ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধে নেপথ্য অনুঘটকসমূহের মূলোৎপাটন জরুরী

বাংলাদেশে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আজকে আমারা সবাই আপনজনের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। এমন অবস্থায় দেশব্যাপী আন্দোলন হচ্ছে, মানুষ এইসব ঘৃণ্য সামাজিক ক্ষত থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। আমি এবং আমার স্ত্রী ঘুরতে পছন্দ করি। কিন্তু সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার পর একাকী কোথাও ঘুরতে যেতে সাহস পাচ্ছি না। এমতাবস্থায়, ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সামাজিক সমস্যাগুলোর পিছনের কারণ বা অনুঘটক চিহ্নিত করা ও প্রতিরোধের পথ খুঁজতে এই লেখা।

ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির মতো কাজগুলোকে সাধারণত মনে করা হয় যৌন কাজ। কিন্তু এর পিছনের কারণ শুধুমাত্র যৌনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়- মানুষ কেন ধর্ষণ করে? ধর্ষণ প্রতিরোধের কার্যকরী উপায় কী? ধর্ষণ বন্ধে কি একমাত্র সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই যথেষ্ট? ইত্যাদি। আমি মনে করি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতনসহ যে কোনো সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধের উপায় তার নেপথ্য কারণ বা অনুঘটকগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর মুলোৎপাটনের মধ্যে নিহিত। কোনো সমস্যার মূল কারণ বুঝতে পারলে সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়।

ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সামাজিক সমস্যাগুলোর নেপথ্য অনুঘটকসমূহ:

ধর্ষণের পিছনে যেসব অনুঘটক কাজ করে সেগুলো একটি আর অপরটির সাথে জড়িত, ঠিক যেন মাকড়সার জালের মতো। কখনো যে কোনো একটি অনুঘটকের কারণে, আবার কখনো একের অধিক অনুঘটকের কারণে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ও অমানবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। মোটাদাগে কয়েকটি অনুঘটক চিহ্নিত করতে পারি আমরা। যেমন –

. ভারসাম্যহীন ক্ষমতা
. জেন্ডার অসমতা
. আইনের অপপ্রয়োগ, আইনের শাসনের অভাব এবং দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
. রাজনীতিশূন্যতা বা চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির অভাব
. মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়
. ঘৃণা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি
. সুস্থ্য বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার অভাব
. পরিবার ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ে শিক্ষার অভাব
. ব্যক্তির নেতিবাচক মানসিকতা এবং ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান
. রাজনৈতিক কমিটমেন্টের অভাব ইত্যাদি।

চলুন নেপথ্য কারণ বা অনুঘটকগুলো একটি একটি করে বুঝার চেষ্টা করি, সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজি।

ভারসাম্যহীন ক্ষমতা:

ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির ও নারী নির্যাতনের মতো ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার জন্য ভারসাম্যহীন ক্ষমতা অন্যতম দায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়েও ক্ষমতা বিষয়টি বেশি জড়িত। ধর্ষক এবং ধর্ষিতার মধ্যে বরাবরই ক্ষমতার অসমতা থাকে। এই ক্ষমতার অসমতা হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক অবস্থান এমনকি জেন্ডার অসমতার দিক থেকে। ফলে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষমতা ও পরিচয় ব্যবহার করে মানুষ রূপে অমানুষগুলো একের পর এক ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ করে দিনের পর দিন পার পেয়ে যাচ্ছে। একইভাবে, ক্ষমতা ব্যবহার করে ছাত্রনেতা ও দলীয় নেতা, পুলিশ, শিক্ষক, অর্থ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের সন্তানেরা, বিকৃত মানসিকতার পুরুষেরা ধর্ষক হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জরুরী অবস্থা, এমনকি জাতিগত দাঙ্গা ও যুদ্ধকালীন ধর্ষণও ভারসাম্যহীন ক্ষমতার একটি ফল।

জেন্ডার অসমতা:

