নারী প্রসংগে
১। আরো ছয়/সাত বছর আগের কথা। চা খেতে বের হইছি। মিসটাইমিং এর কারণে ইপিজেডের ছুটি শেষে কর্মজীবী নারীদের ঘরে ফেরার মিছিলের মধ্যে পড়ে গেছি। এই সময় লাখখানেক শ্রমিকের দুইদিকের আসা যাওয়ার মধ্যে পড়ে আপনি ঠেলা ধাক্কা খাবেনই। এড়ানো অসম্ভব। বহু কসরত করে সামনে এগুচ্ছি। কিছুক্ষণ বাদে পিছনে এক নারী চিৎকার করে উঠলো। কেউ একজন তার গায়ে হাত দিছে। এতো এতো নারীর ভীড়ে একেবারেই অল্প কয়েকজন পুরুষ। নারীরা চাইলেই ঐ পুরুষটারে ধরে আচ্ছা কেলান দিতে পারতো। কিন্তু কেউই সেই নারীর চিৎকার চেঁচামেচিরে আমলে নিচ্ছে না। আমি ভীড়ের ধাক্কায় এমনিতেই কিছুটা সামনে আগাইয়া গেলাম। একবার ভীড় ঠেলে পিছনে যেতে চেয়েও সামনেই মনোযোগী হলাম। কী দরকার! গার্মেন্টসের মেয়ে। এমনিতেও এদের ভীড়ে হেঁটে যাওয়াটাই আমার জন্য বেমানান। আর এদের গ্যাঞ্জামের ভিতর যেচে জড়িয়ে পড়ার কোন মানে হয় না।
২। কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম। একটা মেয়ে বলতেছে সে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনটা ছেলে এসে তার গাল আর গলার এখানে ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করে চলে গেলো। মেয়েটা চিৎকার করেছিল। কেউ আগাইয়া আসে নাই। এবং মেয়েটা ডিসক্লেইমার দিচ্ছিল যে সে এখন যেই পোশাক পড়ে আছে, এই পোশাকেই ছিল। এইটা শালীন নাকি অশালীন বলবেন এইটা আপনের বিবেচনা। একটা মেয়ে প্রকাশ্যে মলেস্টের শিকার হয়েও যখন কারো কাছ থেকে নূন্যতম সাড়া পায় না, উপরন্তু তাকে ডিসক্লেইমার দিতে হয় যে পোশাক শালীন নাকি অশালীন সেই আলাপটা নিয়ে, তখনই বুঝা যায় আমরা কেমন সমাজে বাস করতেছি। মেয়েটা বারবার ফামব্লিং করতেছিল। গলাটা কাঁপতেছিল খুব যখন ও কথাগুলো বলতেছিল।
৩। আমি বোধহয় তখন থ্রি/ফোরে পড়ি। আমার বড় দুইবোন মানিকজোড় একই ক্লাসে পড়তো। সবসময়ই একসাথে চলাফেরা করতো। বাসার সামনে একদিন হঠাৎ করে পিছন থেকে গিয়ে একজনের বোরকা ধরে টান দিছিলাম ভয় দেখানোর জন্য। তারা দুইজনই একসাথে চিৎকার করে উঠেছিল। আমাকে দেখে খুব কড়া করে বলে দিছিল কোনদিনই যেন এই কাজ আর না করি। আমার মনে পড়লো ১৮/২০ বছর আগে আমার বোনের ঠিক একই কাঁপা কাঁপা গলা। ফামব্লিং করতেছে। ঠিক ভিডিওতে মেয়েটার মতো।
৪। তখনো ৭ মার্চ সারাদিন ঢাকায় কি হইছে আমি জানি না। আমি আর আলামিন ভাই বাসে করে ফিরতেছি। একটা মেয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার সময় আলামিন ভাই বললেন, আপনে আসার আগে মেয়েটা একটা ভদ্রলোকরে সেই থাপ্পড় দিছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাহিনী কী? আলামিন ভাই বললেন, ভীড়ের মধ্যে কেউ বোধহয় মেয়েটারে টাচ করছে। মেয়েটার ইমিডিয়েট পিছনে যেই লোকটা ছিল, মেয়েটা হঠাৎ করে ঘুরেই তারে ঠাটাইয়া চড় দিলো। আলামিন ভাই বলতেছিলেন, উনি পুরা কেইসটাই দেখছেন শুরু থেকে। লোকটার কোন দোষ নাই। আর মেয়েটারেও দোষ দেই ক্যামনে? ডেফিনেটলি মেয়েটা কোন অযাচিত স্পর্শ অনুভব করছে বইলাই ভিজিল্যান্ট হইছে। আমি চিন্তা করলাম লোকটার জায়গায় আমি হইলে ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল্লাগতো না। বিনা অপরাধে এই ধরনের একটা গুরুতর অভিযোগ নিয়ে এতো মানুষের সামনে চড় খাওয়া। আর মেয়েটার জায়গায় আমার বোনরে কল্পনা করে দেখলাম, এই ধরনের ভিজিল্যান্ট না হইলে এইই অসভ্য দেশে রাস্তায় মেয়েরা চলবে ক্যামনে?
