথিবীকে দেখেছেন। নিজেকে ‘মন ও হৃদয়’কে রুমি ও ইবনে আরাবীর হাতে তুলে দিন তাহলে বুঝবেন “দয়া,সহানুভূতি, বিষ্ময় ও ভালোবাসা” কি জিনিস! ‘ইবনে তোফায়েল, ইবনে বতুতার’ মত পরিব্রাজকদের দিকে একটু নজর বুলান,শিখবেন যে, এখনকার মুক্তবিশ্বের আগেও অতীতে কিভাবে এ পণ্ডিতরা বৈশ্বিক অবস্থানে মুক্ত বিশ্বের ধারণাকে উন্নতি করেছে। “হাফিজ,খৈয়াম,সাদী,আত্তার,ফুযুলি,ইউনুস এম্রে”র মত অমর মরমী কবিরা কিভাবে ‘স্বর্গীয় ভালোবাসা ও মানবতার’ জয়গান গেয়েছেন, তা শিখতে এসব নিরন্তর কবিতায় নিজেকে অবগাহন করান।
চায়না ও ভারতীয় সভ্যতার মহৎ ঐতিহ্য সমূহ স্টাডির অন্তভূর্ক্তি এ তালিকাকে আরো দীর্ঘ করবে। যে পড়া আমাদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় তাই কাজের পড়াশুনা। তাই এ পড়শুনাটা করতে হবে ধীরেসুস্থে ও নিয়ম মেনে মেনে সুশৃঙ্খল উপায়ে। ছুটি বলুন আর ব্যস্ততা বলুন অথবা গ্রীষ্ম বা শীত কিংবা বাড়ি বা রাস্তায় সব জায়গায় পড়াশুনায় এমনভাবে মগ্ন থাকতে হবে যার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের সামনে দিগন্ত প্রসারিত খোদাতায়ালার নিদর্শন ও আমাদের আত্মার গভীরে লুকায়িত সম্ভাবনাময় ‘স্রষ্টার নিদর্শন প্রতিভা’ উন্মোচন করতে পারি।
লেখক-
ড. ইব্রাহিম কালিন
তুরস্কের বর্তমান গোয়েন্দা প্রধান
ডেইলি সাবাহ থেকে অনূদিত
অনুবাদক- নাজিম মোহাম্মদ