জেন্ডার অসমতার কারণে নারী ও পুরুষের মাঝে যে ক্ষমতার ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকেও ধর্ষণের মতো ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে। আমাদের সমাজে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নারীরা শিখে পুরুষদের অধীনস্থ থাকার বিষয়গুলো; আর পুরুষরা শিখে কিভাবে নারীদের অধীনস্থ রাখা যায়, কিভাবে নারীদের ব্যবহার করা যায়। এমনকি যারা জেন্ডার সমতা ও নারী অধিকারের কথা বলেন, তারাও বিভিন্নভাবে জেনে অথবা মনের অজান্তে নারীকে পন্য হিসেবে উপস্থাপণ করছেন। এক্ষেত্রে মানুষের বেড়ে ওঠার পরিবেশ, চিন্তাজগৎ, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক এবং মিডিয়ার ইত্যাদির প্রভাব থেকে মানুষ শিখছে – পুরুষ ক্ষমতাধর, চাইলে সব পারে, ক্ষমতার জোরে ধর্ষণ করেও দায়মুক্তি পাওয়া যায়।

আর এভাবে ভারসাম্যহীন ক্ষমতা ও জেন্ডার অসমতার সুযোগে ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে।

আইনের অপপ্রয়োগ, আইনের শাসনের অভাব এবং দীর্ঘসূত্রিতা বিচারহীনতার সংস্কৃতি:

আইনের অপপ্রয়োগ, আইনের শাসনের অভাব এবং দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মতো ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার জন্য দায়ী আরেকটি অন্যতম অনুঘটক। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যমতে, ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার ঘটনার বিশ শতাংশের বেশি থানায় মামলা হয় না। সেখান থেকে মাত্র দুই দশমিক ছয় শতাংশ মামলার চূড়ান্ত রায় হয় এবং এক শতাংশের বেশি শাস্তির আওতায় আসে না। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৫৪০০ জন নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষনের মামলা হয় এবং মারা যায় ১২ শিশু এবং ২৬ জন নারী। চলতি বছরে এই সংখ্যা বহুগুনে বেড়েছে, কোনোভাবেই কমছে না। তাহলে, বাস্তবে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতনের চিত্র কত ভয়াবহ হিসাব করে দেখতে পারেন। কেন এমন হচ্ছে? আমরা অধিকাংশ মামলায় দেখি, প্রমাণের অভাবে, ভুল পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এ দেশে আইনের অপপ্রয়োগ এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যতটুকু আইন আছে তার সঠিক প্রয়োগ নেই। অর্থবিত্ত, ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে আইনের ফাঁক-ফোকর পেরিয়ে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্ষক ও যৌন নিপীড়করা মুক্তি পাচ্ছে, সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপরদিকে, ধর্ষিতা বা নির্যাতিতা সমাজের চোখে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ এভাবে আইনের শাসনের অভাবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষক বা নিপীড়করা হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য। একজনকে দেখে অপরজন উৎসাহিত হচ্ছে। আর এই জালে আটকা পড়ে আমাদের মা, বোন, কন্যা, স্ত্রীরা অসহায় ও ভীতিকর জীবনযাপন করছেন। গণদাবির মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। আমিও তাই চেয়েছি। তবে, দেশে আইন থাকলে হবে না, আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে। যেমন, মানুষ হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু তাই বলে হত্যা/খুন কমেনি, ঐ একই কারণে।

রাজনীতিশূন্যতা বা চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক সামাজিক শক্তির অভাব:

রাজনীতিশূন্যতা বা চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির অভাবেও ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। যখন কোনো সমাজে একক কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক শক্তির শাসন চলে, তখন সেই সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ অপকর্ম করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সমাজে গত দুই দশকে এরকমই একটি অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা ছোট বেলায় দেখতাম, বড়রা কাউকে শাসন করলে ছোটরা মাথা নিচু করে তা মেনে নিতো। বড়দের সামনে ছোটরা কোনো ভুল কাজ করার সাহস করতো না। কিন্তু সময় ও বাস্তবতা পাল্টেছে বহুগুণে। এখন ছোটরা বড়দের সামনে নেশা করতেও দ্বিধা করে না। চোখের সামনে স্কুল পড়ুয়া কোনো ছেলে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানিমূলক কোনো কাজ করলেও কেউ ভয়ে তাকে শাসন করা তো দূরের কথা, কিছু বলার সাহস পায় না। এমনকি মুরুব্বি কোনো ব্যক্তিও স্কুলে পড়ুয়া ছেলেদেরকে শাসন করতে ভয় পায়। কেন না, তারা এখন কোনো না কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠছে। দেশে শুদ্ধ রাজনীতি চর্চা তো কবেই উঠে গেছে। আমাদের যে সামাজিক শক্তি ছিল, সময়ের ব্যবধানে তাও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোরদার সামাজিক অবস্থান নিতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। ফলে ধর্ষণের ঘটনায় গোপন মিমাংসা, টাকার বিনিময়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে, এমনকি ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দিয়ে অপরাধীর অপরাধ ধমাচাপা দেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই ধর্ষণের মতো অপরাধের পক্ষে কখনো ছিল না এবং থাকবে না। এটি সামাজিক শক্তি। কিন্তু এই শক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না, শুধুমাত্র রাজনীতিশূন্যতা বা চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভাবে।