৫। বছর খানেক আগে। গুলিস্তান মাজারের সামনে থেকে ছোঁ মেরে এক ছিনতাইকারী বাসে বসা এক মহিলার কানের দুল নিয়ে গেছে। গ্রাম থেকে আসা ক্ষ্যাত মহিলাটা কানতেছে। বাসভর্তি সবাই মহিলারে দুষতেছে। দ্বীনি সবক দিতেছে। রাস্তায় কান না ঢেকে বের হইছে কেন? স্বামী ছাড়া অন্যরে সৌন্দর্য্য দেখানো হারাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ফতোয়াবাজরা কেউই দাঁড়ি টুপি পড়া মোল্লা না। ক্লিন শেভড/ ভাবের খোঁচাখুঁচা দাঁড়ি, স্যুটেড, ব্যুটেড জেন্টেলম্যান।
৬। বেশ কয়েক বছর আগে বাসে রমনার সামনে থেকে ছেঁড়া জামা পড়া ২৩-২৪ বছরের তরুণী উঠলো। ক্ষুধা। ভাত খাবে। আমি তার দিকে তাকায়া ভাবতেছি একবেলা ভাতের জন্য তারে শেয়াল কুত্তার খাবার হইতে হয়। আমার কাছে এসে হাত পাতলে আমি পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিলাম। টাকাটা নিতে গিয়ে মেয়েটা আমার চোখের দিকে তাকাইলো। আমিও তার চোখে চোখ রাখলাম। একটু বাদে মেয়েটা চোখ নামাইয়া বাস থেকে নেমে গেলো। মেয়েটার চোখ দুইটার অসহায়ত্ব এখনো আমার চোখে লেগে আছে। ২৩-২৪ বছরের তরুণী। এক বেলা ভাতের জন্য যারে শিয়াল কুত্তার খাদ্য হইতে হয়।
৭। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমের ছাত্রীদের গল্প শুনলাম। তাদেরকে বাধ্য করা হয়। ব্লাকমেইল করা হয়। যারা পলিটিক্স করে তাদের অবস্থা আরো করুণ। নেতাদের মনোরঞ্জন ফরজে কেফায়া। একটা সময় পরে নাকি নেতাদের সাথে শোয়ার জন্য মাসে বেতন ভাতাও ধরা হয়।
৮। বড় হয়ে শুনেছি, আমার এক ফুফাতো ভাইয়ের চাচী শ্বাশুড়ীরে বাচ্চা প্রসবের সময় হাসপাতালে নেওয়া হয় নাই। কারণ এইটা হারাম। ডেলিভারির সময় মারা গেলে শহীদী মৃত্যু। পেটে দুইটা বাচ্চা নিয়ে উনি শহীদী মৃত্যু বরণ করছেন।
৯। আমাদের মসজিদের আঙিনায় এক লোক কিছু পাঞ্জাবী নিয়ে আসছে। আব্বা এসে খবরটা দিলেন। বললেন, পাঞ্জাবী দেখে আয়। আমি নিজে কখনোই জামা কাপড় কিনি নাই। স্কুল কলেজে পড়ার সময় আব্বা কিনতো। তারপর আপুরাই কিনতো। এখন ছোটভাই কিনে। সুতরাং আমার চয়েজের উপরে কারো কোন আস্থা নাই। আম্মা আপুদেরকে যাইতে বললেন। কিন্তু ব্যাপারটাতে আমি কমফোর্ট ফিল করতেছি না, এইটা আমার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সমাজে আমাদের ফ্যামিলর যেই রেপুটেশন আছে, তার সাথে এইটা যায় না যে, এলাকার মসজিদের সামনে গিয়ে আমার বোনেরা দরদাম করবে। আমার চেহারায় ফুটে উঠা আনকমফোর্ট ফিলিংসের কারণে আপুরাও সাহস করতে পারতেছে না। তো, আব্বা আগাইয়া এসে প্রবলেম সলভ করে দিলাম। আমি মুখে কিছু না বললেও আব্বা নিজ থেকেই বললেন, তোর চিন্তাটা ভুল। তোর বোনরা তো ঠিকই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। ঢাকায় শপিং মলে কেনাকাটা করে। বরঞ্চ বাসার মসজিদের সামনে থেকে কেনাকাটারে আরো অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। কারণ এইটা শপিং মলগুলাতে ঘুরাঘুরি করার তুলনায় বেহেস্তি কাজকারবার। আমি আব্বার কথা মাইনা নিলাম। অস্বস্তিভাবটাও দূর হয়ে গেলো।
