জেন্ডার রোল রিডিফাইনিং এবং টমবয় কালচার

ফুটবল খেলে ইনজুরিতে পড়ে দু্-তিনদিন যাবত গৃহবন্দী সময় কাটলো। এই ফাঁকে বেশ কয়েকটি বাংলা নাটক দেখলাম। দর্শক হিসেবে আমার একটি পর্যবেক্ষণ আছে। পর্যবেক্ষণে অবশ্য ভুল থাকতে পারে। তবু বলি। উল্লেখ্য, বাংলা সিনেমা খুব একটা না দেখার ফলে সেগুলো আমাদের সমাজকে কতটা রিপ্রেজেন্ট করছে তা বলতে পারবো না। তবে নাটকগুলো সমাজকে ভালোই রিপ্রেজেন্ট করে বলে আমার ধারণা। বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণদেরকে। এই ভিজ্যুয়াল মিডিয়া তরুণদের জীবনদর্শন ও মূল্যবোধ পাল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। এই প্রজন্মের তরুণদের জীবনদর্শন কী হবে, লাইফস্টাইল কেমন হবে, জীবনে কী পেলে তারা নিজেদেরকে সফল মনে করবে বা ব্যর্থ ঠাওরাবে— এসব ঠিক করে দিচ্ছে।

গত কয়েকদিনে যে কয়টা নাটক দেখলাম, তার সবগুলো ইউটিউবে দুই মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে পাবলিশ হয়েছে। প্রত্যেকটা নাটকে কিছু কমন প্যাটার্ন আছে। যেমন:

১। মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে ওড়নার বালাই নেই। কদাচিৎ থাকলেও নামমাত্র, শুধু গলায় ঝুলছে।

২। প্রেম-ভালোবাসা কোনো ব্যাপারই না। অর্থাৎ এসব নিয়ে কোনো ট্যাবু নেই, লুকোচুরি নেই। বরং প্রচুর প্রেম (নাটকের ভাষায় ‌‘রিলেশনশিপ’) হবে, তারপর ব্রেকআপ হয়ে যাবে।

৩। এবং এই ব্রেকআপও মামুলি ব্যাপার। ব্রেকআপের কথা যত্রতত্র বলা যাবে। যার সাথে ব্রেকআপ হয়ে যাবে তাকে অ্যাড্রেস করার জন্য নাটকের ভাষা হচ্ছে ‌‘এক্স’। কিছু কিছু নাটক এই এক্সকে কেন্দ্র করেই বানানো।

৪। নাটকগুলোতে বাবাদের ভূমিকা নগণ্য। পরিবারের মূল চরিত্র হচ্ছে মা। সবার সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করা; মোটকথা, পরিবারের প্রায় সবকিছুতে ভূমিকা রাখেন মা। বাবা নামমাত্র কিছু ফুটফরমাশ খাটেন। বাবারা হচ্ছেন effeminate man এবং মায়েরা হচ্ছেন masculine woman।

সম্প্রতি দেখা একটি নাটক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তানভীর ও আয়েশা নামের দুটি চরিত্রের এরেইঞ্জড ম্যারেইজকে কেন্দ্র করে নাটকের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। এখানেও উপরে উল্লেখিত ৪ নম্বর প্যাটার্নটি আছে বলিষ্ঠভাবে। দুই পরিবারেই মায়েরা হর্তাকর্তা। এক পরিবারে বাবা নাই। আরেক পরিবারে থেকেও নাই।

নাটকের গল্পটা সংক্ষেপে বলি আপনাদের। আয়েশাকে দেখার জন্য তানভীরের ফ্যামিলি আসবে। আয়েশা রাজি নয়। প্রথমে সে শাড়ি পরবে না বলে মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করে। এক পর্যায়ে মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বলে, সে আসলে এখন বিয়ে করতেই রাজি নয়। এ কথা শুনে মা খুব রেগে গেলেন। বাবাকে ডাকলেন মেয়েকে শাসন করতে। কিন্তু বাবা নরম সুরে কথা বলছেন দেখে আয়েশার মা চটে গেলেন— ‍“তোমাকে ডেকেছি মেয়েকে শাসন করতে, আর তুমি আশকারা দিচ্ছো!” এক পর্যায়ে বললেন, ‍“তোমার আশকারা পাইয়া পাইয়া দুইটা একদম মাথায় উইঠা গেছে। একটা হইছে ‌‘টমবয়’, আরেকটা আহ্লাদি।” উল্লেখ্য, আয়েশারা দুইবোন। আয়েশা ‌‘টমবয়’, আর ছোটটা আহ্লাদি। ‌‘টমবয়’ শব্দটা শুনে আমি যেন একটা শক খেলাম। কয়েকবার টেনেটুনে শুনলাম। মূলত এই শব্দটা শুনেই আমার এই লেখার নিয়ত।

টমবয় সম্পর্কে আমার কিছুটা পূর্ব ধারণা ছিল। সম্ভবত এই শব্দটা আমি প্রথম শুনি আরিফ আহমেদ আপন ভাইয়ের কাছে। কর্মসূত্রে তিনি ফিলিপাইনে দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন। তিনি এক আড্ডায় আমাদেরকে ফিলিপাইনের টমবয়দের সম্পর্কে বলেছিলেন। নাটকের টমবয় শব্দটা শুনে আমার মাথায় তাই প্রথমেই ফিলিপাইনের টমবয়দের কথা মনে পড়লো। নাটকের এই টমবয় চরিত্র কি তাহলে সেদিকেই যাচ্ছে? ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

এ পর্যায়ে টমবয় লিখে আমি গুগল সার্চ করি। আরেকটু এডুকেটেড হওয়ার চেষ্টা করি। এই টমবয় জিনিসটা কী? খুব সাদামাটাভাবে বললে, টমবয় হচ্ছে যে মেয়ে ‌‘টিপিক্যালি’ ছেলেদের চরিত্র ধারণ করে, ‌‘টিপিক্যাল জেন্ডার রোল’ ভেঙে দেয়। সে ছেলেদের মতন কাপড়চোপড় পরে, ছেলেদের মতন খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ফিজিক্যাল এক্টিভিটিতে জড়ায়। অর্থাৎ আমরা লোকাল ভাষায় ‌‘দামড়া বেডি’ বলতে যা বুঝিয়ে থাকি। ‌‘দামড়া বেডি’ কিন্তু শ্রুতিমধুর না। আনসফেস্টিকেইটেড৷ It doesn’t sound ‌‘cute’ like Tomboy.