মূল্যবোধ নৈতিকতার অবক্ষয়:

ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সামাজিক সমস্যাগুলোর পিছনে আরেকটি বিষয় সমানভাবে অনুঘটকের কাজ করছে, তা হলো মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়। আমাদের সমাজে এখন পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা দেখছি দুর্বল সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থা। দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয় এখন প্রতিদিনকার খবর। একটা সময় মানুষ ভাবতো ঘরে থাকলে মা-বোনেরা নিরাপদ থাকবে। পর্দা করলে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু এখন এসব গল্প। এখন কোলের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা সমানভাবে ধর্ষিত হচ্ছে। প্রতিববন্ধিকে খাবার দেয়ার নামে ধর্ষণ করা হচ্ছে, গৃহকর্মী, নববধু, পর্যটক, সন্তানের মা, রাস্তার পাগলী, চিকিৎসাধীন রোগী, এমনকি ছেলে শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কখনো শুনে লজ্জিত হতে হয় যে পিতা কন্যাকে ধর্ষণ করেছে। জেনে আশ্চর্য হবেন, অধিকাংশ ধর্ষক বা যৌন নিপীড়ক মনেই করেন না তারা কোনো গুরুতর অপরাধ করেছে। উল্টো তারা তাদের কৃত অপরাধের জন্য মেয়ে বা নারীকেই দোষী মনে করে। আবার, ধর্ষকদের পৃষ্ঠপোষক এমনকি পিতা-মাতা তাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা বলতে লজ্জাবোধ করতো। এখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বড়দের সামনে এমনকি বাবা-মায়ের সামনে অবাধে অশ্লীলতা করছে, লজ্জাবোধ তো দূরের কথা। পারিবারিক বন্ধন এখন দুর্বল। বাংলাদেশের মানুষকে মনে করা হয় ধর্মভীরু, কিন্তু বাস্তবে ধর্মের নামে অধর্মের ছড়াছড়ি। নামে ও বিশ্বাসে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য একটি দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু ইসলামী জ্ঞান, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চার জায়গায় অনেক অভাব। এভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ নতুন নতুন অপরাধ জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধীরা অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছে।

ঘৃণা গোপনীয়তার সংস্কৃতি:

ঘৃণা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ধর্ষিতা সবার কাছে মূহূর্তে ঘৃণার পাত্রী হয়ে উঠে। নিকট আত্মীয় থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে কত যে শিশু ও নারীরা ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝা সম্ভব নয়। সমাজে ঘৃণার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষিতা বা তার পরিবার সব সময় চেষ্টা করে বিষয়গুলো গোপন রাখতে। এই গোপনীয়তার সংস্কৃতি ধর্ষণসহ সকল সামাজিক সমস্যার অন্যতম কারণ। এর ফলে ধর্ষক ও নিপীড়করা খুব সহজেই সামাজিক দায়মুক্তি পেয়ে যায়। আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। ফলে নিকট আত্মীয় থেকে শুরু করে নারীরা কারো কাছেই আজ আর নিরাপদ নয়। নারীর জীবনে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের প্রভাব পড়ে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে। আর এভাবে ঘৃণা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতির কারণে আমাদের মেয়ে, শিশু ও নারীরা শারীরিকভাবে ধর্ষিত হয়ে, মানসিক, সামাজিক এমনকি বিচার না পেয়ে সমাজে ধিকৃত হয়ে সব শেষে রাষ্ট্রীয়ভাবে হচ্ছে লাঞ্চিত। সভ্য সমাজের জন্য কত বড় লজ্জার বিষয়!