১০। আমার আম্মা কখনোই বাসার বাইরে বের হন না। আপনি বাইরে থেকে দেখলে তারে একজন বন্দী নারী হিসেবে দেখতে পারেন এবং নারীমুক্তির শ্লোগান দিয়ে তারে নিজেরে লিবারেট করার নসীহাত করতে পারেন। কিন্তু তাতে কোন ফায়দা নাই। আমার আব্বা তারে বইলা কইয়াও বাসার বাইরে যাইতে রাজি করাইতে পারে না। কারণ এইটা তার জন্য কমফোর্টেবল ফিলিংস না। অথচ আমার বোনরা ‘শিক্ষিত’ হয়েও কেন টিচিং প্রফেশনে গেলো না- এইটা নিয়া তার মৃদু আপত্তি আছে। তার মতে সন্তানরে মানুষ কইরাও টিচিং প্রফেশনে আত্মনিয়োগ করা যায়। আমাদের সকল আত্মীয় স্বজন আমাদের বাসা থেকে মাত্র ৩০-৪৫ মিনিটের ডিস্টেন্সের মধ্যে থাকে। বোনেরা আধা ঘন্টারও কম সময়ের দূরত্বে। তবুও তারা একা একা আমাদের বাসায় আসে না। হয় আমাদের কেউ গিয়ে নিয়ে আসে, নতুবা দুলাভাইরা দিয়ে যায়। কারণ, তারা একলা আসা যাওয়া করতে পারে, এইটা বুঝলে দুলাভাইরা তাদেরকে একলা ছাইড়া দিতে পারে- এইটা তাদের আশংকা। মানে তারা একলা চলাফেরা করার স্বাধীনতাটা নিজ থেকেই ভোগ করতে চায় না। তাইলে নারীমুক্তি আসলে কারে কয়?
১১। গতকালকে ফার্মগেট থেকে হেঁটে হেঁটে অফিসে যাচ্ছিলাম। ন্যাম ফ্ল্যাটের একটু সামনে একটা ভবঘুরে দুই কান্ধে দুইটা বোঝা নিয়া যাইতেছে। হঠাৎ করে তিনটা কুত্তা ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌঁড়াইয়া তারে ঘিরা ফেললো।কই থেইকা যেন দৌঁড়াইয়া আরেকটা রকস্টার জিপসি আইলো। টুটাফাটা জিন্স, হ্যাট। তারে কালার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।পিছনে তিনটা কুত্তা। ঘটনাটা দেখার জন্য আমিও সাথেসাথে হাঁটা দিলাম। রকস্টারটা ঝোলাওয়ালারে আচচ্ছামতন গালি দিচ্ছে। যা বুঝলাম, রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা এক নারীরে এই ঝোলাওয়ালা নানান খারাপ কথা বলছে (অপ্রকাশযোগ্য)। রকস্টার তারে থাপড়াইতে থাপড়াইতে গালি দিয়ে বললো, এইটা তোর মা লাগে। মা ডাক। মহিলাটাও তারে সমানে থাপড়াইতেছে। ঝোলাওয়ালাও তারে সমানে মা ডাকতেছে। তবু থাপড়ানো থামে না। ঝোলাওয়ালা চিল্লায়া বলতেছে, ভুল হইছে। মাফ চাই। মা, মাফ কইরা দেন। তাও থামে না। আর রকস্টার কইতেই আছে, মা ডাক, মা ডাক। ঝোলাওয়ালা চিল্লাইয়া কইলো, মা ডাকছি তো ভাই, মাফ কইরা দেন। আমি এতোক্ষণে মুখ খুললাম। কইলাম, তোমার মা ডাকে অনুশোচনা নাই। দরদ দিয়া মা ডাককো। রকস্টার এইবার নতুন উদ্যমে থাপড়াইতেছে আর কইতেছে, দরদ দিয়া মা ডাক। ও কিছুক্ষণ দরদ দিয়া মা ডাকার পরে আমি কইলাম, ঠিকাছে বইন, এইবার মাফ কইরা দেন। ঘড়িতে তখন নয়টা প্রায় বেজে গেছে। আমি তাই কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত কইরা শামীম ওসমানের সেই বিখ্যাত বাণীটা দিলাম: নারী মা, নারী বোন, নারী স্ত্রী। নারী কোন খেলার সামগ্রী না। তারপর মানুষের মর্যাদা সংক্রান্ত একটা কোরআনের আয়াত বলে ভবিষ্যতে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে চলে আসলাম। নয়টা বেজে গেছে। তাই দোয়া মুনাজাত কিংবা সূরা আসর পড়া ছাড়াই কর্মসূচী সমাপ্ত হয়ে গেলো।