যাহোক, টমবয় শব্দটির এই সাদামাটা অর্থটাই কিন্তু শেষ কথা নয়। সময়ের ব্যবধানে এর অর্থের বিবর্তন ঘটেছে। আমাদের স্থানীয় পরিভাষা ‌‘দামড়া বেডি’ এর ভাবকে এখন আর ধারণ করতে পারছে না। এই পর্যায়ে এটি এলজিবিটিকিউ’র সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। লেসবিয়ান সেক্সের একটা পার্ট হয়ে ওঠেছে। লেসবিয়ান সেক্স হচ্ছে দুইজন নারীর যৌন সম্পর্ক। কিন্তু দুইজন নারী সেক্স করে কীভাবে? এই বিকৃত যৌনাচার কীভাবে সম্ভব? আল্লাহ/প্রকৃতি তো মানুষকে সমলিঙ্গে যৌন সম্পর্ক করার মতন শারীরিক গঠনে তৈরি করেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ফেমিনিজম এখানে আর নারীকে মুক্তি দিতে পারছে না! দুইজন নারীকে পুরুষমুক্ত হয়ে সেক্স করতে গিয়েও পুরুষালি কাজের দ্বারস্থ হতে হয়। অর্থাৎ লেসবিয়ান সেক্সেও একজন নারীকে পুরুষের ভূমিকা পালন করতে হয়৷ সে সেক্সটয় ইত্যাদি ব্যবহার করে হলেও পেনিট্রেশনের ভূমিকা পালন করে। এই পেনিট্রেশনের ভূমিকা যে পালন করে, সে-ই হচ্ছে টমবয়। এটাই টমবয়ের হাল-হাকিকত। ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে জানি না।

নাটকের টমবয় আয়েশা এই পর্যায়ে পৌঁছেনি। তবে যাত্রা শুরু করেছে। আয়েশার একটা ‌‘রিলেশনশিপ’ ছিল। এ সম্পর্কে সে তানভীরকে এনগেজমেন্টের দিন বলেছিল। কিন্তু আয়েশার সেই রিলেশনশিপ ভেঙে যায়। কারণ, যেই ছেলের সাথে আয়েশার সম্পর্ক সেই ছেলেকে সে কয়েকদিন কয়েকটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে। সে তার বয়ফ্রেন্ডকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়, এরা তার ফ্রেন্ড, ‌‘জাস্টফ্রেন্ড’!

এই জাস্টফ্রেন্ডও একটা নতুন কালচার। গত কয়েক বছর ধরে চলছে। একদিন এরকম এক জাস্টফ্রেন্ডের সাথে আয়েশা তার বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে পেয়ে রাগে-ক্ষোভে বয়ফ্রেন্ডের ‌‍“জায়গামতন” লাথি মারে৷ এসব সে খুব ফানি মুডেই বলছিল। তানভীর জিজ্ঞেস করে, ‍“এখন আপনি এসব বেশ ফান করে বললেও, তখন নিশ্চয় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন?” আয়েশা তানভীরকে অবাক করে দিয়ে জানায়— না, সে মোটেই কষ্ট পায়নি। কারণ, সে তো রিলেশনশিপে ‌‘লয়াল’ ছিল। কষ্ট যে পাওয়ার সে ‌‘জায়গামতন’ পেয়েছে। আয়েশা ‌‘ব্রোকেন হার্ট’ বটে, তবে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিতে পেরেছে। কিন্তু যদি না পারতো?

এখানে এসেই বলবো, এই নাটক নিয়ে আমাদের শঙ্কিত হওয়ার ব্যাপার আছে। আপন ভাই বর্ণিত ফিলিপাইনের টমবয়দের বিবর্তন কিন্তু এভাবেই হয়েছিলো। তারা হুলস্থুল রিলেশনশিপ করে। তারপর ব্রেকআপ হয়। এক্সদের চিটিংয়ের কারণে ব্রোকেন হার্টরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে। তাই তারা ভিন্ন টেস্ট পেতে চায়। ফলে লেসবিয়ান সেক্সে জড়ায়৷ আর তখনই তাদের ‌টমবয় প্রয়োজন হয় বা নিজেদেরকে টমবয় হতে হয়৷

তাই সফটকোর টমবয় আয়েশাদের নিয়ে আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। কারণ, এরই পরিণতি হলো লেসবিয়ান টমবয়। এরা আমাদের দেশে এখনই আছে। তবে তারা সংখ্যালঘু এবং অনেকটা পর্দার আড়ালে। কিন্তু নাটক-সিনেমার টমবয়রা তাদেরকে সোসাইটিতে ইন্টিগ্রেট করে নিবে। ব্যাপারগুলো নর্মালাইজ করবে। সোশ্যাল সাইকিতে জায়গা দিবে। নৈতিক বৈধতা দিবে।

এ ধরনের আরো লেখা