সুস্থ্য বিনোদন সংস্কৃতি চর্চার অভাব এবং পরিবার শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষা বিষয়ে শিক্ষার অভাব:

এই বিষয়গুলোও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য সামাজিক সমস্যা তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আগেকার দিনে ছেলেমেয়েরা মুক্ত পরিবেশে খোলা মাঠে খেলাধুলা করতে পারতো। এখন, খেলার মাঠের জায়গা করে নিয়েছে ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, টিভি ইত্যাদি। কিশোর-কিশোরীরা অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। পর্ণগ্রাফি কিংবা অবাধ যৌনতা অনেককে আকর্ষণ করছে। বিকৃত মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। কারণ, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সব সময় বেশি থাকে। সঠিক সময়ে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হওয়ার বিষয়টিও দিন দিন কঠিন হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যৌতুকের দায়ে সমাজ জর্জরিত। ফলে অনেকের মধ্যে হতাশা কাজ করে। বিয়েকে সহজ করা এবং যৌতুক মুক্ত করা জরুরী। সুস্থ্য সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ বঞ্চিতরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, হতাশা বাড়ছে। এসব হতাশার ফলে অনেকে বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ হিসেবে আবার কেউ কেউ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা করছে না।

ব্যক্তির নেতিবাচক মানসিকতা এবং ব্যক্তির আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা অবস্থান:

ব্যক্তি ও পারিবারিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলাধুলা, বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, চলমান রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় আইনকানুন ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর ভিত্তি করে একজন ব্যক্তির মানসিকতা গড়ে উঠে। বেড়ে উঠার এই সব স্তরের কোনো একটিতে নেতিবাচক নিয়ামক দ্বারা কেউ যদি প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়, তখন সে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। আবার অনেকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ও মর্যাদার দাম্ভিকতায় এসব অপকর্ম করতে উৎসাহিত হয়। কারণ সে জানে, অপরাধ করার পর তাকে রক্ষা বা পৃষ্ঠপোষকতা করার মানুষ আছে। অন্যদিকে, অনেক সময় মানুষের বেকারত্ব, চরম অভাব বা দারিদ্রতা, অশিক্ষা, একাকিত্ববোধ, অক্ষমতাবোধ, ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভ, অপমান অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা, সুস্থ্য বিনোদন ও সংস্কৃতি চার্চার অভাব, মাদকাসক্তি, বিকৃত যৌন আসক্তি ইত্যাদি ধর্ষণের মতো অপরাধের সহায়ক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।

রাজনৈতিক কমিটমেন্ট অভাব:

সর্বোপরি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন সামাজিক ঘৃণ্য অপরাধের জন্য আর একটি বিষয় অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে যা অনেকেই হয়তো ভাবতেই পারেন না। তাহলো, এসব সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের অভাব। আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি যত গুরুত্ব পায়, মানুষের আর্থ-সামাজিক সমস্যা ঠিক ততোটা গুরুত্ব পায় না। বাংলাদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কমিটমেন্টের উদাহরণ হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বিষয়। বর্তমানে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অপমান করে সরকারের কাছে কেউ এক বিন্দু ছাড় পাবেনা। ধর্ষণসহ বিভিন্ন সামাজিক ঘৃণ্য অপরাধের বিষয়ে এরকম রাজনৈতিক কমিটমেন্ট-এর ঘাটতি এদেশে আছে তা স্বিকার করে নিতে হবে। সময় থাকতে এসব ভয়াবহ সামাজিক সমস্যাগুলোর বিষয়ে কঠোর রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জরুরী।

তাহলে করণীয় কী?

নেপথ্য অনুঘটক সমূহের সরবরাহ বন্ধ করতে হবে:

একটা কথা প্রচলিত আছে, সুযোগের অভাবে আমরা সবাই সৎ। অবৈধ সুযোগের পথ বন্ধ থাকলে মানুষ সৎ থাকতে বাধ্য। আবার সবার মধ্যে যৌন চাহিদা আছে, কিন্তু সবাই তো ধর্ষক বা যৌন নিপীড়ক নয়। অর্থাৎ, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির যেসব অনুঘটক উপরে আলোচনা করেছি সেগুলোর বলয় থেকে যারা মুক্ত তারা ধর্ষণসহ যে কোনো সামাজিক অপরাধ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্ত। অন্যদিকে, ধর্ষণের কোনো একটি বা একাধিক অনুঘটক যখন সমাজে বিদ্যমান ও কার্যকর থাকে, ব্যক্তি যখন সে জালে আটকা পড়ে। তখন উক্ত ব্যক্তি ধর্ষক ও যৌন নিপীড়ক হয়ে উঠে। তখন ব্যক্তি নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। ধূমপান বা মাদকদ্রব্য সেবনের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, ধূমপায়ীরা জানে। বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়লেও মানুষ কিন্তু সেটা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছে না। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের ব্যবহার কোনোভাবে কমানো যাচ্ছে না। কেন? কারণ, ধূমপান বা মাদকদ্রব্যের উপকরণের সরবরাহ যতদিন বন্ধ করা যাবে না, ততদিন আইন করে, শাস্তির বিধান করে কিংবা দাম বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। ঠিক একইভাবে, ধর্ষণের মতো সামাজিক যত ঘৃণ্য অপরাধ আছে সেগুলোর নেপথ্য অনুঘটক সমূহের সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি অনুঘটক বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যা মানবসভ্যতার শুরু থেকে বিদ্যমান ছিল এবং আছে। কিন্তু সমস্যা সমাধান বা প্রতিকারের বিষয়টি সমাজে কতটা গুরুত্ব পায় তার উপর ভিত্তি করে সমস্যার স্থায়িত্ব নির্ভর করে। যত তারাতারি ঐসব অনুঘটকের পথ সংকুচিত হবে, মূল উৎপাটন করা সম্ভব হবে, তত তারাতারি ধর্ষণসহ সকল সামাজিক ক্ষত থেকে আমরা আমাদের সমাজকে মুক্ত করতে পারবো।

শেষ কথা:

আশার দিক হলো, আমাদের সমাজে এখনো এইসব ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে মানুষের মাঝে সামাজিক ও ব্যক্তিগত অসম্মতি রয়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই সামাজিক অসম্মতিকে কাজে লাগিয়ে জোরদার রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জিং শক্তি এবং সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি করতে হবে। যাতে করে সমাজে ধর্ষক, যৌন নিপীড়কদের এবং তাদের মদদদাতাদের কোনো স্থান না হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য ও আইনের শাসন জরুরী। জেন্ডার সমতা, মানুষের মাঝে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং পারস্পারিক মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। ধর্ষণের মতো সমস্যাকে পুরুষ বনাম নারীর সমস্যা হিসেবে নায় বরং মানবতার সমস্যা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও ক্ষমতার ভারকেন্দ্রিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলোকে জোরদার করতে হবে। ছেলে-মেয়েদেরকে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং সুরক্ষার বিষয়গুলো শিখাতে হবে। আমাদের সমাজের সামাজিক মনস্তত্ব ও সামাজিক গঠনের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে তা সারিয়ে তুলতে হবে। কিছু কিছু ক্ষত ক্যান্সারের মতো। সুতরাং, সেগুলো সমাধানের প্রয়োজনে সামাজিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যা থাকলে সমাধানের পথ সবসময় মুক্ত থাকে, কিন্তু সেটা খুঁজে নিতে হয়। ঘৃণা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, সুস্থ্য বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার পথ উম্মুক্ত করতে হবে। ধর্ষণসহ সকল সামাজিক সমস্যা মুক্ত সমাজ গঠনে এসবের মূলে যেসব চিহ্নিত অনুঘটক কাজ করছে সেগুলো প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আইন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ সকল পর্যায়ে জোরদার অবস্থান তৈরি করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রকে প্রাথমিক দায়িত্ব নিতে হবে, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বন্ধে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের জায়গায় শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। পরিবার ও সমাজকে নৈতিক দায়িত্ব নিতে হবে, শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিকে হতে হবে প্রকৃত মানুষ। এভাবে না পারলে, ধর্ষণ আপাতত কমে আসবে কিন্তু আবার দিনে দিনে বেড়ে যাবে। যে যার অবস্থা ও অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে।

সুতরাং, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন এবং সামাজিক সমস্যামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নেপথ্য অনুঘটকসমূহের মূলোৎপাটন জরুরী।

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *